“তা প্রায় ৪৫০ রকম পাখির ডাক তো আমি চিনি-ই।”
আসলে মিকা রাইয়ের ক্ষেত্রে এই দক্ষতাটা অত্যাবশ্যিক। তিনি যে একজন বন্যপ্রাণ আলোকচিত্রী, অর্থাৎ ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার, দুর্লভ যত পাখি ও প্রাণীদের ক্যামেরাবন্দি করাটা হার না মানা ধৈর্য্যের খেলা, আর এই খেলার শর্ত শব্দের অভিজ্ঞান।
বিহঙ্গ থেকে স্তন্যপায়ী, এ অবধি মিকা প্রায় ৩০০টি আলাদা আলাদা প্রজাতির ছবি তুলেছেন। বিশেষ করে তাঁর মনে পড়ে একটি পাখির কথা — শিস্ ফুটকি বা ব্লাইদস্ ট্রাগোপ্যান (ট্রাগোপ্যান ব্লাইদি), যার দেখা পাওয়াটা বরাতের খেল।
সময়টা অক্টোবর ২০২০, মিকা সবে সবে একখান সিগমা ১৫০এমএম-৬০০এমএম টেলিফটো জুম লেন্স কিনেছেন। মনে মনে ঠিক করলেন, এই জম্পেশ লেন্স দিয়ে শিস্ ফুটকির ছবি না তুললেই নয়। নাছোড়বান্দা মানুষ, পাখির ডাক শুনে শুনে ধাওয়া করতে লাগলেন। “কাফি দিন সে আওয়াজ তোহ্ সুনায়ি দে রাহা থা [বহুদিন যাবৎ পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম]।” মাসের পর মাস কেটে গেল, কিন্তু শিস্ ফুটকি কিছুতেই আর ধরা দেয় না তাঁর ক্যামেরায়।
শেষমেশ মে ২০২১-এ দর্শন দিলেন তিনি। মিকা রাই সেদিন আবারও অরুণাচল প্রদেশের ঈগলনেস্ট বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের ঘন জঙ্গল ভেদ করে হেঁটে চলেছিলেন, ব্লাইদস্ ট্রাগোপ্যানের ডাক লক্ষ্য করে। সিগমা ১৫০এমএম-৬০০এমএম টেলিফটো জুম লেন্স সমেত নিকন ডি৭২০০ বাগিয়ে তিনি প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, কিন্তু বাধ সাধল তাঁর উত্তেজনায় টানটান অবস্থাটা। “ঝাপসা একটা ছবি উঠল। কোনও কম্মের নয়,” স্মৃতিচারণ করছিলেন মিকা।
দু’বছর পর, পশ্চিম কামেংয়ের বোম্পু ক্যাম্পের কাছে সেই অধরা বিহঙ্গ আবারও দেখা দিল, সাদা-সাদা ফুটকিযুক্ত উজ্জ্বল মরচেরঙা দেহ পাতায় আংশিক ঢাকা। এবার কিন্তু মিকা রাইয়ের নিশানা আর ফসকায়নি। এক ঝটকায় ৩০-৪০টি ছবি (বার্স্ট শট) তুলে ফেলেন, যার মধ্যে ১-২টি বেশ ভালো ছিল। সর্বপ্রথম সেটা প্রকাশিত হয় পারিতে: কয়লাখনিতে বিপন্ন ক্যানারি: অরুণাচলের পাখিকূল
অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম কামেং জেলার পূর্ব হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে জলবায়ু বিবর্তনের ধাক্কায় প্রভাবিত পক্ষীকূলকে ঘিরে গবেষণায় নেমেছেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের (আইআইএসসি) কয়েকজন বিজ্ঞানী। মিকা রাই-সহ স্থানীয় কিছু মানুষ তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন।
“ঈগলনেস্টে আমরা যেটা করছি সেটার মিকার মতো মানুষজনের দৌলতেই সম্ভব হচ্ছে। নইলে আমাদের যে ধরনের তথ্য প্রয়োজন, সেটা ক্ষেত্রসমীক্ষায় [ওঁদের ছাড়া] সংগ্রহ করা অসম্ভব হত,” পক্ষীবিদ ড. উমেশ শ্রীনিবাসন জানাচ্ছেন।
