ধামতারির জেলার নাগরি তহসিলে পথের ধারে জনা দশেক লোকের একটা জটলা নজরে পড়ল। আমি সেদিকে পায়ে-পায়ে এগোলাম - এতো মন দিয়ে তাঁরা কী দেখছেন তা জানতে।

কয়েকজন অল্প বয়সী লোক মৌচাক নিঙড়িয়ে টাটকা মধু বিক্রি করছেন। এই মৌচাক স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের ছাদ থেকে ভেঙে আনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আদেশে ওঁনারা এই চাক ভেঙে এনেছেন।

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোথা থেকে তাঁরা আসছেন। শৈবাল খুব সৌজন্য মাখা গলায় বলেন, “কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ।” “খাশ কলকাতা?” আমি জানতে চাই। “আপনি সুন্দরবনের নাম শুনেছেন?” তিনি প্রত্যুত্তরে জানতে চান। অবশ্যই - আমি জানাই। আমি ভাবছিলাম সুন্দরবনেও তাঁরা এই মধু সংগ্রহের কাজই করেন কি না?

Saibal (in red shirt, pouring the honey) and Ranjit Mandal (not in the photo), along with a few others, at their makeshift roadside honey stall in Nagri tehsil
PHOTO • Purusottam Thakur
Saibal (in red shirt, pouring the honey) and Ranjit Mandal (not in the photo), along with a few others, at their makeshift roadside honey stall in Nagri tehsil
PHOTO • Purusottam Thakur

শৈবাল (লাল জামা, মধু ঢালছেন) আর রঞ্জিত মণ্ডল (ছবিতে অনুপস্থিত) সহ আরও অনেকে নাগরি তহশিলের পথের ধারে অস্থায়ী দোকানে

“মধু বেচে আমরা সংসার চালাই না। আমরা ঘর-বাড়ি রং করি। কেউ বললে তবেই আমরা এই চাক-ভাঙার কাজ করি। কিন্তু আমাদের গ্রামে কী করে মৌচাক ভেঙে মধু জোগাড় করা হয় তা আমরা জানি। এ আমাদের প্রথাগত কাজ। আমার ঠাকুরদা, তাঁর ঠাকুরদা ওই একই কাজ করে এসেছেন।”

শৈবালের কাছে জেনেছিলাম কেমন করে তাঁরা গুঞ্জনমুখর, উড়ন্ত মৌমাছিদের তাঁরা সামলান। প্রথমে ওরা কিছু খড় জ্বালিয়ে ধোঁয়া তৈরি করেন। তার ঝাঁঝে মৌমাছিরা চাক ছেড়ে বেরিয়ে আসে। “আমরা ধোঁয়া ছড়িয়ে রানি মৌমাছিকে ধরে ফেলি।” তিনি বলছেন, “আমরা কর্মী মৌমাছিদের মারি না, পোড়াইও না। শুধু রানি মৌমাছিকে ধরে থলের ভেতরে পুরে ফেলি। ফলে অন্য মৌমাছিরাও অক্ষত থাকে।” তারপর ফাঁকা চাক থেকে সংগ্রাহকেরা মধু বের করে নেন। “আমরা রানি মৌমাছিকে জঙ্গলে ছেড়ে দিই যাতে তারা নতুন চাক বানাতে পারে।”

'We neither kill honeybees nor burn them... we release the queen bee in the forest. So that they can make their new colony'
PHOTO • Purusottam Thakur
'We neither kill honeybees nor burn them... we release the queen bee in the forest. So that they can make their new colony'
PHOTO • Purusottam Thakur

“আমরা কর্মী মৌমাছিদের মারিও না, পোড়াইও না আমরা রানি মৌমাছিকে জঙ্গলে ছেড়ে দিই যাতে তারা নতুন করে চাক বানাতে পারে’

নাগরিতে পথের পাশে ওরা ৩০০ টাকা কিলো দরে মধু বেচে (সাথে মধু ভরা চাকও থাকে)। ২৫ কিলো মধু পেয়েছিলেন তাঁরা সেইদিন। এটাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের পারিশ্রমিক হিসেবে ধরে দেয়। ৪০০ টাকা কিলো দরে তাঁরা মৌচাকের মোমও (চাকের ষটকোণ জালিকা) বেচেন। ছত্তিশগড়ে ঘাদওয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁদের বিশিষ্ট ডোকরা শিল্পকর্মে এই মোম ব্যবহার করে থাকেন।

এই দলের  কনিষ্ঠতম সদস্য রঞ্জিত মণ্ডলের কাছে যখন জানতে চাইলাম এই কাজ আগে তিনি কতবার করেছেন, তিনি বলেন, “প্রায় ৩০০ বার হবে - জগদলপুর, বিজাপুর, দান্তেওয়াড়া, সিকিম, ঝাড়খণ্ড এবং এমন আরও কয়েক অনেক জায়গায়।”

বছর দুয়েক আগে খরা নিয়ে একটি খবর করবার জন্য ধামতারি জেলার এই তহশিলেরই একটি গ্রাম জাবাররার পাশের এক জঙ্গল ধরে আমকে বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল। সে সময় তপশিলি জনজাতির কামার সম্প্রদায়ের মানুষ অনজুরা রাম সোরির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, তিনি বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি জানিয়েছিলেন, “যে এলাকাতে খরা দেখা দেয় সেই এলাকার জঙ্গল থেকেও মৌমাছিরা বাসা গুটিয়ে চলে যায়।” তখন আমার মনে হয়েছিল অসহায় মানুষ যেমন বাধ্য হয়ে ঘর বসত ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, মৌমাছিরাও তেমন কোনও সবুজ বনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।

বাংলা অনুবাদ : শৌভিক পান্তি

Purusottam Thakur

পুরুষোত্তম ঠাকুর ২০১৫ সালের পারি ফেলো। তিনি একজন সাংবাদিক এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা। বর্তমানে আজিম প্রেমজী ফাউন্ডেশনে কর্মরত পুরুষোত্তম সমাজ বদলের গল্প লেখায় নিযুক্ত আছেন।

Other stories by পুরুষোত্তম ঠাকুর
Translator : Shouvik Panti

উত্তর ২৪ পরগনার মফস্বল শহর ধান্যকুড়িয়ার মানুষ শৌভিক পান্তির ঠিকানা এখন কলকাতা। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শৌভিক ডিজিটাল হিউম্যানিটিজে প্রশিক্ষিত। কলকাতার বিখ্যাত কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় পুরোনো, ধূলিমলিন এবং অমূল্য বইয়ের সন্ধান তাঁর প্রিয়তম কাজ।

Other stories by Shouvik Panti