পূর্বঘাট পর্বতমালার গর্ভে অস্ত গেলেন সূর্যদেব, পাহাড়ি ময়নার তীক্ষ্ণ সুর দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেল আধাসামরিক বাহিনীর বুটজুতোর তলায়। ওরা আজ আবার গ্রামগুলোয় টহল দিচ্ছে। এই সন্ধ্যাগুলোকেই সবচাইতে বেশি ভয় পায় মেয়েটি।
মেয়েটা জানত না তার নাম কেন দেমাথী রাখা হয়েছিল। "তিনি তো আমাদের গাঁয়েরই মানুষ ছিলেন গো, কোনও ভয়ডর ছিল না তাঁর। একাই সমস্ত সাহেবদের খেদিয়েছিলেন উনি বটে," বিশাল উৎসাহ নিয়ে এই গল্পটা মেয়েটির মা তাকে মাঝে মাঝে শোনাত। কিন্তু মেয়েটি তো একেবারেই সেই দেমাথীর মতো ছিল না – বড্ড শান্তশিষ্ট তো এই মেয়ে।
পেটের ভিতর গুমরে গুমরে ওঠা ব্যথা, ছিঁড়ে খাওয়া খিদে, খাওয়ার জল নেই, দিনের পর দিন ভাঁড়ারে একটাও পয়সা নেই, চারিদিকে সন্দীহান চোখ, হাড়হিম করা চাউনি, বলা নেই কওয়া নেই হুট করে গ্রেফতারি, অকথ্য অত্যাচার, মশা মাছির মতো পড়তে থাকা মানুষের লাশ – এসবের সঙ্গেই ছিল মেয়েটির ঘরকন্না। তবে এই যে জঙ্গল, ওই যে দিগন্তঘন গাছের সারি, কুলকুল করে বয়ে যাওয়া ঝোরা, এসবও তো ছিল তার। শালগাছের ফুলে ও মায়ের গন্ধ পেত, জঙ্গলের ঝুপসিকথায় ওর ঠাকুমার গানগুলো ফিরে ফিরে আসত। সে জানত যে যতদিন এসব আছে তার কাছে ততদিন সব সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা সে সইতে পারবে।
তাও কেন আজ তারা মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিতে চায়? তার এই ছোট্টো কুঁড়েঘর, এই গাঁ, এই জল-জঙ্গল-জমি, এসবের থেকে হাজার হাজার ক্রোশ দূরে... কেন? ও যা যা সত্যি বলে জানে সেগুলো ছাপা আছে এমন কোন কাগজ নেই বলে? তার বাবা শিখিয়েছিল কোন গাছের কী নাম, শিখিয়েছিল যে কোন ঝোপে, কোন পাতায়, বাকলে, শিকড়ে কী কী ওষুধ লুকিয়ে আছে – তবে এসব দিয়ে কিস্যু হবে না, কাগজ লাগবে, কাগজ। যখনই সে তার মায়ের সঙ্গে ফলমূল, বাদাম আর জ্বালানির কাঠ কুড়োতে যেত, মা তাকে আদর করে দেখাত সেই গাছটা যেটার ছায়ায় তার জন্ম হয়েছিল। বড়ো সোহাগ করে ঠাকুমা তাকে জঙ্গলের গান শেখাত। মেয়েটা তার ভাইয়ের সঙ্গে দৌড়ে বেড়াত চারিদিকে, পাখিদের দেখত, ওদের ডাক নকল করত।
কিন্তু এই যে জ্ঞান, এই যে অফুরন্ত গল্প, গান, ছোটবেলার দৌড়ঝাঁপ, এসব দিয়ে আদৌ কি কিছু প্রমাণ করা যায়? চুপটি করে বসে মেয়েটা ভাবছিল ওর নামের মানে, ভাবছিল সেই আগুনরঙা কিশোরীর কথা যার নামে তার নাম রেখেছিল মা-বাবা। সে যে এই জঙ্গলেরই অবিচ্ছেদ্য একটা শিকড়, একটা ঝোরা, সেটা আজ ওর জায়গায় সেই দেমাথী থাকলে না জানি সে কীভাবে প্রমাণ করতো...
মুক্তিরূপেণ সংস্থিতা *
একলা হুতুমবুড়ি
সুতলি বেলায়,
ফোকলা সিঁদুর
খোঁজে কার আঙিনায়?
হাসি তার
সাত'রাজা গোবরের ছড়,
ফুলকি খোয়াবদানে
আঁশটে মুখর।
জিরজিরে
হাড়ে তার লালডুরে চাঁদ,
আলোর অসুখে
আটপৌরে জিহাদ –
হাসি তার
হলদেটে, এলোকেশী ঢেউ,
উল্কি আধাঁরে
কথা রাখেনি তো কেউ...
তবু সে তাথই
আঁখি
দুমুঠো গোধূল
ফাঁকি
ঘরকুনো মহুলের
থুত্থুড়ে ছায়,
একলা হুতুমবুড়ি
জনম সাজায়।
মিলে গেছে
যুগে যুগ, চোখ-গেল মোর –
এবড়োখেবড়ো
দাঁতে দেমাথী শবর,
আলজিভে অগোচরে
খিদের স্বয়ম্বরে
আমার সাকিন
বাঁধে জঠরে তাহার –
একলা হুতুমবুড়ি
সুজনি রাজার।
চোখ-গেল
চোখ-গেল ইলশে আদিম,
বউকথা দেহ
তার আলোনা চাঁদিম।
শোলকে নোলক
বাঁধা
রক্তবীজের
ধাঁধা
আঙারে আঁধার
থাকে জলকে চলায় –
টায়রা,
কিরীটি, লাঠি,
ইচ্ছে শীতলপাটি,
নড়বড়ে
দেমাথীরা সূর্য নাচায়।
শরীর শরীর
জানে
ছিঁড়ে নেওয়া
ভগবানে
নীলচে পলাশে
কে গো লিখেছে "অসুর"?
এগারো রুদ্র
আসে
আদিত্য বারোমাসে
যক্ষে অযোনি
রেখে অষ্টবসুর।
মরুৎ মরুৎ
মহী,
রজস দ্রোহং
দেহি,
গোলাপও দধীচি
হবে পুলহ মালায়।
অশ্বিনী
দস্তকে
শিকড়ে স্যমন্তকে
মৃত্যু ভুলেছি
গান্ধর্ব কথায়।
ঝুপসি হুতুমবুড়ি
একলা সে নহে,
ন'মাসে হাজার
কোটি কালজানি বহে।
সালিহা সে
লেলিহান কন্যা চরণ **
তলপেটে মলোটভা
শাহিন বরণ।
চল্লিশ কোটি
তারা
স্বপ্ন হয়েছে
যারা
বিদ্রোহে
বিদূষকে নয় অসহায়।
স্লোগানে
বা চুল্লিতে
রাঙা আরাবল্লীতে
সালিহা সালিহা
নাচে ভারতবেলায়।
কুড়ানি
অমলতাসে ছোঁয়ানি বিকেল,
পেটকাটি
বেয়োনেট, আবাগি হেঁশেল।
বেহায়া
হুল্কি পাখি
জানে সে
লড়াই বাকি
আমার মা-বাবা
খোঁজে অস্তমী তাই –
যেখানে কুনকি
রাজা
আয়না ভাঙার
সাজা
সেখানে হুতুমবুড়ি
জঠর পোড়ায়।।
আদি দেমাথীর কথা জানতে হলে এখানে ক্লিক করুন।
অডিও: সুধন্য দেশপাণ্ডে জন নাট্য মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা ও পরিচালক, সেইসঙ্গে তিনি লেফ্টওয়ার্ড বুকস্-এর একজন সম্পাদকও।
কভার চিত্রণ: ২০২০ সালের পারি ফেলোশিপ প্রাপক স্ব-শিক্ষিত চিত্রশিল্পী লাবনী জঙ্গীর নিবাস পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়। তিনি বর্তমানে কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেসে বাঙালি শ্রমিকদের পরিযান বিষয়ে গবেষণা করছেন।
* মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ের (তৃতীয় খণ্ড) ৮-৮২ নং শ্লোক অপরাজিতা স্তুতি বা তান্ত্রিক দেবীসূক্তম্ নামে পরিচিত। এখানে স্বর্গচ্যুত দেবতারা হিমবান/হিমালয় পর্বতে উপনীত হয়ে দেবী দুর্গার সহায়তা প্রার্থনায় স্তব করছেন। এই স্তবে মাতৃকা আদ্যাশক্তিকে একে একে বুদ্ধি, নিদ্রা, ক্ষুধা, ছায়া, শক্তি, তৃষ্ণা, ক্ষান্তি/ক্ষমা ইত্যাদি ১৯টি মৌলিক রূপে অবস্থিতা বলা হলেও মুক্তিরূপের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে দেখানো হয়নি –– আর ঠিক সেইখানেই মুক্তির দেবী হয়ে উঠে আসছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী দেমাথী দেই শবর।
** 'চরণ কন্যা' হল জাভেরচাঁদ মেঘানির রচিত একটি বিখ্যাত গুজরাতি কবিতা যেটি গুজরাতের চরণ জনগোষ্ঠীর একটি ১৪ বছরের কিশোরীর অদম্য সাহসকে ঘিরে লেখা। কবিতায় বর্ণিত আছে যে মেয়েটির জনপদে একবার একটি সিংহ এসে হামলা করে আর মেয়েটা একাই একটা লাঠি নিয়ে রুখে দাঁড়ায়।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)