“এইমাত্র একটা দোয়েলের (Oriental Shama) ডাক শুনলাম।”
উত্তেজনায় টগবগ করছেন মিকা রাই। ডাকটাকে বর্ণনা করলেন একসারি সুরেলা কিচিমিচির হিসেবে।
তাঁর উত্তেজনায় তবু মিশে আছে সাদা-কালো, হলুদ ডানার ছোট্ট পাখিটিকে নিয়ে একরাশ উদ্বেগ। “এদের সাধারণত [৯০০ মিটারের] নিচে দেখা যায়, কিন্তু আজকাল এখানেও [২০০০ মিটার] ডাক শুনতে পাচ্ছি,” জানালেন ৩০ বছর বয়সি বনকর্মী। গত এক দশক ধরে অরুণাচল প্রদেশের ইগলনেস্ট অভয়ারণ্যে পাখি পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন তিনি।
বিজ্ঞানী, গবেষক এবং বনকর্মীদের নিয়ে তৈরি একটি কার্যনির্বাহী দলের সদস্য এলাকার বাসিন্দা মিকা, যাঁরা গত ১০ বছর ধরে অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম কামেং জেলার ক্রান্তীয় পার্বত্য অরণ্য এলাকায় পাখিদের নানা প্রজাতি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন।
ঘন নীল-কালোয় মেশানো শরীর আর ল্যাজে সাদা ডোরা কাটা - চমকপ্রদ দেখতে পাখিটিকে হাতে বসিয়ে ড. উমেশ শ্রীনিবাসন জানালেন, “এর নাম ধলালেজ দোয়েল (White-tail Robin)। সবচেয়ে বেশি যে উচ্চতায় একে সাধারণত আগে দেখা গেছে তা ১৮০০ মিটার, কিন্তু গত তিন-চার বছর ধরে ২০০০ মিটারে দেখা যাচ্ছে।”
পক্ষীবিশারদ শ্রীনিবাসন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স বা আইআইএসসি-তে কর্মরত, এবং অরুণাচল প্রদেশে কর্মরত এই দলটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। “গত ১২ বছর ধরে পূর্ব হিমালয়ের পাখি প্রজাতিরা ক্রমশ তাদের বসবাসের উচ্চতা বদল করছে,” যোগ করলেন শ্রীনিবাসন।
দলে স্থানীয় মানুষদের উপস্থিতির কারণে আশার আলো দেখছেন এলাকার মানুষজন, যাঁরা অনেকদিন ধরেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি তথা এই পরিবর্তনকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা তা নিয়ে চিন্তিত। (এই বিষয়ে প্রতিবেদনের দ্বিতীয় ভাগে বিস্তারিত আলোচনা আছে।)
পশ্চিম কামেং-এর এই দলটিতে আছেন ছয় জন - স্থানীয় মানুষ এবং বিজ্ঞানীরা মিলে বোঝার চেষ্টা করছেন ঠিক কেমনভাবে বাসস্থান কমে আসা এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে পাখিদের ব্যবহারে পরিবর্তন আসছে এবং তাদের বাধ্য করছে আরও উঁচুতে চলে যেতে। অন্য যেসব কম উচ্চতার পাখির মধ্যে বেশি উচ্চতায় চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে তারা হল পাতি সবুজতাউরা (Common Green-Magpie), ল্যাঞ্জা মোটাঠুঁটি (Long-tailed Broadbil), এবং হলুদ রামগাংরা (Sultan Tit)। এতে প্রভাব পড়বে তাদের প্রাণধারণের হারেও।
“এটা কিন্তু সাধারণ অভিবাসন নয়,” সতর্ক করে দিচ্ছেন দলের পক্ষীবিশারদ। “এটা ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার একটা ফলশ্রুতি যা এই পাখিগুলিকে আরও উঁচুতে চলে যেতে বাধ্য করছে।” মেঘাকীর্ণ এই অরণ্যে শুধু যে আকাশচারীরাই উষ্ণতার পদচারণা টের পাচ্ছে তা কিন্তু নয়। “গত তিন-চার বছর ধরে পাহাড়ের গরম অনেকটা বেড়ে গেছে,” জানাচ্ছেন ঐতি থাপা।
