১৯৪৭ সালের সেই রক্তাক্ত সন্ধিক্ষণে র‍্যাডক্লিফ রেখা শুধু এ দেশটাকেই দুটুকরো করে ছাড়েনি, দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল পঞ্জাবও। সীমান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান সিরিল র‍্যাডক্লিফ ছিলেন পেশায় উকিল, তাঁর নামাঙ্কিত রেখায় ভূগোল তো ভাগ হয়েইছে, একই সঙ্গে দেওয়াল উঠেছে পঞ্জাবি ভাষার দুটি লিপির মাঝেও।

“সাহিত্য আর পঞ্জাবি ভাষার দুটি হরফের দেহে দেশভাগের ক্ষতটা আজও টাটকা দগদগে,” জানালেন এ রাজ্যের লুধিয়ানা জেলার কিরপাল সিং পান্নু। নিবাস পায়েল তেহসিলের কাটাহ্‌রি গাঁয়ে।

আজ তিন দশক ধরে দেশভাগ-জাত ক্ষতে মলম লাগিয়ে চলেছেন ৯০ বছরের অবসরপ্রাপ্ত এই সেনানায়ক। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উপ-সেনানায়ক (ডেপুটি কমান্ডান্ট) ছিলেন কিরপাল সিং পান্নু। আজ অবধি তিনি গুরু গ্রন্থ সাহিবের মতো ধর্মগ্রন্থ, বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র এবং মহান কোষের (পঞ্জাবি ভাষার শ্রেষ্ঠ বিশ্বকোষগুলির মধ্যে অন্যতম) মতো অসংখ্য সাহিত্যকর্ম গুরুমুখী (গুরমুখী) থেকে শাহমুখী এবং তার বিপরীত শাহমুখী থেকে গুরুমুখীতে লিপ্যন্তর করেছেন।

উর্দুর মতোই ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখা হয় শাহমুখী। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এপারের পঞ্জাবে এটি আর ব্যবহার করা হয় না। ১৯৯৫-৯৬ সালে পান্নু এমন একখানি কম্পিউটার প্রোগ্রাম বানিয়েছেন, যেটায় গুরুমুখী থেকে শাহমুখী, এবং শাহমুখী থেকে গুরুমুখীতে লিপ্যন্তরিত হয়েছে গুরু গ্রন্থ সাহিব।

দেশভাগের আগে, শাহমুখীতে লেখা পঞ্জাবি পড়তে উর্দুভাষীদের কোনও অসুবিধাই হত না। এমনকি পাকিস্তান গঠনের আগে তো সাহিত্য আর সরকারি আদালতের নথিপত্রের সিংহভাগটাই লেখা হত শাহমুখী হরফে। উপরন্তু অবিভক্ত পঞ্জাবে কিস্যা নামের যে প্রথাগত গল্প-বলিয়ে শিল্পরূপটি ছিল, সেটিতে শাহমুখী বই ছাড়া অন্য কিছুই ইস্তেমাল হত না।

বাঁদিক থেকে ডানদিকে লেখা গুরুমুখীর সাথে দেবনাগরী বর্ণমালার খানিক মিল রয়েছে। পাকিস্তানের পঞ্জাবে এই হরফ কেউ ব্যবহার করে না। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের পঞ্জাবিভাষী পাকিস্তানীরা নিজেদেরই সাহিত্যকর্মগুলির রসাস্বাদন করতে পারেননি। অবিভক্ত পঞ্জাবের যে মহতি সাহিত্য সম্ভার, সেটা শাহমুখীতে লিপিবদ্ধ হলে তবেই তার পাঠোদ্ধার সম্ভব হবে।

Left: Shri Guru Granth Sahib in Shahmukhi and Gurmukhi.
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu
Right: Kirpal Singh Pannu giving a lecture at Punjabi University, Patiala
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu

বাঁদিকে: শাহমুখী ও গুরুমুখীতে লেখা শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিব। ডানদিকে: পাতিয়ালার পঞ্জাবি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখছেন কিরপাল সিং পান্নু

