“আরে! এখানে কী করছেন?” প্রশ্নকর্তার নজর কৌতূহলে ভরা, আর গলার স্বর বেশ কঠোর!
তৎক্ষণাৎ আমার বোধোদয় হল এটা ঠিক দাঁড়ানোর জায়গা নয়! নদীর পাড়ে তাঁর সঙ্গে মোলাকাতের এই জায়গাটায় লোকে বিশেষ পা রাখে বলে তো মনে হচ্ছে না।
লম্বা লম্বা ক্ষিপ্র পদক্ষেপে নিচের দিকে নদীতে নামতে নামতে হঠাৎ থেমে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন, তারপর সতর্কবাণী শোনালেন, “ওইখানে যে মড়া পোড়ায়! কালই তো একজন মারা গেল। ওখানে দাঁড়াতে নেই। এইদিকে চলে আসুন!”
ঠিক কথা বটে, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে মৃতেরা অবশেষে যে নিরালা শান্তি অর্জন করেছেন, তাতে বাগড়া দেওয়া কেন মিছিমিছি।
দুই মিটার উঁচু নদীর পাড় থেকে নিচের দিকে নামতে গিয়ে দেখলাম মানুষটা পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার কংসাবতীর হাঁটুজলে কেমন তরতরিয়ে এগোচ্ছেন। তাঁর গতির সঙ্গে তাল মেলানো আমার কম্ম নয়, তবুও তাঁর সমান্তরালে পাড় ধরে এগোতে থাকলাম।
চলাফেরায় এই সাবলীল ক্ষিপ্রতা দেখে তাঁর বয়স আন্দাজ করতে বেগ পাবেন, কায়িক দক্ষতায় তিনি এতটাই লাজবাব। ৫০-এর কোঠার শেষে পৌঁছানো মানুষটাকে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না, “ও কাকা, নদীতে কী করছেন?”
অনিরুদ্ধ কাকা কোমরে বাঁধা সাদা কাপড়ের কোঁচড়টা আলগা করে একতাল চিংড়ির মধ্যে থেকে আলতো করে একটা তুলে ধরে শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে বলে উঠলেন, “এই চিংড়ি দেখছেন? আজ দুপুরে এই দিয়েই খাওয়া হবে। শুকনো লংকা আর রসুন দিয়ে খুব করে ভেজে গরম ভাতের সঙ্গে খেতে দারুণ লাগে।” আহা, সত্যিই লোভনীয়।
কিন্তু এ কেমন ব্যাপার? মাছ ধরছেন, তার উপর আবার চিংড়ি, অথচ মাছ ধরার জালের কোনও নামগন্ধই নেই। “আমি কস্মিনকালেও জাল ব্যবহার করিনি। এই দুইহাতেই মাছ ধরি। ওরা কোথায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে, আমি সেসব খুব ভালো জানি।” নদীর দিকে ইশারা করে বললেন, “জলের তলায় পাথরের এই খাঁজগুলো দেখছেন? আর এই শ্যাওলা আর আগাছা? এইগুলোর মধ্যেই চিংড়ি থাকে।”
নদীর জলে ভালো করে চেয়ে দেখলাম সত্যিই তো, আগাছা আর শ্যাওলার মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে আছে চিংড়ি! ঠিক যেমনটা অনিরুদ্ধ কাকা বললেন!
দুপুরের খাবারের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে কাকা এবার বলছিলেন চিংড়ির সঙ্গে যে ভাতটা খাওয়া হবে তার চাল কোথা থেকে আসে। “এক ফালি জমি আছে আমার, ধান হয় তাতে। গতর ঢেলে বেজায় খাটলে সারাবছরের খোরাকিটুকুর মতো ভাতের জোগাড় করতে পারি বৌ-বাচ্চার জন্য।”
পুরুলিয়ার পুঞ্চা ব্লকের কৈরা গ্রামের এই বাসিন্দার পরিবারটি ভূমিজ সমাজভুক্ত, এটি পশ্চিমবঙ্গে তফসিলি জনজাতি বলে চিহ্নিত। গ্রামের মোট জনসংখ্যা ২,২৪৯-এর (আদমসুমারি ২০১১) অর্ধেকের বেশিই আদিবাসী সমাজের মানুষ। খাদ্যের প্রয়োজনে বহুলাংশেই তাঁরা নদীর উপর নির্ভরশীল।
অনিরুদ্ধ কাকা বেচার জন্য মাছ ধরেন না – এই মাছ তাঁর পরিবারের খোরাকি। তিনি বলেছিলেন মাছ ধরা তাঁর পেশা নয় মোটেই, এ হল তাঁর নেশা, ভালোবাসার কাজ। বলতে বলতে গলা ভারি হয়ে এসেছিল তাঁর। “কিন্তু এই সব মায়া কাটিয়ে দূর অচিন দেশে চলে যেতে হয় পেটের দায়ে।” কাজের সন্ধানে ছুটেছেন তিনি উত্তরপ্রদেশ আর মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে। দৈনিক মজুরির বিনিময়ে এইসব রাজ্যে মুলত নির্মাণক্ষেত্রে কাজ করেন তিনি, অবস্থার ফেরে অবশ্য অন্যান্য কাজও করতে হয়।