২০ বছর বয়সি থাপা দলের নবতম সদস্যদের একজন, থাকেন কাছেই পশ্চিম কামেং জেলার সিংচুং তেহসিলের রামালিংগাম গ্রামে। গ্রামে তাঁর পরিবার টমেটো, বাঁধাকপি আর কড়াইশুঁটি চাষ করে। “এখন চাষ করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে কারণ বৃষ্টিপাতও ভীষণ অনিয়মিত হয়ে গেছে। আগে এরকম ছিল না,” বলছেন তিনি।
হিমালয়ের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে, জানাচ্ছে এই গবেষণাপত্রটি: হিমালয় পর্বতে ব্যাপক জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রসমূহে তার প্রভাব। “হিমালয় পর্বতে উষ্ণায়নের হার বিশ্ব গড়ের চেয়ে বেশি, যা থেকে আবারও প্রমাণিত হয় যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা যে অঞ্চলগুলি তার মধ্যে হিমালয় পর্বতমালা অন্যতম।” পৃথিবীর স্থলজ জীববৈচিত্র্যের ৮৫ শতাংশের বাসস্থান এই পর্বতমালা, কাজেই পরিবেশ সংরক্ষণের কাজ এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাখিরা যেহেতু তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি চলমান, তাদের গতিবিধি থেকে অন্যান্য ক্রান্তীয় পার্বত্য জীববৈচিত্র্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের কী কী প্রভাব পড়ছে তার একটা আন্দাজ পাওয়া সম্ভব
“পৃথিবী জুড়ে এই বসুন্ধরার উপর মানুষের যে প্রভাব, তারই একটা আরও ব্যাপৃত রূপ কাজ করছে হিমালয়ের জীববৈচিত্র্যের উপর,” জানাচ্ছেন উমেশ। অরুণাচল প্রদেশের ২১৮ বর্গকিমি জুড়ে বিস্তৃত ইগলনেস্ট অভয়ারণ্যের ভিতর বংপু ব্লাংসা এলাকার একটি শিবির এখন তাঁর গবেষণাগার।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অভয়ারণ্যের উচ্চতা ৫০০ মিটার থেকে ৩২৫০ মিটারের মধ্যে। পৃথিবীর খুব কম জায়গা আছে যেখানে এই উচ্চতায় হাতি দেখা যায়; এই জঙ্গল তার মধ্যে অন্যতম। অন্য যেসব জন্তু-জানোয়ার দেখা যায় তারা হল গেছো বাঘ (clouded leopards), মার্বেল বিড়াল (marbled cats), এশীয় সোনালি বিড়াল এবং লেপার্ড বিড়াল। ক্যাপ্ড লেঙ্গুর বা মুখপোড়া হনুমান, লাল পান্ডা, এশীয় কালো ভল্লুকের মতো বিপন্ন প্রজাতি এবং অরুণাচল ম্যাকাক ও গউর-এর মতো বিপদ্গ্রস্ত প্রজাতিও এই অরণ্যে বাস করে।
ঐতি আর দেমা তামাং, কুড়ির কোঠার শুরুর দিকে বয়স উভয়ের, তাঁদের রামালিংগাম গ্রাম তথা গোটা রাজ্যেই প্রথম মহিলা যাঁরা পাখি নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রথম যখন কাজ পান দুই তরুণী, বড়োদের মত ছিল না। “ওদের তোমরা জঙ্গলে কেন নিয়ে যেতে চাও? এগুলো মেয়েদের কাজ নয়,” এইসব বলতেন তাঁরা।
“আমি ওঁদের বোঝালাম পৃথিবীটা এখন আর ওরকম নেই,” জানালেন মিকা। তিনি নিজেও ওই গ্রামের বাসিন্দা, এবং এই রাজ্যে তো বটেই, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের জঙ্গলেও পাখি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। “ছেলে আর মেয়েরা একই কাজ করতে পারে।”