পাতিয়ালা-নিবাসী ভাষা বিশেষজ্ঞ ও ফরাসী শিক্ষক ডঃ ভোজ রাজ, ৬৮, শাহমুখী পড়তে পারেন। তাঁর বক্তব্য: “১৯৪৭ সালের আগে শাহমুখী আর গুরুমুখী দুটোই ব্যবহৃত হত, তবে গুরুমুখীর ইস্তেমাল মূলত গুরুদ্বারাতেই (শিখধর্মের উপাসনাস্থল) সীমাবদ্ধ ছিল,” বললেন তিনি। এই কথাও জানালেন, স্বাধীনতার আগে পঞ্জাবি ভাষায় পরীক্ষা দিতে হলে সাধারণত শাহমুখীতেই লিখতে হত পড়ুয়াদের।

“এমনকি রামায়ণ-মহাভারতের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থও লেখা হয়েছিল ফার্সি-আরবি লিপিতে,” জানালেন ডঃ রাজ। দেশভাগের কোপে পঞ্জাবের সঙ্গে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল তার হরফমালাও। মুহাজির হয়ে পশ্চিম পঞ্জাবে পাড়ি দেয় শাহমুখী, হয়ে যায় পাকিস্তানী, আর ভারতের মাটিতে একলা পড়ে থাকে গুরুমুখী।

পঞ্জাবি সংস্কৃতি, বুলি, সাহিত্য ও ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদানটি হারিয়ে যেতে বসেছে, তাই দশকের পর দশক ধরে জমা হয়েছে উৎকণ্ঠা — সে আঁধারে পিদিম হয়ে দেখা দিয়েছে পান্নুর এই প্রকল্পটি।

“পূর্ব পঞ্জাবের (ভারত) লেখক আর কবিরা চান তাঁদের লেখাপত্তর পশ্চিম পঞ্জাবের (পাকিস্তান) মানুষ পড়ুক, এর উল্টোটাও সত্যি,” জানালেন পান্নু। টরোন্টো, কানাডার বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনে গিয়ে দেখতেন, পাকিস্তান তথা অন্যান্য দেশের পঞ্জাবিরা কেমন হাহুতাশ করছেন দেশভাগ নিয়ে।

একে অপরের সাহিত্য পড়ার যে কতখানি তাগিদ, সেটা এরকমই একটি সম্মলনে প্রকাশ করেছিলেন পাঠক ও পণ্ডিতেরা। “এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন উভয়পক্ষই দুটো লিপি পড়তে পারবে,” বললেন কিরপাল সিং পান্নু, “তবে হ্যাঁ, এটা বলা যতটা সহজ, করা ঠিক ততই কঠিন।”

এ সমস্যার সমাধান একটাই — সাহিত্যের প্রধান নমুনাগুলি যে হরফে গরহাজির, তার সেই লিপিতেই প্রতিলিপিকরণ।

অবশেষে, পান্নুর কম্পিউটার প্রোগ্রামের কৃপায় একজন পাকিস্তানী পাঠক শিখধর্মের পবিত্র পুস্তক গুরু গ্রন্থ সাহিব পড়তে পারবেন শাহমুখীতে। আবার এই প্রোগ্রামেই পাকিস্তানের উর্দু কিংবা শাহমুখীতে লেখা বই ও লেখাপত্র পড়া যাবে গুরুমুখী লিপিতে।

Pages of the Shri Guru Granth Sahib in Shahmukhi and Gurmukhi
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu

শাহমুখী ও গুরুমুখীতে লেখা শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিবের কয়েকটি অঙ্গ (পৃষ্ঠা)

*****

১৯৮৮ সালে, অবসর নেওয়ার পর কম্পিউটার শিখতে কানাডায় পাড়ি দেন পান্নু।

সে দেশের জনসংখ্যার একটি বড়ো ভাগ পঞ্জাবি। মাতৃভূমির খবর পড়ার তাগিদে মুখিয়ে থাকতেন তাঁরা। অজিত ও পঞ্জাবি ট্রিবিউনের মতো পঞ্জাবি সংবাদপত্র বিমান মারফৎ ভারত থেকে পাঠানো হত কানাডায়।

তারপর, এগুলি তথা অন্যান্য খবরের কাগজের পাতা কেটে কেটে নতুন খবরের কাগজ তৈরি হত টরোন্টোয়, জানালেন পান্নু। যেহেতু এই সংবাদপত্রগুলি বিভিন্ন প্রকাশনার কাটিং জুড়ে বানানো কোলাজের মতো, তাই ছাপা ফন্টের সংখ্যাও ছিল একাধিক।

