“এখন আর আগের সেদিন নেই। আজকালকার মহিলারা জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজখবর রাখেন,” ইট আর সিমেন্টের ছোটো সমুদ্র-সবুজ রঙা বাড়ির রোদ ঝলমলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালেন সলাহ খাতুন।
তিনি যা বললেন তা তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ — বিগত এক দশক ধরে তিনি ও তাঁর ভাইপোর স্ত্রী, শমা পরভীন সরকারি স্বীকৃতি ছাড়াই বিহারের মধুবনী জেলার হাসানপুর গ্রামে পরিবার পরিকল্পনা ও মাসিক ঋতুস্রাব সংক্রান্ত স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শদাতা নিযুক্ত হয়েছেন।
মহিলারা প্রায়ই জন্মনিয়ন্ত্রণ, দু’টি শিশুর জন্মের মধ্যে সময়ের ব্যবধান রাখার উপায় ও টিকাকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিতে তাঁদের কাছে যান। কেউ কেউ তো দরকার পড়লে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নেওয়া যায় এমন হরমোন ঘটিত জন্মনিরোধক পদ্ধতি গোপনে গ্রহণ করতে চান।
শমার বাড়ির কোণের একটা ঘরে তাকে শিশি ও রাংতার মোড়কে ওষুধ সহ নিরালায় আছে এক ক্লিনিক। ৪০-এর গোড়ায় বয়স শমার আর ৫০-এর গোড়ায় বয়স সলাহ, দু’জনের কেউই প্রশিক্ষিত নার্স না হয়েও মাংস পেশিতে প্রদত্ত এই ইঞ্জেকশন দিয়ে থাকেন। অনেক মহিলা একাই আসেন, ইঞ্জেকশন নিয়ে দ্রুত চলে যান। তাঁদের বাড়িতে কারও কিছু জানার দরকারই নেই,” বললেন সলাহ। অনেকে আবার নিজেদের স্বামী বা অন্য মহিলা আত্মীয়দের নিয়ে আসেন।”
ফুলপরস ব্লকে, সইনি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ২,৫০০ জন মানুষ সম্বলিত গ্রাম হাসানপুরে এক দশক আগেও প্রায় কেউ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন না — সে তুলনায় এখনকার ঘটনাকে এক অর্থে নাটকীয় পরিবর্তনই বলা যায়।
এই পরিবর্তন এলো কেমন করে? “এ হল একদম ভেতরের কথা,” বললেন শমা।
হাসানপুরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করার ঘটনাটি বিহার রাজ্যের সাধারণ পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ — এনএফএইচএস-৪ (২০১৫-১৬) রিপোর্ট অনুসারে সারা দেশের মোট জন্মহার যেখানে ২.২ বিহারে সেখানে ৩.৪ যা লক্ষ্যণীয়ভাবে বেশি (মোট জন্মহার অর্থাৎ সন্তানধারণে সক্ষম থাকাকালীন একজন মহিলা গড়ে যে সংখ্যক সন্তান ধারণ করবেন)।
রাজ্যের মোট জন্মহার এনএফএইচএস-৫, ২০১৯-২০২০ সালে নেমে আসে ৩-এ এবং এই কমে যাওয়া জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা ৪ ও ৫-এর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ২৪.১ থেকে বেড়ে ৫৫.৮ হওয়ার সঙ্গে তাল রেখে ঘটেছে।
আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলির মধ্যে, ৮৬ শতাংশ, অর্থাৎ পরিসংখ্যানের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় মহিলাদের টিউবাল লাইগেশন (এনএফএইচ-৪)। এ সম্বন্ধে এনএফএইচএস-৫ থেকে এখনও বিষদে জানা বাকি থাকলেও এটুকু বলা যায় যে দু’টি শিশু জন্মের মাঝে সময়ের ব্যবধান রাখতে ইঞ্জেকশন নির্ভর জন্মনিয়ন্ত্রক সহ অন্যান্য নতুন পদ্ধতির উপর রাজ্য এখন নীতিগতভাবে প্রাধান্য দিচ্ছে।
