“সারা বছরে কোনওমতে একটামাত্র এমন দিন জোটাতে পারি।”

২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর দিনটার কথা বলছিলেন স্বপ্নালি দত্তাত্রেয় জাধভ। বেদ মানে একটা মারাঠি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। দেশজোড়া নামডাক হয়নি বটে, তবে কলাকুশলীদের প্রত্যেকেই বেশ পরিচিত। বছর গেলে এক-দুদিনই এমন অবকাশ মেলে গৃহশ্রমিক স্বপ্নালির। ৩১ তারিখ ছিল সেরকমই একটা ছুটির দিন, তাঁর পছন্দমাফিক ওই সিনেমাটাই দেখতে গিয়েছিলেন।

সাতরাজার ধন সমান সেই ছুটির দিনটির কথা মনে করে দৃশ্যতই খুশি বছর ২৩-এর স্বপ্নালি বলছিলেন: “ইংরেজি নিউইয়ার ছিল তো সেদিন, ওইজন্যই। বাইরেই খাওয়াদাওয়া করেছিলাম, গোরেগাঁওয়ের ওদিকটায়।”

বছরের বাদবাকিটা জীবনের জাঁতাকলে পিষতে থাকেন স্বপ্নালি। মুম্বই শহরে ছয়খানা গেরস্থালির গৃহকর্মের দায়-দায়িত্ব একাহাতে সামলান তিনি — বাসনকোসন মাজা, জামাকাপড় ধোওয়া, সবকিছুই। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে ১০-১৫ মিনিট লাগে, ওটুকু সময় ফোনে মারাঠি গান শোনেন। অবকাশের এই ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্তগুলো যেন একচিলতে হাসি হয়ে ফুটে উঠল তাঁর চোখেমুখে: “খানিক টাইমপাস হয় এগুলো শুনে।”

Swapnali Jadhav is a domestic worker in Mumbai. In between rushing from one house to the other, she enjoys listening to music on her phone
PHOTO • Devesh
Swapnali Jadhav is a domestic worker in Mumbai. In between rushing from one house to the other, she enjoys listening to music on her phone
PHOTO • Devesh

স্বপ্নালি যাধভ মুম্বইয়ে কর্মরত একজন গৃহশ্রমিক। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি দৌড়োদৌড়ি করার ফাঁকে ফোনে গান শুনতে ভালোবাসেন তিনি

ফোন নামক যন্তরটি থাকলে সত্যি যে খানিক জিরোনো যায়, এ বিষয়ে ২৫ বছর বয়সি নীলম দেবীও সহমত। তাঁর কথায়, “ফুরসৎ পেলে মোবাইলে ভোজপুরি আর হিন্দি সিনেমা দেখতে ভাল্লাগে খুব।” ফসল কাটার মরসুম এসেছে, তাই পরিযায়ী এই খেতমজুরটি বিহারের মোহাম্মদপুর বাল্লিয়া গ্রাম ছেড়ে ১৫০ কিলোমিটার দূর মোকামেহ তালে এসে উঠেছেন।

তিনি ছাড়া আরও ১৫ জন মহিলা এসেছেন মজুরির কাজে। কাজ বলতে ডালের ঝাড় কেটে বাণ্ডিল বেঁধে খেত থেকে গুদামে নিয়ে যাওয়া। পারিশ্রমিক বাবদ মেলে খেতের ফসল — ১২ বাণ্ডিল ডালগাছ কেটে, বাঁধাছাঁদা করে বইলে পরে এক বাণ্ডিল মেলে। খাবারদাবার বলতে যেটুকু জোটে, তার মধ্যে ডালের মূল্যই সর্বাধিক। এ বিষয়ে সুহাগিনী সোরেনের বক্তব্য: “বছরভর ডাল খাওয়া যায়, আবার কাছের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলিয়েও দেওয়া চলে।” সারাটা মাস ঘাম ঝরালে তবেই গিয়ে মজুরি হিসেবে এক কুইন্টাল ডাল রোজগার হয়, জানালেন তিনি।