এরকমই একটি দৈনিক সংবাদপত্রের নাম ছিল হমদর্দ উইকলি, পরবর্তীকালে পান্নু কাজ করতেন এখানে। ১৯৯৩ সাল থেকে একটাই ফন্টে ছাপাবার সিদ্ধান্ত নেন হমদর্দের সম্পাদকমণ্ডলী।

“একের পর এক ফন্ট আসছিল হাতে, কম্পিউটার ইস্তেমাল করাটাও সম্ভব ছিল। গুরুমুখীর এক ফন্ট থেকে অন্য ফন্টে রূপান্তর করা দিয়ে শুরু করি,” বললেন পান্নু।

নব্বইয়ের গোড়ার দিকে, টরোন্টোয় তাঁর বাড়ি থেকেই প্রকাশিত হয় হমদর্দ উইকলির সর্বপ্রথম টাইপ করা কপিটি; ছাপা হয়েছিল অনন্তপুরে ফন্টে। ঠিক তারপরেই, পঞ্জাবি কলমন দা কাফলা সংস্থার (পঞ্জাবি লেখক সংঘ) একটি সভায় সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন যে গুরুমুখী-শাহমুখী লিপ্যন্তর প্রয়োজন। ১৯৯২ সালে পথচলা শুরু করেছিল টরোন্টোর পঞ্জাবি লেখকদের এই সংগঠনটি।

Left: The Punjabi script as seen on a computer in January 2011.
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu
Kirpal Singh Pannu honoured by Punjabi Press Club of Canada for services to Punjabi press in creating Gurmukhi fonts. The font conversion programmes helped make way for a Punjabi Technical Dictionary on the computer
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu

বাঁদিকে: জানুয়ারি ২০১১, কম্পিউটারের পর্দায় দেখা যাচ্ছে পঞ্জাবি লিপি। ডানদিকে: গুরুমুখী ফন্টের জন্ম দিয়ে পঞ্জাবি প্রেসকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন বলে কিরপাল সিং পান্নুকে সম্বর্ধনা জানাচ্ছে কানাডার পঞ্জাবি প্রেস ক্লাব। এই প্রতিবর্ণীকরণ প্রোগ্রামেই লুকিয়ে আছে কম্পিউটারে ব্যবহৃত পঞ্জাবি টেকনিক্যাল অভিধানের বীজ

তখনকার দিনে, খুব কম লোকই পান্নুর মতো এমন সচ্ছন্দ্যে কম্পিউটার চালাতে পারতেন। তাই বর্ণান্তরের গুরুদায়িত্বটি তাঁকেই দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে উত্তর আমেরিকার পঞ্জাবি আকাদেমি (অ্যাকাডেমি ও পঞ্জাব ইন নর্থ আমেরিকা) বা এপিএনএ-র সঙ্গে যৌথভাবে সম্মেলন করেছিল সংস্থা নামের একটি পঞ্জাবি সাহিত্য সংগঠন। সেখানে বক্তব্য রাখেন অন্যতম খ্যাতনামা পঞ্জাবি কবি নবতেজ ভারতী: “কিরপাল সিং পান্নু একটি প্রোগ্রাম বানাচ্ছেন। কি তুস্সি ইক ক্লিক কারোগে গুরমুখী তন শাহমুখী হো জাউগা, ইক ক্লিক কারোগে তে শাহমুখী তন গুরমুখী হো জাউগা [মোটে একবার ক্লিক করলেই গুরুমুখীটা শাহমুখী হয়ে যাবে আর শাহমুখী হয়ে তাবে গুরুমুখী]।”

শুরুতে মনে হয়েছিল, বুঝি বা আঁধারে ঢিল ছুঁড়ছেন। তবে গোড়ার কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা কাটিয়ে অচিরেই আশার আলো দেখতে পান, এগিয়ে চলে কাজ।

“যারপরনাই উদ্দীপ্ত হয়ে জাভেদ বুটাকে দেখাতে গেলাম, উনি সাহিত্য জগতের নামজাদা মানুষ, উর্দু আর শাহমুখীও জানেন,” বলছেন পান্নু।

কিন্তু পান্নুর উত্তেজনায় পানি ঢেলে বুটা বলেন, তিনি শাহমুখীতে যে ফন্টটি ব্যবহার করেছেন সেটা বড্ড সাদামাটা, যেন দেওয়ালে গাঁথা সারি সারি কংক্রিটের ইট। সঙ্গে এটাও জানিয়েছিলেন যে ফন্টটা খানিক কুফির (আরবি লেখা হয় যে ফন্টে) মতো দেখতে, উর্দুপাঠকের দুনিয়ায় যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। উর্দু বা শাহমুখীতে বরং নাস্তালিকের আদর আছে — বর্ণমালা যেখানে শুষ্ক গাছের পাতাহীন ডালপালার মতন।