তবে পাখি নিয়ে মিকার উৎসাহটা কেবল বিজ্ঞানের পরিসরেই সীমাবদ্ধ নয়। বরকত পাখি বা ব্লেসিং বার্ড ঘিরে একটি নেপালি উপকথা জানা গেল তাঁর কাছে: “একটা লোক তার সৎমায়ের অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে জঙ্গলে গিয়ে মাথা গোঁজে, সেখানে সে বুনো কলা খেয়েছিল বেঁচেছিল, তারপর ধীরে ধীরে পাখিতে রূপান্তরিত হয়। নেপালি লোকধারায় এই রংবেরঙের রাতচরা পাখি মানুষ ও প্রকৃতির ভিতর শাশ্বত এক রহস্যময় যোগসূত্রের প্রতীক।” মিকা রাইয়ের মতে সেই প্রাণীটি লালচে নিমপোখ (মাউন্টেন স্কপস্ আউল) বই আর কিছু নয় — অনেকেরই বিশ্বাস, সচরাসচর দেখা না দেওয়া এই বিহঙ্গটিই সেই বরকত পাখি। লালচে নিমপোখের বিরলতাই লোককথাটির রহস্যের সারাংশ।
এ অরণ্যে পাখির পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে আর পাঁচজনের মতন মিকাও বেশ ক’বার চারপেয়েদের পাল্লায় পড়েছেন, বিশেষ করে দুনিয়ার সবচাইতে বড়ো, লম্বা আর ভারি বোভাইন প্রজাতির — বুনো গৌর বা বনগরু (বস গাওরস), যা ভারতীয় বাইসন নামেও পরিচিত।
একবার হয়েছে কি, সারারাত বৃষ্টিবাদলার পর দুজন বন্ধুর সঙ্গে আবর্জনা সরিয়ে রাস্তা সাফ করতে এসেছেন মিকা। হঠাৎই তিনজন দেখেন যে মোটে ২০ মিটার দূরে একটা বনগরু দাঁড়িয়ে আছে। “আমি চেঁচাতেই মিথুনটা [গৌর] ভীমবেগে আমাদের দিকতে ধেয়ে আসতে লাগল!” সেবার তিন ইয়ার মিলে কীভাবে হ্যাঁচড় প্যাঁচড় করে গাছে উঠে জান বাঁচিয়েছিলেন, সেটা বলতে গিয়ে হেসে একসা হলেন। সেযাত্রা মানে মানে রক্ষে পেয়েছিলেন।
মিকা রাই জানাচ্ছেন, ঈগলনেস্ট বনে তাঁর প্রিয়তম প্রাণী হচ্ছে এশীয় সোনালি বেড়াল (ক্যাটোপুমা টেম্মিংকি) নামের একজাতীয় মাঝারি আকারে বনবিড়াল। একদিন গোধূলি লগ্নে বোম্পু শিবিরে ফেরার সময় এ প্রাণীটিকে দেখেছিলেন। “সঙ্গে একখান ক্যামেরা [নিকন ডি৭২০০] ছিল, ফটো তুলেছিলাম,” উৎফুল্ল হয়ে বললেন তিনি। “তবে আর কখনও চোখে পড়েনি।”
*****
মিকা রাইয়ের জন্ম পশ্চিম কামেংয়ের দিরাং গাঁয়ে, তারপর কোনও এক সময় ওই জেলারই রামালিঙ্গমে স্থানান্তরিত হয় তাঁর পরিবার। “সব্বাই আমায় মিকা রাই বলে ডাকে। ইনস্টাগ্রাম আর ফেসবুকেও আমার নাম মিকা রাই। তবে নথিপত্রে সেটা ‘শম্ভু রাই’,” ২৯ বছরের যুবক জানালেন আমাদের। তবে “টাকাপয়সার বড্ড টানাটানি ছিল, ছোটো ভাইবোনদের পড়তে হত,” তাই ক্লাস ফাইভের পর আর স্কুলমুখো হতে পারেননি তিনি।
পরের কয়েকটা বছর খাটাখাটনির ধাক্কায় ঝাপসা হয়ে গেছে — দিরাংয়ে রাস্তা নির্মাণ, লামা ক্যাম্প আর ঈগলনেস্ট অভয়ারণ্যের বোম্পু ক্যাম্পে রান্নার কাজ। উক্ত দুটি ক্যাম্পই সিংচুং বুগুন ভিলেজ কৌম সংরক্ষিত অরণ্যের (এসবিভিসিআর) অন্তর্গত।