এঁদের স্বামীরা আরও দূর-দূরান্তে যান কামকাজের খোঁজে। বাচ্চাকাচ্চারা গাঁয়েই রয়ে যায় কারও হেফাজতে, তবে খুব ছোটো হলে মায়েদের সঙ্গেই পাড়ি দেয় তারা।

তবে দেশগাঁ ছেড়ে কাজে এলে ফোনে সিনেমা দেখা আর হয় না, কারণ “এখানে চার্জ দেওয়ার জন্য বিজলিই নেই,” — রুখাসুখা খড় পাকিয়ে দড়ি বানাতে বানাতে পারিকে জানালেন নীলম। তবে নিজের একখান ফোন যে আছে, এই ঢের, কারণ অক্সফাম ইন্ডিয়ার প্রকাশিত ডিজিটাল বৈষম্য: ভারতের অসমতা রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী গ্রামীণ ভারতে মোটে ৩১ শতাংশ মহিলার কাছে নিজের ফোন রয়েছে, অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৬১ শতাংশ।

তবে হ্যাঁ, নীলম কিন্তু মাথা খাটিয়ে জব্বর একখান ফন্দি এঁটেছেন! যেহেতু ট্রাক্টরগুলোর অধিকাংশই মজুরদের অস্থায়ী ঝুপড়ির পাশে দাঁড় করানো থাকে, “আমরা ফোন-টোন সব ট্রাক্টরে চার্জ দিয়ে জরুরি কলগুলো সেরে নিই, তারপর মোবাইল সরিয়ে রাখি। ঠিকঠাক কারেন্ট পেলে আলবাত সিনেমা দেখতাম আমরা,” জোরগলায় বললেন তিনি।

Neelam Devi loves to watch movies on her phone in her free time
PHOTO • Umesh Kumar Ray
Migrant women labourers resting after harvesting pulses in Mokameh Taal in Bihar
PHOTO • Umesh Kumar Ray

বাঁদিকে: ফুরসত পেলে ফোনে ছায়াছবি দেখতে ভালোবাসেন নীলম দেবী। ডানদিকে: বিহারের মোকামেহ তাল, ডালের ফসল কাটার পর খানিক জিরিয়ে নিচ্ছেন খেতমজুর মহিলারা

ভোর ৬টা বাজতে না বাজতেই কাজে লেগে পড়েন মোকামেহ তালের এই মহিলারা, কারণ মাঝদুপুরে তাপমাত্রা এতটাই চড়ে যায় যে চাষের সরঞ্জাম নামিয়ে না রেখে আর উপায় নেই। এবার নিজের নিজের সংসারের জন্য টিউবওয়েলে জল আনতে যাবেন তাঁরা। “সব্বারই তো নিজের জন্য খানিটকা সময় বার করা দরকার,” জানালেন অনিতা। সাঁওতাল আদিবাসী তিনি, বাড়ি ঝাড়খণ্ডের গিরিডি জেলার নারাইনপুর গ্রামে। তাঁর কথায়, “বিকেলে ঘুমোই, এমন গরম পড়ে যে কামকাজ করা যায় না।” এই দিনমজুরটি ঝাড়খণ্ড থেকে বিহারের মোকামেহ তালে এসেছেন ডাল-সহ অন্যান্য ফসল কাটাইয়ের কাজে।

গোধূলি লগ্নে চলছিল আমাদের বাতচিত। আধ-কাটা ফসলে ভরা মাঠ, ক্রমশ ফিকে হতে থাকা আলোয় বসেছিলেন জনা বারো মহিলা, সামনে ছড়ানো ছিল সারি সারি শ্রান্ত পা।