বিষন্ন মনে ফিরে এসেছিলেন কিরপাল সিং পান্নু। পরে অবশ্য ছেলেদের সাহায্য পেয়েছিলেন, হাত বাড়িয়েছিলেন তাঁদের ইয়ার-দোস্তরাও। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেন, একের পর এক গ্রন্থাগারে দ্বারস্থ হন। মদত মিলেছিল বুটা ও তাঁর পরিবারের থেকেও। শেষ পর্যন্ত সফল হলেন পান্নু — জন্ম নেয় নূরি নাস্তালিক ফন্ট।

Left: Pannu with his sons, roughly 20 years ago. The elder son (striped tie), Narwantpal Singh Pannu is an electrical engineer; Rajwantpal Singh Pannu (yellow tie), is the second son and a computer programmer; Harwantpal Singh Pannu, is the youngest and also a computer engineer.
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu
Right: At the presentation of a keyboard in 2005 to prominent Punjabi Sufi singer
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu

বাঁদিকে: নিজের ছেলেদের সঙ্গে পান্নু, আনুমানিক ২০ বছর আগে। বড়োছেলে নরবন্তপাল সিং পান্নু (ডোরাকাটা টাই পরিহিত) একজন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, মেজোছেলে রাজবন্তপাল সিং পান্নু (হলুদ টাই গলায়) ও ছোটোছেলে হরবন্তপাল সিং পান্নু দুজনেই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ডানদিকে: ২০০৫ সালে, বিশিষ্ট এক পঞ্জাবি সুফি গায়কের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি কিবোর্ড তুলে দেওয়া হচ্ছে

ততদিনে ফন্ট বিষয়ে সুগভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করে ফেলেছিলেন, তাই দরকার মতো নূরী নাস্তালিকের ছাঁদ বদলাতে কোনও অসুবিধাই হত না। “গুরুমুখীর ছায়া ধরে বানিয়েছিলাম ওটা। তাই আরেকখান বিরাট সমস্যা থেকেই যাচ্ছিল। ওটা ডানদিকে টেনে আনতে হত, যাতে ডাইনে থেকে বাঁয়ে লেখা যায়। তাই, লোকে যেভাবে দড়ি দিয়ে খুঁটে বাঁধা পশুদের টানে, অক্ষরগুলো সেভাবেই ধরে ধরে বাঁদিক থেকে ডানদিকে টানতে লাগলাম,” বললেন পান্নু।

লিপ্যন্তর প্রক্রিয়ায় উৎসলিপি ও গন্তব্যের হরফমালার মধ্যে উচ্চারণগত সাদৃশ্য থাকাটা একান্তই প্রয়োজন। কিন্তু শাহমুখী আর গুরুমুখীর দুটোতেই এমন কিছু ধ্বনি ছিল, যার সমতূল্য আখর অন্যটায় নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে শাহমুখীর নূন (ن) অক্ষরটির কথা — নূনের নীরব অনুনাসিক শব্দটি গুরুমুখী বর্ণমালায় অনুপস্থিত। তাই এমন সব ধ্বনির জন্য প্রচলিত অক্ষরের গায়ে আঁকিবুঁকি বা ফুটকি জুড়ে জুড়ে নতুন আখর তৈরি করেছিলেন কিরপাল সিং পান্নু।

তিনি আজ গুরুমুখীতে ৩০টিরও অধিক ফন্ট এবং শাহমুখীতে তিন-চারটে ফন্ট নিয়ে কাজ করতে সক্ষম।

*****

পান্নু চাষিবাড়ির সন্তান। কাটাহ্‌রিতে ১০ একর জমি আছে তাঁর পরিবারের। পান্নুর তিন ছেলেই ইঞ্জিনিয়ার, থাকেন কানাডায়।