সলাহ এবং শমা লক্ষ্য করছেন যে হাসানপুরেও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার বেড়েছে — প্রধানত খাওয়ার বড়ি সর্বাধিক প্রচলিত হলেও হরমোন ইঞ্জেকশন যাকে ডেপো-মেড্রক্সি প্রোজেস্টেরন অ্যাসিটেট (ডিএমপিএ) বলে আর ভারতে যা ডেপো-প্রোভেরা বা ‘পারি’ নামে পরিচিত তারও চাহিদা আছে। সরকারি ঔষধালয়ে ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই ইঞ্জেকশন ‘অন্তরা’ নামে দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে ভারতে চালু হওয়ার আগে বিহারে ডেপো ব্যক্তিগত বা কোনও সংগঠন, যেমন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে নিয়ে আসা হত পড়শি দেশ, নেপাল থেকে। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে বিনামূল্যে দেওয়া হলেও অন্যত্র এর দাম পড়ে ২৪৫ থেকে ৩৫০ টাকা অবধি।
এই ইঞ্জেকশনের ক্ষতিকারক দিকও আছে বলে বহু বছর একে এখানে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল এবং ৯০এর দশকে জনস্বাস্থ্য ও নারী অধিকার নিয়ে কর্মরত সংগঠনের কর্মীরা এই পদ্ধতির ডিসমেনোরিয়া (যন্ত্রণাময় অথবা অতিরিক্ত রক্তস্রাব), আমেনোরিয়া (রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া), ওজন অস্বাভাবিক বেড়ে বা কমে যাওয়া, অনিয়মিত ঋতুস্রাব ও ব্রণ হওয়ার মতো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলির কারণে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গোড়ে তোলেন। সম্ভাব্য ক্ষতির কথা ভেবে দীর্ঘ আন্দোলন, টানা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিবিধ গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রতিক্রয়া নেওয়া ইত্যাদি কারণে ২০১৭ অবধি ভারতে ডেপো চালু করা সম্ভব হয়নি। এখন এদেশেই এই ওষুধ তৈরি হয়।
বিহারে এই ইঞ্জেকশন অন্তরা নামে চালু হয় ২০১৭ সালে আর ২০১৯ সালের মধ্যে দেশের সব গ্রাম ও শহরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ও স্বাস্থ্য-উপকেন্দ্রে তা পৌঁছে যায়। রাজ্য সরকারের তথ্য অনুসারে অগস্ট ২০১৯-এর মধ্যে এই ইঞ্জেকশনের ৪২৪,৪২৭টি ডোজ দেওয়া হয়েছে। যে মহিলারা একবার এই ইঞ্জেকশন নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ৪৮.৮ শতাংশ দ্বিতীয়বারও তা নিয়েছেন।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে ডিএমপিএ ব্যবহার করা নিয়ে দুশ্চিন্তার বাস্তব কারণও আছে। হাড়ে খনিজের ঘনত্ব কমে যাওয়ার ঝুঁকি এর থেকে আসা বিপদগুলির অন্যতম (ইঞ্জেকশন বন্ধ করলে এই ক্ষতি আবার পূরণ হতে পারে বলে মনে করা হয়)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী ডিএমপিএ ব্যবহারকারী মহিলাদের প্রতি দুই বছরে একবার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা দরকার।
শমা ও সলাহ জোর দিয়ে বললেন যে তাঁরা নিরাপত্তার বিষয়ে খুব সতর্ক থাকেন। উচ্চরক্তচাপ আছে এমন মহিলাদের ইঞ্জেকশন নেওয়ার পরামর্শ কখনই দেওয়া হয় না এবং এই দুই স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যকর্মীই সবসময় ইঞ্জেকশন দেওয়ার আগে অবশ্যই রক্তচাপ পরীক্ষা করে নেন। তাঁরা আরও জানালেন যে এর কোনওরকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা তাঁদের কানে আসেনি।