ঐতির মতো বনকর্মীরা মাসে ১৮,০০০ টাকা মাইনে পান, তাই সংসারে অনেকটা সাহায্যও করতে পারেন, যেখানে বেশিরভাগ পরিবারই ভাগচাষি।
গবেষণাকাজের কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও সহাস্য ঐতির বক্তব্য, “পাখিদের ইংরেজি নামগুলো মুখস্থ করা সবচেয়ে কঠিন ছিল।”
*****
উনিশ শতকে কয়লাখনিতে কাজ করার সময় খনিশ্রমিকরা ক্যানারি পাখি ব্যবহার করতেন ঝুঁকি পরীক্ষার কাজে। এই ছোট্ট পাখিগুলি কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের প্রতি তীব্র সংবেদনশীল, এবং খনি দুর্ঘটনা এড়ানোয় কাজে লাগত - এই গ্যাসের সংস্পর্শে এলেই মরে যেত তারা। ‘কয়লাখনিতে ক্যানারি’ বা ‘আ ক্যানারি ইন দ্য কোলমাইন’ শব্দবন্ধটি সে সময়ে সম্ভাব্য বিপদের আগাম সংকেত বোঝাতে ব্যবহৃত হত।
পাখিরা যেহেতু তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি চলমান, তাদের গতিবিধি থেকে অন্যান্য ক্রান্তীয় পার্বত্য জীববৈচিত্র্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের কী কী প্রভাব পড়ছে তার একটা আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। কাজেই বংপু দলের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইগলনেস্ট-এ প্রায় ৬০০টি প্রজাতির পাখি আছে। “এখানে শয়ে শয়ে খুদে, প্রায় স্বচ্ছ পাখি পাবেন যাদের ওজন ১০ গ্রাম বা এক চা-চামচ চিনির চেয়েও কম,” জানাচ্ছেন উমেশ। এছাড়াও পৃথিবীর একাধিক বিরলতম প্রজাতির পাখি এই মেঘাচ্ছন্ন অরণ্যকে তাদের ঘরবাড়ি বানিয়েছে। সিঁদুরপেট কুচকুচি (scarlet-bellied Ward’s trogon), শিস্ ফুটকি (Blyth’s Tragopan), রেশমের মতো মোলায়েম নীলচে-ছাই সুন্দরী বনমালি (Beautiful Nuthatch), এবং সম্ভবত এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত, অতিবিরল সোনাচোখ পেঙ্গা (Bugun Liocichla) এই পর্বতে ঘর বেঁধেছে।
এই অভয়ারণ্যের অভাবনীয় পক্ষীসমাহার দেশ-বিদেশ থেকে পক্ষীবিশারদদের টেনে আনে, সে এই দেশ যত খারাপ আবহাওয়া, কঠিন ভূপ্রকৃতি আর কঠোর জীবনযাত্রায় ভরা হোক না কেন।
গবেষণাদল কাজ করে গভীর অরণ্যে - বসবাস একটি এক-কামরার ছাউনিতে, বিদ্যুৎ, জল তো নেইই, নেই মাথার উপর উপযুক্ত একটা ছাদও। বংপু ব্লাংসায় এই শিবিরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দলের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়; তার মধ্যে পড়ে রান্নাবান্না, বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে কাছের ঝরনা থেকে ড্রামে করে জল নিয়ে আসা পর্যন্ত। দলের স্থানীয় সদস্যরা দুই ঘন্টা দূরের রামালিংগাম গ্রামের বাসিন্দা, আর উমেশ এবং বাকি গবেষকরা দেশের নানান অঞ্চল থেকে এসেছেন।
আজ ঐতির উপর রান্নার ভার, কাজেই কাঠের উনুনে চাপানো বড়ো একটা পাত্রে ডাল খুন্তি দিয়ে নাড়ছেন তিনি। “আমার কাজ যে মানুষকে এই জন্তুজানোয়ারদের আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করছে সেটা আমার খুব ভালো লাগে।” দুই বছর হল এখানে কাজ করছেন তিনি।