১৯৫৪ সালে, তৎকালীন পাতিয়ালা ও পূর্ব পঞ্জাব যৌথপ্রদেশের (পাটিয়ালা অ্যান্ড ইস্ট পাঞ্জাব স্টেট্স ইউনিয়ন বা পিইপিএসইউ) অস্ত্রধারী পুলিশবাহিনিতে যোগ দেন পান্নু। ওই অঞ্চলের প্রাক্তন প্রিন্সলি স্টেটগুলি মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এই যৌথপ্রদেশটি। পাতিয়ালার কিলা (কেল্লা) বাহাদুরগড়ে বরিষ্ঠ পদের কনস্টেবল রূপে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ চলাকালীন গুরদাসপুরের ডেরা বাবা নানকে প্রধান কনস্টেবল পদে কাজ করতেন পান্নু। সে যুগে পঞ্জাবের অস্ত্রধারী পুলিশরাই (পিএপি) র‍্যাডক্লিফ রেখা পাহারা দিতেন।

তারপর, ১৯৬৫ সালে বিএসএফের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় পিএপি, আর পান্নুকে পাঠানো হয় লাহৌল ও স্পিতিতে, যেটা তখন পঞ্জাবেরই অংশ ছিল। শুরুতে বিএসএফ ও গণপূর্ত বিভাগের (পিডাব্লিউডি) ও যৌথ সেতু নির্মাণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। পরে পদোন্নতি হয়ে প্রথমে সাব-ইন্সপেক্টর ও শেষে বিএসএফের সহকারী-কমান্ড্যান্ট বনে যান তিনি।

Left: Pannu in uniform in picture taken at Kalyani in West Bengal, in 1984.
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu
He retired as Deputy Commandant in 1988 from Gurdaspur, Punjab, serving largely in the Border Security Force (BSF) in Jammu and Kashmir . With his wife, Patwant (right) in 2009
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu

বাঁদিকে: ১৯৮৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীতে তোলা ছবিতে উর্দি পরিহিত পান্নু। জীবনের সিংহভাগটা সীমান্তরক্ষা বাহিনীর হয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে কাটানোর পর, ১৯৮৮তে ডেপুটি কমান্ড্যান্ট পদ থেকে পঞ্জাবের গুরদাসপুরে অবসর নেন তিনি। ২০০৯ সালে, স্ত্রী পটবন্তের সঙ্গে

মুক্তচিন্তা ও সীমান্তে থাকার সময় বাড়ির জন্য মন-কেমন করা থেকেই জন্ম নিয়েছে সাহিত্য ও কাব্যের প্রতি পান্নুর ভালোবাসা। স্ত্রীকে লেখা একটি দোহা আবৃত্তি করে শোনালেন তিনি:

“পল ভি সাহা না যায়ে রে তেরি জুদাই অ্যা সচ্ আই
পর ইদ্দা জুদাইয়াঁ ভিচ্ হি ইয়ে বীত জানি হ্যায় জিন্দেগি।”

“বিরহে মরি না তোর, এমন মুহূর্ত যে একটিও নেই,
বিরহ নসিবে লেখা — এভাবেই কাটবে জীবন, আল্লাহ!”

বিএসএফের কোম্পানি কমান্ডান্টের পদে খেম করনে মোতায়েন থাকার সময় পাকিস্তানে তাঁর সমপদে বহাল ছিলেন ইকবাল খান। ওঁরা দুজন মিলে একখান মজাদার রীতি চালু করেন। “তখনকার দিনে, সীমান্তের দুদিক থেকেই লোকে সরহদে আসত। পাকিস্তানী অতিথিদের চা খাওয়ানোর দায়িত্বে ছিলাম আমি, ঠিক তেমনই ভারতীয় মেহমানদের উনি চা না খাইয়ে ছাড়তেন না। পেটে কয়েক পেয়ালা চা পড়লেই জবান হত মধুর, আর হৃদয় হত কোমল,” জানালেন তিনি।

শেষ অবধি ড. কূলবীর সিং-কে তাঁর গুরুমুখী-থেকে-শাহমুখী লিপ্যন্তরের কায়দাটা দেখিয়েছিলেন পান্নু। পেশাদার এই স্নায়ুচিকিৎসকটি মন-প্রাণ দিয়ে পঞ্জাবি সাহিত্য ভালোবাসেন, পরবর্তীকালে তাঁর ওয়েবসাইট শ্রী গ্রন্থ ডট অর্গে স্থান পেয়েছিল পান্নুর প্রতিবর্ণীকরণ । “ওখানে বহু বছর ধরে ওটা ছিল,” বললেন পান্নু।

