তখন সকাল আটটা। রাস্তাঘাট শুনসান। রাস্তার কোণ থেকে জোরে জোরে ভেসে আসছে ঠুকঠাক শব্দ। বালাপ্পা ধোত্রে বসে আছেন ফুটপাথে। তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে বড় বড় পাথর। হাতুড়ি দিয়ে সেগুলোই ঠুকঠাক করছেন তিনি। তাঁর এই অস্থায়ী ‘কর্মশালা’র পেছনে রিকশা, স্কুটার পার্ক করা রয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যাবে জায়গাটা। রিকশাওয়ালারা চলে যাবেন রিকশাগুলো নিয়ে, স্কুটারের মালিকরা নিজ নিজ বাহন নিয়ে। বালাপ্পাও আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চলে যাবেন তাঁর খলনোড়াগুলো নিয়ে - উত্তর মুম্বইয়ের পূর্ব কান্দিভালির ওই ফুটপাথে বসে যেগুলো তিনি তৈরি করেছিলেন।
একটা খলনোড়া বানাতে তাঁর সময় লাগে প্রায় একঘণ্টা। যা দিয়ে পেষাই করা হয় মশলা, চাটনি। তিনি এটাকে বলেন কাল্লু রাব্বু । খলনোড়ার কন্নড় নাম। মারাঠিতে বলে খালবাট্টা । কাজ হয়ে গেলে, খলনোড়াগুলোকে তিনি তাঁর শক্তপোক্ত রেক্সিনের ব্যাগটাতে ঢোকান। রোজ গড়ে তৈরি হয় দুটো কি তিনটে। ওজন প্রতিটির ১ থেকে ৪ কিলোগ্রামের মধ্যে। তারপর ওই ফুটপাথের অস্থায়ী ‘কর্মশালা’ থেকে চলে যান, হাঁটতে হাঁটতে, কাছাকাছি এলাকাগুলোর কোথাও। এবার সেইখানেই ব্যস্ত রাস্তার কোণে খুলে ফেলেন তাঁর ‘দোকান’। অনেক সময়ে তিনি তাঁর হাতের কাছে রেখেও দেন কালা পাত্থর । যদি আরও কোনও খদ্দের এসে দাঁড়ায়, খলনোড়া কিনতে চায়, তাহলে ওখানেই বসে তিনি বানিয়ে দেন তা।
ধোত্রে বলেন, “লোকে আমাকে পাত্থরওয়ালা বলে ডাকে।”
ছোটো খলনোড়াগুলো তিনি বিক্রি করেন দুশো টাকায়, বড়োগুলোর দাম সাড়ে তিনশো থেকে চারশো। বালাপ্পার কথায়, ‘কোনও কোনও সপ্তাহে আমার হাজার, বারোশো টাকা আয় হয়, কোনও কোনও সময়ে কিছুই আয় হয় না।’ কিনতে আসেন যাঁরা, তাঁদের বেশিরভাগেরই বিদ্যুৎচালিত মশলা পেষাইয়ের যন্ত্র কেনার ক্ষমতা নেই। আর আছেন তাঁরা, যাঁরা বসার ঘরে সাজিয়ে রাখেন জিনিসটাকে। আর কেউ কেউ বালাপ্পার স্ত্রী নাগুবাঈয়ের মতো খলনোড়াতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। বালাপ্পার স্ত্রী বলেন, “আমার তো মিক্সি [ইলেকট্রিক মিক্সার] ভালো লাগে না। খাবারে কোনও স্বাদই আসে না। এতে [ কাল্লুতে ] মশলা বাটলে তার স্বাদই আলাদা, একেবারে তাজা।’
![Women buying stone pestle on the road](/media/images/AK_20190604_185844.max-1400x1120.jpg)
![Women grinding on stone pestle](/media/images/AK_20190808_114634.max-1400x1120.jpg)
ব্যস্ত শহরতলির রাস্তায় ধোত্রের ‘দোকান’: যাঁদের বিদ্যুৎচালিত মশলা পেষাইয়ের যন্ত্র কেনার ক্ষমতা নেই তাঁরাই মূলত তাঁর ক্রেতা, আর আছেন যাঁরা পুরনো ধরনের খলনোড়া বাড়িতে সাজিয়ে রাখতে চান, বা পাথরের খলনোড়ায় পেষা মশলার স্বাদ পছন্দ করেন