প্রতি রাতে দলের সবাই মিলে একটা খেলা খেলে; সেখানে এতদিন যা যা পাখি ধরা পড়েছে তার উপর ভিত্তি করে পরের দিন কোন পাখি ধরা পড়বে তার উপর বাজি ধরা হয়। ত্রিপলের ছাউনিতে ঘনঘোর বৃষ্টির শব্দের নিচে হেডল্যাম্পের আলোয় সবাই যোগ দেয় খেলায়।
“কাল সকালে প্রথম কোন পাখিটা জালে ধরা পড়বে?” ঐতি প্রশ্ন করেন।
“আমার মনে হচ্ছে একটা সোনাবুক ছাতারে (Golden-breasted fulvetta) পাব,” তাঁর কণ্ঠস্বর আত্মবিশ্বাসী।
মিকা যোগ দেন, “চশমাপরা পাতা ফুটকি (White-spectacled warbler)।” দম্বর দৃঢ়ভাবে বলেন “না।” তাঁর বাজি, “হলদেগলা ছাতারে (Yellow-throated fulvetta)।”
মিকা আর দম্বর এঁদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ, বংপুর শিবিরে তাঁরা যোগ দিয়েছিলেন বছর কুড়ি বয়সে। উমেশ নিয়ে আসেন তাঁদের। দুজনেই রামালিংগামের স্থানীয় সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। দম্বর একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন, মিকা পঞ্চম শ্রেণিতেই স্কুল ছেড়ে দেন। “আমার পড়াশোনায় একদম মনই ছিল না,” আফশোস শোনা যায় তাঁর গলায়।
শিগগিরই শুয়ে পড়েন সবাই, কারণ পাখি ধরা আর জরুরি তথ্য নথিবদ্ধ করার কাজ সকাল সকালই সবচেয়ে ভালো হয়। “নমুনা সংগ্রহ-ক্ষেত্র কতদূর তার উপর ভিত্তি করে আমাদের হয়তো রাত ৩:৩০-তেই উঠে পড়তে হতে পারে,” জানাচ্ছেন কালিং দাঙ্গেন। ২৭ বছর বয়সি আইআইএসসি-র এই পিএইচডি গবেষক পাখিদের মধ্যে মানসিক চাপজনিত শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দলের বাকিদের সঙ্গে ভোরের নরম আলোয় নমুনা ক্ষেত্রের দিকে রওনা দেবেন তিনি।
*****
পূর্ব হিমালয়ের এই অংশ সুউচ্চ এবং দুর্গম হওয়া সত্ত্বেও মেঘাচ্ছন্ন অরণ্যভূমিগুলিতে বনভূমি ধ্বংস এবং বিশেষ করে কাঠ কাটার কারণে গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন। তিন দশক হয়ে গেল জঙ্গলে কাঠ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট, কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে ততদিনে এখানকার বাস্তুভারসাম্যের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
“কাটা জঙ্গলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলশ্রুতি বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ায়, কারণ সূর্যের আলো সরাসরি ভিতরে এসে পড়ছে। জঙ্গল কাটলে জঙ্গলের মূল প্রকৃতিটাই বদলে যায়,” বলছেন গবেষক কালিং। অবিকৃত জঙ্গলের তুলনায় কাটা জঙ্গল ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উষ্ণতর হতে পারে।
“গরম আবহাওয়ার কারণে পাখিরা গাছের ছায়ায় বেশি সময় কাটায়, ফলে তাদের খাওয়ার সময় কমে যায়; এর জেরে তাদের শারীরিক অবস্থা, প্রাণধারণের সম্ভাবনা এবং জীবনকাল সবই কমে আসতে পারে। আবার হয়তো এই ঘটনা উক্ত বিষয়টার পাশাপাশি কাটা জঙ্গলে পাখিরা যে ধরনের খাবার খায় তার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণেও ঘটতে পারে,” বলছেন কালিং। তিনি মূলত পাখির ওজন, ডানার প্রসার ইত্যাদি তথ্য আহরণ করেন, এবং রক্ত ও মলমূত্রের নমুনা পরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাখিদের শরীরে কী অভিঘাত হচ্ছে।