কৈশোরের মাঝামাঝি আবারও রামালিঙ্গমে ফিরে আসেন মিকা। তাঁর কথায়: “ঘরে মা-বাবার সঙ্গে থাকতাম, খেত-খামাতে ওঁদের কাজে হাত লাগাতাম।” তাঁর নেপালি বংশোদ্ভূত পরিবারটি বুগুন সম্প্রদায় থেকে ৪-৫ বিঘা জমি ইজারায় নিয়ে বাঁধাকপি আর আলু চাষ করে, তারপর ৪ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে তাঁরা আসামের তেজপুরে গিয়ে সেসব বেচে আসেন।
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের (আইআইএসসি) পরিবেশ বিজ্ঞান কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক তথা পক্ষীবিদ ড. উমেশ শ্রীনিবাসন যখন পাখপাখালির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে রামালিঙ্গমে আসেন, ২-৩ জন তরুণকে তিনি ক্ষেত্রকর্মী হিসেবে বেছে নেন। বাঁধা রোজগারের সুযোগ পেয়ে একপায়ে খাড়া হয়ে যান মিকা। জানুয়ারি ২০১১ সালে ড. শ্রীনিবাসনের দলে ক্ষেত্রকর্মী পদে কাজ শুরু করেছিলেন মিকা, তখন তাঁর ১৬ বছর বয়স।
তাঁর প্রকৃত শিক্ষাদীক্ষার আঁতুড়ঘর যে অরুণাচলের এই নিবিড় জঙ্গল, তা এককথায় স্বীকার করেন মিকা। “আমি সবচাইতে ভালো চিনি পশ্চিম কামেং জেলার পাখিদের ডাক,” তিনি বলছেন। মিকার সবচেয়ে প্রিয় “পাহাড়ি চোখাঠোঁটি ছাতারে (সিকিম ওয়েজ-বিলড্ ব্যাবলার)। দেখতে তেমন আহামরি নয় বটে, তবে ওর আদব-কায়দা দারুণ লাগে।” এ পক্ষীর চঞ্চু যেমন অনন্য, তেমনই সাদা কাজল মাখা তার চোখ, মিকা সেটাই বলতে চাইছেন। প্রাণীটি অত্যন্ত বিরল, অরুণাচল প্রদেশ, নেপালের পূর্বপ্রান্ত, সিকিম ও পূর্ব ভুটান বাদে তার দেখা আর কোত্থাও মেলে না।
সম্প্রতি ২,০০০ মিটার উপরে আমি শ্যামার (হোয়াইট-রাম্পড্ শামা বা কপসিকাস মালাবারিকাস) ফটো তুলেছি। ব্যাপারটা অতীব বিচিত্র, কারণ সাধারণত এই পাখিটা ৯০০ মিটার কিংবা তারও নিচে বসবাস করে। তাপমাত্রা বাড়ার জন্যই এ পাখি তার অবস্থান পাল্টাচ্ছে,” বললেন তিনি।
“এ গ্রহের বুকে পূর্ব হিমালয় দ্বিতীয় সর্বাধিক জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা, এখানকার বহু প্রজাতি তাপমাত্রার ব্যাপারে প্রচণ্ড সংবেদনশীল। সুতরাং এখানকার জলবায়ু বদলে গেলে পৃথিবীর মোট প্রজাতিসমূহের একটা বড়ো অংশ বিপন্ন হয়ে পড়বে,” বলছেন ড. শ্রীনিবাসন। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ বিশেষ উচ্চতায় যেসব পাখির দেখা মেলে তারা আজ ঠিকানা পরিবর্তন করে আরও উপরের দিকে উঠছে। পড়ুন: কয়লাখনিতে বিপন্ন ক্যানারি: অরুণাচলের পাখিকূল ।
আমি নিজেও ফটোগ্রাফার, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিশেষ ভাবে আগ্রহী। অবাক হয়ে দেখছিলাম, মিকা রাই তাঁর এযাবৎ তোলা বিহঙ্গের ছবি দেখাচ্ছিলেন ফোন খুলে। তাঁর হাবভাব দেখে ভ্রম হবে, কাজটা বুঝি নেহাতই জলভাত। কিন্তু এ তল্লাটে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে টের পেয়েছি, ঠিকঠাক ছবি উঠতে গেলে কী বিশাল পরিমাণে মেহনত, সাধনা ও অপার ধৈর্য্য লাগে।
