কখনও কখনও কোটরের মধ্যে মৌচাকের সঙ্গে সঙ্গে সাপও থাকে। "সাপ থাকলে মৌমাছিরা আপনাকে কিছুতেই মধু নিতে দেবে না [মধুসংগ্রাহক যাতে সুরক্ষিত থাকেন], কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক সাপটা ঠিক গর্ত থেকে সরে যাবে।" কথাগুলো বলছিলেন বিক্কাপাতিমুন্ড গ্রামের কাথে কুট্টান। তখন মৌ-সংগ্রাহক দিব্যি হাত বাড়িয়ে সেই সুস্বাদু সোনালি চাক বার করে আনতে পারবেন। কাথে আরও বললেন, "সাপটা মৌমাছিকে 'কথা দেয়' যে মধু নিতে আসা কারও কোনও ক্ষতি সে করবে না।"

মধু শিকারি পবিত্র শরীর-মনে আসলে তবেই অবশ্য এসব হবে, নাহলে অন্য কিছু ঘটতেই পারে।

কাথের মতো তিলতোষ কুট্টানও পেশায় মৌ-সংগ্রাহক অর্থাৎ মউলি। তিনিও বিক্কাপাতিমুন্ডের টোডা জনগোষ্ঠীরই একজন। এই গ্রামে ৩৫ জন টোডার বাস। গোষ্ঠীর লোকেদের মোষগুলো যে ঘাসজমিতে চরে বেড়ায় তারই লাগোয়া শোলা অরণ্যের অংশটুকুর মধ্যে দিয়ে ছেলেকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে হেঁটে চললেন তিনি। আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত টোডাদের বসবাস তামিলনাড়ুর নীলগিরি পার্বত্যাঞ্চলে। এঁরা মূলত পশুপালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং প্রকৃতিকে সম্মান জানাতে কঠোর নিরামিষ খাদ্যাভাস মেনে চলেন। ধরিত্রীর নানান অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবশত তারা হাঁটেনও খালি পায়ে।

ছোট্ট এক নদী পেরিয়ে একটা পাহাড়ি ঢালে চড়ার পর তিলতোষ দেখালেন বড়ো গাছগুলোর একটাতে ছোট্ট, প্রায় চোখেই পড়বে না এমনি একখানা গর্ত। তরমুজের মাপের এক পাথর গর্তের মুখ প্রায় পুরোটাই আটকে রেখেছে আর মৌমাছির ঝাঁক উড়ছে তার চারপাশে। এগুলো এশিয়া মহাদেশের এশীয় মধুমক্ষী (এপিস সেরানা)। মৌমাছির যেসব প্রজাতিকে খুব সহজেই পোষ মানিয়ে মৌপালন বাক্সে চাক বাঁধানো যায়, এরা তাদের মধ্যে অন্যতম।

কিন্তু টোডারা মৌমাছিদের প্রাকৃতিক বাসস্থানেই রাখতে পছন্দ করেন। মধু সংগ্রহ করার সময় মৌমাছিদের চাক থেকে বার করে আনতে নীলগিরির অন্যান্য মধু সংগ্রাহক আদিবাসী গোষ্ঠীর মতো তাঁরা আগুন বা ধোঁয়া ব্যবহার করেন না। মৌচাকের খোঁজ পেলে মধুশিকারি চাকের মুখে একটা পাথর রেখে দেন যাতে এই পাহাড়ি এলাকায় দুলকিচালে টহল দিয়ে বেড়ানো ভাল্লুকগুলোকে এর থেকে দূরে রাখা যায়। মধু বার করে আনার জন্য তৈরি হয়ে এসে পাথরটি সরিয়ে নেন তিনি আর ফাঁকের কাছে মুখ এনে আস্তে আস্তে ফুঁ দিতে থাকেন। এতে মৌমাছিদের জন্য আলতো করে বেরিয়ে আসা সম্ভবপর হয় আর শিকারি তখন বহুকক্ষ চাকটার মধ্যে থেকে মধু নিয়ে নিতে পারেন।

Hive of bees, honey gatherer removing a stone that covers the entrance to a bee hive
PHOTO • Courtesy: Keystone Foundation (Kotagiri, Tamil Nadu, India)