হাজার ক্লান্তি সত্ত্বেও এই মহিলা খেতমজুরদের হাতগুলি কিন্তু এক পলকের জন্যও স্থির নেই। হয় ডাল ছাড়িয়ে সাফ করছেন, কিংবা পরেরদিন বাণ্ডিল বাঁধবেন বলে খড় পাকিয়ে দড়ি বানিয়ে রাখছেন। সন্নিকটে তাঁদের ঝুপড়ির সারি — ছাদ বলতে পলিথিন, আর শুকনো ডালগাছ দিয়ে বানানো তিন ফুট উঁচু দেওয়াল। একটু পরেই জ্বলে উঠবে মাটির উনুন, তোড়জোড় শুরু হবে নৈশভোজের, গল্পগাছার বাকিটা তোলা থাকবে কালকের জন্য।

২০১৯-এর এনএসও তথ্য অনুসারে, এ দেশের মহিলারা গড় হিসেবে প্রতিদিন ২৮০ মিনিট করে বিনা-মজুরির মেহনত তথা বাড়ির লোকের দেখভাল করে কাটান। অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা মোটে ৩৬ মিনিট।

Anita Marandi (left) and Suhagini Soren (right) work as migrant labourers in Mokameh Taal, Bihar. They harvest pulses for a month, earning upto a quintal in that time
PHOTO • Umesh Kumar Ray
Anita Marandi (left) and Suhagini Soren (right) work as migrant labourers in Mokameh Taal, Bihar. They harvest pulses for a month, earning upto a quintal in that time
PHOTO • Umesh Kumar Ray

বিহারের মোকামেহ তালে কাজ করেন অভিবাসী শ্রমিকদ্বয় অনিতা মারান্ডি (বাঁদিকে) ও সুহাগিনী সোরেন (ডানদিকে)। টানা একমাস ডালের ফসল কাটলে মজুরি হিসেবে কুইন্টালখানেক ডাল মেলে

The labourers cook on earthen chulhas outside their makeshift homes of polythene sheets and dry stalks
PHOTO • Umesh Kumar Ray
A cluster of huts in Mokameh Taal
PHOTO • Umesh Kumar Ray

বাঁদিকে: পলিথিন আর খড় দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঝুপড়ির বাইরে মাটির উনুনে রান্না করেন এই শ্রমিকেরা। ডানদিকে: মোকামেহ তালে কুঁড়েঘরের সারি

*****

অন্যদিকে সাঁওতাল জনজাতির আরতি সোরেন ও মঙ্গলি মুর্মুর কাছে ফুরসত মানে নেহাতই একে অপরের সান্নিধ্যে কাটানো কিছু এলোমেলো সময়, সর্বদা সেটার জন্যই মুখিয়ে থাকে মেয়ে দুটি। আরতি ও মঙ্গলি একে অপরের তুতো-বোন, বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পারুলডাঙা গাঁয়ে। দুজনেরই মা-বাবা ভূমিহীন খেতমজুর। একটি গাছতলায় বসে ছিল দুই বোন, কাছেই চরছিল তাদের গরুবাছুর। আরতির কথায়, “এখানে এসে পাখপাখালি দেখতে বড্ড ভাল্লাগে। মাঝেমধ্যে দুজন একসাথে মিলে ফল পেড়ে খাই। এই সময়টায় [ফসল কাটার মরসুম] খুব একটা দূর-দূর যেতে হয় না, গরুছাগলগুলো দিব্যি চরে চরে খড়ের নাড়া খায়। আমরাও সময় পাই আরাম করে কোনও গাছের তলায় বা ছায়া-টায়া দেখে জিরোনোর।”

পারির সঙ্গে যেদিন ওদের দেখা হয়, সেদিনটা ছিল রবিবার। আরতি ও মঙ্গলির মায়েরা পাশের গ্রামে (বীরভূমেই) এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বোনের দিকে একগাল হেসে আরতি বলে উঠল, “আমার মা-ই গরুছাগল চরাতে নিয়ে যায়, তবে রোববার করে আমার পালা। এখানে এসে মঙ্গলির সাথে খানিক সময় কাটাতে ইচ্ছে করে খুব। ও তো আমার সই-ই বটে।”

তবে মঙ্গলির জন্য গবাদি পশু চরানোটা নিত্যকার কাজ। পঞ্চম শ্রেণি অবধি পড়েই ইস্কুলজীবনে ঢ্যাঁড়া পড়ে যায় তার, বাবা-মায়ের পক্ষে মেয়েকে আর পড়ানো সম্ভব ছিল না। “তারপর তো লকডাউন এসে হাজির হল, আমাকে ইস্কুলে ফেরত পাঠানোটা আরও কঠিন হয়ে উঠল শেষে,” জানালো মঙ্গলি। বাড়িতে রান্নাবান্নার কাজটাও সে সামলায়। ঊষর এই মালভূমি অঞ্চলে রুজিরুটির একমাত্র নিশ্চয়তা পশুপালন, তাই মঙ্গলি যে গরুবাছুর চরাতে নিয়ে যায়, তার গুরুত্ব অপরিসীম।

Cousins Arati Soren and Mangali Murmu enjoy spending time together
PHOTO • Smita Khator

তুতো-বোন আরতি সোরেন ও মঙ্গলি মুর্মু, একসঙ্গে সময় কাটাতে বড্ড ভালোবাসে তারা

অক্সফাম ইন্ডিয়ার প্রকাশিত ডিজিটাল বৈষম্য: ভারতের অসমতা রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী গ্রামীণ ভারতে মোটে ৩১ শতাংশ মহিলার কাছে নিজের ফোন রয়েছে, অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৬১ শতাংশ

আরতি বলছিল, “আমাদের মা-বাবার কাছে ছোটো ফোন (ফিচার ফোন) আছে। একসঙ্গে থাকলে আমরা কখনও-সখনও এসব জিনিস [নিজেদের জন্য ফোন কেনা] নিয়ে কথা বলি।” ডিজিটাল বৈষম্য: ভারতের অসমতা রিপোর্ট ২০২২ বলছে যে ভারতে যতজনের কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে, তাদের প্রায় ৪০ শতাংশের স্মার্টফোন নেই, সুতরাং মঙ্গলি ও আরতির অভিজ্ঞতায় অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

অবসর ঘিরে আলাপ-আলোচনায় মোবাইল ফোনের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসতেই থাকে — অবশ্য এই কথাটা কামকাজের প্রসঙ্গেও খাটে, বেজায় রেগে গিয়ে সেটাই জানালেন সুনীতা প্যাটেল: “যখন শহরে শহরে সবজি ফেরি করি, চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে খদ্দেরদের ডাকি, ওনারা [শহুরে মহিলারা] তো পাত্তাটুকুও দেন না, ফোনেই ডুবে থাকেন। খুব কষ্ট হয়, রাগে কান-মাথা ভোঁভোঁ করে।”

ছত্তিশগড়ের রাজনন্দগাঁও জেলা, রাকা গ্রামের একটি ধানখেতে মধ্যহ্নভোজ সেরে খানিক জিরোচ্ছিলেন সুনীতা, সঙ্গে জনাকয় মহিলা খেতমজুর। কয়েকজন বসেছিলেন, আর বাকিরা ফাঁকতালে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছিলেন।

“সারাটা বছর মাঠে খেটে মরি। ছুটিছাটার কোনও প্রশ্নই নেই,” ভাবলেশহীন সুরে বলে উঠলেন দুগদি বাই নেতম। এই প্রৌঢ়া আদিবাসী খেতমজুর বৈধব্যভাতা পান ঠিকই, কিন্তু দিনমজুরি না করলে পেট চালানো দায়। “আপাতত ধানখেতের আগাছা নিড়োচ্ছি; বছরভর কাজ করে যাই।”

ফোন ঘিরে স্মৃতির জেরে তখনও তিতিবিরক্ত হয়েছিলেন সুনীতা, তাই দুগদির কথার রেশ টেনে জানান দিলেন: “একফোঁটা অবকাশের সুযোগ পাই না! ওসব শুধু শহুরে মেয়েদেরই জোটে।” অবকাশের অর্থ পেটভরা খাবারদাবারও বটে, সেই সূত্রে তিনি বললেন, “ভিতর ভিতর বড্ড ইচ্ছে হয়, এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে ভালোমন্দ খাইদাই, কিন্তু পয়সাকড়ি নেই, তাই ওসব আর কোনওদিনও হয়ে ওঠে না।”

