তিন আঙুলের আলতো ছোঁয়া আর ভেজামতন একটা চৌকো কাপড়ের টুকরো। “আমায় বেজায় সাবধানী হতে হয়।”
বিজয়া পুতারেকু বানানোর ব্যাপারে বলছেন — এটি অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলের একটি স্থানীয় মিষ্টান্ন। ভাতের মাড় দিয়ে তৈরি কাগুজে পরতের ভিতর গুড় ও বাদাম-টাদামের পুর ভরা এই মিষ্টি পালা-পার্বণের মরসুমে চাহিদার তুঙ্গে থাকে। বিজয়া একজন পটিয়সী ময়রা, প্রতিদিন শ-দুয়েক রেকু বানান, যেগুলো আশপাশের মিষ্টির দোকানের লোক এসে নিয়ে যায়। “পুতারেকু তৈরির সময় ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে শুধু ওটাই থাকে। কারও সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলারও জো নেই,” পারিকে জানিয়েছিলেন তিনি।
“কোনও পালা-পার্বণ হোক, বা বাড়িতে কোনও বিশেষ অনুষ্ঠান, পুতারেকুলু ছাড়া সবই অসম্পূর্ণ,” জি. রামকৃষ্ণ জানালেন। আত্রেয়পুরম-নিবাসী রামকৃষ্ণ এখানকার কয়েকটা দোকানে মোড়ক হিসেবে ব্যবহৃত মালপত্র ও বাক্স ইত্যাদি সরবরাহ করেন। “আশ্চর্য এক মিষ্টি, তাই আমার খুব ভাল্লাগে! প্রথম দর্শনে মনে হবে পাতি কাগজ, ভাববেন হয়ত বা কাগজ খাচ্ছি। কিন্তু এককামড় দিলেই দেখবেন মুখের ভিতর গলে যাচ্ছে। তামাম দুনিয়ায় এরকম মিষ্টি আর আছে বলে মনে হয় না,” সগর্বে বললেন তিনি।
পরম যত্নে নাজুক হাতে তৈরি হওয়া এ মিষ্টান্নের আসল পরিচয় অন্ধ্রপ্রদেশের ড. বি.আর. আম্বেদকর কোনাসীমা জেলার চাল। রামচন্দ্রপুরম ব্লকের আত্রেয়পুরম গ্রামের ময়রা কায়েলা বিজয়া কোটা সত্যবতীর কথায়, “চালটা বেশ চটচটে, তাই রেকু [পরত] বানানো ছাড়া আর কোনও আসে লাগে না।” ২০২৩ সালে ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) হাসিল করেছে এ গাঁয়ের পুতারেকু। গতবছর ১৪ই জুন এই জিআই তকমার শিরোপাটি বিশাখাপত্তনমের স্যার আর্থার কটন আত্রেয়পুরম পুতারেকুলা নির্মাতা কল্যান সমিতির হাতে তুলে হয়।
এই নিয়ে এ রাজ্যের তিনটি খাদ্য সামগ্রীর ঝুলিতে ভৌগলিক নির্দেশক জুটল (অন্য দুটি তিরুপতি লাড্ডু ও বন্দর লাড্ডু)। হস্তশিল্প, খাদ্যসামগ্রী, কৃষি তথা আরও নানান বিভাগ মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে ২১টি জিআই-যুক্ত পণ্য রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশে। গেল বছর পুতারেকুর সঙ্গে জিআই শিরোপা জিতেছিল গোয়ার বেবিঙ্কা মিষ্টান্ন। মোরেনার গজক ও মুজাফ্ফরনগরের গুড় অবশ্য তারও আগেই ভৌগলিক নির্দেশক হাসিল করে ফেলেছে।
বিজয়া একজন প্রবীণ ময়রা, ২০১৯ থেকে রেকু বানিয়ে চলেছেন। তাঁর বক্তব্য, সম্পূর্ণ মনোযোগ ছাড়া এ কাজে হাত দেওয়া চলে না। “তবে আজকাল আমি দিল-খুলে গল্পগুজব করতে করতে অন্যান্য মিষ্টি বানাই, কারণ ওগুলো বানানো তুলনায় সোজা।” বাড়িতে নিজেদের খাওয়ার জন্য সুন্নুনডালু ও কোভার মতন নানান মিষ্টান্ন তৈরি করেন তিনি।
