গোটা একটা পাহাড় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল সেদিন রাত্রে।

ঘড়িতে তখন রাত ১১টা, গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলেন অনিতা বাকাডে। চার-পাঁচটা বাড়ি গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এটাই তাঁর পাড়া। একান্নবর্তী বাকাডে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৭, তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন প্রত্যেকেই। তাঁর কথায়, "হঠাৎই একটা জোরালো গুড়গুড় শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমাদের, চকিতে বুঝে যাই যে কী হচ্ছে, আঁধারের মধ্যেই ছুটতে শুরু করলাম, ততক্ষণে আশেপাশের বাড়িগুলো সব ভেঙে পড়েছে হুড়মুড় করে।"

মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার পাটান তালুকে সহ্যাদ্রি পর্বতমালার কোল ঘেঁষে অনিতাদের গ্রাম মিরগাঁও। সেবার পাহাড়ের ধ্বসে শুধুমাত্র বাকাডে পরিবারের বাড়িটাই রক্ষা পেয়েছিল। তবে এবছর জুলাই ২২শের সেই রাত কেড়ে নিয়েছিল তাঁদের পরিবারের ১১ সদস্যের প্রাণ। মৃতদের মধ্যে সবচাইতে কম বয়স ছিল ভাইপো যুবরাজের (৭), আর প্রবীণতম ছিলেন দূর সম্পর্কের আত্মীয় যশোধা বাকাডে (৮০)।

সকাল হতে না হতেই এসে হাজির হয় বিপর্যয় রক্ষা বাহিনী, অনিতা সহ সমস্ত গ্রামবাসীদের নিয়ে যাওয়া হয় ছয় কিলোমিটার দূরে কোয়নানগর গ্রামের জেলা পরিষদ স্কুলে। কোয়না জলাধার নামক প্রকাণ্ড জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি মিরগাঁও থেকে আনুমানিক ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

Anita’s house escaped the landslide that hit her village Mirgaon on July 22, but she lost 11 members of her joint family
PHOTO • Hrushikesh Patil
Anita’s house escaped the landslide that hit her village Mirgaon on July 22, but she lost 11 members of her joint family
PHOTO • Ganesh Shelar

২২শে জুলাই পাহাড়ি ধ্বসে আক্রান্ত হয় মিরগাঁও, অনিতার বাড়িটি রক্ষা পেলেও তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারের ১১জন সদস্য প্রাণ হারান

"৪টে নাগাদ ছোটোখাটো একটা ধ্বস নামার পর আমরা সন্ধে ৭টার পর লোকজনকে গ্রাম থেকে বের করে আনার কাজ শুরু করে দিই, ভেবেছিলাম যে ফাঁড়া কেটে গেছে। কিন্তু রাত ১১টায় গোটা গ্রামটাই ধ্বংস হয়ে গেল, সে যে কী ভয়ানক পরিস্থিতি, তা বলে বোঝাতে পারব না," জানালেন গ্রামের পুলিশ পাতিল (কনস্টেবল) সুনীল শেলার।

২৮৫ জন (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী) বসবাস করতেন মিরগাঁওয়ে, তাঁদের মধ্যে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন এই পাহাড়ি ধ্বসে। প্রবল বর্ষণ, ছোটোখাটো ধ্বস, এসব তাঁদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল, তবে জুলাই ২২শের মতো ওরকম প্রলয় আগে কখনও ঘটেনি, হলফ করে বললেন তাঁরা। একাধিক সংবাদ মাধ্যমের খবর থেকে জানতে পারা যাচ্ছে যে সেদিন কোয়না অঞ্চলে ৭৪৬ এমএম বৃষ্টিপাত তো হয়েইছিল, উপরন্তু সারা সপ্তাহ জুড়ে বান ডেকেছিল মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে।

"২১শে জুলাই বিকেল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়, তবে আমরা বিশেষ পাত্তা-ফাত্তা দিইনি, কারণ বছরের এই সময়টায় জোর বৃষ্টিবাদলা লেগেই থাকে। কিন্তু তার পরদিন রাত ১১টা নাগাদ একটা বিকট শব্দে এক নিমেষে ঘুম ছুটে যায় আমাদের। কয়েক মিনিটের মধ্যে গোটা পাহাড়টা ভেঙে পড়ল গাঁয়ের উপর, সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। ভাগ্যিস যে কোনওমতে দৌড়ে কাছের ওই মন্দিরটায় পালাতে পেরেছিলাম আমরা," জেলা পরিষদ স্কুলে বসে বসে জানালেন ৪৫ বছরের জয়শ্রী সপকাল।

কোমল শেলার (২১) বলছিলেন, "গাঁয়ের কয়েকজন দৌড়ে এসে আমাদের জানায় যে পাহাড়টা নাকি হুড়মুড়িয়ে ধ্বসে পড়ছে। একটা মুহূর্তও আর নষ্ট না করে আমরা তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছেড়ে পালাই। একটাও আলো নেই, চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, এক কোমর জলকাদা ঠেলে কোনওমতে মন্দিরে গিয়ে উঠি। ওখানেই বাকি রাতটুকু কাটিয়েছিলাম সবাই।"

Neera and Lilabai Sapkal (inside) at the school. Uttam Shelar (right): 'There are cracks in the mountains in the Koyna area. We live under constant threat'
PHOTO • Ganesh Shelar
Neera and Lilabai Sapkal (inside) at the school. Uttam Shelar (right): 'There are cracks in the mountains in the Koyna area. We live under constant threat'
PHOTO • Ganesh Shelar

জেলা পরিষদ স্কুলে নীরা এবং লীলাবাই সপকাল (ভিতরে)। উত্তম শেলার (ডানদিকে): 'কোয়না অঞ্চলে অনেকগুলো ফাটল আছে পাহাড়ে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি আমরা'

শুধু যে বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে বা মানুষ মারা গেছে তা নয়, বৃষ্টি আর ধ্বসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খেত-খামারেরও। "ধ্বস নামার কয়েকদিন আগেই ধানের চারা লাগিয়েছিলাম, আশা ছিল এবছর বেশ ভালো ফসল হবে," বলছিলেন রবীন্দ্র সপকাল (৪৬)। তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারটি ১২খানা বাড়ি হারিয়েছে এই বিপর্যয়ের কারণে। "খেতিবাড়ি সব শেষ হয়ে গেল। চারিদিকে থিকথিক করছে কাদা। কী করব মাথায় ঢুকছে না, জমির ধানের উপরেই ভরসা করেছিলাম আমরা।"

এই যে জেলা পরিষদ স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া, মিরগাঁওয়ের প্রবীণ বাসিন্দারা এমনটা এর আগেও বার দুয়েক করেছেন। প্রথমবার, যখন কোয়না জলাধার বানানো হয় ষাটের দশকে। আদি গ্রামটি চিরতরে জলমগ্ন হয়ে যাওয়ায় গ্রামবাসীরা বাধ্য হয়েছিলেন উঁচু জমিতে উঠে যেতে। তারপর আসে ১১ই ডিসেম্বর ১৯৬৭ সালের কালান্তক ভূমিকম্প, বিধ্বস্ত হয়ে যায় কোয়না অঞ্চলটি। 'নতুন' মিরগাঁওয়ের পাশাপাশি কাছেপিঠের সবকটি গ্রামের মানুষজন বাধ্য হন ত্রাণশিবিরে মাথা গুঁজতে। একটা সময় পরে তাঁরা ফিরে যান বটে, তবে সেই 'নতুন' গ্রামটিও আর রইলো না এবছরের এই ধ্বসের পর।

উত্তম শেলার (৪২) বলছিলেন, "জলাধারটা বানানোর সময় হাজারটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার, বলেছিল যে চাকরি দেবে, শালি জমি দেবে। ৪০টা বছর পেরিয়ে গেছে আজ, কেউ একটা ফুটো কড়িও পাইনি। কোয়না অঞ্চলে খানিক ঘোরাঘুরি করলেই দেখতে পাবেন পাহাড়ে কীরকম সব মারাত্মক ফাটল ধরেছে। আসছে বর্ষায় সব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে বেঁচে আছি আমরা।"

Beside damaging houses and claiming lives, the rain and landslide destroyed Mirgaon's farmlands and crops too
PHOTO • Ganesh Shelar
Beside damaging houses and claiming lives, the rain and landslide destroyed Mirgaon's farmlands and crops too
PHOTO • Ganesh Shelar

শুধু যে বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে বা মানুষ মারা গেছে তা নয়, বৃষ্টি আর ধ্বসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খেত-খামা রের

মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে বন্যা তথা ধ্বসের কারণে যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের পরিবারগুলিকে ৫ লাখ করে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাজ্য সরকার, ২৩শে জুলাই প্রকাশিত হওয়া একটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে একথা জানা যাচ্ছে। অনিতা বাকাডের পরিবার এই টাকাটা পেয়েছে। তবে অনুরূপ প্রতিশ্রুতি কেন্দ্র সরকারও দিয়ে বলেছিল যে ২ লাখ করে টাকা দেবে। বাকাডে পরিবারের আজও এই টাকাটার আশায় বসে আছে।

কিন্তু ধ্বসের কারণে যাঁদের বাড়িঘর খেত-খামার সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে কারোরই তেমন মাথাব্যথা নেই।

"রাজস্ব বিভাগের বাবুরা আমাদের একটা ফর্ম [দোসরা আগস্ট, ক্ষতিপূরণের জন্য] ভরতে বলেছিল, কিন্তু টাকাপয়সা দেওয়ার কথা আজ অবধি কিছু বলেনি," কাদা আর জঞ্জালে ডুবে যাওয়া তাঁর চাষজমিটা দেখাতে দেখাতে বললেন গণেশ শেলার। নবি মুম্বইয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করতেন, কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে সেসব ছেড়েছুড়ে গ্রামে এসে পারিবারিক ধানচাষে হাত লাগান তিনি। "দশ একরের খেতটার কিসুই রইল না আর, চারাগাছ যা লাগিয়েছিলাম সব শেষ হয়ে গেল। মনে তো হচ্ছে না সরকারের থেকে এর জন্য একটা পয়সাও হাতে পাব," কান্নার তোড়ে কথা আটকে যাচ্ছিল তাঁর।

এদিকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে গেছে, মিরগাঁওয়ের হতভাগ্য মানুষজন আজও পড়ে রয়েছেন জেলা পরিষদ স্কুলে, সরকার তথা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে যেটুকু খাবারদাবার আর প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্র দিচ্ছে সেসবের দয়াতেই বেঁচে আছেন। স্থায়ী ভদ্রস্থ পুনর্বাসনের আশায় দিন গুনছেন তাঁরা। "আজন্মকালের জন্য শেষ হয়ে গেল গাঁ-টা আমাদের। এখন একটাই দাবি, নিরাপদ কোন জায়গায় আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে," জানালেন পুলিশ পাতিল সুনীল শেলার।

'The revenue department made us fill a form [for compensation] but nothing has been announced yet', says Ganesh Shelar, who is helping out at the school
PHOTO • Hrushikesh Patil
'The revenue department made us fill a form [for compensation] but nothing has been announced yet', says Ganesh Shelar, who is helping out at the school
PHOTO • Hrushikesh Patil

'রাজস্ব বিভাগ থেকে আমাদের একটা ফর্ম ভরতে বলেছিল, কিন্তু টাকাপয়সা দেওয়ার কথা আজ অব ধি কিছু বলেনি , বলছিলেন গণেশ শেলার, স্কুলের ত্রাণশিবিরের কাজে হাত লাগিয়েছেন তি নি

"বাড়িতে ফিরে যেতে চাইছে না কেউই। এমন অলক্ষুণে জায়গায় থাকতেই চাইনা আর, আমাদের একটাই দাবি, পাকাপাকি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক," দৃঢ় ভাবে জানালেন গণেশ শেলার।

ধ্বসের থেকে একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন অনিতার জ্ঞাতিভাই সঞ্জয় বাকাডে। তিনি বলছিলেন: "সরকার কথা দিয়েছিল যে স্বাধীনতা দিবসের [১৫ই আগস্ট] আগেই ওরা আমাদের জন্য অস্থায়ী ঘর বানিয়ে দেবে যাতে আপাতত কদিন মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই খুঁজে পাই, কিন্তু সে কথাটা কথাই রয়ে গেল। আর কদ্দিন এরকম ইস্কুলে পড়ে থাকব বলুন তো?" এই স্কুলটিতে না আছে মহিলাদের জন্য ঠিকঠাক কোনও শৌচালয়, না আছে পর্যাপ্ত পানীয় জল। "অন্য জেলায় চলে যেতেও রাজি আছি আমরা, কিন্তু ঠিকঠাক স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।"

মিরগাঁওয়ের যে ১১টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল সেই ভয়াবহ ধ্বস, ১৪ই অগস্ট বিকেল ৪টে নাগাদ এক এক করে তাঁদের প্রত্যেকের নাম স্মরণ করে খানিকক্ষণের জন্য নিরবতা পালন করেছিলেন স্কুলের ত্রাণশিবিরের মানুষজন। চোখ বন্ধ ছিল সব্বার, কেবল অনিতা বাদে, আসলে ভালোবাসার ১১জন মানুষকে একসঙ্গে এভাবে হারানোটা এখনও মেনে নিতে পারেনি তাঁর মন।

অনিতা এবং তাঁর স্বামী দুজনেই চাষি, ছেলেকে নিয়ে এখনও সেই স্কুলেই পড়ে আছেন তাঁরা। কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে হলঘরের একটা কোনায় বসেছিলেন তিনি, বলছিলেন, "পরিবার, বাড়িঘর, সবকিছু চলে গেল এক নিমেষে। গাঁয়ে যে ফিরে যাব সে উপায়ও নেই আর।" চোখের জলে একাকার হয়ে যাচ্ছিল তাঁর কথাগুলো।

কভার চিত্র: গণেশ শেলার

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Hrushikesh Patil

সাওয়ন্তওয়াড়ি ভিত্তিক স্বতন্ত্র সাংবাদিক হৃষিকেশ পাতিল আইনের ছাত্র। প্রান্তিক জনজাতির মানুষের জীবনে জলবায়ু বিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তিনি কাজ করছেন।

Other stories by Hrushikesh Patil
Translator : Joshua Bodhinetra

জশুয়া বোধিনেত্র পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার (পারি) ভারতীয় ভাষাবিভাগ পারিভাষার কন্টেন্ট ম্যানেজার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল উত্তীর্ণ জশুয়া একজন বহুভাষিক কবি তথা অনুবাদক, শিল্প সমালোচক এবং সমাজকর্মী।

Other stories by Joshua Bodhinetra