*****

A group of women agricultural labourers resting after working in a paddy field in Raka, a village in Rajnandgaon district of Chhattisgarh
PHOTO • Purusottam Thakur

ছত্তিশগড়ের রাজনন্দগাঁও জেলা, রাকা গ্রামের একটি ধানখেতে কাজ করার পর একদল মহিলা খেতমজুর খানিক জিরিয়ে নিচ্ছেন

Women at work in the paddy fields of Chhattisgarh
PHOTO • Purusottam Thakur
Despite her age, Dugdi Bai Netam must work everyday
PHOTO • Purusottam Thakur

বাঁদিকে: ছত্তিশগড়ের ধানখেতে কর্মরত মহিলারা। ডানদিকে: বয়স হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন খেটে মরতে বাধ্য হন দুগদি বাই নেতম

Uma Nishad is harvesting sweet potatoes in a field in Raka, a village in Rajnandgaon district of Chhattisgarh. Taking a break (right) with her family
PHOTO • Purusottam Thakur
Uma Nishad is harvesting sweet potatoes in a field in Raka, a village in Rajnandgaon district of Chhattisgarh. Taking a break (right) with her family
PHOTO • Purusottam Thakur

ছত্তিশগড়ের রাজনন্দগাঁও জেলার রাকা গাঁয়ে মাঠ থেকে রাঙাআলু তুলছেন উমা নিষাদ। পরিবারের সঙ্গে কাটানো খানিক অবকাশের মুহূর্ত (ডানদিকে)

মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলা। কিঞ্চিৎ বিশ্রাম নিতে নিতে কোলাপুর-সাঙ্গলি হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়িঘোড়ার কাফিলা দেখছিলেন ইয়াল্লুবাই নন্দীওয়ালে, কাছেই জৈনাপুর গ্রাম। চিরুনি, চুলে পরার নানান সামগ্রী, নকল গয়না, অ্যালুমিনিয়ামের বাসনকোসন — রকমারি জিনিস বেচেন তিনি। একটি বেতের ঝুড়ি আর ত্রিপলের থলিতে ৬-৭ কেজি মালপত্তর ভরে রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করেন।

আসছে বছর ৭০-এ পা দেবেন ইয়াল্লুবাই। দাঁড়ালে বা হাঁটলে যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যায় হাঁটু দুটো, অথচ পেট চালাতে দুটোই করতে বাধ্য তিনি। টনটন করতে থাকা হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে তিনি জানালেন, “একশোটা টাকা পেতেও নাভিশ্বাস উঠে যায়, একেকদিন তো ওটুকুও জোটে না।”

স্বামী ইয়ালাপ্পার সঙ্গে শিরোল তালুকের দানোলি গ্রামে থাকেন সত্তুরে ফেরিওয়ালি। ভূমিহীন এই দম্পতি যাযাবর নন্দীওয়ালে সম্প্রদায়ভুক্ত।

“কোনও কিছুর প্রতি আগ্রহ, ফূর্তি, ফুরসত... বিয়ে-থা করার আগে ছিল ওসব,” যৌবনে ফেলে আসা আনন্দের মুহূর্তগুলো মনে করে আলতো আলতো হাসছিলেন ইয়াল্লুবাই, “একদণ্ড বাড়িতে পা টিকত না... মাঠেঘাটে টোটো করতাম... নদীতে যেতাম। বিয়ের পর সেসব আর কিছুই রইল না। শুধু হেঁশেল আর বাচ্চাকাচ্চা।”

Yallubai sells combs, hair accessories, artificial jewellery, aluminium utensils in villages in Kolhapur district of Maharashtra
PHOTO • Jyoti Shinoli
The 70-year-old carries her wares in a bamboo basket and a tarpaulin bag which she opens out (right) when a customer comes along
PHOTO • Jyoti Shinoli

