কথা বলতে গিয়েও মাঝপথে থমকে গেলেন তিনি। গভীর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে শুরু করলেন আবারও। তবে ক্ষণে ক্ষণে যেন কেঁপে উঠছিল গলাটা। চোখ দুটো নামিয়ে নিলেন, না জানি কোন সে দুখের ঢেউ খেলে গেল চিবুকে তাঁর। প্রায় এক বছর হতে চলল সাহসিকতার মুখোশ পরে বেঁচে আছেন অনীতা সিং। তবে প্রয়াত স্বামীর স্মৃতিগুলো যে বড্ডো নিষ্ঠুর। "ছোট্ট সে এক সুখের সংসার ছিল," বলে উঠলেন অনীতা (৩৩), "জীবন দরিয়ায় নোঙর বলতে স্বামীই ছিল আমার।"

অনীতার স্বামী জয়করন সিং (৪২) উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহর থেকে ২০ কিমি দূরে লখৌতি গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন। এপ্রিল ২০২১-এর প্রথম সপ্তাহেই তাঁর শরীরের একে একে ফুটে উঠতে থাকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের উপসর্গ। আমরা যখন অনীতার সঙ্গে দেখা করতে যাই ওঁর শহরের বাড়িতে, উনি বলেছিলেন: "জ্বর, কাশি আর সর্দি লেগে কাহিল হয়েছিল মানুষটা। দ্বিতীয় প্রবাহে গোটা দেশটা ছারখার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকদের ঘাড় ধরে ইস্কুলে পাঠানো হয়েছিল। তখনই বোধহয় রোগটা এসে ধরে ওকে।"

২০শে এপ্রিল, ২০২১, দেখা গেল জয়করনের করোনাভাইরাসের রিপোর্ট পজিটিভ। শ্বাসকষ্ট শুরু হতে দেখা গেল যে, শহরের কোনও হাসপাতালেই অক্সিজেন নেই। "হাসপাতালের দরজায় দরজায় গিয়ে ভিক্ষে করেছি, হাতেপায়ে ধরেছি, কিন্তু সব্বাই না বলে দিল মুখের উপর," মনে করছিলেন অনীতা, "হুহু করে অবনতি ঘটছিল ওর, তাই একের পর এক ফোন করতে থাকি। কিছুতেই আর হিল্লে হল না কোনও। শেষে বাড়িতেই সেবা-শুশ্রূষা শুরু করলাম।"

স্থানীয় এক ডাক্তার এসে জ্বর আর কাশির ওষুধ দিয়ে গেলেন জয়করনকে। অনীতার আত্মীয়েরা না জানি কোত্থেকে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারও জোগাড় করে ফেললেন। "যন্তরটা কেমন করে ব্যবহার করতে হয় কিসুই তো জানতাম না। মাথা খাটিয়ে নিজেদেরই শিখতে হয়েছিল সবকিছু," বলছিলেন তিনি, "তবে হাসপাতালে একটা বেড পাওয়ার চেষ্টাটা কিন্তু ছাড়িনি।"

দেশের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল যে কতটা শোচনীয়, বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে, সেটা অতিমারির দয়ায় নগ্ন হয়ে বেরিয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের সামনে। যেহেতু মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) মোটে ১.০২ শতাংশ (২০১৫-১৬র হিসেব অনুযায়ী) জনস্বাস্থ্যের খাতে ব্যবহার করা হয়, সেহেতু জনসাধারণের সুরক্ষা কবচ বলতে কিছুই যে নেই, সেটা একেবারেই আশ্চর্যজনক নয়। জাতীয় স্বাস্থ্য খতিয়ান (ন্যাশনাল হেল্থ প্রোফাইল) ২০১৭ বলছে যে একেকজন সরকারি অ্যালোপাথি ডাক্তারের ভরসায় বেঁচে আছেন ১০,১৮৯ জন মানুষ, এবং প্রতি ৯০,৩৪৩ জন মানুষের জন্য রয়েছে একটি করে সরকারি হাসপাতাল।

PHOTO • Parth M.N.

