৬ই ডিসেম্বর বাবাসাহেব আম্বেদকরের মৃত্যুবার্ষিকীতে জাঁতা পেষাইয়ের গানের সংকলন পারি’র গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রজেক্ট নিবেদন করছে এই ওভিটি যেটি গাইতে গাইতে লাওয়ারদে গ্রামের লীলাবাই শিন্ডে আম্বেদকরের প্রতি তাঁর ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছেন

“আমরা আমার মায়ের বাড়িতে আছি, কারণ আমার বাড়িটা ভেঙেচুরে আবার নতুন করে বানানো হচ্ছে,” পুণে জেলার মুলশি তালুকের লাওয়ারদে গ্রামের লীলাবাই শিন্ডে এমনটাই জানালেন আমাদের। ২০১৭ সালের এপ্রিলে আমরা গিয়েছিলাম ওঁর কাছে। জাঁতা পেষাইয়ের গানের সংকলন গ্রাইন্ডমিল সংগস্ ডেটাবেসের আরেকজন গায়িকা জয় সাখালে থাকতেন ঠিক পাশের বাড়িটাতে, লীলাবাই তাঁরই একমাত্র মেয়ে। নিজের মায়ের ফ্রেমবদ্ধ একটি ফটো আমাদের দেখিয়ে উনি সেটা সযত্নে খবরের কাগজে মুড়ে তুলে রাখলেন একটা বড়সড় শস্য মজুত করে রাখার টিনের কৌটোয়। আমাদের অবাক অবস্থা দেখে উনি বোঝালেন: “বাড়ির কোনো দেওয়ালেই পেরেক গাঁথা নেই তো আসলে।”

Woman sitting in the doorway of a house
PHOTO • Samyukta Shastri

লীলাবাই আর তাঁর মা দুজনেরই বেশ কয়েকটি দোহা আছে গ্রাইন্ডমিল সংগস্ সংকলনে

যেসব গীতিকারদের কাজ আমাদের ডেটাবেসটিতে আছে তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে তাঁদের বেশিরভাগই বৈবাহিক কিংবা জন্মসূত্রে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। কেউ মা ও মেয়ে, কেউ বা বোন, কেউ বা ননদ বৌদি, অথবা জা, অন্যরা শাশুড়ি ও বৌমা। লীলাবাইয়ের মা মারা গেছেন ২০১২ সালে, তবে তাঁর একটি ওভি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি। ২০১৭ সালের মে মাসে সেটি পারিতে প্রকাশিত হয়েছিল চাষি এবং বর্ষণগীতি শিরোনামে।

জাঁতা পেষাইয়ের গানের সংকলনের কাজে নিযুক্ত আদি দলটি লীলাবাইয়ের সাতটি গান লিপিবদ্ধ করেছিল, কিন্তু অডিও রেকর্ডিং করাটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই এবার রেকর্ড করার জন্য আমরা তাঁকে গাইতে অনুরোধ করলাম। প্রথমটায় রাজি না হলেও শেষমেশ উনি রাখলেন আমাদের কথা। বাড়ির বাইরের ছাউনি দেওয়া একচিলতে উঠোন, সেখানে আছে একটা পাথরের জাঁতাকল, উনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে ওখানেই গিয়ে বসলেন। জাঁতাকলের বাঁশের হাতলটা ধরে এক এক করে ১১টি ওভি গাইলেন বাবাসাহেবের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যরূপে।

ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকরের জন্ম হয় ১৮৯১ সালের ১৪ই এপ্রিল, তৎকালীন সেন্ট্রাল প্রভিন্সের (আজকের মধ্য প্রদেশে) মহৌ নামক একটি ক্যান্টনমেন্ট শহরে। উনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ, আইনবিদ এবং ভারতের সংবিধানের রূপকার। আজীবন লড়াই করে ৬৫ বছর বয়েসে তিনি দিল্লিতে মারা যান।

বাবাসাহেব আমৃত্যু সংগ্রাম চালিয়েছিলেন অবহেলিত লাঞ্ছিত দলিত মানুষজনের স্বাধিকারের জন্য। তাঁর লেখা অ্যানাইলেশন অফ কাস্ট (১৯৩৬) প্রবন্ধটিকে সাধারণত তাঁর মহতী রচনা বলে ধরা হয়। দলিত নিপীড়িত নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য তাঁর যে সংগ্রামে এই প্রবন্ধটি ছিল অন্যতম হাতিয়ার। স্বাধীনতা, সাম্য ও স্বাধিকারের এই লড়াইয়ে নিজের অনুসারীদের তিনি ‘শিক্ষা, সংগ্রাম, সংঘবদ্ধতা!’ – এই ত্রিমুখী মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন।

শিক্ষা ও বৌদ্ধধর্মে দীক্ষার মাধ্যমে দলিত সমাজকে বহুকাঙ্খিত আশা ও ভরসা উপহার দিয়েছিলেন বাবাসাহেব। বর্ণবাদী হিন্দু সমাজ যাঁদের চিহ্নিত করে ‘অপবিত্র’ ও ‘অচ্ছুৎ’ বলে, তাঁদের কাছে এটাই ছিল একমাত্র রাস্তা এই অত্যাচার, অবদমন ও শোষণের অবসান ঘটানোর।

লীলাবাই শিন্ডের জাঁতা পেষাইয়ের গান

ভিডিওটি দেখুন: লীলাবাই শিন্ডে তাঁর পড়শিদের সঙ্গে গান গেয়ে বলছেন যে ভীমরাও আজ স্বর্গে ইন্দ্রসভার অধিপতি হয়েছেন

এই ওভিগুলিতে ডঃ আম্বেদকরকে সস্নেহে ভীম, ভীমবাবা, ভীমরায় কিংবা বাবাসাহেব বলে ডাকা হচ্ছে। বাবাসাহেবের কৃতিত্বে গর্বিত গীতিকার সসম্মানে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে চান

এই ওভিগুলিতে দলিত সমাজ, বিশেষত নারীরা, ডঃ আম্বেদকরের তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেন। তাঁরা অন্তরঙ্গতায় গেঁথে রাখেন তাঁদের এই শ্রদ্ধা - এখানে ডঃ আম্বেদকরের আদরের নাম ভীম, ভীমবাবা, ভীমরায়, কোথাও বা বাবাসাহেব। বাবাসাহেবের কৃতিত্বে গর্বিত গীতিকার সসম্মানে মাথা উঁচু করে সমাজে বেঁচে থাকতে চান সমতায়।

“ভীম আমার গুরুভাই (শিক্ষক এবং ভ্রাতা),” এমনটাই জানালেন লীলাবাই তাঁর গানে। ওঁর জন্য আম্বেদকর একজন পথপ্রদর্শক, একান্ত আপনজন, যেন তাঁর নিজের বড়োদাদা। (রক্ষণশীল সমাজের চোখরাঙানি এড়ানোর জন্য বিভিন্ন লিঙ্গ ও জাতির মানুষজন এই পন্থাটিকেই বেছে নেন। পুরুষ যেখানে গুরুভাই আর নারী তার গুরুবোন, অর্থাৎ তাঁদের সম্পর্ক শিক্ষক এবং ভগিনী।) লীলাবাইয়ের মনে হয় তিনি যেন আশীর্বাদ পেয়েছেন ভীমরায়ের, তাঁর পাথরের শিল যেন নিখাদ সোনা দিয়ে তৈরি। তিনি বলেন যে ভীমের নাম নিলে তাঁর মুখ ভরে ওঠে অপার্থিব মিষ্টতায়, মনুবাদী সমাজের (অচ্ছুৎ-নামক) নারকীয় কলঙ্ক মুছে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন “সুপবিত্র”।

চতুর্থ দোহায় লীলাবাই বুদ্ধের মন্দিরে সোনার দুয়ারের কথা বলেন, এও জানান যে তাঁর সন্তান বুদ্ধের উপাসনায় মগ্ন। আমরা এটাও জানতে পারি যে তাঁর মা তড়িঘড়ি করে শাড়ি পরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাবাসাহেবের কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হতে।

Woman sitting on the floor of a house with a grindmill
PHOTO • Samyukta Shastri

জাঁতাকল নিয়ে বসে আছেন লীলাবাই তাঁর বাড়ির ঠিক সামনেই

পঞ্চম দোহায় গীতিকার জিজ্ঞেস করেন যে, “অছুৎ! অছুৎ কে গো ডাকে বেমালুম?” উনি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে ভেদাভেদ মুছে ফেলতে ভীম সকল ব্রাহ্মণকে তাঁর কুটুম্ব বানিয়ে ফেলেছিলেন। (ডঃ আম্বেদকরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সবিতা ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ, এই অনুষঙ্গ সেদিকেই ইঙ্গিত করে)।

পারিজাত দিয়ে ভীমের পাগড়ি বেঁধে দিতে চান লীলাবাই, তাই ষষ্ঠ ওভিটিতে তিনি শুধান, “কী ফুল এনেছো ওগো মালিনী এবার?” এরপর সপ্তম দোহায় একটি দ্বৈত্বভাব ফুটে ওঠে। একাধারে বর্ণিত হয় তুরের ডালে (অড়হর ডাল, সম্মান ও সমৃদ্ধির প্রতীক, যার বদলে ছান্দিক ভাবানুবাদের নিরিখে এখানে “মুসুরের ডাল” ব্যবহৃত হয়েছে রূপক হিসেবে) আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছুটে আসা ট্রেন (অগ্রগতির চিহ্নবিশেষ), অন্যদিকে থাকে “লাশকাটি” মারাঠি মানুষ যারা জন্তুজানোয়ারের মৃতদেহ পরিষ্কার করে। উচ্চবর্ণের মানুষেরা দলিতদের বরাবর বাধ্য করে এসেছে পশুপ্রাণীর লাশ পরিষ্কার করতে - এই ভাবনাতীত অমানবিকতার জন্য তাদের প্রতি যুগ যুগ ধরে জমে উঠেছে দলিত সমাজের যে ক্ষোভ, সেটাই প্রকাশ পেয়েছে এই গানে। তাই ট্রেন ও তুরের ডাল যেমন দলিত সমাজের প্রগতি ও স্বাধিকারের প্রতীক, তেমনই “মারাঠি মানুষ” সেই সকল উচ্চবর্ণের রূপক যারা নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রতি জিইয়ে রেখেছে শুধুই অত্যাচার, অবমাননা এবং অপমান।

শেষ তিনটি স্তবক মূলত বিলাপ, তবে এখানেও ফুটে উঠেছে মুক্তির জয়গান। ডঃ আম্বেদকর মারা গেলেও তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাননি। হিন্দু পুরাণের ইন্দ্রসভা জয় করেছে নবযানী বৌদ্ধবাদ। ভীমবাবা আজ স্বর্গের অধিপতি, ইন্দ্র তাঁর প্রজামাত্র। দলিত সমাজের সোনা, তাঁদের কনকচূড়া, তাঁদের ভগবান হলেন স্বর্গগত বাবাসাহেব, লীলাবাই তাই ধানের অর্ঘ্য সঁপে দেন তাঁর প্রতি।

সর্বশেষ ওভিটিতে আমরা দেখতে পাই যে ভীমবাবার মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহে একটি গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং কেমনভাবে তাঁর পিছু পিছু মানুষের ঢল নেমেছিল। লক্ষ লক্ষ দলিত মানুষ ডঃ আম্বেদকরের পদানুসরণ করে হিন্দুধর্মের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে এসে বৌদ্ধধর্মে মুক্তি খুঁজে পান, এই স্তবক সেদিকেই ইঙ্গিত করে। বাবাসাহেবের পথে তাঁরা শিক্ষা ও স্বাভিমানের হাত ধরে তাঁরা অত্যাচার ও শোষণের থেকে নিজেদের মুক্ত করে বাঁচতে শেখেন।

ভীম! ভীম! বলি আমি, মোর গুরুভাই,
সোনার শিলেই দুটি ধান ভানি তাই।

ভীম! ভীম! বলি আমি, মিছরি সে ইষ্টি,
বাবাসাহেবের সনে খিদে হ'ল মিষ্টি।

ভীম! ভীম! বলি আমি, চিনিমাখা গন্ধে,
নিকনো এ দেহ মোর ভীমের আনন্দে।

বুদ্ধের মন্দিরে সোনার দুয়ার,
খোকা মোর তথাগতে হয় পারাপার।

আমার মায়ের গানে জুঁইরঙা শাড়ি
ভীম চরণ খোঁজে সাত'তাড়াতাড়ি।

"অছুৎ! অছুৎ" কে গো ডাকে বেমালুম?
বামুন সে হ'ল মোর ভীমের কুটুম।

কী ফুল এনেছো ওগো মালিনী এবার?
ভীমের মুকুটে মোর শিউলি আঙার।

ওই ছুটে আসে ট্রেন, আধপেটা হ্যারিকেন,
মহামারী গাঁয়ে তার মুসুরের হুঁশ -
এ দেশ ভীমের দান, তথাগত নবযান,
লাশকাটি মোরা তাই মারাঠি মানুষ।

ভীমবাবা মৃত আজ, তবু সে যে সাঁই,
ইন্দ্র তো প্রজা তার স্বর্গসভায়।

ভীমবাবা মৃত আজ, দু'আনি ধানের লাজ
আদরে আঁজল ভরে হয়েছি সমান -
দুলকি আকাশ জোড়া, বেঁধেছি কনকচূড়া,
তথাগত ছুঁয়ে দ্যাখো খিদের লবান।

ভীম, ভীম, নেই আর, শিলেবাটা হাহাকার,
গাড়িতে সাজানো তাঁর দেহখানি হায় -
ঘুরছে আদিম চাকা, ভীমেই ভারত রাখা,
পিছু পিছু হেঁটে চলি জাতক সবাই।

PHOTO • Samyukta Shastri

পরিবেশক/গায়িকা: লীলাবাই শিন্ডে

গ্রাম: লাওয়ারদে

তালুক: মুলশি

জেলা: পুণে

জাতি: নব-বৌদ্ধ

বয়স: ৬০

সন্তান: তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে

জীবিকা: ধানচাষি

এই গানটি ২০১৭ সালের ৩০শে এপ্রিল রেকর্ড করা হয়েছিল।

পোস্টার - সিঞ্চিতা মাজি


অনুবাদ - জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)


PARI GSP Team

পারি গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রজেক্ট টিম: আশা ওগালে (অনুবাদ); বার্নার্ড বেল (ডিজিটাইজেশন, ডেটাবেস নির্মাণ, রূপায়ণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ); জিতেন্দ্র মেইদ (প্রতিলিপি এবং অনুবাদ সহায়ক); নমিতা ওয়াইকার (প্রকল্প প্রধান এবং কিউরেশন); রজনী খলাদকর (ডেটা এন্ট্রি)

Other stories by PARI GSP Team

নমিতা ওয়াইকার লেখক, অনুবাদক এবং পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া, পারির নির্বাহী সম্পাদক। ২০১৮ সালে তাঁর ‘দ্য লং মার্চ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে।

Other stories by নমিতা ওয়াইকার
Translator : Joshua Bodhinetra

জশুয়া বোধিনেত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল করেছেন। বর্তমানে অনুবাদ সহায়ক হিসেবে জশুয়া পারি'র সঙ্গে কর্মরত। কবি, শিল্পলেখক, শিল্প সমালোচক তথা সমাজ কর্মী ইত্যাদি নানান ভূমিকায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

Other stories by Joshua Bodhinetra