*****
ড. শ্রীনিবাসন ও মিকা রাইয়ের দলটি ছাউনি পেতেছে বোম্পু ক্যাম্পে, জায়গাটি ঈগলনেস্ট অভয়ারণ্যের মধ্যে পড়ছে — সারা দুনিয়ার পাখি-পাগল মানুষজন দলে দলে ছুটে আসেন এখানে। ছাউনিটা অস্থায়ী, ভাঙাচোরা কংক্রিটের কাঠামো ঘিরে কাঠের জাল আর ত্রিপলের আঁটোসাঁটো বাঁধুনি। ড. উমেশ শ্রীনিবাসনের নেতৃত্বে কর্মরত এই গবেষণা-দলে বিজ্ঞানী ছাড়াও একজন ইন্টার্ন এবং পশ্চিম কামেং জেলার ক্ষেত্রকর্মীরা রয়েছেন। মিকা রাই এ দলের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
মিকা রাই আর আমি গবেষণা ছাউনির বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, চাবুকের মতো উথালপাথাল হচ্ছে ঝোড়ো হাওয়া। চারপাশের সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মেঘমাল্যে ঢাকা, থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে তারা। মিকার মুখে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা শোনার জন্য মুখিয়ে আছি আমি।
“ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি যদি তাপমাত্রা খুব বেশি বেড়ে যায়, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলেও সেটা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এখানকার পাহাড়েও তাপ বাড়ছে। আমরা জানি, বদলে যাওয়া জলবায়ুর ফলে বর্ষাটা উল্টে গেছে,” তিনি জানালেন আমায়, “আগেকার যুগে লোকজন মরসুমের নকশা জানত। বুড়োবুড়িদের মনে আছে, ফেব্রুয়ারি মাসটা কেমন মেঘলাটে হিম হয়ে থাকত।” আর আজ ফেব্রুয়ারির বেমরসুমি বর্ষায় চাষ ও চাষবাস দুই-ই ছারখার হতে বসেছে।
ঈগলনেস্ট অভয়ারণ্যের এই শ্যামল জঙ্গলের মাঝে জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুগম্ভীর প্রভাব কল্পনাও করাও কঠিন, চতুর্দিকে পাখপাখালির কলতান, গগনচুম্বী সব মহীরুহ — অলডার, কিরমোলী (মেপল), রূপসী (ওক)। ভারতের এই পূর্বাঞ্চলের পর্বতে সাততাড়াতাড়ি আড়মোড়া ভাঙে সূর্য, শিবিরের কর্মীরা ভোররাত ৩.৩০ থেকে উঠে বসে আছেন। ঝকঝকে আসমানি আকাশের তলে সবাই কামকাজে ব্যস্ত। শ্বেতশুভ্র ডানায় ভর করে দুলকি চালে ভেসে চলেছে বিশালবপু মেঘের দল।
ড. উমেশ শ্রীনিবাসনের তত্ত্বাবধানে ‘মিস্ট নেটিং’-এর আদবকায়দা শিখেছেন মিকা রাই — মাটিতে দুটো বাঁশের খুঁটি পুঁতে, তাতে নাইলন বা পলিয়েস্টারের সূক্ষ্ম জাল টাঙিয়ে পাখি ধরার কৌশল। ধরার পর পাখিদের চালান করা হয় বটুয়ার ভিতর। তারপর, ছোট্ট ছোট্ট সেই সবুজ বটুয়া থেকে খুব সাবধানে পাখিদের বার করে ড. শ্রীনিবাসনের হাতে তুলে দেন মিকা।