বাঁদিকে: মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলার গাঁয়ে-গাঁয়ে চিরুনি, চুলে পরার সামগ্রী, নকল গয়না, অ্যালুমিনিয়ামের বাসনকোসন ইত্যাদি ফেরি করে বেড়ান ইয়াল্লুবাই। মালপত্র সব একটি বেতের ঝুড়ি আর ত্রিপলের থলিতে থাকে, খদ্দের এলে এগুলো খুলে মালপত্তর বার করেন

সমগ্র দেশ জুড়ে দিনের প্রায় বিনা মজুরির ২০ শতাংশ গৃহকর্ম এবং বাড়ির লোকের দেখভাল করে কাটান গ্রামীণ মহিলারা — তথ্যটি উঠে এসেছে এ বিষয়ে সংঘটিত সর্বপ্রথম সমীক্ষায়। টাইম ইউজ ইন ইন্ডিয়া ২০১৯ শিরোনামে এই রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যান ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন মন্ত্রক (মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন বা এমওএসপিআই)।

গ্রামীণ ভারতের বহু নারী শ্রমিক, মা, স্ত্রী, কন্যা এবং বৌমার ভূমিকা থেকে যখনই খানিক ফুরসত পান, লেগে পড়েন আচার বানানো, পাঁপড় শুকানো বা সেলাই-ফোঁড়াইয়ের মতো সাংসারিক কাজে। উর্মিলা দেবীর কথায়: “হাতে করে যে কোনও ধরনের সেলাইয়ের কাজ বড্ড স্বস্তি দেয়। খানকতক পুরনো শাড়ি বেছে সেগুলো কেটেছেঁটে জোড়া লাগিয়ে ঘরের জন্য কাথারি [কাঁথা] বানাই আমরা।” উর্মিলা উত্তরপ্রদেশের বৈঠকবা জনপদে থাকেন।

গরমকাল পড়লেই ৫০ বছর বয়সি এই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীটি আর পাঁচজন মহিলার সঙ্গে মোষেদের সাঁতার কাটাতে নিয়ে যান — এরকমই বেশকিছু সুখকর মুহূর্তের কথা জানালেন তিনি। “এর-তার থেকে টুকিটাকি খবরাখবর পাই, হাঁড়ির হাল জানি, ওদিকে আমাদের বাচ্চাকাচ্চারা বেলান নদীর পানিতে হুটোপাটি করতে ব্যস্ত,” সঙ্গে সঙ্গে চটজলদি এটাও বলে দিলেন যে ব্যাপারটা বেশ নিরাপদ, কারণ গ্রীষ্মকালে নদীটা আদতে নালায় পরিণত হয়।

কোরাঁও জেলার দেউঘাট গ্রামে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হিসেবে কাজ করেন বলে উর্মিলার সপ্তাহগুলো কাটে নতুন মা এবং তাঁদের শিশুদের দেখভাল, টিকাকরণের লম্বা তালিকা তৈরি তথা প্রাক-প্রসব ও প্রসবোত্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে।

চার-চারটে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের মা এবং তিন বছরের কুঞ্জ কুমারের ঠাকুমা হওয়ার পাশাপাশি ২০০০ থেকে ২০০৫ অবধি দেউঘাটের নির্বাচিত গ্রামপ্রধান ছিলেন তিনি। মূলত দলিত অধ্যুষিত এই জনপদে মুষ্টিমেয় শিক্ষিত নারীর মধ্যে তিনি অন্যতম। “অল্পবয়সি মেয়েগুলো ইস্কুলছুট হয়ে বিয়েথা করে নেয়, নিয়মিত ওদের নাম কাটি তালিকা থেকে। না ওরা, না ওদের বাড়ির লোকজন, কেউ কোনও কথাই তোলে না কানে,” অসহায় ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানালেন উর্মিলা।