২০০০ সালে, শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিবের আরবি সংস্করণে ফার্সি লিপি ব্যবহার করার সময় পান্নুর বানানো প্রোগ্রামটি ব্যবহার করেছিলেন সাহিত্যের আরেক জাদুকর ড. গুরবচন সিং।

Left: The cover page of Computran Da Dhanantar (Expert on Computers) by Kirpal Singh Pannu, edited by Sarvan Singh.
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu
Right: More pages of the Shri Guru Granth Sahib in both scripts
PHOTO • Courtesy: Kirpal Singh Pannu

বাঁদিকে: সরভন সিংয়ের সম্পাদনায় কিরপাল সিং পান্নুর লেখা কম্পিউটারন দা ধনন্তর-এর (কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ) প্রচ্ছদ। ডানদিকে: দুই হরফে লেখা শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিবের আরও কয়েকটি অঙ্গ (পাতা)

এরপর মহান কোষ বর্ণান্তরণের কাজ শুরু করেন পান্নু। মূলত গুরুমুখী হরফে লেখা পঞ্জাবি ভাষার অন্যতম এই বিশ্বকোষটি ১৪ বছরেরও অধিক সময় ধরে সংকলিত করেছিলেন ভাই কাহন সিং নাভা।

এছাড়াও হীর ওয়ারিস কে শেরোঁ কা হাওয়ালা নামের একটি ১,০০০ পৃষ্ঠার কাব্যগ্রন্থ গুরুমুখীতে লিপ্যন্তর করেছেন তিনি।

পাকিস্তানের শকরগড় তেহসিলটি ৪৭ সালের আগে ভারতের গুরদাসপুর জেলার মধ্যে পড়ত। সেখানকার এক সাংবাদিক, সাবা চৌধুরী জানালেন যে এ অঞ্চলের উঠতি প্রজন্ম আজ পঞ্জাবি জানে না বললেই চলে। কারণ পাকিস্তানে উর্দু বলার উপরেই জোর দেওয়া হয়। তাঁর কথায়: “ইস্কুলের পাঠ্যক্রমে পঞ্জাবির স্থান নেই। এখানকার লোকজন গুরুমুখী জানেই না, আমিও ওই দলেই পড়ি। কেবল আমাদের পূর্বপ্রজন্মের মানুষজন এ হরফ পড়তে পারতেন।”

তবে যাত্রাটা কিন্তু সবসময় রোমাঞ্চকর ছিল না। ২০১৩ সালে এই লিপ্যন্তর প্রক্রিয়াটি নিজের বলে দাবি করে বসেন এক কম্পিউটার বিজ্ঞান অধ্যাপক। পান্নু বাধ্য হন সে দাবি নস্যাৎ করে একটি বই লিখতে। এ বিষয়ে মানহানির মামলা ঠোকা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। নিম্ন আদালত পান্নুর পক্ষেই রায় দিয়েছে বটে, তবে মামলাটি আজও ঝুলে রয়েছে উচ্চতর আপিল আদালতে।

বছরের পর বছর মাথা খাটিয়ে দেশভাগের নির্মমতম ক্ষতের মধ্যে একটি সারাতে পেরে কিরপাল সিং পান্নু আজ সত্যিই খুশি। সীমান্তের এপার-ওপার দুই গগনে আজও জ্বলজ্বল করছে পঞ্জাবি ভাষার সূর্য-চন্দ্র — গুরুমুখী ও শাহমুখী। প্রেম ও বিরহের ভাষা সর্বজনীন, আর সে ভাষার অন্যতম নায়ক পান্নু।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Amir Malik

আমির মালিক একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক ও ২০২২ সালের পারি ফেলো।

Other stories by Amir Malik
Editor : Kavitha Iyer

কবিতা আইয়ার দুই দশক জুড়ে সাংবাদিকতা করছেন। ২০২১ সালে হারপার কলিন্স থেকে তাঁর লেখা ‘ল্যান্ডস্কেপস অফ লস: দ্য স্টোরি অফ অ্যান ইন্ডিয়ান ড্রাউট’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে।

Other stories by Kavitha Iyer
Translator : Joshua Bodhinetra

জশুয়া বোধিনেত্র পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার (পারি) ভারতীয় ভাষাবিভাগ পারিভাষার কন্টেন্ট ম্যানেজার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল উত্তীর্ণ জশুয়া একজন বহুভাষিক কবি তথা অনুবাদক, শিল্প সমালোচক এবং সমাজকর্মী।

Other stories by Joshua Bodhinetra