বাঁদিকে: এপিস সেরেনা মৌমাছিদের চাক। ডানদিকে: মিষ্টি সোনালি চাকের টুকরো সংগ্রহ করার আগে একজন মধু সংগ্রাহক ফাঁকের মুখ আটকে রাখা পাথরটি সরিয়ে দিচ্ছেন

মৌমাছিরা তাঁকে কামড়ায় না কেন? টোডাদের বিশ্বাসে এর কারণ মৌমাছিরা ঠিক বুঝতে পারে যে মানুষটির মন ও দেহ পবিত্র কিনা। কিন্তু নতুন নতুন মধু সংগ্রহ শিখতে আসা তরুণরা (টোডা সম্প্রদায়ের পুরুষরাই শুধু মধু সংগ্রহ করেন) মাঝে মাঝে মৌমাছির কামড় খায়। তিলতোষ বললেন, "ওরা [শিক্ষানবীশরা] প্রথমে তো একটু ভয় পাবেই, কিন্তু কয়েকবার কামড় খেলে তারপর ঠিক হয়ে যাবে। তখন আর ভয়ডরের বালাই থাকবে না।" এমনকি যখন তিনি কথা বলছিলেন তাঁর বারো বছরের ছেলেটাকে দেখতে না দেখতে একটা মৌমাছি কামড় দিল। তিলতোষ ছেলের কাছে গেলেন, হুল ফোটানো জায়গাটা ভালো করে দেখলেন এবং ওভাবেই ছেড়ে দিলেন।

এর আগে কাথে কুট্টন এক শিকারির গল্প বলছিলেন, যাঁকে হুল ফোটার জ্বালা সইতে হয়েছিল "নিয়মনীতি মেনে চলেনি" বলে। মন্দির যাওয়ার দিনের মতো নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন গোষ্ঠীর লোকেদের কাজ করায় বারণ রয়েছে।

চারিদিকে পাহাড়ঘেরা তাঁর গ্রামে একটা গাছের তলায় বসে কথা বলতে বলতে কাথে মন দিয়ে বাঁশ চিরে লম্বা লম্বা পট্টি তৈরি করছেন আর নরম করছেন সেগুলোকে। তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে বাঁশের জটপাকানো পট্টি ও চেরার পর অবশিষ্ট ছালবাকল। আরও কয়েকজন পুরুষ এই বাঁশ থেকে নরম দড়ি বানাচ্ছেন, এদিকে পাশেই একটা জায়গায় বসে টোডাদের নিজস্ব বিশেষ সুচারু নকশা দিয়ে শাল বুনছেন মহিলারা। এইসব বাঁশের পট্টি নতুন একখানা মন্দির বানাতে কাজে লাগবে।

আরেক গ্রামবাসী উনির কুট্টন পুরোনো দিনের কথা মনে করে বলেন, যখন রাশি রাশি কুরিঞ্জি ফুল ফোটে তখন তাদের রস থেকে কেমন এক বিশেষ মধু তৈরি করে মৌমাছিরা। ১২ বছরে একবার মাত্র পাপড়ি মেলে এই ফুল আর ফোটার মরসুমে (সাধারণত এপ্রিল থেকে জুনের মাঝে) গোটা পাহাড় বেগুনি নীল গালিচায় ঢেকে যায় - এই থেকেই পাহাড়ের নাম নীলগিরি বা নীল পাহাড়। কিন্তু আজকাল, কুট্টনের আফসোস, মরসুমেও কুরিঞ্জি কুঁড়ির দেখা প্রায় মিলছে না। তাই দুর্লভ হয়েছে ওই বিশেষ ধরনের মধুও।

Kathi Kuttan making bamboo strips for a new temple in his Toda village
PHOTO • Audra Caroline Bass
Ooneer Kuttan paused with stripping bamboo and draped in Toda Embroidery
PHOTO • Audra Caroline Bass