ধোত্রে তাঁর বয়স আর মনে করতে পারেন না। তবে তাঁর ছেলে, মধ্য-ত্রিশের অশোক জানান, তাঁর বাবার বয়স ৬৬। ২০১১ সালে বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপাল কর্পোরেশের (বিএমসি) সাফাইকর্মীর কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন ধোত্রে। তবে নিজেকে ‘কারিগর‘ বা শিল্পী বলতেই বেশি ভালোবাসেন তিনি। পাথরের এই কাজই তো বহুকাল যাবৎ তাঁর পারিবারিক জীবিকা। উত্তর কর্নাটকের বিদর জেলার হোমনাবাদ তালুকে গ্রাম ছিল তাঁর, নাম মান্নেখাল্লি। সেখানেই তাঁর বাপ-ঠাকুর্দা পাথরের কাজ করতেন। তাঁরা কাল্লু ভাদ্দার জনগোষ্ঠীর মানুষ (কালু ভাদ্দার- কর্নাটকের অন্যান্য অনগ্রসর জনজাতি তালিকার অন্তর্গত, পাথরের কাজে নিবেদিত ভাদ্দার সম্প্রদায়ের অন্তর্গত এক গোষ্ঠী)।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে বহু পরিবারই পাথরের খলনোড়া ব্যবহার করত। তখন তাই বালাপ্পার বাপ-ঠাকুর্দারও মোটামুটি ভালোই রোজগার ছিল। বালাপ্পার মনে পড়ে, একেকটা খলনোড়ার দাম ছিল পাঁচ থেকে পনেরো পয়সা। অনেক সময় বিনিময় প্রথাতেও বেচাকেনা চলত। তাঁর কথায়, “ কাল্লুর বদলে গম, জোয়ার, চাল সবই পেতাম আমরা।”
বালাপ্পার যখন ১৮ বছর বয়স, নাগুবাঈকে নিয়ে মুম্বই চলে এসেছিলেন বালাপ্পা। তার আগে মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে খলনোড়া বিক্রি করে বেড়াতেন তিনি। বালাপ্পার কথায়, ‘আমি বীড আর ঔরঙ্গাবাদ জেলায় বাপ-ঠাকুর্দার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের সঙ্গে একটা গাধা থাকত। আমরা ওটার পিঠে মালপত্র চাপিয়ে গ্রামে গ্রামে কাল্লু বিক্রি করতাম।’
![On left A man sitting on a sofa, on right side - man is hammering stone](/media/images/qudratiptic2.max-1400x1120.jpg)
ছেষট্টি বছরের বালাপ্পা বলেন, ‘লোকে আমাকে পাত্থরওয়ালা বলে ডাকে’
এক প্রবল খরার প্রকোপে তিনি মুম্বই চলে আসতে বাধ্য হন। ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকের সেই খরার কথা বলতে গিয়ে বলেন বালাপ্পা, “আমাদের গ্রামে দুষ্কাল [খরা] এসেছিল। সব ফসল শুকিয়ে গেল, খাবার জন্য কিছুই ছিল না। জঙ্গল শুকিয়ে গেছিল। কোনও ঘাস ছিল না। বাড়ির গরুছাগল- তারা কী খাবে! কোনও জল নেই, খাবার নেই, টাকাও আসছে না, কিচ্ছু না,” বালাপ্পা বলে চলেন। তারপরে সকলে ধীরে ধীরে গ্রাম ছাড়তে শুরু করল। কেউ কেউ জমি বিক্রি করে চলে গেল শহরে। পাথরের খলনোড়া তা হলে কে কিনবে আর! খদ্দের কমতে লাগল। বালাপ্পার নিজের পরিবারের চাষের জমি ছিল না। তাঁদের শুধু ছিল ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর, সেখানেই শৈশব কেটেছে বালাপ্পার। (এখনও সে বাড়ি আছে, অন্য একটা পরিবার ভাড়া থাকে সেখানে।)
বাপ-ঠাকুর্দার আউজার (সরঞ্জাম) - হাতুড়ি, ছেনি-বাটালি, খুরপি, কোদাল - সব নিয়ে শহরে এসেছিলেন তিনি খলনোড়া বানানোর জন্য।
প্রথম যখন মুম্বই এলেন ওঁরা, বালাপ্পা, আর নাগুবাঈ থাকতেন দাদর রেল স্টেশনের কাছে, প্লাস্টিকের আচ্ছাদনে তৈরি একটা ছোট্ট ঝুপড়িতে। পরের বছরগুলো মুম্বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন তাঁরা। লোয়ার প্যারেল, বান্দ্রা, আন্ধেরি- যেখানে যেখানে কাজের টানে থাকতে হয়েছে তাঁদের। যেখানেই একটু ফাঁকা জায়গা পেয়েছেন, সেখানেই বানিয়ে নিয়েছেন থাকার মতো ছোট্ট কুঁড়ে ঘর।
তাঁর সঙ্গে স্ত্রী নাগুবাঈও খল-নোড়া বিক্রি করার জন্য জায়গায় জায়গায় ঘুরতেন। নাগুবাঈ বলেন, “আমার বাবাও কাল্লু বানাতেন। আমার মা, আর আমি সেইগুলো বিক্রি করতাম। বিয়ের পর আমি ওর (বালাপ্পা) সঙ্গে বিক্রি করতে যেতাম। এখন পিঠে খুব ব্যথা হয়, আর পারি না।”
![Balappa Chandar Dhotre's family members sitting together in their house](/media/images/AK_20190808_113450.max-1400x1120.jpg)
![](/media/images/AK_20190316_115530.max-1400x1120.jpg)
যখন প্রথম মুম্বইয়ে এসেছিলেন ওঁরা, বালাপ্পার স্ত্রী নাগুবাঈ (বাঁদিকে, সঙ্গে তাঁদের ছেলে অশোক, তাঁর স্ত্রী কাজল, এবং তাঁদের সন্তানরা) তাঁর সঙ্গে খলনোড়া বিক্রি করতে যেতেন
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিক মিক্সার গ্রাইন্ডারের চল বাড়ল, পাথরের খলনোড়ার চাহিদা কমতে থাকল। মান্নেখাল্লিতে ফিরে আসার উপায় ছিল না তাঁদের, কারণ সেখানে কাজ নেই। বালাপ্পা নাগুবাঈয়ের সঙ্গে মুম্বইতেই থাকতে শুরু করলেন (ততদিনে তাঁদের সাতটি সন্তান হয়েছে- তিন ছেলে, চার মেয়ে)। নানা কিসিমের কাজ করতে শুরু করলেন বালাপ্পা, কখনও কখনও ফিল্ম শুটের জন্যও টুকটাক কাজ। “বিভিন্ন জিনিসপত্র বয়ে দেওয়া, সেট পরিষ্কার করার জন্য সেই সময়ে ওরা দিনে পনেরো টাকা করে দিত”— বলে চলেন বালাপ্পা।
তারপর একদিন বিকেলে, তখন তাঁরা আন্ধেরি রেল স্টেশনের কাছে থাকেন, বিএমসি তাঁকে এবং তাঁর মতো আরও কিছু মানুষকে কাজে নিল, বোরিভালিতে সাফাইয়ের কাজ। বালাপ্পার বড়ো ছেলে, শেষ ত্রিশের কাছাকাছি বয়স, তুলসীরাম বলেন, “রাস্তা পরিষ্কারের কাজের জন্য তাঁদের নেওয়া হয়েছিল, অস্থায়ী ভিত্তিতে। পরে বিএমসি তাঁদের স্থায়ী চাকরি দেওয়ার কথা ভাবে।”
বিএমসির এমপ্লয়ি কার্ড পাওয়ার পরে পূর্ব কান্দিভালির সাফাইকর্মী হিসেবে নিযুক্ত হলেন বালাপ্পা। বোরিভালি স্টেশনের কাছে দেবীপাড়াতে, বাঁশ আর প্লাস্টিক শিটের কাঁচা বাড়ির কলোনিতে গিয়ে উঠলেন তাঁরা। বিএমসির কর্মী হিসেবে প্রথম দিকে মাস গেলে আয় হত তাঁর ৫০০ টাকা।
এই সবের মধ্যেও পাথরের খলনোড়া তৈরি আর বিক্রির কাজটা চালিয়ে যেতে থাকলেন বালাপ্পা। তুলসীরাম বলেন, “সকাল ছটায় কাজে (বিএমসির কাজ) বেরোতেন বালাপ্পা। দুপুর দেড়টা নাগাদ মা তাঁর ডাব্বা নিয়ে যেতেন।” তাঁর দুপুরের খাবার থাকত সেই ডাব্বায় । আর থাকত, নানা যন্ত্রপাতি - হাতুড়ি, নানা ধরনের, নানা আকারের ছেনি-বাটালি। তাঁর কাজের সময়টা পেরিয়ে গেলে তিনি তাঁর পাথরগুলো নিয়ে বসতেন কাজে, বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা-ছটা।
![Stone hammering tools](/media/images/AK_20190808_104109.max-1400x1120.jpg)
বালাপ্পা তাঁর বাপ-ঠাকুর্দার আউজার (সরঞ্জাম/যন্ত্রপাতি) নিয়ে এসেছিলেন বড়ো শহরে, খলনোড়া তৈরি করবেন বলে
কাজের জন্য কাঁচামাল বলতে তাঁর লাগত শুধু কাল্লা পাত্থর । বালাপ্পা বলেন, “[অতীতে] মাটি খুঁড়ে [কোদাল, বড়ো হাতুড়ি দিয়ে] পাওয়া যেত তা।” এখন শহরের বিভিন্ন নির্মাণ-ক্ষেত্রগুলি থেকে সেই পাথর সংগ্রহ করেন বালাপ্পা।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিএমসিতে সাফাইকর্মী হিসেবে কাজ করার পর ২০১১ সালে অবসর গ্রহণ করেছেন বালাপ্পা। তাঁর ছেলে অশোক জানান, বাবা যখন অবসর নিলেন, তখন তাঁর রোজগার মাসে ১৮,০০০ - ২০,০০০ টাকা। এখন পেনশন পান মাসে ৮ হাজার টাকা।
বাবা অবসর নেওয়ার পর সাফাইকর্মী হিসেবে বাবার চাকরিটা পেয়েছেন অশোক। তুলসীরাম এবং বালাপ্পার সেজ ছেলে - দুজনেই দিনমজুরের কাজ করেন। কখনও কাজ পান, কখনও পান না। বালাপ্পা আর নাগুবাঈয়ের চার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তাঁরা মুম্বইয়েরই নানান প্রান্তে থাকেন। ছেলেমেয়েদের কেউই আর পাথরের কাজ করেন না। বালাপ্পা বলেন, “আমার এটা মোটেই ভালো লাগে না। কিন্তু করারও কিছু নেই। ওরা যখন ওই কাজটা করতেই চায় না, তখন ওরা সেটা করবে না।’
তিন বছর আগে দেবীপাড়া ছেড়ে কাছেই একটা চওলের কাছে থাকতে শুরু করেছেন বালাপ্পা আর নাগুবাঈ। এক বিল্ডার তাঁদের কথা দিয়েছেন, দেবীপাড়ায় বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়ে গেলে, একটা ফ্ল্যাট দেবেন তাঁদের।
ক্রেতার সংখ্যা কমলেও কিন্তু বালাপ্পা পাথরের খলনোড়া তৈরির কাজ থেকে বিরত হননি। তাঁর কথায়, “আমার বাপ-ঠাকুর্দাও এই কাজ করতেন; আমিও তাঁদের মতোএকজন কারিগর, আমি এটাই।’ নাগুবাঈ বলছেন, “আসলে ওর এটা করতে ভালো লাগে। আর আমারও ভালো লাগে, বুড়োটা [এখনও] কিছু কাজ করছে দেখে।”
বাংলা অনুবাদ : রূপসা রায়