মিষ্টির দোকানে-দোকানে রেকু বেচা কেমনভাবে আরম্ভ করেছিলেন, সেটা বোঝাতে গিয়ে বিজয়া বললেন, “পরিবারের কাজে লাগবে আর নিজেরও, সেজন্য খানিক রোজগার করতে চাইতাম। এটা ছাড়া তো অন্য কোনও কামকাজ জানিনে, তাই এসবেই জড়িয়ে পড়লাম আর কি।” বিক্রিবাটার জন্য পুতারেকু ব্যতীত আর কিছু বানান না তিনি।
মাসের গোড়াতেই স্থানীয় হাট থেকে ৫০ কিলো খুচরো চাল কিনে ফেলেন বিজয়া। পুতারেকুলুর শুধু জয়া বিয়্যম দিয়েই বানানো হয়, এই চালের দাম ৩৫ টাকা কিলো। “জয়া বিয়্যম একবার সেদ্ধ করলেই চ্যাটচ্যাটে হয়ে যায়, তাই রেকু তৈরি ছাড়া এ চাল অন্য কোনও কাজে লাগে না,” বুঝিয়ে বললেন তিনি।
সকাল ৭টা বাজলেই ময়রার কাজ শুরু করে দেন বিজয়া। রেকু বানাতে আধা কেজি জয়া বিয়্যম ভালো করে ধুয়ে-টুয়ে অন্তত আধঘণ্টা জল সমেত ঢেকে রাখেন।
ছেলেরা স্কুলে চলে গেলে ভিজিয়ে রাখা চালটুকু ঘন করে বেটে ফেলেন বিজয়া। তারপর সেই চালবাটা একখান বাটিতে ঢেলে সেটা ঘরের বাইরের ছোট্ট কর্মশালায় গিয়ে পুঁচকে একখানি কাঠের পিঁড়ির উপর বসিয়ে দেন।
এরপরের ধাপটাই আসল। ঘড়ির কাঁটা ৯টায় পৌঁছলে কর্মশালার এককোনায় বসে, একদিকে ফুটোওয়ালা বিশেষ একখান উল্টোনো হাঁড়ির সাহায্যে মাকড়সার জালের মতন সূক্ষ্ম, নাজুক রেকুলু বানাতে লাগেন বিজয়া। “এই পাত্রটা শুধু এ তল্লাটেই বানানো হয়, এখানকার মাটি দিয়ে। অন্য কোনও কলসি বা হাঁড়ি দিয়ে এ কাজ হবে না। রেকুর উল্টানো আকার কেবলমাত্র এ হাঁড়ি দিয়েই সম্ভব,” যত্ন সহকারে বোঝালেন আমাদের।
শুখা নারকেল পাতার গনগনে আঁচে হাঁড়িটা গরম হতে থাকে। “নারকেল পাতা চটজলদি পুড়ে যায়, তাই একটানা সমানভাবে বিশাল আঁচ তৈরি হয় [অন্য কোনও পাতায় যেটা না-মুমকিন]। যুতসই পাত্র আর আঁচ না পেলে রেকুলু গড়া যাবে না।”
“হাঁড়িটার দাম ৩০০-৪০০ টাকা। দু-তিন মাস অন্তর অন্তর আমি নতুন একটা করে কিনি। ওর চাইতে বেশিদিন টেকে না,” বিজয়া বললেন। এছাড়ৃ দু’সপ্তাহ বাদে বাদে স্থানীয় হাট থেকে ৫-৬ আঁটি নারকেল পাতাও কিনে আনেন — একেকটা আঁটির দাম ২০-৩০ টাকা।
উল্টোনো হাঁড়িটা যতক্ষণ গরম হচ্ছে, বিজয়া একখান চৌকোমতন কাপড়ের টুকরো বার করে ভিজিয়ে নেন। এ কাজে যে কোনও কেচে রাখা সুতির কাপড় হলেই চলে, সেটা তাঁর শাড়ি হোক বা অন্য কিছু। এবার চালবাটাটা বড়ো একটা থালায় ঢেলে ন্যাকড়াটা তাতে চুবিয়ে নেন।
তারপর আলতো করে বস্ত্রখণ্ডটি তুলে, তাতে লেগে থাকা পানিমিশ্রিত চালবাটার একটা প্রলেপ বসিয়ে দেন উল্টোনো পাত্রটির গায়ে। চোখের নিমিষে ধোঁয়া-বাষ্প বেরিয়ে তৈরি হয় সাদাটে-ধূসর রঙের একটি পরত, কাগজের মতো পাতলা। রান্নাটা সম্পূর্ণ হতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগে না।