“সাদালেজা রবিন পাখি সাধারণত শুঁয়োপোকা এবং হেমিপটেরান বা ‘ট্রু বাগ’ জাতীয় পোকা খায়। এমন [কাটা] জঙ্গলে এই ধরনের পোকার সংখ্যা হু হু করে কমে যায়,” জানাচ্ছেন উমেশ। তিনি আরও জানাচ্ছেন, সাদালেজা রবিন পাখিদের সংখ্যা কমে আসার সঙ্গে জঙ্গল কাটার নানা অভিঘাতের সরাসরি সম্পর্ক আছে। “পাখিদের জন্য এটা একদম সরাসরি শারীরিক অভিঘাতও হতে পারে, কারণ গরম বেড়ে যাচ্ছে।”
হিমালয় পর্বতমালায় গাছগাছড়া ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সঙ্গে যুঝতে আরও বেশি বেশি উচ্চতায় জন্মাতে শুরু করেছে। পাখিরাও এই গাছেদের সরণের পথই অনুসরণ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। “বেঁচে থাকার তাগিদে ঐতিহাসিকভাবে ১০০০-১২০০ মিটার উচ্চতায় বসবাসকারী প্রজাতিদের এখন পাওয়া যাচ্ছে ১২০০-২২০০ মিটার উচ্চতায়,” বলছেন উমেশ। পাপুয়া নিউ গিনি এবং আন্দেজ পর্বতমালার মতো অন্যান্য ক্রান্তীয় অঞ্চলেও পাখিদের বেশি উচ্চতায় চলে যাওয়ার ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এই প্রজাতিগুলি এইভাবে আরও বেশি বেশি উচ্চতায় উঠে যেতে থাকলে একদিন না একদিন তারা শীর্ষে পৌঁছে যাবে, আর তারপর আর ওঠার জায়গা না পেয়ে সেখানেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ইগলনেস্টের পাদভূমিতে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ অরণ্য আছে, মাঝারি উচ্চতায় আছে নাতিশীতোষ্ণ চওড়া পত্রবিশিষ্ট অরণ্য, এবং শীর্ষের কাছাকাছি পাইন ও রডোডেনড্রন জাতীয় গাছপালা। এবং এইসব কিছুর মাঝে, “আমাদের এখন যেটা দরকার তা হল জলবায়ুগত অবিচ্ছিন্নতা। প্রজাতিগুলি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতে সরে যেতে পারে,” বলছেন উমেশ, গবেষণার পাশাপাশি যিনি প্রশিক্ষিত চিকিৎসকও বটে। পাখিদের ভালোবেসে পেশা পরিবর্তন করেছিলেন।
পাহাড়ের মাঝে মাঝে চাষাবাদ বা নগরপত্তন হয়ে গেলে সেই অবিচ্ছিন্নতা সম্ভব নয়,” বলছেন তিনি। “এই প্রজাতিগুলিতে বাঁচাতে হলে আমাদের বিভিন্ন উচ্চতা জুড়ে ব্যাপৃত বড়ো মাপের করিডর তৈরি করায় জোর দেওয়া উচিত,” যোগ করলেন তিনি।
*****
মিকা রাই, দম্বর প্রধান, ঐতি থাপা এবং দেমা তামাং-এর মতো স্থানীয় বনকর্মীরা এই গবেষণার অপরিহার্য অঙ্গ - তাঁরা অত্যন্ত জরুরি সব তথ্য সংগ্রহ করছেন এবং একাধিক গবেষণাপত্রে সহকারী লেখক হিসেবে স্বীকৃতিও পাচ্ছেন।
বনকর্মীদের প্রত্যেককে জাল দেওয়া হয়, এবং মিস্ট নেটিং বা কুয়াশা জালিকা নামের একটি পদ্ধতিতে সেই জাল দিয়ে পাখি ধরেন তাঁরা। ঘন গাছগাছালি থাকার কারণে পাখিরা খুব বেশি দেখতে পাবে না এমন সব জায়গায় খুঁটি দিয়ে স্বচ্ছ ও পাতলা জাল টাঙিয়ে এই কাজ করা হয়। পাখিরা জালের মধ্যে উড়ে এসে জড়িয়ে যায়।
