গ্রামীণ জনজীবনে জন্মধাত্রীর মাহাত্ম্য ও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়া তাঁদের জ্ঞানের ভাণ্ডার ঘিরে কয়েকটি ওভি গেয়ে শোনাচ্ছেন পুণের মুলশি তালুকের তারা উভে, তারই সাথে কথায় কথায় উঠে আসছে জাঁতাপেষাইয়ের গানের প্রকল্পের জন্মলগ্নের কাহিনি
"নারী শব্দটার অর্থ কী? সে কি মালপত্তর, নাকি খেলার পুতুল? সে যদি জীবন্তই হয়, তাহলে তো তার জীবনের কথা ভাবাটা খুবই জরুরি, তাই না? কিন্তু যুগযুগান্ত ধরেই তো নারীকে তার মনুষ্যত্ব দিয়ে মাপা হয় না। অনেকে তো মেয়েদের ' চুলি চি রাখ ' [উনুনের ছাইপাঁশ] বা ' কান্দ্যাচি পাট ' [ছাঁচি পেঁয়াজের সবজেটে কলি] বলে ডাকে। আমরা কি আদৌ মেয়েদের মানুষ বলে মনে করি?"
তারা উভের আঙারঘন চোখদুটি তাঁর প্রশ্নগুলোর মতোই চিন্তা করতে বাধ্য করবে আপনাকে। পুণে শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে কোলাভাডে গ্রাম, সেখানকার খাড়কওয়াড়ি জনপদে থাকেন তিনি। ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ আমরা দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। গরিব ডোঙ্গরি সংগঠনের সদস্য হওয়ায় তিনি মুলশির গ্রামে গ্রামে ঠিক কী ধরনের কাজ করেন সেকথা জেনেছিলাম। এই সংগঠনটির কামকাজ সবই পুণে জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারী গরিবগুর্বোদের ঘিরে। জাঁতাপেষাইয়ের গানের প্রকল্পের জন্মলগ্ন তথা শৈশবের কথাও বললেন, সেই যখন দলবেঁধে গান সংগ্রহ করতে বেরোতেন তিনি।
হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ, এই দুই সমাজ বিজ্ঞানীর হাত ধরেই ১৯৭৫ সালে শুরু হয় গরিব ডোঙ্গরি সংগঠনের (জিডিএস) পথচলা। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি কোলাভাডে তথা অন্যান্য গ্রাম থেকে তাঁদের সঙ্গে দেখা করে এই সংগঠনে যোগ দেন তারাবাই সহ আরও অনেকেই। সে যুগে মুলশিতে না ছিল জলের পাইপ, না ছিল বিদ্যুৎ বা পাকা রাস্তা। এ হেন সমস্যার সমাধান করতে তারাবাই এবং জিডিএসের অন্যান্য সদস্যরা একের পর এক প্রতিবাদ মিছিল বার করেন, ন্যূনতম সামাজিক পরিষেবার দাবি তুলেন ধরেন রাজনৈতিক নেতাদের দরবারে। এছাড়াও আরেকটি নাছোড়বান্দা সমস্যা তাড়া করে ফিরত তাঁদের। মদের নেশায় তলিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের পুরুষেরা, তাই মহিলারা ঠিক করেন যে এটা না শুধরে তাঁরা ছাড়বেন না। "ক্যান আর বড়সড়ো গামলায় মদ ভরে রাখত মরদরা। আমরা ওদের পথ আটকে সব গামলাগুলো ভেঙে দিলাম," বললেন তারাবাই, "ইস্কুল ছাড়িয়ে কয়েকটা শুঁড়িখানা ছিল। আমরা মোর্চা বার করে ওগুলোও গুঁড়িয়ে দিয়ে এলাম।"
হরিজন বস্তি নামক যে দলিত জনপদটি রয়েছে তাঁদের গ্রামে, জাতপাতের বৈষম্য তথা অস্পৃশ্যতার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরতেন সেখানকার মানুষেরা। মদের সমস্যা মিটিয়ে তাই জিডিএসের মহিলারা আদাজল খেয়ে লেগে পড়লেন বর্ণপ্রথার মোকাবিলায়। তারাবাই জানালেন কীভাবে তিনি লীলাবাই কাম্বলেকে তাঁর বাড়িতে রান্নাবান্নার কাজে বহাল করেছিলেন। লীলাবাই দলিত জাতির মানুষ, জিডিএসের সদস্য হওয়ার পাশাপাশি তিনি জাঁতাপেষাইয়ের গানও গেয়ে থাকেন। ওই সময় নতুন করে বাড়ি বানাচ্ছিলেন তারাবাই, ইমারতির কাজে কর্মরত মজুরদের প্রত্যেকেই ছিলেন মারাঠা জাতির লোক। তাঁরা সাফ জানিয়ে দেন যে একজন দলিত, অর্থাৎ লীলাবাইয়ের হাতের রান্না তাঁরা ছুঁয়েও দেখবেন না। কিন্তু নাছোড়বান্দা তারাবাই, শেষে একদিন হার মানতে বাধ্য হয় সেই মজুরদের দল। ছোঁয়াছুঁইয়ের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে তাঁরা হাতে তুলে নেন লীলাবাইয়ের রান্না। তবে এখানকার দলিত মানুষজন আজও বাকি গ্রামের থেকে আলাদা হয়ে সেই হরিজন বস্তিতেই থাকেন, সমতার জন্য তাঁদের লড়াই আজও জারি রয়েছে।
নারী হয়ে এ হেন যুদ্ধে নামা কিন্তু মুখের কথা নয়, এ সংগ্রামের প্রতিটা ধাপ পেরোতে গিয়ে হাজারটা পাহাড়-পর্বত টপকেছেন তাঁরা। আশির দশকে বাড়ির বাইরে অবধি বেরোতে দেওয়া হত না গ্রামের মহিলাদের, বিশেষ করে যেখানে সিংহভাগই মারাঠা জাতির মানুষ।
মুম্বইয়ের একটি কাপড়ের কারখানায় কাজ করতেন তারাবাইয়ের স্বামী সদাশিব। একদিন শ্রমিকেরা সবাই মিলে ধর্মঘটে নামেন, তালা ঝুলে যায় কারখানার দরজায়, অসহায় হয়ে ঘরে ফিরে আসতে বাধ্য হন সদাশিব। তখন তাঁর বড়দা ও বৌদি বলেন যে সদাশিব যেন তক্ষুনি বউয়ের হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। আসলে তারাবাই যে সমাজকর্মে লিপ্ত ছিলেন, এটা তাঁরা ঠিক মানতে পারতেন না। নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে, তাই ভিটেহারা উভে দম্পতি কয়েক বছর মজুরি করে পেট চালান। আজ তাঁরা এক একর খেতের মালিক। ধান, শামাধান, গম এসব চাষ করেন দুইজন মিলে। তাঁদের তিন ছেলে বিয়ে করে সংসার পেতেছেন পুণে শহরে।
তারা উভে ও লীলা কাম্বলে সহ কোলাভাডের একদল মহিলা এবং নন্দগাঁও থেকে কুসুম সোনাওয়ানে সহ আরও বেশ কয়েকজন মিলে পুণে শহরে পাড়ি দেন। লক্ষ্য ছিল একটাই, জিডিএসের ছত্রছায়ায় কীভাবে লোক জড়ো করে সংগঠন বাঁধবেন সে ব্যাপারে হাতেখড়ি নিতে হবে হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁর কাছে। "গ্রামে গ্রামে ঘুরে দৈনন্দিন সমস্যার কথা কইতাম, বোঝাতাম যে ওই একই ঘানিতে আমরাও পিষে মরছি, এসব শুনে ধীরে ধীরে তাঁদের না-বলা কথাগুলো বলতে শুরু করলেন মহিলারা," জানালেন লীলাবাই, এই মানুষটি নিজের গ্রাম ছাড়াও আরও ১৭টি গ্রামে লড়াই করেছেন। একটা জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন এঁরা, জাঁতাপেষাইয়ের গান শোনালে মহিলারা খুব সহজেই উজাড় করে দিতে পারেন চেপে রাখা কথাগুলো। "শোনানোর মতো দুঃখকষ্ট নেই, এমন কোনও মেয়ে আছে বলে তো মনে হয় না। শুধু একটুখানি দম নেওয়ার জায়গা আর স্বাধীনতা লাগে, তাহলেই অন্যের কাছে কথাগুলো কওয়া যায়। সেই অন্য মানুষটা আর কেউ নয় গো, আমাদের জাঁতাকল, সকাল হলেই যার পায়ে ঘাম ঝরাতে ছোটেন মহিলারা।"
*****
যে সে জাঁতা নয় এতো পাহাড়িয়া সাধু এক
খুকি রে তেনার কাছে দিল খুলে কয়ে দ্যাখ।
আশির দশকে মুলশিতে জন্ম নেয় জাঁতাপেষাইয়ের গানের প্রকল্প (গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রজেক্ট, বা জিএসপি), তারপর আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে, ১১,০০টিরও অধিক গ্রাম আজ এই প্রকল্পের ছত্রছায়ায় এসেছে। সেদিন থেকে আজ অবধি ১১০,০০০টিরও বেশি গান সংগ্রহ করেছি আমরা।
হরেক কিসিমের সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে, তাই ১৯৯৭ সালের মার্চে একদল জাঁতাপেষাইয়ের গায়ক একত্রিত হন পুণের শিরুর তালুকের পাবাল গ্রামে। সেই আলোচনার মধ্যমণি ছিলেন গ্রামীণ জন্মধাত্রী বা ধাইমারা। না আছে হাতের নাগালে হাসপাতাল, না আছে আপাতকালীন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য কোনও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ফলত প্রসবকালে হবু মায়ের আশা বা ভরসা রূপে ধাইমা ছাড়া আর কেউই থাকেন না।
সাধারণত অন্য আরেকজন ধাত্রীর কাজ দেখেই শিক্ষা নেন তাঁরা – নিজের মা, কিংবা কাকিমা বা দিদা। তারাবাই জানালেন যে পুঁথিপড়া কোনও ডাক্তার-বদ্যি মরে গেলেও ধাইমার জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার নাগাল পাবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গানগুলোও কেমন যেন ফিকে হয়ে গেছে তারাবাইয়ের স্মৃতি থেকে। তিনি যাতে সেই আবারও সেসব মনে করতে পারেন, তাই পারির জিএসপি দল তথা জিডিএসের সদস্য জিতেন্দ্র মেইদ এবং তারাবাইয়ের পড়শি মুক্তাবাই উভে দুইজনে মিলে গানের কথাগুলো পড়ে পড়ে শোনান তাঁকে। এখানে বলে রাখা ভালো যে মুক্তাবাই উভে নিজেও একজন সুদক্ষ জাঁতাপেষাইয়ের গায়িকা।
জাঁতাপেষাইয়ের গানের প্রকল্পের এই কিস্তিটিতে ১১টি অনুরূপ ওভি প্রকাশিত হয়েছে। হাসপাতাল পরিষেবার অভাবে জন্মধাত্রীরা কেমনভাবে বাচ্চা প্রসব করানোর আদব-কায়দা নিজেরাই শিখে নেন সে কথাই উঠে এসেছে এখানে। অথচ আমাদের এই আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের দরবারে তাঁদের হাড়ভাঙা খাটুনি এবং যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত জ্ঞান বিন্দুমাত্র সম্মানটুকুও পায় না।
এই দোহাগুলির মাধ্যমে এক ধাত্রীর দক্ষতার কথা তুলে ধরছেন গায়িকা। "কাদায় রে ভাই ফাঁসলে গরু," তাকে সযত্নে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে ধাইমার প্রজ্ঞাপূর্ণ হাতজোড়া। গাঁয়ের ত্রিসীমানায় কোনও হাসপাতাল নেই, ফলত প্রসবের মতন দুরূহ কাজ অবলীলাক্রমে করে উঠতে ধাইমার জুড়ি মেলা ভার, ঠিক "য্যামনে লাগামখানি বলদে বলদে টানি"। ওভির উপমায় গ্রামীণ জীবনের পাশাপাশি উঠে এসেছে সামাজিক ধারাভাষ্য। ডাক্তারদের মতো এককাঁড়ি পয়সা খসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ওস্তাদ হননি ধাত্রীরা, এ কাজ তাঁরা হাতেনাতে শিখেছেন প্রবীণতর ধাইমাদের দেখে দেখে, জীবনের অভিজ্ঞতাই তাঁদের করে তুলেছে পটু।
গ্রামীণ মহিলাদের ঈশ্বর তিনি, তলব পড়লে হাতের কাজকম্ম সবকিছু ফেলে ছুটে যান। দক্ষতা তাঁর "সোনার কাঠি", যার ছোঁয়ায় মায়ের গর্ভ হতে মুক্তি পেয়ে পৃথিবীর আলো দেখে নবজাতক। এমনই এক জন্মধাত্রীর কথা ফুটে উঠৈছে তারাবাইয়ের অন্তিম দোহায়।
যে সে জাঁতা
নয় এতো পাহাড়িয়া সাধু এক,
খুকি রে
তেনার কাছে দিল খুলে কয়ে দ্যাখ।
ধাইমা তাহার
জ্ঞানের আধার, আপনা
হাতের কাম,
কী ছাই
তোদের বদ্যি পাঁচন? চাসনে
দিতেই দাম।
কোথা থেকে
পাইলা, যেও
মোরে বইলা, ধাইমা
তোমার ওগো জ্ঞানের ভাঁড়ার...
ডিঙায়ে
উপত্যকা, কাজ
করে একা একা, আপসে
পেরিয়ে যায় পোয়াতি পাহাড়।
পাহাড় ঘেরা
গেরাম আমার, বদ্যি
খুঁজেই মরি,
ধাইমা মোদের
জ্ঞানের সাগর, ভরসা
তারেই করি।
হরেক রকম
তজুরবা তার, ধাইমা
আমার আই,
স্কুল
কলেজের মুখ সে বাপের জম্মে দেখেই নাই।
জন্মলগনে
জানি ছিঁড়ে যাবে মোর যোনি,
পয়লাবারের তরে হইব গো আই...
রেখে দে পাশুলি
মোর, বন্ধকে
বেঁধে ডোর, আকন্দ
তলে সখী দোহাই দোহাই।
এককাঁড়ি
টাকা ঢেলে জ্ঞানী হল বদ্যি,
ধাইমা নিজেই
শানে আপনার বুদ্ধি।
পাঁচপাঁচি
তুই যেমন তেমন, ধাইমারে
হায় বলিসনে মন, মানুষটা
সই বড্ড ভালো পোয়াতির ভগবান...
কাদায় রে
ভাই ফাঁসলে গরু, পাঁচটি
আঙুল সরু সরু, সেই
আঙুলের হ্যাঁচকা টানে বাঁচবে বাছুরখান।
হাজার হাজার
বছর জুড়ে, জ্ঞানের
ভাঁড়ার রাখল ধরে, ধাইমা
রে তোর বড়ই সোঁদর পেটকাটানির কাজ,
মাইয়াটা
মোর ন’মাস ধরে, পেটের ভিতর রাখল যারে, সেই ছানাটার
জন্ম দিলি এক নিমেষেই আজ।
পাহাড়ি
উপত্যকা, বেঁচে
আছি একা বোকা, ডাক্তার
বদ্যিরা আসেনা যে আর...
য্যামনে
লাগামখানি বলদে বলদে টানি,
তেমনই ধাইমা নাড়ে হাতদুটি তার।
হড়বড়িয়ে
ছুটছে ভগা, বল
দেখি সই কোথা?
সোনার কাঠি
ছুঁইয়ে ভোলায় নতুন মায়ের ব্যথা।
গায়িকা/পরিবেশক : মুক্তাবাই উভে
গ্রাম : কোলাভাডে
জনপদ : খাড়কওয়াড়ি
তালুক : মুলশি
জেলা : পুণে
জাতি : মারাঠা
বয়স : ৬৫
সন্তান : তিনটি মেয়ে ও একটি ছেলে
পেশা : চাষি
গায়িকা/পরিবেশক : লীলাবাই কাম্বলে
গ্রাম : কোলাভাডে
তালুক : মুলশি
জেলা : পুণে
জাতি : নববৌদ্ধ
বয়স : ৬২
সন্তান : তিনটি ছেলে
পেশা : ভাগচাষি
গায়িকা/পরিবেশক : তারাবাই উভে
গ্রাম : কোলাভাডে
জনপদ : খাড়কওয়াড়ি
তালুক : মুলশি
জেলা : পুণে
জাতি : মারাঠা
বয়স : ৬১
সন্তান : তিনটি ছেলে
পেশা : চাষি
তারিখ : এই ওভিগুলি ২০২২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রেকর্ড করা হয়েছে
পোস্টার: উর্জা
হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ ' র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন ।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)