বুলন্দশহরের বাড়িতে অনীতা সিং। ২০২১ সালে স্বামীকে হারানোর পর থেকে মনের জোরে লড়াই করে চলেছেন

' অসমতার খতিয়ান ২০২১: বৈষম্যে ভরা ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা ' শিরোনামে গতবছর জুলাই মাসে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া, সেখানে বলা হয়েছে এ দেশে প্রতি ১০,০০০ জন মানুষের জন্য মোটে ৫টি করে হাসপাতালের বেড এবং ৮.৬ জন ডাক্তার মোতায়েন রয়েছে। উপরন্তু দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বসবাস গ্রামে হলেও হাসপাতালের বেডের ভিতর কেবলমাত্র ৪০ শতাংশ রয়েছে তাঁদের ভাগে।

বেডের জন্য অনীতার সে চিরুনি তল্লাশি শেষ হয় জয়করনের মৃত্যুতে। ২৬শে এপ্রিল ২০২১, একটিবারের জন্য বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার লড়াইয়ে হার মানতে বাধ্য হলেন জয়কর। তার দুদিন পরেই নির্বাচনী কাজে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। অতিমারি তুঙ্গে ওঠা সত্ত্বেও পঞ্চায়েত নির্বাচন পিছোতে চায়নি এ রাজ্যের সরকার বাহাদুর।

ইউপির পঞ্চায়েত ভোটের (এপ্রিল ১৫-২৯, ২০২১) বাধ্যতামূলক দ্বায়িত্ব সামলাতে গিয়ে বলি হয়েছিলেন আরও অসংখ্য মানুষ। মে মাসের মাঝামাঝি নাগাদ কোভিড-১৯ কিংবা 'কোভিড-সম' উপসর্গ কেড়ে নেয় ১,৬২১ জন শিক্ষকের প্রাণ

তাঁদের পরিবারের জন্য ৩০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। কিন্তু জয়করন যেহেতু নির্বাচনী কাজে যাওয়ার দুদিন আগেই মারা যান, তাই সে ক্ষতিপূরণের মুখদর্শন করাটা অনীতার আর হয়ে ওঠেনি। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে উঠলেন, "এটা অন্যায়! সৎ চাকুরিজীবী ছিল আমার মানুষটা। তার বদলে এইটা পেলাম। এবার আমাদের বাচ্চাদের দেখভাল করব কীভাবে শুনি? আমি তো চাই ওরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াক। কিন্তু পয়সাকড়ি ছাড়া যে কোনওকিছুই সম্ভব নয়।"

মাস গেলে ৭০,০০০ টাকা মাইনে পেতেন জয়করন। সংসারটা তাঁর একার রোজগারেই চলত। উনি মারা যাওয়ার পর মানবিকতার খাতিরে বুলন্দশহরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন বটে অনীতা, কিন্তু "বেতন মোটে ২০,০০০," জানালেন তিনি। জয়করনের মৃত্যুর পর থেকে মেয়ে অঞ্জলি (৭) ও ছেলে ভাস্করের (১০) ইস্কুল যাওয়া বন্ধ। "ঘরকন্না সামলাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে," বলছিলেন অনীতা।

PHOTO • Parth M.N.

অনীতা একটা চাকরি পেয়েছেন বটে, তবে মাইনেটা তাঁর প্রয়াত স্বামীর উপার্জনের কিয়দাংশ। 'ঘরকন্না সামলাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে,' জানালেন তিনি

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে অক্সফ্যাম দ্বারা প্রকাশিত ' অসমতাই মৃত্যুর কারণ ' নামক একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের ৮৪ শতাংশ পরিবারের রোজগার হ্রাস পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিউ গবেষণা কেন্দ্র মার্চ ২০২১ সালে একটি গবেষণাপত্রে বলেছে যে ২০২০ সালে একদিকে যেমন ভারতের মধ্যবিত্তের তালিকা থেকে বাদ গেছে ৩ কোটি ২০ লক্ষ নাম, অন্যদিকে নিম্নবিত্তের (যাঁদের দৈনিক আয় ২ ডলার কিংবা তারও কম) খাতায় যোগ দিয়েছেন ৭ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ।

২০২০ সালের মার্চে দেশজুড়ে আচমকা নেমে আসে লকডাউনের থাবা, রুজিরুটি খোওয়া যায় সংখ্যাতীত মানুষের, তার সঙ্গে ছিল নড়বড়ে জনস্বাস্থ্য কাঠামো, ফলত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়নি এমন গেরস্থালি বোধহয় ভারতে নেই বললেই চলে। দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণের অচিরেই ধ্বসে পড়ে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা, ফলত ট্যাঁকে জোর না থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয় অসংখ্য পরিবার।

এঁদের মধ্যে রেখা দেবীর পরিবারও ছিল। ২০২১-এর এপ্রিল মাসে বারাণসীর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে ভর্তি হন তাঁর ভাজ (ভাইয়ের বউ), ২৪ বছরের সরিতা। কিন্তু ঠিকঠাক সেবাযত্ন পাচ্ছিলেন না, তাই সেখান থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন রেখা দেবী (৩৬)। "চারিপাশে পোকামাকড়ের মতো মারা যাচ্ছে লোকজন," চন্দৌলি জেলায় তেন্দুয়া গ্রামে তাঁর চালাঘরের বাইরে বসে বললেন তিনি, "সরিতার কোভিড হয়নি। কিন্তু বেচারির পেটব্যথাটা কিছুতেই কমছিল না। রোগীতে উপচে পড়ছিল হাসপাতালটা, তাই ডাক্তারবাবুরা আলাদা করে ওর দিকে নজর দিতে পারেনি। ফ্যালফ্যাল করে বিছানায় পড়েছিল মেয়েটা, বুঝতেই পারছিল না কী হচ্ছে।"

এক সপ্তাহ কষ্ট পাওয়ার পর সরিতাকে বিএইচইউ (সরকারি) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার আগে অবশ্য ওঁর স্বামী গৌতম (২৬) সোনভদ্রে তাঁদের বাড়ির কাছের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে। চন্দৌলির নৌগড় ব্লকের তেন্দুয়া থেকে এটি ৩০ কিমি দূরে। "মোটে একদিনের জন্য ভর্তি ছিল ওখানে, তাতেই ব্যাটারা ১২,০০০ টাকার বিল তুলে দিল। তারপরেও বলে কিনা চিকিৎসা করতে পারবে না আর, অন্য কোথাও নিয়ে যান!" রাগত স্বরে জানালেন রেখা। "গৌতম বেঁকে বসাতে ওরা ভয় দেখাতে শুরু করল, বলল যে মেয়েটা যে কোনও মুহূর্তে মারা যেতে পারে। ও ঘাবড়ে গিয়ে সরিতাকে আমার কাছে নিয়ে আসে, তৎক্ষণাৎ বিএইচইউ-তে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি।"

PHOTO • Parth M.N.

ভাইয়ের স্ত্রীর চিকিৎসা যে এতটা ব্যয়বহুল হবে সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি রেখা দেবী, '’এক লাখ বেরিয়ে গেল মেয়েটার চিকিৎসায়'

বারাণসীর হাসপাতালটি তেন্দুয়া থেকে ৯০ কিমি দূরে। সেখানে যাওয়ার জন্য ৬,৫০০ টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করেছিলেন গৌতম আর রেখা। বিএইচইউয়ের হাসপাতাল থেকে সরিতাকে ছাড়িয়ে এনে তাঁরা নিয়ে যান চাকিয়া শহরে, যেটা কিনা বারাণসী আর নৌগড়ের মাঝখানে। আরও ৩,৫০০ টাকা বেরিয়ে গেল গাড়ির ভাড়া বাবদ। "চাকিয়ার একটা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করালাম, এক সপ্তাহ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠল মেয়েটা," জানালেন রেখা, তবে সেই 'পেট ব্যথাটা' যে আদতে কেন হচ্ছিল, সে ব্যাপারে আজও অন্ধকারেই রয়েছেন তিনি। "কিন্তু চিকিৎসার পিছনে এক লাখ বেরিয়ে গেল।"

রেখা ও তাঁর পরিবার জাটভ জাতির মানুষ, উত্তরপ্রদেশে তফসিলি হিসেবে চিহ্নিত। খেতমজুরের কাজ করে দৈনিক ২০০ টাকা হাতে আসে তাঁর। গৌতম কাজ করেন সোনভদ্রের কাছে পাথরের খাদানে, দিন গেলে রোজগার হয় ২৫০ টাকা। রেখা বলে উঠলেন: "লকডাউনের [মার্চ ২০২০] পর থেকে কাজকম্ম কিছুই সেভাবে জুটছে না ছেলেটার। মাসে পর মাস কেটে গেল, একটা টাকাও আসেনি হাতে।" অবস্থা এতটাই খারাপ যে লকডাউন চলাকালীন লুকিয়ে চুরিয়ে নিয়ম ভঙ্গ করে খাদানে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন গৌতম। "সরকার আর বেসরকারি কিছু সংস্থা থেকে বিনেপয়সায় যে রেশনটা দিত, ওটার ভরসাতেই টিকেছিলাম। সরিতার পিছনে যে এতটা টাকা বেরিয়ে যাবে সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি কেউ।"