গ্রামে ঠিক কতজন ডেপো-প্রোভেরা ব্যবহার করেছেন সে সম্বন্ধে সঠিক তথ্য তাঁদের কাছে না থাকলেও দৃশ্যত এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় কারণ এতে যেমন গোপনীয়তা বজায় থাকে তেমনই তিনমাসের জন্য একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। যে সব মহিলাদের স্বামীরা শহরে কাজ করেন এবং বছরের মাত্র কয়েক মাসের জন্য বাড়ি ফেরেন তাঁদের জন্য এটি একটি সহজ স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা। (স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্র অনুসারে ইঞ্জেকশন ব্যবহারের পর তিনমাস কেটে যাওয়ার আর কয়েক মাস পরে সন্তানধারণ ক্ষমতা আবার ফিরে আসে)।
মধুবনীতে হরমোন ইঞ্জেকশন জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে এছাড়াও আছে ঘোঘরডিহা প্রখণ্ড স্বরাজ্যবিকাশ সঙ্ঘ নামের একটি সংগঠন যা ৭০-এর দশকে বিনোভা ভাবে ও জয়প্রকাশ নারায়ণের বিকেন্দ্রীকৃত গণতন্ত্র ও সমাজভিত্তিক আত্মনির্ভরতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্থাপিত হয়েছিল। (এই বিকাশ সঙ্ঘ রাজ্য সরকারের টিকাদান কর্মসূচি ও নির্বীজকরণ শিবিরেও সহায়তা করেছে — যে কর্মসূচি ‘লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক’ হওয়ার কারণে সমালোচিত হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে)।
একটি মুসলমান প্রধান গ্রামে পোলিও রোগের টিকাকরণ এবং পরিবার পরিকল্পনার কাজ ২০০০ সালে যখন এগোতে পারছিল না তখন এই গ্রাম সহ অন্যান্য গ্রামে এই সঙ্ঘ মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও মহিলা মণ্ডল গড়ে তুলতে শুরু করে। সলাহ একটি ছোটো স্বল্পসঞ্চয় গোষ্ঠীর সদস্য হন এবং শমাকেও সদস্য হতে বলেন।
বিগত তিন বছর ধরে এই দুই মহিলা সঙ্ঘ দ্বারা পরিচালিত মাসিক ঋতুস্রাব, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ গ্রহণ করেছেন। প্রায় ৪০টি গ্রাম, যেখানে সঙ্ঘ কাজ করে সেখানে তারা মহিলাদের সহেলি-নেটওয়ার্ক তৈরি করে তাদের হাতে তুলে দেয় মাসিক ঋতুস্রাবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য-সরঞ্জাম, কন্ডোম ও জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি যা মহিলারা বিক্রি করতে পারেন। এর ফলে, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পৌঁছে যায় মহিলাদের দোরগোড়ায়, আর তাও আবার নিজেদের সমাজের খোলামেলা চিন্তার সদস্যদের মাধ্যমে। ২০১৯-সালে যখন পারি নামে ডিএমপিএ চালু হল তখন সেটিও ওই সরঞ্জামের তালিকায় যুক্ত হয়ে গেল।
“সহেলি নেটওয়ার্কটি থেকে ৩২ জন মহিলা সদস্যকে নিয়ে এখন একটি বিপণন নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। আমরা একজন স্থানীয় পাইকারের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি, তাঁর কাছ থেকে এই সদস্যরা পাইকারি দামে একসঙ্গে অনেকটা কিনে নেন,” বললেন, মধুবনী ভিত্তিক সঙ্ঘের প্রধান কার্যকারী আধিকারিক (সিইও), রমেশ কুমার সিং। এই কাজের জন্য সঙ্ঘ কিছু মহিলাকে প্রারম্ভিক পর্বে খানিকটা মূলধন দিয়ে সাহায্য করেছিল। প্রতিটি সামগ্রী বিক্রি বাবদ তাঁরা ২ টাকা করে লাভ রাখতে পারেন,” জানালেন সিং।