তড়িৎগতিতে পাখির ওজন, ডানার প্রস্থ, পায়ের দৈর্ঘ্য ইত্যাদি সব এক মিনিটেই মেপে, একটা পায়ে আইডেন্টিফিকেশন রিং (পরিচয়-বেড়ি) এঁটে তাদের উড়িয়ে দেওয়া হয়। মিস্ট নেটিং দিয়ে পাখপাখালি ধরে, তাদের অস্থায়ী টেবিলে এনে, মাপজোক করে উড়িয়ে দিতে মোট ১৫-২০ মিনিট লাগে। পুরো প্রক্রিয়াটা এঁরা প্রতি ২০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টায় একবার করে করেন, অন্তত আটঘণ্টা ধরে, তবে পুরোটাই আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল। আর মিকা এইটা আজ প্রায় ১৩ বছর ধরে করে আসছেন।
“আমরা প্রথম প্রথম যখন পাখি ধরা আরম্ভ করি, হোয়াইট-স্পেক্ট্যাকেল্ড ওয়ার্বলারের (চশমাপরা পাতা ফুটকি বা সেইসেরকাস অ্যাফিনিস) মতো ইংরেজি নাম উচ্চারণ করতে হিমশিম খেতাম। ইংরেজি বলার অভ্যাস তো নেই, তাই বড্ড ঝামেলা হত। এসব শব্দ তো জম্মে কখনও শুনিনি,” জানালেন মিকা।
ঈগলনেস্ট অভয়ারণ্যে পক্ষীবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার ফলে পড়শি রাজ্য মেঘালয়ে পাড়ি দেওয়ার সুযোগ পান মিকা। তবে গিয়ে দেখেন, জঙ্গলের বেশ কিছু অংশ কেটে সাফ করে দেওয়া হয়েছে। “১০ দিন ধরে চেরাপুঞ্জি [২০১২ সালে] ঘুরে দেখেছি, অথচ পাখির ২০টা প্রজাতিও চোখে পড়েনি। তখন বুঝতে পারি যে আমি ঈগলনেস্টেই কাজ করতে চাই, কারণ ওখানে আরও অসংখ্য প্রজাতির পাখি রয়েছে। বোম্পুতে বসে বসেই কত যে পাখি দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই।”
“ক্যামেরা কা ইন্টারেস্ট ২০১২ সে শুরু হুয়া [ক্যামেরার প্রতি আমার আগ্রহ ২০১২ সালে শুরু], বলছেন মিকা।” ঘুরতে আসা বিজ্ঞানী নন্দিনী ভেলহোর ক্যামেরাখানা ধার করতেন সেই দিনগুলোয়। “সবুজলেজি মৌটুসি (গ্রীন-টেইলড্ সানবার্ড বা এইথোপিজা নিপালেনসিস) প্রজাতিটা খুবই সাধারণ। ওইটার ছবি তুলে তুলে হাত পাকিয়েছিলাম।”
তার বছর দুয়েক পর, পাখি দেখতে আসা পর্যটকদের পথপ্রদর্শন করা চালু করেন মিকা রাই। ২০১৮ সালে মুম্বইয়ের বিএনএইচএস (বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি) থেকে একটি দল এসেছিল। তাঁদের অনুরোধে ফটো তুলে দেন মিকা। ছবি তোলায় তাঁর পুলক দেখে দলের এক সদস্য তাঁকে একখান পি৯০০০ ক্যামেরা উপহার দিতে চান। কিন্তু মিকা বলে ওঠেন, “স্যার, আমি একটা ডিএসএলআর (ডিজিটাল সিঙ্গেল-লেন্স রিফ্লেক্স) মডেল কিনতে চাই। আপনি যে ক্যামেরাটা দিতে চাইছেন, সেটা আমার লাগবে না।”
ওই দলের চার সদস্যের দরাজ-দিল অনুদান, সঙ্গে তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রকর্ম ও পাখি-প্রদর্শনের রোজগার মিলিয়ে, “আমি ৫০ হাজার টাকা জমাই, তবে দাম পড়ছিল ৫৫ হাজার। তাই আমার বস [ড. শ্রীনিবাসন] বললেন যে বাকি টাকাটা উনিই দিয়ে দেবেন।” শেষমেশ ২০১৮ সালে জীবনের সর্বপ্রথম ডিএসএলআর ক্যামেরাটি কেনেন মিকা — নিকন ডি৭২০০, সঙ্গে একখানা ১৮-৫৫এমএম জুম লেন্সও ছিল।