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে 'ভারতীয় রোগীদের জন্য অধিকার আদায়' শিরোনামে একটি সমীক্ষার রিপোর্ট বার করে অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া, ইউপি থেকে যে ৪৭২ জন অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৬১.৪৭ শতাংশ আগাম জানতেই পারেননি চিকিৎসা বাবদ কতটা খরচ হতে পারে। দেশজুড়ে এ সমীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ৩,৮৯০ জন, অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন এঁদের মধ্যে ৫৮ শতাংশ মানুষ – অর্থাৎ রোগীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বাজে ভাবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তরফ থেকে রোগীর অধিকার ঘিরে ১৭ অঙ্কের যে দাবি সনদটি তৈরি করা হয়েছে, সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে যে "হাসপাতালে চিকিৎসার কোন খাতে কি হারে খরচা হতে পারে সেটা আগাম জানার অধিকার রয়েছে" রোগী ও তাঁর সেবায় নিযুক্ত মানুষদের।

ভ্রাতৃবধূর চিকিৎসার খরচা মেটাতে নিজের দুই একর জমির এক-তৃতীয়াংশ এবং বেশ কিছু গয়নাগাঁটি বন্ধক রাখতে বাধ্য হন রেখা। "মাসে ১০ শতাংশের হারে সুদ নিচ্ছে মহাজন। আসলটা [৫০,০০০ টাকা] ছোঁয়া তো দূর অস্ত, সুদ গুনতে গুনতেই মাথা খারাপ হবার জোগাড়। এই কর্জ যে কবে শোধ করতে পারব তা বুঝে ওঠাই দায়," অসহায় কণ্ঠে জানালেন তিনি।

PHOTO • Parth M.N.

চন্দৌলি জেলার তেন্দুয়া গ্রামে নিজের জমিতে বসে আছেন রেখা। বেসরকারি হাসপাতালের বিল মেটাতে গিয়ে এটার এক-তৃতীয়াংশ বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছেন তিনি

অতিমারির প্রথম তিনটে মাসে ৮৩ শতাংশ অতিরিক্ত ঋণের দায়ে ডুবে গেছে ইউপির বহু গ্রাম। তৃণমূল স্তরে কর্মরত বেশ কিছু সংস্থা মিলে কালেক্ট (সিওএলএলইসিটি) নামক একটি সংগঠন বানিয়েছে, নয়খানি জেলা জুড়ে সমীক্ষা চালিয়ে উপরোক্ত তথ্যে উপনীত হয়েছে তারা। দেখা গেছে যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া ঋণের পরিমাণ ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর-ডিসেম্বরে ৮৭ এবং ৮০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছিল যথাক্রমে।

তবে মুস্তাকীম শেখের (৬৫) গল্পটা কিন্তু আরও ভয়ঙ্কর।

পেশায় ক্ষুদ্র চাষি এই মানুষটির এক একরেরও কম জমি আছে গাজিপুর জেলার জালালাবাদ গ্রামে। মার্চ ২০২০, অতিমারির বাঁধ ভাঙার দিনকয়েক আগেই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। তার ফলে শরীরের বাঁদিকটা খানিকটা হলেও অসাড় হয়ে যায়, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। "লাঠি ছাড়া চলাফেরা করতে পারি না। এদিকে বাঁ-হাতটার এমন অবস্থা যে লাঠি ধরতে গিয়েও নড়বড় করে," জানালেন তিনি।

না নিজের জমিতে কাজ, না অন্য কোথাও মজুরি, কোনও কিছুই আর সম্ভব নয় মুস্তাকীমের পক্ষে। "বুড়ো মানুষ তো, সরকারের থেকে যে ভাতাটা পাই সেটার ভরসাতেই টিকে আছি," শুকনো মুখে বলে উঠলেন তিনি, "এমনই প্যাঁচে পড়েছি যে কেউ দুটো পয়সা ধারও দেবে না, সব্বাই জানে এ অবস্থায় খাটাখাটনি করে সে টাকা ফেরত দিতে পারব না।" বৃদ্ধ মানুষটির একমাত্র সহায় বার্ধক্য ভাতা। ২০২০ সালের জাতীয় স্বাস্থ্য খতিয়ান অনুসারে গ্রামীণ ইউপির ৯৯.৫ শতাংশ মানুষের না আছে কোনও স্বাস্থ্য বিমা, না আছে চিকিৎসা বাবদ খরচাপাতির জন্য কোনও সহায়ক ব্যবস্থা।

ফলত ওঁর স্ত্রী সাইরুনও (৫৫) যখন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন – মুস্তাকীমের আন্দাজ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য – তখন করার আর তেমন কিছুই ছিল না। "স্ট্রোক হয়ে উল্টে পড়ে গেল। শিরদাঁড়ায় চোট পেয়েছিল," জানালেন তিনি। ২০২০ সালের এপ্রিল, দেশের সর্বত্র থাবা বসাতে শুরু করেছে কোভিড-১৯। "আজমগড়ের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম বিবিকে, কিন্তু গিয়ে দেখি যে শুধু কোভিডেরই চিকিৎসা হচ্ছে।"

PHOTO • Parth M.N.