“আমাদের প্রত্যেককে ৮-১০টা করে জাল দেওয়া হয়,” তাঁর লাগানো একটি জালের অভিমুখে কাদাভরা ঢাল বেয়ে প্রায় গড়িয়ে নামতে নামতে জানালেন ২৮ বছর বয়সি দম্বর। অকুস্থলে পৌঁছে দ্রুত এবং সতর্ক হাতে ছোট্ট প্রাণীগুলিকে জাল থেকে ছাড়িয়ে সবুজ রঙের সুতি কাপড়ের বস্তায় ঢুকিয়ে রাখেন।
১৫ মিনিটের বেশি কোনও অবস্থাতেই পাখিদের জালে রাখতে নেই। বৃষ্টির সামান্যতম সম্ভাবনা দেখলেই দলের সদস্যরা দ্রুত নমুনাক্ষেত্রগুলিতে গিয়ে পাখিগুলিকে সঙ্গে সঙ্গে বার করে দেন যাতে তাদের উপর অভিঘাত যথাসম্ভব কমানো যায়।
রিঙ্গার্স গ্রিপ, পাখির গলা জড়িয়ে আলগা করে ধরার একটি বিশেষ কায়দায় বস্তা থেকে পাখিদের বার করা হয়। অত্যন্ত যত্নে কাজ করতে হয় কারণ সামান্যতম চাপেও ছোট্ট প্রাণীগুলির জীবন বিপন্ন হতে পারে। পাখিগুলিকে এরপর ওজন করা, মাপা এবং রিং পরানো হয়।
“এই কাজটা আমি কখনও হালকাভাবে নিই না,” জানাচ্ছেন দেমা। “পাখিদের নিয়ে কাজ করতে খুব ভালোবাসি। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এখানে আসেন, আর খুব ভালো কপাল হলেও অনেক দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে ওদের দেখতে পান। আমি ওদের ছোঁয়ার সুযোগ পাই।”
দশম শ্রেণির পর পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া ঐতি জানালেন, “২০২১ সালে এই কাজে যোগ না দিলে এতদিনে আমি আমার পরিবারের সঙ্গে আমাদের ভাড়ার চাষজমিতে কাজ করতাম।” দেমা এবং ঐতির মতো তরুণীরা মিকার কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে আসছেন। এই অরণ্যে শিকার করার দীর্ঘ প্রথাকে প্রশ্ন করতে শিখছে অল্পবয়সি ছেলেরাও।
“ছেলেছোকরা গুলতি দিয়ে পাখিদের দিকে ছুড়ে নামানোর চেষ্টা করত। স্কুলের পর সময় কাটাতে জঙ্গলে গিয়ে এইসব করত।” কিন্তু উমেশ মিকাকে এই পাখিগুলিকে নথিবদ্ধ করার কাজে নিয়োগ করার পর মিকা রামালিংগামের বাচ্চাদের জঙ্গল এবং বন্যপ্রাণের ছবি দেখাতে পারছেন। “আমার ছোটো ছোটো ভাইপো-ভাইঝি, আমার বন্ধুবান্ধব, এরা এখন শিকার আর সংরক্ষণের ব্যাপারগুলোকে অন্যভাবে দেখে,” বলছেন তিনি।
ইগলনেস্টের ঘন অরণ্যে তাঁর অনায়াস বিচরণক্ষমতার কারণে সহকর্মীদের কাছে মানুষ জিপিএস উপাধি পাওয়া মিকা আরও বলছেন, “যখন ছোটো ছিলাম, খুব ইচ্ছে করত শহরে থাকব। কোনও পক্ষীপ্রেমীর যেমন নতুন কোনও প্রজাতির পাখি দেখতে ইচ্ছে করে, ঠিক তেমন ইচ্ছে। কিন্তু ভারতের অন্য সব জায়গায় ঘোরার পর আমার শুধু অরুণাচল প্রদেশের জঙ্গলে ফিরে আসতে ইচ্ছে করত।”
মখমলি সবুল পার্বত্য অরণ্য আর সারি সারি উপত্যকার উপর এক পাথরে লাগানো একটি জালের কাছে পৌঁছে বলে ওঠেন তিনি, “যতবারই আসি না কেন, এই জঙ্গল আমায় সবসময় অভিভূত করে দেয়।”
এই প্রতিবেদনের দ্বিতীয় ভাগে পড়ুন কেমনভাবে স্থানীয় মানুষরা জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করছেন।
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী