“নর্দমাটা প্রায় ২০ হাত গভীর ছিল। প্রথমে পরেশ নামল। দু-তিন বালতি আবর্জনা টেনে টেনে বার করল, তারপর উঠে এসে খানিক জিরিয়ে নিয়ে ফের নামল নর্দমার ভিতর। দ্বিতীয়বার নামা মাত্র চিৎকার করে উঠল...
“পরিস্থিতিটা ঠিক বুঝতে পারিনি, তাই গালসিং ভাইও নামল। কিন্তু টুঁ শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম না। তখন অনিপ ভাইও নামল। ভিতরে তিন-তিনটে মানুষ, অথচ কোনও সাড়াশব্দ নেই। এবার তাই আমাকে দড়ি বেঁধে নামাল বাকিরা। কার যেন একটা হাত ধরেছিলাম, ছাড়তে মানা করল, কার হাত তা বলতে পারব না। কিন্তু হাতটা ধরতেই আমায় টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগল, আর ঠিক তক্ষুনি আমি বেহুঁশ হয়ে গেলাম,” একটানা রুদ্ধশ্বাসে বলে গেলেন ভবেশ।
তাঁর সঙ্গে যখন দেখা করি, তখন এক সপ্তাহও হয়নি বড়দা পরেশ-সহ দুজন সহকর্মীকে চোখের সামনে হারিয়েছেন ভবেশ। দৃশ্যতই বিধ্বস্ত মানুষটি, দুর্ঘটনার কথা বলতে গিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন। বিষাদসিক্ত কণ্ঠে দলা পাকিয়েছিল অবসাদ।
গুজরাতের দাহোদ জেলার খারসানা গ্রামের ২০ বছরের ভবেশ কাটারার নসিবের জোর আছে বলতে হবে, নইলে সে যাত্রা রক্ষে পেতেন না। ভারুচ জেলার দাহেজ গাঁয়ে বিষাক্ত নর্দমা সাফাই করছিলেন ৫ জন আদিবাসী পুরুষ, তাঁদের মধ্যে ভবেশ সহ দুজন বাদে মারা যান বাকিরা। আরেকজন যিনি বেঁচে ফিরেছেন, তিনিও দাহোদ জেলার মানুষ। বালেন্দিয়া-পেতাপুরের এই বাসিন্দাটির নাম জিগনেশ পারমার, ১৮।
এই ঘটনায় নর্দমার গ্যাসে দম আটকে (অ্যাস্ফিক্সিয়েশন্) জান খুইয়েছেন জিগনেশের গাঁয়ের অনিপ পারমার ২০, দাহোদের দন্তগড়-চাকালিয়ার গালসিং মুনিয়া, ২৫ এবং ভবেশের দাদা পরেশ কাটারা ২৪ — স্বাভাবিকভাবে ভাইয়ের মতো তিনিও খারসানা-নিবাসী ছিলেন। [এখানে উল্লিখিত বয়স এঁদের আধার কার্ড থেকে নেওয়া, এবং এগুলি সঠিক ভাবার কোনও কারণ নেই। হামেশাই দেখা যায় যে নিচুতলার অফিসকর্মীরা অধৈর্য হয়ে আনতাবড়ি সংখ্যা বসিয়ে দিচ্ছেন খাতায়]।
কিন্তু, পাঁচজন আদিবাসী যুবক নিজ নিজ গাঁ থেকে ৩২৫-৩৩০ কিলোমিটার দূর দাহেজে নর্দমা সাফ করছিলেন কেন? দুজন শুনলাম অন্য একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে মাসমজুরির কাজ করতেন। আর বাকি তিনজন? পেট চালাতে হাজারটা কামকাজ করতেন — তা বাদে আর কিছুই জানেন না তাঁদের বাড়ির লোকজন। এঁরা প্রত্যেকেই ভিল আদিবাসী জনজাতির ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠীর সদস্য।
৪ঠা এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে নেমে এল বিপর্যয়। পাশের একটি চেম্বারে কাজ করছিলেন জিগনেশ, তাঁর মনে পড়ে, “একজন ভিতরেই আটকে ছিল। বিষাক্ত গ্যাস শুঁকে অবশ হয়ে গেছিল। তখন ওকে বাঁচাতে আরেকজন [গালসিং] নর্দমায় নামল, কিন্তু ওকেও বিষাক্ত গ্যাসে কেড়ে নিল। ভিতরে লুটিয়ে পড়ল। ওদের দুজনকেই বাঁচাতে অনিপ ঢুকল ভিতরে, কিন্তু গ্যাসটা বড্ড কড়া ছিল। ওরও মাথা ঘুরতে লাগল, মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।”
“ওর জান বাঁচাতে চিৎকার জুড়েছিলাম,” জানালেন জিগনেশ, “তখনই গাঁয়ের লোকজন এসে পৌঁছয়। পুলিশ আর দমকলকে ডাক পাঠানো হয়। কিন্তু ভবেশকে যখন ভিতরে নামানো হল, সে বেচারাও গ্যাস খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ওদের টেনে টেনে বার করে আনার পর ভবেশকে প্রথমে পুলিশ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর হুঁশ ফিরতে পুলিশরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।”
কিন্তু তৎক্ষণাৎ তাঁকে হাসপাতালে কেন নিয়ে যাওয়া হয়নি? কেন এরকম জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করা হয়েছিল? ভবেশ ও জিগনেশ দুজনেই নিরুত্তর ছিলেন। ভবেশ জানে বেঁচে গেছিলেন সে যাত্রা।
*****
বিয়ের আগে থেকেই দাহেজে কাজ করতেন অনিপ। ২০১৯ সালে বিয়ে সম্পন্ন হতে না হতেই স্বামীর সঙ্গে কাজে লেগে পড়েন সদ্য বিবাহিতা রমিলা বেন। তাঁর কথায়, “সক্কাল সক্কাল [কাজে] চলে যেতাম, আটটা বাজতে না বাজতেই। উনি খেয়েদেয়ে ১১টা নাগাদ যেতেন, একাই। তালাতি সাহেব বা সরপঞ্চের (গ্রামপ্রধান) কথামতন কাজ করতেন।” অনিপ মারা যাওয়ার সময় তিনি যে কেন তাঁর সঙ্গে ছিলেন না, সেটাই বুঝিয়ে বললেন রমিলা বেন।
“আগে আগে আমরা একসঙ্গে গাটার পরিষ্কার করতাম,” বলছিলেন তিনি, “শাদির প্রথম চারটে মাস ওই কাজই করেছি। তারপর ওরা আমাকে ‘ট্রাক্টরের কাজ’ করতে বলল। ট্রাক্টরে চেপে গোটা গাঁ ঘুরতাম, লোকজন এসে এসে ট্রলিতে আবর্জনা ফেলে যেত। তারপর সেগুলো আমি বাছাই করতাম। দাহেজে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব নর্দমা সাফ করেছি। ইয়াব্বড়-বড় চেম্বারওয়ালা ওই যে বেসরকারি গাটারগুলো আছে না? বালতিতে একগাছি দড়ি বেঁধে নোংরা-টোংরা সব বার করতাম।”
“দিন গেলে কাজের জন্য ওরা ৪০০ টাকা করে দিত। আমিও কাজে গেলে ৪০০ টাকা করে পেতাম। মার চারেক পর মাসমজুরির ভিত্তিতে টাকা দিতে লাগল। প্রথমে ন’হাজার, তারপর বারো, শেষে পনেরো হাজার টাকা,” বলছিলেন রমিলা। অনিপ ও গালসিং এভাবেই কয়েক বছর ধরে মাসিক মজুরির ভিত্তিতে দাহেজ গ্রাম পঞ্চায়েতে গতর খাটাতেন। পঞ্চায়েত থেকে ওঁদের থাকার জন্য একখানা কামরাও দিয়েছিল।
কিন্তু এ কাজে বহাল করার আগে কোনও লিখিত চুক্তি আদৌ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের?
ওঁদের আত্মীয়স্বজনরা নিশ্চিত নন এ বিষয়ে। জন প্রশাসন সংস্থাগুলি কোনও বেসরকারি ঠিকেদারের দ্বারা এই মৃত মজুরদের নিযুক্ত করেছিল কিনা, এটা তাঁরা জানেন না। পঞ্চায়েতের সঙ্গে সাময়িক বা পাকাপাকি কোনও চুক্তি হয়েছিল কিনা সেটাও বলতে পারলেন না কেউ।
অনিপের বাবা ঝালু ভাই জানালেন, “সরকারি শিলমোহর দেওয়া কাগজে কিছু একটা আলবাৎ ছিল, কিন্তু সেটা বোধহয় অনিপের পকেটেই থেকে গেছে।” দুর্ঘটনায় জান যায়নি ভবেশ ও জিগনেশের, অথচ তাঁরাই এই কাজে অপেক্ষাকৃত নতুন বহাল হয়েছিলেন। উপরোক্ত সওয়ালটির জবাব দিলেন ভবেশ: “সই-সাবুদ বা চিঠিপত্তর কিসুই ছিল না। ডাক আসত, আর সেইমতন আমরা যেতাম।”
ভবেশ ওখানে মজুরি শুরু করার দশদিন পরেই এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। সেদিন কাজের ডাক পেয়েছিলেন জিগনেশ ও পরেশ, এটাই ছিল তাঁদের প্রথম দিন। তাঁরা যে ঠিক কোন ধরনের কাজ করতে যাচ্ছেন, বাড়ির লোক তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পরেশের মা স্বপ্না বেন, ৫১। “পঞ্চায়েতে কিছু একটা কাজ আছে, ওকে ডাকছে ওখানে [দাহেজে] — এটা বলে পরেশ সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। ওর বড়দা ভবেশ তো দশদিন আগেই চলে গেছিল সেখানে। গালসিং ভাই ডেকে পাঠিয়েছিল। দিন গেলে ৫০০ টাকা করে দেবে — ভবেশ আর পরেশ দুজনেই একথা বলেছিল। কিন্তু নর্দমা সাফ করার কথা কেউই জানায়নি আমাকে। কদিন ধরে কামকাজ চলবে, সেটা আমরা কেমন করে জানব? ছেলেদুটো ওখানে কোন কাজ করতে গেছে, সেটাই বা আমরা জানব কোত্থেকে?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
গালসিং মুনিয়ার বাড়িতেও একই চিত্র। স্বামী যে ঠিক কোন কাজ করতেন, সে বিষয়ে একেবারেই অবগত নন কনিতা বেন। তাঁর কথায়, “আমি তো চৌকাঠের বাইরে পা-ই রাখি না তেমন। ‘আমি পঞ্চায়েতের কাজে যাচ্ছি,’ বলেই উনি বেরিয়ে যেতেন। কাজটা যে ঠিক কী, সেটা কোনওদিন বলেননি। এই কাজে বহাল রয়েছেন, সে আজ সাত বছর তো হবেই। একটিবারের জন্যও আমার সঙ্গে কাজ নিয়ে কথা বলতেন না, ঘরে ফেরার পরেও না।”
পাঁচটি পরিবারের কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতেন না যে তাঁদের ছেলে, স্বামী, ভাই কিংবা ভাইপো-বোনপোরা কোন করছেন। পঞ্চায়েতের হয়ে কিছু একটা কাজ করেন, শুধু এটুকুই জানতেন তাঁরা। তাঁর সন্তান যে ঠিক কী করত, সেটা অনিপকে খুইয়ে তবেই জানতে পেরেছিলেন ঝালু ভাই। তাঁর ধারণা, চাট্টি ভাতের তাগিদেই এ হেন কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন অনিপ, পরেশ, জিগনেশরা। “পানসায়াৎনু কোম এৎলে ভুন্ড উঠাভাভনু কেহ্ তো ভুড উঠাভাভু পাদই (পঞ্চায়েতের কামকাজ মানে ওনারা বললে আমাদের শুয়োরের লাশ অবধি কাঁধে তুলতে হয়),” জানালেন ঝালু ভাই, “ওরা নর্দমা সাফ করতে বললে সেটাও আমরা করতে বাধ্য। নইলে তাড়িয়ে দেবে। বলবে যে বাড়ি ফিরে যাও...”