গাজিপুর জেলায় নিজের গ্রামে মুস্তাকীম শেখ। স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে রাজ্য সরকারের বার্ধক্য ভাতার ভরসাতেই দিন গুজরান হয় তাঁর

তাঁর বাড়ি থেকে ৩০ কিমি দূরে আজমগড় হাসপাতাল, গাড়ি ভাড়া করে সেখানে যেতে গিয়ে ৩ হাজার টাকা বেরিয়ে যায়। "গাজিপুরের সরকারি হাসপাতালে তেমন ব্যবস্থাপনা নেই, তাই গেলে সেই বারাণসীতেই যেতে হত। সেক্ষেত্রে [বারাণসী পৌঁছাতে] এককাঁড়ি টাকা লাগতো আরও। ট্যাঁকে একটা পয়সাও পড়ে নেই। বেসরকারি হাসপাতালের জন্য ইয়ার দোস্তদের জিজ্ঞাসা করলাম বটে, কিন্তু সেখানকার খরচ টানা যে আমার নাগালের বাইরে, এইটা বুঝতে বিশেষ দেরি হয়নি।"

অগত্যা সাইরুনকে নিয়ে জাখানিয়া ব্লকে নিজের গ্রামে ফিরে এলেন, মনস্থির করলেন যে স্ত্রীর চিকিৎসা স্থানীয় ভাবেই করাবেন। "ওমন করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ, বিবিও সায় দিয়েছিল," বলছিলেন তিনি, "ওষুধপত্তর যা কিছু লাগবে তা গাঁয়ের ঝোলা-ছাপ (হাতুড়ে) ডাক্তারই বলে দিলেন।"

সরকারি ডাক্তারের চেয়ে ঝোলা-ছাপদের (কোয়্যাক বা হাতুড়ে ডাক্তার) উপরেই গ্রামের মানুষ ভরসা করেন বেশি। "হাতুড়ে বাবুরা আমাদের সম্মানও করেন, আবার কিছু জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করলে জবাবও দেন," জানালেন মুস্তাকীম, "যখন অন্য ডাক্তাররা আমাদের ছায়টুকু মাড়াতেও ভয় পাচ্ছিল, তখন ওনারাই তো ছিলেন আমাদের পাশে।" তবে একটা কথা মনে রাখতেই হবে, হাতুড়ে ডাক্তররা চিকিৎসা করেন বটে, কিন্তু প্রথাগত প্রশিক্ষণ তাঁদের কারোরই নেই।

অক্টোবর ২০২০, স্ট্রোক হওয়ার মাস ছয়েক পর যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তাঁদের এক-কামরার কুঁড়েঘরে শুয়ে শুয়েই মারা গেলেন সাইরুন। তবে মুস্তাকীম কিন্তু আপোস করে নিয়েছেন এই মৃত্যুর সঙ্গে। তাঁর কথায়: "হাসপাতালে তো হাজারটা হইহট্টগোল নিয়ে মরছে লোকজন। তার চেয়ে আমার বিবির মৃত্যুটা অনেক শান্তির।"

ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশান থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে পার্থ এম. এন. জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Parth M.N.

২০১৭ সালের পারি ফেলো পার্থ এম. এন. বর্তমানে স্বতন্ত্র সাংবাদিক হিসেবে ভারতের বিভিন্ন অনলাইন সংবাদ পোর্টালের জন্য প্রতিবেদন লেখেন। ক্রিকেট এবং ভ্রমণ - এই দুটো তাঁর খুব পছন্দের বিষয়।

Other stories by Parth M.N.
Translator : Joshua Bodhinetra

জশুয়া বোধিনেত্র পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার (পারি) ভারতীয় ভাষাবিভাগ পারিভাষার কন্টেন্ট ম্যানেজার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল উত্তীর্ণ জশুয়া একজন বহুভাষিক কবি তথা অনুবাদক, শিল্প সমালোচক এবং সমাজকর্মী।

Other stories by Joshua Bodhinetra