“২-৩ বছর ধরে ওই ছোট্ট ১৮-৫৫এমএম লেন্সটা দিয়ে বাড়ির আশপাশে ফুলের ছবি তুলে বেড়াতাম।” অনেক দূর থেকে পাখির ক্লোজ-আপ ফটো তুলতে গেলে বিশাল লম্বা আর শক্তিশালী টেলিফটো লেন্স প্রয়োজন। “কয়েক বছর পর ভাবলাম, এবার আমার ১৫০-৬০০এমএম সিগমা লেন্স কেনা উচিত।”
তবে সেই লেন্সটা ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। আপ্যারচার, শাটার স্পিড আর ক্যামেরার আইএসও-র পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝে উঠতে বেগ পেতে হয়। “অত্যন্ত বেকার সব ছবি উঠত তখন,” মনে করে বললেন মিকা। সিনেমাটোগ্রাফার তথা ভালো বন্ধু রাম আল্লুরি ছিলেন বলেই ডিএসএলআর ব্যবহারের খুঁটিনাটি হাতেনাতে শিখতে পেরেছিলেন তিনি। “সেটিংসগুলো ব্যবহার করতে উনিই শিখিয়েছিলেন, আর এখন আমি কেবল ম্যানুয়ালেই ছবি তুলি।”
তবে পক্ষীকূলের শুধু ঝাঁচকচকে ছবি তোলাটাই যথেষ্ট ছিল না। পরের ধাপ, ফটোশপ সফটওয়্যার দিয়ে সেগুলো এডিট করতে শেখা। ২০২১ সালে, স্নাতকোত্তর পড়ুয়া সিদ্ধার্থ শ্রীনিবাসনের সঙ্গে একত্রে বসে ফটোশপ দিয়ে ছবি সম্পাদনায় তালিম নেন মিকা রাই।
অচিরেই ফটোগ্রাফিতে তাঁর দক্ষতার খবর ছড়িয়ে পড়ে আর দ্য থার্ড পোল ওয়েবসাইট থেকে ‘লকডাউন ব্রিঙ্গস্ হার্ডশিপ টু বার্ডার্স্ প্যারাডাইস ইন ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধের জন্য ফটো পাঠাতে অনুরোধ করা হয় মিকা রাইকে — এই ওয়েবসাইটি শুধু হিমালয়-কেন্দ্রিক খবরাখবর ছাপে। “ওরা আমার তোলা সাতটা ছবি নিয়েছিল [উক্ত প্রবন্ধটির জন্য]। প্রতিটার জন্য আলাদা করে পয়সা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম,” মিকা বললেন। ক্ষেত্রকর্মের এই মৌলিক কাজে তাঁর লাগাতার অবদানের জন্য বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে মিকা সহলেখকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
মিকা রাইয়ের প্রতিভা আক্ষরিক অর্থেই বহুমুখী! যত্নবান ক্ষেত্রকর্মী, উৎসাহী ফটোগ্রাফার ও পক্ষী-প্রদর্শক ছাড়াও তিনি একজন গিটারবাদক।
চিত্রে বস্তির গির্জায় ঢুকতেই মিকার বায়েন-অবতারটি চোখে পড়ল। তাঁর দোস্ত, স্থানীয় পাদ্রির মেয়ের বিয়ে, সেই উপলক্ষ্যে গান গাইবেন মিকা, সেদিন সেটারই মহড়া চলছিল। গিয়ে দেখি আলতো আঙুলে গিটার বাজাচ্ছেন মিকা, তাঁকে ঘিরে গানের তালে তালে দুলছে তিনটি মেয়ে। গিটারের তারে তাঁর দুরন্ত আঙুলের মুন্সিয়ানা দেখে মনে পড়ল, জঙ্গলের মিস্ট-নেটিংয়ে আটকে থাকা বিহঙ্গদের ঠিক কতটা সন্তর্পণে তিনি ছাড়িয়ে আনেন।
মিকা গত চারদিনে যতগুলো পাখিকে মেপে, ট্যাগ পরিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের সবগুলোই ক্রমশ ঘনিয়ে আসা এক জলবায়ু বিপর্যয়ের অগ্রদূত...
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র