এরপরের ধাপটা সবচাইতে কঠিক ও নাজুক। আলতো হাতে, মোটে তিন আঙুল দিয়ে রেকুটি হাঁড়িগাত্র হতে ছাড়িয়ে নেন বিজয়া। “ছাড়ানোর কাজটা সবচেয়ে চাপের। ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলে সব খতম। তাই প্রচণ্ড সাবধানে করতে হয়।” দক্ষ হাতে হাঁড়িমুক্ত রেকুগুলি একটার উপর আরেকটা চাপিয়ে রাখেন পাশেই। বিজয়ার আন্দাজ, ঘণ্টাপিছু ৯০-১০০টির মতন রেকু বানান তিনি। ঘণ্টা দুই-তিনের মধ্যে তাঁর হাতে ১৫০-২০০টির মতন রেকু তৈরি হয়ে যায়। উৎসব-পার্বণের দোরগোড়ায় যখন বায়নার পরিমাণ ৫০০ ছুঁয়ে ফেলে, তখন সেটা মাথায় রেখে বেশি বেশি করে চাল বাটেন তিনি।
আত্রেয়পুরমে রেকুলু রাঁধেন, এমন মহিলার সংখ্যা প্রচুর, তাঁদের অধিকাংশই বাড়িতে রেকু বানান বটে, তবে জনাকয় দোকানেও কাজ করেন।
আত্রেয়পুরম গ্রামের বাসস্ট্যান্ডের সন্নিকটে, কেকে নেতি পুতারেকুলু নামের একটি দোকানে কাজ করেন ভি. শ্যামলা (৫৪)। থাকেন বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরে মিষ্টান্নটি বানাচ্ছেন এই পোড় খাওয়া কারিগর। গোড়াতে বিজয়ার মতোই ঘরে রেকু বানিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর ময়রা-জীবন। “দিন গেলে ১০০টার মতন পরত বানাতাম, ২৫-৩০ টাকা মজুরি জুটত,” মনে করে বললেন শ্যামলা। আজ তিনি মূলত পুতারেকুর অন্তিম ধাপের সঙ্গে যুক্ত: চিনি, গুড়, বাদাম-কিশমিশ, ভালো পরিমাণে ঘি সহ নানান জিনিসের পুর ভরে রেকুগুলি মুড়ে দেন। হররোজ হেঁটে হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়াটা তাঁর পক্ষে অসম্ভব, কারণ “হাঁটুদুটোয় বড্ড ব্যথা হয়।” তাই প্রতিদিন তাঁর ছেলে তাঁকে দোকানে ছেড়ে দিয়ে যায়।
রোজ কেকে নেতি পুতারেকুলুতে এসেই পিছনদিকের একটি কোনায় থিতু হন শ্যামলা। শাড়ি সামলে, উঁচু একখান ধাতব টুল টেনে রোদ এড়িয়ে বসে পড়েন। মুখটা থাকে সড়কের দিকে। পথচলতি খদ্দেররা তাঁকে পুতারেকুর ভিতর পুর ভরা দেখতে অভ্যস্ত।
পাশে ডাঁই করা আছে অজস্র রেকু, সেখান থেকে আলতো হাতে একটা তুলে নিয়ে ভিতরের দিকে যুৎ করে ঘি মাখিয়ে নেন, তারপর পালা গুড়ের গুঁড়ো ছড়ানোর। “সাদামাটা পুতারেকুর জন্য এটাই কাফি, এছাড়া আর কোনও মালমশলা লাগে না,” গুড়-ঘি মাখানো রেকুর উপর আরেকখান রেকুর অর্ধেকটা বসাতে বসাতে বলে উঠলেন তিনি। এবার রেকুটা সযত্নে মুড়তে থাকেন যাতে ভিতরের পুর বাইরে না বেরিয়ে আসে। এটা করতে এক মিনিটেরও বেশি বখত লাগে শ্যামলার। প্রথাগত পুতারেকু চৌকো হয় বটে, তবে সিঙ্গাড়ার মতো তিনকোনা করেও মোড়া যায়।
সিঙ্গাড়ার মতন করে ভাঁজ করলে পুতারেকু-পিছু ৩ টাকা অতিরিক্ত পান তিনি। তাঁর কথায়, “সামোসার মতন আকারে ভাঁজ করাটা আমার পক্ষেও বেশ কঠিন। প্রচণ্ড সাবধান না হলে মুড়মুড়িয়ে ভেঙে যাবে রেকুটা।”