বাঁদিকে: কাথে কুট্টন বাঁশের কঞ্চি কাটছেন যা গ্রামে নতুন মন্দির বানানোর কাজে ব্যবহৃত হবে। ডানদিকে: মৌমাছিরা নীল কুরিঞ্জি ফুলের মকরন্দ সংগ্রহ করে কেমন ভাবে বিশেষ মধু তৈরি করত সেই গল্পই শোনাচ্ছেন বরিষ্ঠ গ্রামবাসী উনির কুট্টন। তাঁর গায়ে জড়ানো টোডাদের স্বতন্ত্র নকশাদার শাল

তিলতোষ জানালেন, প্রতি বছর ফুল ক্রমশ অমিল হচ্ছে বলেই হয়তো মধুও পাওয়া যাচ্ছে কম। যদিও কেন যে এমনটা ঘটছে তা তিনি বলতে পারলেন না, আমাদের ধারণা জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা তামিলনাড়ুতে শোলা অরণ্য ও ঘাসজমির চাষাবাদের জমিতে রূপান্তরের মতো কয়েকটা কারণে এমন হতে পারে।

টোডারা মূলত মধু সংগ্রহ করেন বাড়িতে ব্যবহারের জন্য আর গ্রামের লোকেদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য। যেটুকু বেঁচে থাকে তা তাঁরা বিক্রি করেন, যদিও এমনটা সচরাচর হয় না। এমনটা তখনই ঘটে, যখন মধু বাড়তি হয় বা কোনও পর্যটক গ্রামে ঘুরতে-টুরতে আসেন। সাধারণত কেজি প্রতি ৫০০ টাকা দরে বিকোয় এই মধু।

জীবনধারণের জন্য টোডা জনজাতির মানুষেরা জঙ্গলের ওপরেই ভরসা করে থাকেন। তাঁরা ভীষণ রকম স্বনির্ভর। তাঁদের খাদ্যের প্রধান উৎস মোষের দুধ আর নিজেদের ফলানো ফসল। এমনকি তাঁদের ভিটেগুলোও একসময় পুরোপুরি বন থেকে সংগৃহীত সরঞ্জাম দিয়েই বানানো হত, এখন যদিও অনেকেই সরকারের তরফ থেকে গড়ে দেওয়া বাড়িতে থাকেন। অতিরিক্ত খাদ্যের জোগান হিসেবে থাকে মধু। এখন কাজের খোঁজে কেউকেউ গ্রামের বাইরে চলে গিয়েছেন, রয়েও গেছেন কয়েকজন।

তিলতোষ মনে করেন না পরবর্তী প্রজন্ম আর মধু সংগ্রহের বিরাসত চালিয়ে যাবে। কিন্তু অন্যরা আবার আরেকটু আশাবাদী। কাথের দৃঢ় বিশ্বাস যে তরুণ প্রজন্ম এই পরম্পরা ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখবে। সময়ই বলবে কার কথা ঠিক।

এই সমস্ত সাক্ষাৎকার আয়োজনে সহায়তা প্রদানের জন্য কিস্টোন ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ, এবং ধন্যবাদ সর্বানন রাজনকে যিনি মধু সংগ্রাহকদের খুঁজতে সাহায্য করেছিলেন এবং প্রতিটা সাক্ষাৎকারে অনুবাদক হিসেবে আমার সঙ্গে ছিলেন।

অনুবাদ: সাগ্নিক রায়
অনুবাদ সম্পাদনা: রম্যাণি ব্যানার্জী

Audra Caroline Bass

আমেরিকান ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ক্লিনটন ফেলো অড্রা ক্যারোলিন বাস তামিলনাড়ুর কোটাগিরি স্থিত কীস্টোন ফাউন্ডেশনে কাজ করেছেন (সেপ্টেম্বর ২০১৬ - জুন ২০১৭)। এখানে তাঁর কাজের অংশ হিসেবে তিনি মধু শিকারিদের গল্প সংগ্রহ করছিলেন।

Other stories by Audra Caroline Bass
Translator : Sagnik Roy

সাগ্নিক রায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক স্তরের ছাত্র। লোকসংস্কৃতি, ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব, বাংলার ইতিহাস ও সাহিত্য এবং দলিত বিদ্যাচর্চার মতো ক্ষেত্রগুলিতে তিনি আগ্রহী। বই পড়তে, সিনেমা দেখতে, গান শুনতে এবং গাইতে সাগ্নিক ভালোবাসেন।

Other stories by Sagnik Roy