তবে বিয়ে-শাদি ও আশীর্বাদ বা আর যা-ই হোক না কেন, অন্তত কিছুটা করে সময় নিজেদের জন্য আলাদা করে তুলে রাখতে সক্ষম হন মহিলারা, কারণ “আমরা একসঙ্গে গান গাই, হসিঠাট্টায় মাতি,” বললেন উর্মিলা। হাসতে হাসতে তাঁর সংযোজন, বৈবাহিক তথা পারিবারিক সম্পর্ক ঘিরে এই গানগুলি কিন্তু বেশ আদিরসাত্মক।

Urmila Devi is an anganwadi worker in village Deoghat in Koraon district of Uttar Pradesh
PHOTO • Priti David
Urmila enjoys taking care of the family's buffalo
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: উর্মিলা দেবী উত্তরপ্রদেশের কোরাঁও জেলার দেউঘাট গাঁয়ে কর্মরত একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। ডানদিকে: বাড়ির মোষগুলোর দেখভাল করতে উর্মিলার খুব ভালো লাগে

Chitrekha is a domestic worker in four households in Dhamtari, Chhattisgarh and wants to go on a pilgrimage when she gets time off
PHOTO • Purusottam Thakur
Chitrekha is a domestic worker in four households in Dhamtari, Chhattisgarh and wants to go on a pilgrimage when she gets time off
PHOTO • Purusottam Thakur

ধামতারি, ছত্তিশগড়ে চারটি বাড়িতে গৃহশ্রমিকের কাজ করেন চিত্রেখা। ছুটি পেলেই তীর্থে যেতে ইচ্ছে হয় তাঁর

এখানে আরেকটা কথা উল্লেখ করা উচিত — শুধুই বিয়েবাড়ি নয়, পালাপার্বণগুলিও খানিকটা করে অবকাশ এনে দেয় নারীজীবনে, বিশেষ করে অল্পবয়সি মেয়েদের।

আরতি ও মঙ্গলির থেকে পারি জানতে পেরেছে যে বাঁদনা পরবটাই তাদের সবচাইতে আনন্দের সময়। বীরভূমের সাঁওতাল আদিবাসীরা এটি জানুয়ারি মাসে পালন করে থাকেন। “রংচঙে জামাকাপড় পরি, নাচি-গাই। মায়েরা ঘরে থাকে, তাই খুব একটা কামকাজ করতে হয় না, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটাতে পারি। যা ইচ্ছা তাই করি, কেউ বকাঝকা করে না,” বলল আরতি। এসময় তাদের বাবারা গবাদি পশুর যত্ন নেন, কারণ এই পরবের প্রাণকেন্দ্র জুড়ে রয়েছে পশু-উপাসনা। মুচকি হেসে মঙ্গলি বলে উঠল, “আমাকে কিসুই করতে হয় না।”

অবকাশের তালিকায় রয়েছে তীর্থযাত্রাও। ছুটিছাটা পেলেই তীর্থে যেতে ইচ্ছুক বলে জানালেন ধামতারি-নিবাসী চিত্রেখা: “বাড়ির সবার সঙ্গে সিহোর জেলার [মধ্যপ্রদেশ] শিবমন্দিরে গিয়ে দু-তিনদিন কাটানোর ইচ্ছে আছে, একদিন না একদিন ছুটি নিয়ে ঠিক যাবই।”

পেশায় গৃহশ্রমিক ছত্তিশগড়ের এই ৪৯ বছর বয়সি বাসিন্দা ভোর ৬টায় উঠে ঘরকন্না সামলান। তারপর একছুটে বেরিয়ে যান কাজে। একে একে চারটি গেরস্থালি সামলে বাড়ি ফেরেন সন্ধে ৬টায়। মাস গেলে সব মিলিয়ে ৭,৫০০ টাকা আসে হাতে। এই রোজগারটুকু না থাকলে তাঁর পাঁচ সদস্যের — চিত্রেখা, তাঁর দুই সন্তান, স্বামী ও শাশুড়ি — পরিবারটি অথই জলে গিয়ে পড়ত।