হাসানপুরে যখন অল্প সংখ্যক মহিলা ইঞ্জেকশন নিতে চাইলেন তখন নিশ্চিত করা হল যাতে প্রথম খোরাকের পর তিন মাস কাটলে দ্বিতীয় খোরাকটি নিতে যেন দুসপ্তাহের বেশি দেরি না হয়। এই সময়ে, সলাহ এবং শমা আরও ১০ জন মহিলার সঙ্গে নিকটবর্তী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এএনএম-দের (সহায়ক নার্স-ধাত্রী) কাছে ইঞ্জেকশন দিতে শিখেছিলেন (হাসানপুরে কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, নিকটতম স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি ফুলপরস ও অন্যটি ঝঞ্ঝরপুরে, ১৬ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত)।
ফুলপরস পিএইচসিতে যাঁরা অন্তরা ইঞ্জেকশন নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন খুব স্বল্প ব্যবধানে জন্মানো তিন সন্তানের তরুণী মা, উজমা (নাম পরিবর্তিত)। তাঁর কথায়, “আমার স্বামী কাজ করতে দিল্লি এবং আর পাঁচটা জায়গায় যায়। আমরা ঠিক করি যে ও গ্রামে ফিরলে আমি তখন ইঞ্জেকশন নিয়ে নেব। সময় এখন বড্ডো খারাপ, বড়ো পরিবার টানার জোর আমাদের মোটেই নেই।" উজমা জানালেন যে এরপর তিনি টিউবাল লাইগেশনের মাধ্যমে একটা "স্থায়ী" সমাধান দেখবেন।
যে মহিলারা ‘ভ্রাম্যমান স্বাস্থ্যকর্মী’ হওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তাঁরা যেসব মহিলারা নিখরচায় অন্তরা ইঞ্জেকশন নিতে চান তাঁদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যোগযোগ করিয়ে দেন যেখানে তাঁদের নাম নথিভুক্ত করতে হয়। গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদেরও মহিলাদের কাছে অন্তরা পৌঁছে দেওয়ার কথা, বলে জানালেন সলাহা ও শমা। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রকের একটি সংক্ষিপ্ত পুস্তিকা থেকে জানা যাচ্ছে যে তৃতীয় দফায় এই ইঞ্জেকশন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি থেকেও পাওয়া যাবে।
শমা জানালেন যে এখন গ্রামের বেশিরভাগ মহিলা দুই সন্তানের পর ‘ক্ষান্তি’ দিতে চান।
কিন্তু হাসানপুরে এই পরিবর্তন আসতে সময় লেগেছে। “আমাদের সময় লেগেছে কিন্তু শেষ পার্যন্ত আমরা করতে পেরেছি,” বললেন শমা।
শমার স্বামী রহমাতুল্লাহ আবু, বয়স ৪০-এর শেষ ভাগে, এমবিবিএস পাস না করেও হাসানপুরে চিকিৎসার কাজ করেন। তাঁর সমযোগিতায় ১৫ বছর আগে শমা, মাদ্রাসার আলিম স্তর অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিক সমতুল স্তর অতিক্রম করেছেন। স্বামীর সমর্থন এবং মহিলা গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করে শমা যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছেন তার বশেই তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে রোগীদের কাছে যান, কখনও সন্তান প্রসব করাতে যান আবার কখনও নিজেদের বাড়ির ডাক্তারখানায় রোগীদের কষ্টের উপশম করার চেষ্টা করেন।
শমা ও সলাহ মনে করেন না যে মুসলমান প্রধান গ্রামে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তাঁদের ধর্মের মতো সংবেদনশীল বিষয়ের সঙ্গে কোনও সমঝোতা করতে হয়েছে। তাঁরা বরং জানালেন যে সময়ের সঙ্গে মানুষের চিন্তাভাবনা বদলেছে
সদ্য সদ্য কৈশোরে পা রাখা শমা ১৯৯১-এ বিয়ের পর বর্তমান সুপৌল জেলার দুবিয়াহি থেকে চলে আসেন হাসানপুরে। “আগে আমি রীতিমতো পর্দা প্রথা মেনে চলতাম; আমি আমাদের মোহল্লাটা পর্যন্ত দেখিনি,” তিনি জানালেন। মহিলা গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করে এসব বদলে গেছে। “এখন আমি একটা বাচ্চার সমস্ত পরীক্ষা করতে পারি। ইঞ্জেকশন দিতে পারি, স্যালাইনও লাগাতে পারি। এই অবধি দিব্যি করে দিতে পারি,” তিনি বললেন।
শমা ও রহমাতুল্লাহর তিনটি সন্তান। বড়ো ছেলেটি ২৮ বছর হলেও এখনও যে অবিবাহিত তা শমা সগর্বে জানালেন। তাঁর মেয়ে স্নাতক স্তরের শিক্ষা শেষ করেছেন, এবার বি এড কোর্সে ভর্তি হতে চান। “মাশ-আহ-আল্লাহ ও শিক্ষক হবে,” বললেন শমা। ছোটো ছেলেটি কলেজে পড়ে।
শমা যখন বলেন পরিবার ছোটো রাখতে, তখন হাসানপুরের মহিলারা তাঁর উপর আস্থা রাখেন। “ওরা কখনও কখনও আমার কাছে অন্য কোনও অসুখের জন্য এলেও আমি ওদের জন্মনিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দিই। পরিবার যত ছোটো হবে ওরা ততই আনন্দে থাকবে।”
নিজের বাড়ির রংচটা কিন্তু পোক্ত দেওয়াল আর থামওয়ালা রোদ ঝলমলে বারান্দায় শমা প্রতিদিন ৫ থেকে ১৬ বছরের ৪০টি মেয়েকে পড়ান। স্কুলের পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে খানিক সেলাই, ছুঁচে ফুল তোলা, গান ইত্যাদি মিশিয়ে তিনি পড়ান। তাছাড়া কিশোরীরা এখানে অনায়াসে নিজেদের নানান প্রশ্ন শমাকে করতে পারে।
তাঁর প্রাক্তন ছাত্রীদের মধ্যে একজন গাজালা খাতুন, বয়স ১৮। “মায়ের গর্ভ শিশুর প্রথম মাদ্রাসা। সব শিক্ষা আর সুস্বাস্থ্যের শুরু ওখান থেকেই হয়,” শমার কাছে বহু বার শোনা কথাগুলো সে বলল। তার কথায়, “মাসিকের সময়ে যা করা উচিত থেকে বিয়ের সঠিক বয়স, সব আমি ওঁর কাছে শিখেছি। এখন পরিবারের সবাই স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে, কাপড় না। আমি পৌষ্টিক আহার সম্বন্ধেও সচেতন। আমার স্বাস্থ্য যদি ভালো হয় তবে ভবিষ্যতে আমার সন্তানরাও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে।”
সলাহ (যিনি নিজের পরিবার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলতে চান না) নিজেও তাঁর সমাজের কাছে খুবই বিশ্বস্ত। তিনি ১২—১৮ জন মহিলাদের নিয়ে গঠিত নয়টি ক্ষুদ্রসঞ্চয় গোষ্ঠীর নেত্রী — তাঁরা ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকা প্রতিমাসে জমা করেন। গোষ্ঠীগুলি মাসে একবার করে নিজেদের সভা করে। এগুলিতে বহু কমবয়সী মায়েরাও আছেন, ফলে সলাহ সেখানে পরিবার পরিকল্পনার কথাবার্তায় উৎসাহ দেন।
জিতেন্দ্র কুমার, জিপিএসভিএসের মধুবনী স্থিত প্রাক্তন সভাপতি, যিনি ৭০-এর দশকে এই সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম, জানালেন, “আমাদের ৩০০টি মহিলা গোষ্ঠীর নাম কস্তুরবা মণ্ডল, এবং আমরা গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষমতায়নকে এমন রক্ষণশীল (হাসানপুর) সমাজেও বাস্তবায়িত করতে চাই।” তিনি জোরের সঙ্গে বললেন যে তাঁদের সর্বব্যাপী কাজের কারণে মহিলারা শমা ও সলাহর মতো স্বেচ্ছাসেবীদের বিশ্বাস করেন। “এখানে তো এমন গুজবও ছিল যে পালস পোলিওর টিকা ছেলেদের নির্বীজ করে দেবে। পরিবর্তন আসতে সময় লাগে...”
যদিও শমা ও সলাহ মনে করেন না যে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলতে তাঁদের ধর্মের মতো সংবেদনশীল বিষয়ের সঙ্গে কোনও সমঝোতা করতে হয়েছে। তাঁরা বরং মনে করেন যে মানুষের ভাবনাচিন্তা ক্রমে বদলাচ্ছে।
শমা বললেন, “আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দিই, গতবছর আমার এক বিএ পাস করা অত্মীয় আবার সন্তান সম্ভবা হয়। ওর আগেই তিনটে বাচ্চা ছিল আর তৃতীয়টি প্রসবের জন্য ওকে অপারেশন করতে হয়েছিল। আমি বলেছিলাম যেহেতু ওর একবার পেট কাটা হয়েছে, অতএব ওর বেশি সাবধান হওয়া দরকার। শেষে ওর নানা জটিলতা দেখা দেওয়ার পর আবার একটা অপারেশন করতে হয়, এবার জরায়ু বাদ দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ওদের ৩-৪ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়।” এই কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন যে, “এই ধরনের ঘটনা অন্য মহিলাদের নিরাপদ জন্মনিরোধক ব্যবহার করতে উৎসাহ দেয়।”
গুনাহ বা পাপ কাকে বলে তা নিয়ে মানুষ এখন সূক্ষ্মভাবে ভাবতে প্রস্তুত। তাঁর কথায়, “আমার ধর্ম তো সন্তানের যত্ন করার কথাও বলে। তার সুস্বাস্থ্য, ভরণপোষণ নিশ্চিত করে তাকে সুন্দরভাবে মানুষ করার কথাও বলে আমার ধর্ম… এক-আধ ডজন পয়দা করে বসব আর তারপর তাদের চরতে ছেড়ে দেব – আমাদের ধর্ম কিন্তু বলেনি যে সন্তানের জন্ম দিয়ে তাকে নিজের ভরসায় ছেড়ে দাও।”
মানুষ তার পুরোনো ভয়গুলোকে জয় করছে ধীরে ধীরে। “শাশুড়িরা এখন আর সংসারের উপর কতৃত্ব করেন না। ছেলেরা এখন রোজগার করে বউকে টাকা পাঠায়। এখন সেই সংসারের প্রধান। আমরা এখন তাকে দুটি বাচ্চার মধ্যে ব্যবধান রাখতে শেখাই, বলি ইন্ট্রা-ইউটেরাইন পদ্ধতি, জন্মনিরোধক বড়ি বা ইঞ্জেকশনের কথা। আর তার দুটো বাচ্চা থাকলে তাহলে আমরা তাকে অপারেশন [বন্ধাত্বকরণ] করিয়ে নিতে বলি।”
এতে হাসানপুরের মানুষদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। সলাহর কথায়, “পথে এসে গেছে সবাই!”
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে
অনুবাদ: চিলকা