যাঁরা যাঁরা প্রাণ হারালেন, আর যাঁরা সদ্য কাজে ঢুকেছিলেন, তাঁরা আদৌ কাজের ধরনটা জানতেন? ভবেশ ও জিগনেশ বললেন, হ্যাঁ, তাঁরা জানতেন বৈকি। ভবেশের বক্তব্য, “গালসিং ভাই বলেছিল, ওরা ৫০০ টাকা দিনমজুরি দেবে। এটাও বলেছিল যে খানিক নর্দমা পরিষ্কার করার কাজও থাকবে।” এই কথায় সায় দিলেন জিগনেশও, সঙ্গে এটাও বললেন, “অনিপ ডাক পাঠিয়েছিল। আমি গেলাম, তখন ওরা আমাকে সকাল থেকেই সরাসরি কাজে লেগে পড়তে বলল।”
এঁদের মধ্যে একমাত্র জিগনেশই মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। বহিরাগত শিক্ষার্থী হিসেবে গুজরাতি নিয়ে পড়াশোনা করছেন তিনি, স্নাতক স্তরে প্রথম বর্ষ চলছে তাঁর। তবে বাস্তবটা এমনই যে নর্দমা না ঘাঁটলে দারিদ্রের জাল ছিঁড়ে বেরোনোর খোয়াব দেখাটাও যেন বাহুল্য। পেটের ভাত, বাড়ির বাচ্চাদের লেখাপড়া — সবই নির্ভর করছে তাঁদের দিনমজুরির উপর।
*****
সাফাই কর্মচারী জাতীয় কমিশনের ২০২২-২৩ বার্ষিক রিপোর্ট অনুসারে ১৯৯৩ থেকে ২০২২ সালের ভিতর বিপজ্জনকভাবে নর্দমা সাফ করতে গিয়ে ১৫৩ জন মারা গেছেন গুজরাতে। উক্ত সময়সীমার মধ্যে গুজরাত রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে, আর ২২০টি মৃত্যুর জোরে প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে তামিলনাড়ু।
কিন্তু, সত্যিই কত জন মারা গেছেন আর কতজনই বা সেপটিক ট্যাঙ্কি ও নর্দমা পরিষ্কার করছেন — এ বিষয়ে বিশুদ্ধ তথ্য আজও অমিল। তবে হ্যাঁ, গুজরাতের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক থেকে রাজ্যের বিধানসভা জানতে পেরেছে যে ২০২১ ও ২০২৩ সালের মাঝে ১১ জন সাফাইকর্মীর মৃত্যু ঘটেছে — জানুয়ারি ২০২১ থেকে জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত ৭ জন ও জানুয়ারি ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত ৪ জন।
খবর আছে, গত দুইমাসে এ রাজ্যে ৮ জন সাফাইকর্মী জান দিয়েছেন — এটা যোগ করলে মোট সংখ্যাটা আরও বাড়বে বৈকি। এঁদের মধ্যে আছেন মার্চে প্রাণ হারানো রাজকোটের দুজন, এপ্রিল মাসে দাহেজে তিনজন (এই প্রতিবেদনটি যাঁদের ঘিরে) এবং ওই একই মাসে ঢোলকায় দুইজন ও থারাডে একজন।
নিরাপত্তা সাজ-সরঞ্জামের কোনও বালাই আদৌ ছিল?
উত্তরটা পাওয়া যায় ভারুচ পুলিশ থানায় অনিপের ২১ বছর বয়সি বিধবা স্ত্রী রমিলা বেনের দাখিল করা এফআইআর থেকে: “সরপঞ্চ (গ্রামপ্রধান) জয়দীপসিং ভাই গোহিল ও উপসরপঞ্চ (উপপ্রধান) মহেশ ভাই গোহিল বিলক্ষণ জানতেন যে আমার স্বামী ও তাঁর সাথীরা যদি... নিরাপত্তার কোনও সাজ-সরঞ্জামের ছাড়াই দুর্গন্ধযুক্ত ২০ হাত গভীর নর্দমায় ঢোকেন, তাহলে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও তাঁদের নিরাপত্তার সাজ-সরঞ্জাম দেওয়া হয়নি।” [খাতায়-কলমে উপসরপঞ্চ একজন মহিলা। তবে রক্ষণশীল আর পাঁচটা সমাজের মতো এখানেও তাঁর নামে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরান তাঁর স্বামী]।
হাতে-করে মলমূত্র সাফাইকারী নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা ও তাঁদের পুনর্বাসন আইন, ২০১৩ সালের অধীনে যেদিন পূর্বের হাতে-করে মলমূত্র সাফাইকারী নিয়োগ ও খাটা-পায়খানা নির্মাণ (নিবারণ) আইন, ১৯৯৩ আরও সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠেছিল, সেদিন থেকেই মানুষকে দিয়ে নর্দমা ও সেপটিক ট্যাঙ্কি পরিষ্কার করানো আইনত অপরাধ। কিন্তু, এসব কেবলই কথার কথা। কারণ উপরোক্ত আইনে “বিপজ্জনক সাফাইকর্মে” নিযুক্ত মানুষ ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের উপর তাঁদের অধিকারের কথাও বলা আছে। নিয়োগকর্তা যদি সাফাইকর্মীর নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তথা অন্যান্য সাফাইযন্ত্র প্রদান না করেন, তাহলে আইন অনুযায়ী সেটা জামিন-অযোগ্য অপরাধ।
রমিলা বেনের এফআইআর পেতেই দাহেজ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ও উপপ্রধানের স্বামীকে গ্রেফতার করে পুলিশ, কিন্তু চটজলদি জামিনেরও বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত তাঁদের আর্জির যে কী গতি হল, সে বিষয়ে মৃতের পরিবারগুলি আজও অন্ধকারে।
*****
“অগল পাচল কোই নাত। আ পাঁচ সোকরা সে কোই নাত পাল পোস করনারা মারে,” বলতে বলতে আবেগে জড়িয়ে গেল গালসিংয়ের স্ত্রী কনিতা বেনের কণ্ঠ। (“আমার আর কেউ রইল না। এই পাঁচটা বাচ্চা আছে শুধু। আমাদের পেটের ভাত, বাচ্চাদের লেখাপড়া, সব দায়িত্ব তো উনিই নিতেন। এসব সামলানোর আর যে কেউ নেই”)। স্বামী বিয়োগের পর পাঁচ কন্যাসন্তান নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সঙ্গে থাকেন তিনি। বড়ো মেয়ে কিনালের বয়স ৯, কনিষ্ঠতম সারার বয়স তো ১ বছরও হয়নি। গালসিংয়ের মা বাবুদি বেনের কথায়: “চারটে ছেলে হয়েছিল আমার। দুজন থাকে সুরাটে। কোনদিন দেখতেও আসে না আমাকে। বড়ো ছেলে নিজের সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। আমাদের ভাতের জোগান ও দেবে কেন? তাই ছোটো ছেলে গালসিংয়ের কাছেই থাকতাম। আজ ও আর নেই। আমাদের আর কে-ই বা রইল বলুন?”
২১ বছর বয়সে পোয়াতি অবস্থায় বিধবা হওয়া রমিলা বেনের জীবনও এখন গভীর আঁধারে। “কেমন করে বাঁচব এবার? আমাদের খাবারদাবারের ইন্তেজাম কে করবে? আত্মীয়স্বজন আছে ঠিকই, তবে ওদের ভরসায় কদ্দিন বাঁচি এভাবে?” পাঁচজন দেওর, এক ননদ ও অনিপের বাবা-মায়ের কথা বলছিলেন তিনি।
“পেটের এই বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় যাব এবার? আমাদের দেখভাল কে করবে? একলা মেয়ে আমি, গুজরাতের কোথায় যাব বলুন দেখি?” আদতে ইনি রাজস্থানের মানুষ হলেও সেখানে ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। “বাপ আমার এতটাই বুড়ো যে কিছুই করতে পারে না। খেতিবাড়িও করতে পারে না। জমিজমাও তো নেই তেমন, বাড়িতে অনেক লোক। চারটে ভাই আর ছয়টা বোন আছে আমার। কোন মুখে বাপ-মায়ের কাছে ফিরে যাই?” কথা বলতে বলতে নিজের পেটের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন রমিলা। ছয়মাসের গর্ভবতী তিনি।
“অনিপ আমার জন্য বই এনে দিত,” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল অনিপের ১০ বছর বয়সি বোন জাগৃতি।
খুব অল্পবয়সেই বাবাকে হারিয়েছিলেন ভবেশ ও পরেশ। পরিবার বলতে আরও তিন ভাই, দুজন বৌদি, মা ও ছোটো বোন। পরেশ-ভবেশের ১৬ বছর বয়সি বোন ভাবনার কথায়: “আমাকে নিয়ে পরেশের আমোদ-আহ্লাদের শেষ ছিল না। দাদা বলত, আমি ক্লাস ১২ পাশ করলে আমায় পড়তে যেতে দেবে। আমায় একটা ফোনও কিনে দেবে বলেছিল।” এই বছরই ১২ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় বসেছে মেয়েটি।
হ্যাঁ, রাজ্য সরকারের থেকে গালসিং, পরেশ ও অনিপের বাড়ির লোক ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এই পরিবারগুলি বেশ বড়ো, সদস্য সংখ্যা অনেক। মূলত যাঁদের রোজগারে হাঁড়ি চড়ত, সেই মানুষগুলোই আর নেই। গল্পটা কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ক্ষতিপুরণের চেকগুলো যে প্রয়াত মজুরদের বিধবা স্ত্রীর নামেই এসেছে, একথা বললে বোধহয় ভুল হবে না। অথচ এই মহিলারা টাকাটার বিষয়ে কিছুই জানেন না, শুধু পুরুষরাই জানেন।
যে আদিবাসীরা প্রকৃতির কোলেপিঠে মানুষ, তাঁদের কেন আজ এই জাতীয় কাজ করে খেতে হচ্ছে? তাঁদের কি নিজেদের এক ছটাক জমিও নেই? জীবনধারণের কোনও পন্থাই কি নেই তাঁদের নাগালে?
বিষয়টা খোলসা করে দিলেন অনিপের মোটা বাপা (জেঠু): “আমরা একচিলতে করে জমির মালিক। পারিবারিক জমি ১০ একর হতেই পারে, কিন্তু সদস্য সংখ্যাও তেমন ৩০০, সব্বার ভরসা ওই জমিটুকু। এভাবে চালানো যায়? মজুরির কাজ আপনাকে নিতেই হবে। জমির ফসল খেয়ে কোনওমতে পেট যদিও বা ভরে, বেচার জন্য কিছুই পড়ে থাকে না।”
কিন্তু এই জাতীয় কাজ করলে সমাজে কথা ওঠে না?
পরেশের মোটা বাপা, বাচুভাই কাটারা জানালেন, “কলঙ্ক বলতে কিছুই ছিল না বিশেষ, তবে এমন একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটার পর আমাদের সত্যিই মনে হচ্ছে যে এইরকম নোংরা কাজ করা উচিত নয়।”
“কিন্তু সেটা না করলে বাঁচবই বা কেমন করে...?”
মূল প্রতিবেদনটি গুজরাতি ভাষায় লেখা।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র