*****

কাজ (মজুরিশ্রম) করতে হচ্ছে না, কালেভদ্রে এমন দিনের মুখ দেখেন গৃহশ্রমিক স্বপ্নালি। “মাসে মোটে দুদিন ছুটি পাই; সপ্তাহান্তে তাঁরা [তাঁর নিয়োগকর্তারা] সব ছুটি পান, তাই শনিবার-রোববারগুলোও খেটে মরতে হয় আমায়, ওই দুটো দিন ছুটিছাটার কোনও প্রশ্নই নেই,” বুঝিয়ে বললেন। তাঁরও যে অবসরের প্রয়োজন, সেকথা কেউ ভেবেও দেখে না।

“আমার স্বামীকে রোববার কাজ করতে হয় না। মাঝেসাঝে রাত্তিরবেলা করে সিনেমা দেখতে যেতে বলে আমায়, কিন্তু সাহস হয় না, পরদিন সক্কাল-সক্কাল কাজে যেতে হবে তো।”

Lohar women resting and chatting while grazing cattle in Birbhum district of West Bengal
PHOTO • Smita Khator

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় গরুছাগল চরাতে চরাতে আড্ডায় মেতেছে লোহার সমাজের মহিলারা

সংসারের ঘানি টানতে বাড়িতে বসেই হাজারটা কামকাজ করতে হয় মহিলাদের। তখন দেখা যায়, যা কিছু তাঁদের করতে ভালো লাগে, সেগুলোই অবকাশের বিকল্প হয়ে ওঠে। রুমা লোহারের (নাম পরিবর্তিত) কথায়: “বাড়ি ফিরে ঘরকন্নার কাজ সামলাই — রান্নাবান্না, সাফসাফাই, বাচ্চাদের খাওয়ানো। তারপর আরাম করে বসে ব্লাউজ-পিস আর স্টোলে কাঁথা-স্টিচ করি।”

তাঁর বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার আদিত্যপুর গ্রামে। জনাচারেক মহিলার সঙ্গে বসেছিলেন রুমা, কাছেই একচিলতে ঘেসোজমিতে চরছিল তাঁদের গরুছাগলগুলি। ২৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সি মহিলাদের এই দলের প্রত্যেকের পরিবারই ভূমিহীন, তাই অন্যের খেত-খামারে কাজ করে দিন গুজরান হয়। পশ্চিমবঙ্গে তফসিলি জাতিরূপে নিবন্ধিত লোহার জাতিভুক্ত এই পাঁচজনেই।

“সকাল সকাল ঘরকন্নার সমস্ত কিছু সামলে তবেই গরুছাগল চরাতে নিয়ে এসেছি,” রুমার বক্তব্য।

তারপরেই বললেন, “নিজেদের জন্য কেমন করে টাইম বার করতে হয় সেটা জানি গো জানি। কিন্তু সেসব থোড়াই না ফাঁস করব!”

জিজ্ঞেস করলাম, “সময় পেলে কী করেন?”

“তেমন কিছুই করি না। আমি তো টুক করে একটু ঘুমিয়ে নিই, কিংবা যাদের সঙ্গে আমার ভাব আছে, তাদের সঙ্গে গল্প করি,” কথাটা বলেই দলের বাদবাকি মহিলাদের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন রুমা। অমনি, সমবেত হাসির কোরাসে মুখর হয়ে উঠল চারদিক!

“কেউ মনেই করে না যে আমরা যে কাজ করি। সবাই বলে আমরা [মেয়েরা] শুধুই সময় নষ্ট করি।”

মহারাষ্ট্র থেকে দেবেশ জ্যোতি শিনোলি , ছত্তিশগড় থেকে পুরুষোত্তম ঠাকুর , বিহার থেকে উমেশ কুমার রায় , পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্মিতা খাটোর এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রীতি ডেভিড যৌথভাবে এই প্রতিবেদনটি লিখেছেন। সম্পাদনায় সহায়তা করেছেন রিয়া বেহল , সম্বিতি আইয়ার , বিশাখা জর্জ জশুয়া বোধিনেত্র । আলোকচিত্র সম্পাদনায় রয়েছেন বিনাইফার ভারুচা

প্রচ্ছদচিত্র: স্মিতা খাটোর

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra