ইট আর মাটি দিয়ে তৈরি গোয়ালের মেঝে থেকে আঁজলা ভরে গোবর তুলে নেন মনজিৎ কউর। ৪৮ বছরের এই মহিলা উবু হয়ে বসে মেঝেতে শুকিয়ে যাওয়া গোবর হাত দিয়ে চেঁছে তুলে গামলা ভরেন আর তারপর তা মাথায় তুলে সাবধানে ভার সামলে কাঠের গেট দিয়ে বেরিয়ে ৫০ মিটার দূরে গোবরের গাদায় খালি করেন। বুক সমান এই গোবরের পাহাড়টাই তাঁর সারা মাসের পরিশ্রমের মূর্তিমান সাক্ষী।
এপ্রিল মাসের চড়া রোদে ভরা ছিল দিনটা। ৩০ মিনিটের মধ্যে এই সংক্ষিপ্ত পথে মনজিৎ আটবার যাতায়াত করেন। সব শেষে তিনি খালি হাতে জল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করেন সেই গামলা। যাওয়ার আগে, একটা ছোট্ট দুধের পাত্রে তিনি নিজের নাতির জন্য আধা লিটার মোষের দুধ নিয়ে যান।
পঞ্জাবের তরন তারন জেলার হাভেলিয়ান গ্রামের বেশিরভাগ জমি আর পশু সম্পদ যাদের হাতে, সেই শিখ জাটদের বাড়িতে কাজ করেন তিনি — সকাল ৭টা থেকে শুরু করে এখন অবধি এই ছয় নম্বর বাড়িতে কাজ করছেন।
‘উপায় নেই’, তিনি জানালেন। অগত্যা গোয়াল পরিষ্কারের কাজ করেই দিন গুজরান চলতে থাকে। ঠিক কত গোবর তিনি মাথায় বহন করেন তার সঠিক হিসাব যদিও তাঁর কাছে নেই। কিন্তু জানালেন, “এত ওজন টেনে আমার মাথাটা ব্যথায় ছিঁড়ে যায়।”
তাঁর বাড়ির পথের দুইধারে দিগন্ত জোড়া সোনা রঙা গমের খেত। পঞ্জাবের ফসল তোলার উৎসব, বৈশাখী উদযাপন করে এই ফসল ঘরে তোলার কাজ শুরু হবে। গাণ্ডিউইন্ড ব্লকের হাভেলিয়ান গ্রামের বেশিরভাগ চাষের জমির মালিক জাঠ শিখরা, মূলত গম আর ধান চাষ করেন তাঁরা।
অবশ্য মনজিতের দুপুরের খাবারে জোটে কেবল ঠাণ্ডা রুটি আর চা আর তারপর ঘণ্টা খানেকের বিশ্রাম। এখন তাঁর পেয়েছে তেষ্টা। “এই গরমেও ওরা জল খেতে দেয় না,” নিজের উঁচু জাতের মনিবের প্রসঙ্গে বললেন মনজিৎ।
মাজহাবি শিখ সম্প্রদায়ের দলিত গোষ্ঠীর মানুষ মনজিৎ। দুই দশক আগে সপরিবারে তিনি খ্রিস্টধর্ম পালন করতে শুরু করেন। ২০১৯-এ হিন্দুস্তান টাইমস -এ প্রকাশিত খবর অনুসারে হাভেলিয়ান গ্রামের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ তফসিলি জাতি অথবা অপর পেছিয়ে পড়া শ্রেণিভুক্ত জাতির অন্তর্গত এবং তাঁরা কৃষিমজুর অথবা দিনমজুর হিসাবে কাজ করেন। গ্রামের বাকি সবাই জাঠ শিখ। সেই রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায় যে জাঠ শিখদের প্রায় ১৫০ একর কৃষি জমি কাঁটাতারে ছাওয়া পাকিস্তান সীমান্ত থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে অবস্থিত।
হাভেলিয়ানয়ের দলিত মহিলারা জাঠ শিখ বাড়ির গোয়াল সাফাইয়ের কাজ করেন অথবা বাড়ির অন্যান্য কাজ করে পেট চালান।
মনজিতের কথায়, “গরিবের কথা সরকার ভাবে না বলেই তো আমাদের গোবর তুলে দিন কাটে।”
এই কাজ করে তাঁরা কী পান?
“প্রতি গরু বা মোষ পিছু, ছয়মাসে একবার আমরা এক মণ [৩৭ কিলো] গম অথবা চাল পাই, সেটা অবশ্য চাষের মরসুমের উপর নির্ভর করে,” জানালেন মনজিৎ।
যে সাতটি বাড়িতে মনজিৎ কাজ করেন, সবগুলো মিলিয়ে পশুর সংখ্যা ৫০। মনজিৎ গোনা শুরু করেন এইভাবে, “একটা বাড়িতে ১৫টা, আরেকটাতে সাতটা। তৃতীয় বাড়িটিতে পাঁচটা; চার নম্বর বাড়িটিতে ছয়টি...”
যাদের ১৫টি পশু আছে, তারা বাদে আর সবাই সঠিক পরিমাণ গম বা চাল দেয়। ওরা দেয় কেবল ১০ মণ (৩৭০ কিলো), মনজিৎ জানালেন। “আমি ভাবছি ওদের কাজ ছেড়ে দেব।”
যে বাড়িটিতে সাতটি মোষ আছে তাদের কাছে মনজিৎ নিজের সদ্যজাত নাতির জন্য জামা-কাপড় আর গৃহস্থালির অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার জন্য ৪,০০০ টাকা ধার করেছিলেন। মে মাসে সেই বাড়িতে ছয়মাস কাজ করা হয়ে যাওয়ার পর মনজিতের ধার বাবদ বাজার-দর ধরে সম-পরিমাণ গম কেটে রেখে তাঁকে মজুরি দেওয়া হয়েছে।
সাতটি পশুর জন্য তাঁর প্রাপ্য ছিল সাত মণ বা ২৬০ কিলো গম।
ভারতের খাদ্য নিগমের ঘোষণা অনুসারে এবছর গমের সহায়কমূল্য ধার্য হয়েছে কুইন্টাল পিছু ২,০১৫ টাকা। সেই মতো মনজিতের ২৬০ কিলো গমের অর্থমূল্য দাঁড়ায় ৫,২৪০ টাকা। ধার শোধ করার পর মনজিতের কাছে পড়ে থাকে ১,২৪০ টাকা মূল্যের গম।
এর উপর আবার সুদও দিতে হয় নগদে। “ধারের প্রতি ১০০ টাকার উপর ওরা সুধ নেয় মাসে ৫ টাকা,” তিনি জানালেন। তার মানে বাৎসরিক সুদের হারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ শতাংশ।
এপ্রিলের মাঝামাঝি অবধি কেবল সুদ বাবদই দিয়েছেন তিনি ৭০০ টাকা।
মনজিতের পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত — এক, তাঁর কৃষি শ্রমিক স্বামী, যাঁর বয়স বছর ৫০, ২৪ বছরের একটি ছেলে, তিনিও খেতমজুর, পুত্রবধূ, আর ২২ আর ১৭ বছরের দুই অবিবাহিত মেয়ে। এঁরা দুজনেই জাট শিখ পরিবারে ঘরকন্যার কাজ করে মাসে ৫০০ টাকা করে আয় করেন।
মনজিৎ, বিনা সুদে আরও এক মনিব-বাড়ি থকে ২,৫০০ টাকা ধার করেছেন। তাঁর কথায় উঁচু জাতের মানুষের কাছে ধার না করে তাঁরা ঘর-সংসার চালাতে পারেন না, সে আনাজপাতি কেনাই হোক, আর চিকিৎসার খরচ হোক অথবা পরিবারে বিয়ে অথবা অন্য কোনও অনুষ্ঠান বা স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে মাসিক কিস্তির টাকা দেওয়াই হোক — এই জমা প্রকল্পগুলি আবার মেয়েদের গবাদিপশু ইত্যাদি কিনতে বা অন্য খরচের জন্য টাকা দিয়ে সাহায্য করে।
“দলিত উওমন লেবারারস ইন রুরাল পঞ্জাব: ইনসাইট ফাক্টস (গ্রামীণ পঞ্জাবের দলিত নারী শ্রমিক: সম্যক বাস্তব), নামে ২০২০ প্রাকাশিত একটি সমীক্ষায়, পাতিয়ালার পঞ্জাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক ডঃ জ্ঞান সিং জানাচ্ছেন যে তাঁর সমীক্ষক দল দেখেছেন যে গ্রামীণ পঞ্জাবের দলিত শ্রমিক মহিলাদের পরিবারের ৯৬.৩ শতাংশই ঋণগ্রস্ত — পরিবার পিছু গড় ঋণ এঁদের ৫৪,৩০০ টাকা। এই ঋণের ৮০.৪০ শতাংশই অ-প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্র থেকে নেওয়া।
পুরোনো মনিবরা সুদ নেয় না, নেয় যারা নতুন তারা, বুঝিয়ে বললেন, হাভেলিয়ানের আরেক দলিত মহিলা, ৪৯ বছর বয়সী সুখবীর কউর।
মনজিতের আত্মীয়, সুখবীর মনজিতের কাছাকাছিই থাকেন স্বামী আর ২০-এর কোঠায় দুই ছেলের সঙ্গে, নিজের দু’কামরার বাড়িতে। তাঁর পরিবারের সবাই কাজ জুটলে দৈনিক ৩০০ টাকায় খেতমজুরি বা দিনমজুরি করেন। সুখবীর আজ ১৫ বছর ধরে জাট শিখ বাড়িতে গোয়াল পরিষ্কার করছেন আর গোবর সংগ্রহ করছেন।
যে দুই বাড়িতে কাজ করেন তিনি, তাদের মোট পশুর সংখ্যা ১০। তৃতীয় আর একটি বাড়িতে তিনি ঘরকন্যার কাজ করেন মাসিক ৫০০ টাকা মজুরিতে। কাজে বেরোবার সময়ে তাঁর সকাল ৯টা বটে কিন্তু ফেরার সময়ের কোনও ঠিক নেই। “কোনও দিন ফিরি দুপুরে কোনও দিন বা ৩টে নাগাদ। আবার কখনো সন্ধে ৬টাও বেজে যায়,” জানালেন সুখবীর। “বাড়ি ফিরে আমার রান্না করতে হয়, শেষ করতে হয় বাকি সব কাজ। শুতে যেতে যেতে আমার ১০টা বেজে যায়,” বললেন সুখবীর।
সেদিক থেকে মনজিতের অবস্থা খানিক ভালো কারণ তাঁর গৃহিস্থালির কাজ সামলান তাঁর পুত্রবধূ।
মনজিতের মতোই মনিব-বাড়ি থেকে কর্জ করে সুখবীর ঋণের ভারে নুয়ে আছেন। প্রায় পাঁচ বছর আগে মেয়ের বিয়ের জন্য তিনি এক বাড়ি থেকে ৪০,০০০ টাকা ধার করেছিলেন। ছয়মাস অন্তর তিনি মজুরি বাবদ যে ছয় মণ (২২০ কিলো) করে ধান বা গম পান তার থেকে একটা অংশ এতদিন ধরে কাটিয়েও সেই ঋণ শোধ হয়নি।
প্রতি ছয়মাসে একবার বাকি ধারের হিসাব হয় কিন্তু তার মাঝেই তিনি আবার কোনও না কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠান বা জরুরি কারণে ধার করেন। “এ তো চলতেই থাকে আর তাই তো আমরা এই ধারের জাল থেকে বেরতেই পারি না,” বললেন সুখবীর।
যে বাড়ি থেকে তিনি ধার নিয়েছেন তারা তাঁকে বাড়তি কাজ করে দেওয়ার হুকুমও করে। “যেহেতু আমরা ধার নিয়েছি কাজেই কোনও কিছুতেই আর না বলতে পারি না,” বললেন সুখবীর। “একদিনও যদি কাজে যেতে না পারি তাহলে আমাদের কথা শোনায়, বলে তক্ষুনি ধার শোধ করে বাড়ি বসে আরাম করতে।”
দলিত দাস্তা বিরোধী আন্দোলন নামের একটি সংগঠন ১৯৮৫ সাল থেকে দলিত মহিলাদের দাসত্ব আর বর্ণ বৈষম্যের হাত থেকে বাঁচাবার লড়াই চালাচ্ছে — তারই এক আইনজীবী তথা কর্মী গগনদীপ জানাচ্ছেন যে বেশিরভাগ দলিত মহিলাই যৎসামান্য লেখাপড়া জানেন। “ধার শোধ হওয়ার হিসাব তাঁরা রাখতে পারেন না বলে ঋণের জালে জড়িয়েই থাকেন।”
মালওয়া (দক্ষিণ পঞ্জাব) এবং মাঞ্ঝা (পঞ্জাবের সীমান্ত এলাকা যেখানে তরন তারন অবস্থিত) অঞ্চলে এইসব মহিলাদের উপর যে শোষণ চলে তা অতি সাধারণ ঘটনা বলে জানালেন গগনদীপ, তিনি পদবি ব্যবহার করেন না। “দোয়াবা অঞ্চলে (বিপাশা ও শতদ্রু নদের মাঝের এলাকা) অবস্থা এর চেয়ে ভালো কারণ সেখানকার অনেকেই বিদেশে বসবাস করছেন।”
পঞ্জাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষক দলও লক্ষ্য করেছেন যে ১৯৪৮ সালে বলবৎ হওয়া ন্যূনতম মজুরি আইন সম্বন্ধে দলিত মহিলা শ্রমিকরা কিছুই জানেন না।
যে মহিলারা গোবর পরিষ্কার করেন তাঁদের ন্যূনতম মজুরি আইনের অধীনে তালিকাভুক্ত না করায় তাঁরা শ্রমিকের মর্যাদা পান না বলে জানালেন গঙ্গাদীপ। গৃহকর্মের সহায়কদের সরকার এই তালিকাভুক্ত করেছে কিন্ত বাড়ির বাইরে যাঁরা গোয়াল পরিষ্কার করেন তাঁদের রেখে দিয়েছে এই তালিকার বাইরে। “যেহেতু এই মহিলারা একাধিক বাড়ির গোয়াল পরিষ্কার করেন ঘণ্টা পিছু ন্যূনতম মজুরি তো এঁদেরও প্রাপ্য,” দাবি করলেন গঙ্গাদীপ।
এইসব কথা সুখবীর নিজের মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে জানাতে পারেন না। “জানতে পারলে ওরা আমাদের ঘেন্না করবে। ওরা ভাববে যে ওদের ছেলের এক গরিব বাড়িতে বিয়ে হয়েছে,” বললেন সুখবীর। তাঁর জামাই রাজমিস্ত্রির কাজ করলেও পরিবারটি শিক্ষিত। সুখবীর ওঁদের জানিয়েছেন যে তিনি মাঝেমধ্যে দিনমজুরি করেন।
১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে হাভেলিয়ান গ্রামে আসার আগে মনজিৎও কোনদিন কাজ করেননি — দারিদ্রের চাপে এখানেই প্রথম তাঁর কাজ করা। ওঁর মেয়েরা লোকের বাড়িতে কাজ করলেও মনজিতের প্রতিজ্ঞা যে তিনি তাঁদের কখনই গোবর পরিষ্কারের কাজকে জীবিকা করতে দেবেন না।
মনজিৎ আর সুখবীর, দুজনেই জানালেন যে ওঁদের স্বামীরা নিজেদের আয় মদ খেয়েই শেষ করে দেয়। “ওরা নিজেদের মজুরির ৩০০ টাকা থেকে ২০০ টাকাই উড়িয়ে দেয় মদের পিছনে। ফলে ওই [বাকি] টাকায় আর সংসার চলে না,” বললেন সুখবীর। যখন নিজেদের কাজ থাকে না তখন মদ খাওয়ার জন্য বাড়ির মেয়েদের আয়ে ভাগ বসায়। “আমরা বাধা দিতে গেলে ওরা আমাদের মারে, ধাক্কা দেয় আমাদের দিকে বাসনপত্র ছোঁড়ে,” বললেন সুখবীর।
জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৯-২১ (এনএফএইচএস-৫) অনুসারে, পঞ্জাবের ১৮—৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে ১১ শতাংশ নিজেদের স্বামীদের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন কোনও না কোনওভাবে। ৫ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন যে তাঁদের হয় ধাক্কা দেওয়া হয়েছে, ধরে ঝাঁকুনি দেওয়া হয়েছে, অথবা তাঁদের দিকে কিছু ছুঁড়ে মারা হয়েছে। ১০ শতাংশ স্বামীর হাতে চড় খেয়েছেন; ৩ শতাংশকে এমনভাবে কিল বা ঘুষি বা অন্য কিছু দিয়ে মারা হয়েছে যাতে তাঁদের চোট লাগে আর সম সংখ্যক মহিলাকেই লাথি মারা হয়েছে বা টেনে হিঁচড়ে মারা হয়েছে। ৩৮ শতাংশ মহিলাই জানিয়েছেন যে তাঁদের স্বামীরা নিয়মিত মদ খায়।
ওই পাড়াতেই নিজের ১৫ আর ১২ বছরের ছেলে আর মেয়ে এবং ৬০ বছর বয়সী শ্বশুরকে নিয়ে থাকেন ৩৫ বছরের আরেক দলিত মজহবি শিখ মহিলা সুখবিন্দর। তিনি জানালেন যে আরও কম বয়সে তিনি গোবর পরিষ্কার করার কথা ভাবতেই পারতেন না। তাঁর ছেলে হওয়ার পর শাশুড়ি (পাঁচ বছর হল মারা গেছেন) তাঁকে পরিবারের খরচ সামাল দিতে কাজ করার হুকুম দেন, যদিও সুখবিন্দরের স্বামী তখন খেতমজুরের কাজ করতেন।
বিয়ের পাঁচ বছর পর তিনি গোবর সংগ্রহ করা, গোয়াল পরিষ্কার করা আর উঁচু জাতের মানুষের বাড়ির ঘর ঝাড়ামোছার কাজ করতে শুরু করেন। এখন তিনি পাঁচ বাড়িতে কাজ করেন, তার মধ্যে দুই বাড়িতে গৃহ সহায়িকার কাজ করেন মাসিক ৫০০ টাকা মজুরিতে। আর তিনটি বাড়িতে ১৭টি পশু আছে, যাদের গোবর তিনি সংগ্রহ করেন।
আগে তাঁর এই কাজ করতে খারাপ লাগত। “আমার মাথার উপর যেন একটা বোঝা ছিল,” একেকবারে যে ১০ কিলো করে গোবর তিনি বহন করেন সেই প্রসঙ্গে একথা বললেন তিনি। “আর তার বিদঘুটে গন্ধ,” বলে তিনি চিৎকার করে উঠলেন। “ও দিমাগ দা কিড্ডা মর গয়া [এখন আর আমার গায়ে লাগে না কিছু]” বললেন তিনি।
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে তাঁর খেতমজুর স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন, পরে জানা যায় যে তাঁর একটি বৃক্ক (কিডনি) অকেজো হয়ে গেছে। ওঁরা তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান কিন্তু পরেরদিনই তিনি মারা যান। “পরে আমরা চিকিৎসকের রিপোর্ট থেকে জানতে পারি যে ওর এইডস হয়েছিল,” জানালেন সুখবিন্দর।
তখন তিনি নিজের যাবতীয় ডাক্তারি পরীক্ষা করাবার জন্য এক মনিব-বাড়ি থেকে ৫,০০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন। তারপর আরও ১০,০০০টাকা ও ৫,০০০ টাকা ধার করেন স্বামীর শ্রাদ্ধাদি করার জন্য।
স্বামীর মৃত্যুর আগে তিনি একটা ধার করেছিলেন যার জন্যে প্রতি ১০০ টাকায় দশটাকা অর্থাৎ বাৎসরিক ১২০ শতাংশ হারে তাঁকে সুদ দিতে হয়। সেই একই পরিবার তাঁকে ওদের বাড়ি থেকে গয়না চুরি করার অপবাদ দিয়েছিল। “তাই আমি ওদের কাজ ছেড়ে দিই আর সুদ সমেত ওদের ধার মেটাতে অন্যদের কাছ থেকে ১৫,০০০ টাকা ধার করি। “পরে ওরা নিজেদের বাড়িতেই সেই গয়না খুঁজে পেয়েছিল,” জানালেন সুখবিন্দর।
এখনও তাঁর সেই ১৫,০০০ টাকা ধার শোধ করা হয়নি।
দলিত দাস্তা বিরোধী আন্দোলনের তরন তারন জেলার সভাপতি, রঞ্জিৎ সিংয়ের মতে সুদের হার চড়া রাখাই হয় যাতে এই মহিলারা ঋণের জাল থেকে কখনও বেরতেই না পারেন। “সুদের হার এত বেশি যে এঁরা কোনওদিন আর ধার মেটাতেই পারেন না। শেষ অবধি সেই মহিলার বেগার শ্রমিক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না,” তিনি জানালেন। যেমন সুখবিন্দর ১০,০০০টাকা ঋণের উপর প্রতি মাসে সুধ দেন ১,০০০ টাকা।
পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ভারতে বেগার শ্রমিক (নিবারণ) আইন, ১৯৭৬ তৈরি হয়। এই আইন কোনওভাবে ভাঙলে, ন্যূনতম তিন বছর কারাবাস ও ২,০০০ টাকা জরিমানা হওয়ার কথা। তফসিলি জাতি জনজাতি (নৃশংসতা বিরোধী) আইন, ১৯৮৯ অধীনেও কোনও তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষকে বেগার শ্রমে নিযুক্ত করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
রঞ্জিৎ সিংয়ের মতে জেলা প্রশাসন এই সব মামলার বিচার করতে আদৌ আগ্রহী নয়।
নিজের অসহায়তার কথা বলতে গিয়ে সুখবিন্দর বললেন, “ও (ওঁর স্বামী) থাকলে সংসার চালানো সহজ হত। ধার করে আর ধার শোধ করেই আমাদের জীবন কেটে যায়।”
অনুবাদ: চিলকা