২০২০ সালের কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়ে তিনি নাগপুরে আটকে পড়েছিলেন। মনে করে বললেন, “ঠিকাদারের সঙ্গে ওখানে বিল্ডিংয়ের কাজে গেছিলাম। খুব কষ্টে কেটেছে সেই সময়টা। একবছর হল ফিরে এসেছি। আর যাব না বলে পণ করেছি। বয়সও তো হচ্ছে আমার।”
পুরুলিয়া থেকে কাজের সন্ধানে মানুষ পশ্চিমবঙ্গের নানান জেলা তথা রাজ্যের বাইরে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কেরালা মতো দূরদূরান্তের দেশে পাড়ি জমান। এসব কথা জানা গেল কৈরার বাসিন্দা, অমল মাহাতোর কাছ থেকে। ৪০-এর কোঠায় পা রাখা অমলবাবু বর্তমানে শিক্ষকতা করলেও একসময়ে স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে কর্মরত ছিলেন। তিনি আরও জানালেন, চাষের কাজে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে দেনা করেন অঞ্চলের মানুষজন, তারপর সেই দেনা শোধ করতে দেশান্তর যাত্রা করতে হয়। তাঁদের অবর্তমানে মহিলারাই চাষবাসের কাজকর্ম দেখেন, মাঠে কাজ করেন, পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেন। “এখানকার আদিবাসী সমাজের প্রান্তিক তথা ক্ষুদ্র চাষি পরিবারের জন্য এ এক দুষ্ট চক্র। মহাজনের কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হন এঁরা,” বুঝিয়ে বললেন অমলবাবু।
চাষের কাজে প্রয়োজনীয় সার এবং বীজের মতো উপকরণ কিনতে গিয়ে অনিরুদ্ধ কাকা টাকা ধার করেন, আর তা পরিশোধ করার জন্য দিনমজুরির কাজ নিয়ে দূর দেশে পাড়ি জমান। নাগপুরে ইমারতির কাজে সিমেন্ট বালি মেশানো, ওজন বওয়া ইত্যাদি করে দিনে ৩০০ টাকা হত। তবে কৈরায় কাজ করে তেমন আয় করা মুশকিল। তাঁর কথায়, “কাজ না থাকলে খালি বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।” চাষের মরসুমে বীজ বোনা আর ফসল কাটার সময় খানিক কাজ পান বটে, তবে মজুরি ২০০ টাকার বেশি মেলে না। “মাঝেমধ্যে যখন নদীর ‘রয়্যালটি’ নেওয়া পার্টি লরি নিয়ে আসে, তখন নদী থেকে বালি তুলে লরিতে বোঝাই করার জন্য ৩০০ টাকা [দৈনিক] পাই।”
‘রয়্যালটি’ বলতে আসলে তিনি বোঝাতে চাইছিলেন কংসাবতী নদী থেকে বালি তোলার ইজারা নেওয়া পার্টিদের কথা। সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে, পরিবেশ তথা নদীর বাস্তুতন্ত্রের উপর আঘাত এনে প্রায়শই নদীবক্ষ থেকে যথেচ্ছ বালি তোলার কারবার চলে এখানে। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানা গেল প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মদদে নদী থেকে রমরমিয়ে বালি পাচারের এই কারবার চলে। দুঃখের ব্যাপার এটাই যে এই কাজ থেকেই খানিক দিনমজুরির কাজ জুটে যায় অনিরুদ্ধ কাকাদের মতো মানুষদের – কাজের বেআইনি চরিত্র নিয়ে তিনি ওয়াকিবহাল বলে মনে হল না।
অবশ্য, এই “রয়্যালটি বিজনেস” থেকে প্রকৃতির যে কতটা ক্ষতি হচ্ছে, তা তিনি হাড়ে হাড়ে জানেন। তাঁর কথায়, “বিশাল ক্ষতি নদীর। এইভাবে বালি তুলে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ এই বালি তৈরি হতে কত বছর লেগে যায়।”