“আমার মতে পাতি চিনি বা গুড়ের এই মিঠাইগুলোয় আদি পুতারেকু। এই রন্ধনপ্রণালীটাই তো আমাদের গাঁয়ে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম শিখে এসেছে,” কাজু-কিশমিশ দেওয়ার পদ্ধতিটা যে তুলনামূলক ভাবে নতুন, সেটাই আমাদের বোঝালেন ভি. শ্যামলা।
সোম থেকে শনি, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা অবধি দোকান-মালিক কাসানি নাগসত্যবতীর (৩৬) সঙ্গে কাজ করেন শ্যামলা। মজুরি বাবদ দিনে ৪০০ টাকা করে পান। গত তিনবছর মজুরির পরিমাণটা বদলায়নি, পুতারেকু জিআই তকমা পাওয়া সত্ত্বেও।
ভৌগলিক নির্দেশকের সঙ্গে বিজয়া ও শ্যামলার মতো কারিগরদের জীবনের দূর-দূরান্তের কোনও সম্পর্ক নেই। জিআই ট্যাগ মিলেছে, তবু মজুরি বাড়েনি, অথচ দোকান-মালিক তথা অন্যান্য বড়ো বিক্রেতারা যে ব্যাপক হারে মুনাফা লুটছেন, একথা হলফ করে জানাচ্ছেন তাঁরা।
কাসানি নাগসত্যবতী বলেন, তেলুগুভাষী দুই রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় এ মিষ্টান্ন বরাবর জনপ্রিয় ছিল, “তবে আজকাল আরও বেশি বেশি লোকে জানতে পারছে। পুতারেকু খায় না মাখে, সেটা আগে অন্য রাজ্যের মানুষদের বোঝাতে হত। আজ আর অত গৌরচন্দ্রিকার প্রয়োজন পড়ে না।”
সত্যা স্যার আর্থার কটন আত্রেয়পুরম কল্যান সমিতির সদস্য। পুতারেকুর ঝুলিতে জিআই তকমা আনার জন্য এই অ্যাসোসিয়েশনটি প্রায় ১০ দশ ধরে লড়েছিল, তারপর জুন ২০২৩-এ সে স্বপ্ন সফল হলে, “গোটা গাঁয়ের বুক গর্বে ভরে উঠেছিল।”
তাঁর দোকান তো বটেই, এমনকি প্রত্যেকটা দোকানে আরও বেশি বেশি করে বায়না আসছে পুতারেকু বানানোর, “বেশিরভাগ বরাতই আসে ১০ থেকে ১০০ বাক্স মিঠাইয়ের জন্য,” সত্যা জানালেন। প্রতিটা বাক্সে ১০টা পুতারেকু সাজানো থাকে।
“দিল্লি, মুম্বই, আরও নানান জায়গার লোকেরা বায়না করে,” সত্যা বলছিলেন, “গাঁয়ে আমরা একেকটা পুতারেকুর দাম ১০-১২ টাকার বেশি রাখি না, আর ওরা [বাইরের বড়ো দোকানে] একেকটার জন্য তিরিশ টাকারও বেশি দর হাঁকে। জিআই ট্যাগ পাওয়ার পর থেকে দাম ততটাও পাল্টায়নি। দশ বছর আগে একেক পিস পুতারেকুর দাম ছিল ৭ টাকার মতো।”
“গেল হপ্তায় দুবাই থেকে একটা মেয়ে এসেছিল আমার দোকানে। পুতারেকু বানানোর আদব-কায়দা দেখাতেই তাজ্জব বনে গিয়েছিল। মুখে দিতেই গলে যাচ্ছে, এটা তো বিশ্বাসই করতে চাইছিল না। মেয়েটা বলছিল, এ মিঠাই বানানোর পদ্ধতিটা একটা শিল্প। সত্যি বলতে কি আমি নিজে কিন্তু ওভাবে কক্ষনো ভেবে দেখিনি। তবে এটা হক কথা, যে সারাটাবছর আমরা যারা নিখুঁত ভাবে রেকু মুড়ে মুড়ে ভাঁজ করি, এ কাজ অন্য কেউ করতেই পারবে না।”
এই প্রতিবেদনটি রঙ দে -র একটি অনুদানের সহায়তাপ্রাপ্ত।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র