বান, শোল, মাগুর ইত্যাদি মাছের নাম করে অনিরুদ্ধ কাকা বলে চললেন, “এখানে আগে কতরকম মাছ ছিল। জেলেরা জাল দিয়ে সেসব মাছ ধরত। এখন আর ওরা এখানে আসে না। নদী ধরে আগে পিছে অন্যান্য জায়গায় সরে গেছে জেলের দল।” পিকনিক পার্টিদের উপর তিনি বেজায় খাপ্পা, ওরা এখানে এসে নদীর পাড়গুলোতে প্লাস্টিক, খালি বোতল আর থার্মাকল প্লেট ফেলে দূষণ ছড়ায়।
আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই তরতরিয়ে জল বেয়ে নদীতে চিংড়ির সন্ধান চলছিল। সেইসঙ্গে চলছিল অনিরুদ্ধ কাকার স্মৃতিচারণা, “আমাদের ছোটোবেলায় জলে কত চিংড়ি ছিল। কেমন করে চিংড়ি খুঁজে বের করতে হয় আর কেমন করেই বা খালিহাতে সেগুলি ধরতে হয়, সে বিদ্যে আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছিল। বাবা আমার বিরাট মাছোয়াল ছিল।”
জল থেকে এক এক করে চিংড়ি তুলতে তুলতে তিনি বলছিলেন, “চিংড়ি পরিষ্কার করা বড্ড হ্যাপা বটে, তবে খেতে দারুণ লাগে।” এখন আর আগের মতো নদী বা চিংড়ি কোনওটাই নেই বলে দুঃখ করছিলেন। “ওই যে ওখানে ধান আর সরষে খেত দেখতে পাচ্ছেন নদীর পাড়ে? ফসলে সার আর পোকা মারার ওষুধ ছিটিয়ে ওরা জেরিক্যানগুলোকে এই নদীর জলেই পরিষ্কার করে। ওই বিষাক্ত জলে মাছ মরে যায়। নদীতে এখন চিংড়ির আকাল…”
কৈরা থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পিঁড়রা গ্রামের বাসিন্দা শুভঙ্কর মাহাতো নদীতে চান করতে এসেছিলেন। তাঁর কথাতেও অনিরুদ্ধ কাকার বক্তব্যের সমর্থন মিলল। “এইসব নদী একসময় এখানকার আদিবাসী সমাজভুক্ত ভূমিহীন, ক্ষুদ্র তথা প্রান্তিক চাষিদের জীবিকা আর খাদ্যের উৎস ছিল, গাঁটের কড়ি খসিয়ে দোকান থেকে দুর্মূল্য খাদ্য কেনা তাদের পক্ষের মোটেই সম্ভব ছিল না – নদীই প্রোটিনসহ অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান জোগাত।” কথা প্রসঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিলেন পুরুলিয়া রাজ্যের দরিদ্রতম জেলাগুলির একটি।
২০২০ সালের একটি সমীক্ষা বলছে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পুরুলিয়া জেলাতেই দারিদ্রের হার সর্বোচ্চ – এখানে বসবাসকারী মোট পরিবারের ২৬ শতাংশের অবস্থান দারিদ্র সীমার নিচে (বিপিএল)। পেশায় শিক্ষক শুভঙ্কর বললেন, “চিরাচরিতভাবেই এখানকার মানুষ খাদ্যের জন্য নদী আর জঙ্গলের উপর নির্ভর করে এসেছে। এখন প্রাকৃতিক সম্পদ তলানিতে এসে ঠেকেছে।”
অনিরুদ্ধ সিং পাতর নিবিষ্ট চিত্তে চিংড়ি শিকার করছিলেন। এত কষ্ট সয়ে এই দাঁড়া বিশিষ্ট প্রাণীটি যাদের জন্য সংগ্রহ করছেন, আমি সেই পরিবারের কথা তাঁর কাছে জানতে চাইলাম। জবাব দিলেন, “বৌ আমার ঘরের কাজকম্ম দেখে, আর খেতেও কাজ করে। ছেলেটা আমাদের জমিতে খাটে।” সন্তানদের প্রসঙ্গ উঠতেই কাকার মুখ ঝলমলিয়ে উঠল। “আমার তিন মেয়ের সব্বার বিয়ে হয়ে গেছে [অর্থাৎ অন্যত্র থাকেন তাঁরা]। একটিই ছা এখন আমার। ওকে আমি মোটেই কাছছাড়া করব না, আর আমিও কোনও দূর দেশে যাব না।”
তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসার সময় আমি কল্পনা করছিলাম অনিরুদ্ধ কাকা পরিবারের সঙ্গে নিজের দাওয়ায় বসে নিশ্চিন্তে এই শ্রমলব্ধ খাদ্য উপভোগ করছেন। মনে উজাগর হয়ে এল বাইবেলের শ্লোক, “নদী যেদিকেই যাবে, অক্ষয় হবে সে পথে জোট বেঁধে থাকা সব প্রাণ আর নদীজলে মাছ হবে অফুরন্ত।”