“সোনালি পাড় আর খানিক কুঁচি বসিয়ে দেব। হাতায় খানকতক কাটা-কাটা নকশাও বানিয়ে দিতে পারি, তবে সেটার জন্য আরও ৩০ টাকা লাগবে।”

খদ্দেরের সঙ্গে রোজ এসব কথাবার্তা চলে শারদা মাকওয়ানার (৩৬)। হাতা কতটা হবে, হালফ্যাশনের খোলা-পিঠ ব্লাউজ বাঁধার দড়িতে ঠিক কেমন ফিতে বা কতটা ওজনদার লটকন বসবে, একেকজন খদ্দের তো এসব ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে। নিজের দক্ষতা ঘিরে শারদার গর্বের শেষ নেই, “কাপড় দিয়ে ফুল বানিয়ে সেটা সেলাই করে বসিয়ে দিতে পারি,” বলেই সেটা করে দেখাতে লাগলেন তিনি।

শারদা ও তাঁর মতো স্থানীয় ব্লাউজ-দর্জিরাই কুশলগড়ের নারীমহলের মন-পসন্দ ফ্যাশন অ্যাডভাইজার। হবে না-ই বা কেন? বয়স সে যা-ই হোক, শাড়ি পরেন যাঁরা, তাঁদের তো ওই ৮০ সেন্টিমিটার কাপড় ছাড়া গতি নেই।

আদ্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যখন জনসভায় মেয়েদের কথা বলা মানা, জন্মকালীন লৈঙ্গিক অনুপাত প্রতি ১০০০ জন পুরুষে কেবল ৮৭৯ জন মহিলা (জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা, এনএফএইচএস ৫ ), সেখানে অন্তত নিজের বেশভুষার উপর এটুকু দখল যে নারীর আছে, সেটা সত্যিই তারিফ করার মতো জিনিস।

রাজস্থানের বাঁশওয়াড়া জেলার এই ছোট্ট শহরে যেদিকেই তাকাবেন সারি সারি দর্জির দোকান চোখে পড়বে। পুরুষ দর্জিরা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত: একদল জামা-প্যান্ট বানান, আরেকদল কুর্তার মতো বিয়েশাদির কাপড়জামা তৈরিতে ওস্তাদ — এমনকি কোনও বর শীতকালে বিয়ে করতে গেলে গরম কোটও বানিয়ে নিয়ে যান এঁদের থেকে। দুই-ই বড্ড ম্যাড়ম্যাড়ে, মাঝেসাঝে হাল্কা গোলাপি বা লাল বাদে তাঁদের রংয়ের দুনিয়া নেহাতই সীমিত।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: কুশলগড়, বাঁশওয়াড়ার বাজারগলির দৃশ্য। ডানদিকে: নিজের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন শারদা মাকওয়ানা

এই ব্যাপারে অবশ্য শাড়ি-ব্লাউজ দর্জির দোকানগুলো এক্কেবারে উল্টো, রংচঙে রংমশাল যেন — পাক খাওয়ানো সুতোর লটকন বা গোছা, চকচকে গোটা (সোনালি-রুপোলি পাড়), নানানরঙা ছিটকাপড় ছড়ানো চারিদিকে। “আর কয়েক সপ্তাহ পরে আসুন, তদ্দিনে বিয়ের মরসুম শুরু হয়ে যাবে,” বলতে গিয়ে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল শারদার চোখমুখ, “তখন বেজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ব।” বৃষ্টিবাদলার ভয়ে সদা তটস্থ হয়ে থাকেন, কারণ লোকজন বাড়ির বাইরে পা রাখে না, তাঁর কামধান্দা সব লাটে ওঠে।

১০,৬৬৬ মানুষের (জনগণনা ২০১১) এই শহরে শারদা মাকওয়ানার হিসেবে ৪০০-৫০০ ব্লাউজ কারিগর তো আছেই। তবে জনসংখ্যার নিরিখে কুশলগড়ের চেয়ে বড়ো তেহসিল বাঁশওয়াড়া জেলায় খুব কমই আছে, প্রায় তিন লক্ষ মানুষের বাস এখানে। শারদার কিছু খদ্দের ২৫ কিলোমিটার দূর থেকেও আসেন। “উকালা, বাওলিপাড়া, সর্ভা বা রামগড়ের মতো অসংখ্য গ্রামের লোক আমার কাছে আসে,” হাসিমুখে জানালেন তিনি, “আর একবার আমার কাছে আসার পর অন্য কারও কাছে যান না।” কাপড়জামা ছাড়াও ক্রেতার দল জীবন, শরীরস্বাস্থ্য, বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ, এমন নানান বিষয়ে কথা বলেন তাঁর সঙ্গে।

৭০০০ টাকা দিয়ে একখান সিঙ্গার মেশিন কিনে নিজের কারবার শুরু করেছিলেন শারদা, বছর দুয়েক বাদে শাড়ির পিকো (ধার-সেলাই) বা ওই জাতীয় ছোটোখাটো কাজের জন্য ঊষা কোম্পানির একটা পুরোনো সেলাইমেশিনও কেনেন। পিকো করতে ১০ টাকা করে নেন তিনি, আর সায়া বা পাতিয়ালা স্যুট (সালোয়ার-কামিজ) সেলাই করতে নেন যথাক্রমে ৬০ ও ২৫০ টাকা।

পেট চালাতে সেলাইফোঁড়াই ছাড়াও রূপচর্চা করেন শারদা মাকওয়ানা। দর্জিখানার পিছনদিকে রয়েছে একটা নাপিতের কুর্সি, ইয়াব্বড় আয়না আর বিবিধ মেক-আপ সামগ্রী। সুতো পাকিয়ে ভুরু তোলা, শরীরের লোম সাফাই, চুলের ব্লিচ, এবং চুল কাটা, বিশেষ করে বায়নাবাজ বাচ্চাদের চুলের ছাঁট — ৩০ থেকে ৯০ টাকার ভিতর সবই করেন তিনি। “মেয়েরা ফেসিয়াল করাতে বড়ো পার্লারে যায়,” বুঝিয়ে বললেন শারদা।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

শারদার দোকানের সামনেটা তাঁর নিজের হাতে বানানো ব্লাউজে ব্লাউজে (ডানদিকে) ছয়লাপ, আর পিছনদিকে রাখা আছে একপিস নাপিতের কুর্সি, বড়ো আয়না ও রূপচর্চার হরেক সামগ্রী (বাঁদিকে)

তাঁর দর্শন পেতে গেলে আপনাকে কুশলগড়ের সদর বাজারে যেতে হবে। দেখবেন, একাধিক বাসস্ট্যান্ড থেকে হররোজ খান চল্লিশেক বাস ছাড়ছে — যাত্রী দেশান্তরি শ্রমিক, গন্তব্য গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশ। বাঁশওয়াড়া জেলায় বৃষ্টিনির্ভর চাষবাস বাদে আর জীবনধারণের কোনও পন্থা নেই, তাই পেটের দায়ে পরিযানের সমস্যাটা তুঙ্গে উঠেছে।

শহরের পাঞ্চাল মহল্লার এক সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, ছোটো ছোটো মিষ্টির দোকানে বিক্রি হওয়া চিঁড়ে আর জিলিপির মতো জলখাবারের পাশ কাটিয়ে তবেই গিয়ে উঠবেন শারদা মাকওয়ানার এক-কামরার এই দর্জির দোকান কাম বিউটি পার্লারে।

আট বছর হল স্বামীকে হারিয়েছেন। তিনি পেশায় ছিলেন ট্যাক্সিচালক, জীবনভর যকৃতের সমস্যার সঙ্গে লড়তে লড়তে শেষে হার মানেন। শারদা তাঁর সন্তানদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন, তাঁর দেওরের পরিবারও থাকে সেখানে।

অল্পবয়সে বিধবা হওয়ায় শারদার জীবন এক কাকতালীয় মোলাকাতে পাল্টে যায় রাতারাতি। “অঙ্গনওয়াড়িতে এক ম্যাডামের সঙ্গে আলাপ হয়, উনি আমায় সখী সেন্টারে গিয়ে একটা কিছু শেখার পরামর্শ দেন।” অলাভজনক এই কেন্দ্রটিতে অল্পবয়সি মেয়েরা রুজিরুটির তাগিদে নানান জিনিস শিখতে পারেন। কোনও বাঁধাধরা সময় নেই, তাই সংসারের কাজকম্ম সব সামলে নিজের সময়মতন সেখানে যেতে পারতেন। কোনওদিন একঘণ্টা, আবার কোনওদিন আবার দিনের অর্ধেকটাই কাটাতেন সেখানে। শিক্ষানবিশদের কাছ থেকে ফি বাবদ মাথা-পিছু ২৫০ টাকা করে নেওয়া হত।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

অলাভজনক সখী কেন্দ্রে অল্পবয়সি মেয়েরা রুজিরুটির তাগিদে নানান কাজে তালিম নিতে পারেন। শারদা মাকওয়ানা এখানেই সেলাই শিখেছেন

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

আট বছর আগে স্বামী মারা যান, তারপর থেকে একাই তিন ছেলেমেয়েকে মানুষ করছেন শারদা। ‘রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অনুভূতিটাই আলাদা,’ তিনি জানাচ্ছেন

“সেলাই করতে আমার দারুণ লাগে, আর আমাদের হাতে-ধরে শেখানো হয়েছে যত্ন সহকারে,” শারদার কথায় তাঁর অন্তরের কৃতজ্ঞতা টের পাওয়া যায়। ব্লাউজ ছাড়াও আর অনেক কিছু শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। “ওঁদের বললাম, যা যা পারবেন আমায় শেখান, আর মোটে ১৫ দিনে আমি সব রপ্ত করে ফেললাম!” নতুন নতুন দক্ষতার হাতিয়ারের জোরে হয়ে, চার বছর আগে নিজের দোকান খুলে ফেলেন এই উদ্যোগী মানুষটি।

“কুছ অউর হি মজা হ্যায়, খুদ কি কমাই [নিজের রোজগারের টাকা, সে এক আলাদাই মজা],” তিন সন্তানের এই মা কখনওই শ্বশুরবাড়ির ভরসায় দিন গুজরান করতে চাননি, “আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।”

ওঁর বড়োমেয়ে শিবানী এখন বাঁশওয়াড়ার একটি নার্সিং কলেজে পড়ছে, মেজমেয়ে হর্ষিতা ও ছোটো ছেলে যুবরাজ দুজনেই কুশলগড়ের একটি স্কুলে পড়ে। শারদা জানাচ্ছেন যে তাঁর ছেয়েমেয়েদের প্রত্যেকেই ১১ ক্লাসে ওঠার পর স্বেচ্ছায় বেসরকারি স্কুল ছেড়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়, কারণ “প্রাইভেট স্কুলে বড্ড ঘনঘন শিক্ষক বদলাতে থাকে।”

১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল শারদার, ওঁর বড়ো মেয়ে এই একই বয়সে পড়তেই বাড়ির লোকে জোর করে তার বিয়ে দিয়ে দেয়। অল্প বয়সি এই স্বামীহারা মহিলার হাজার ওজর আপত্তি কেউ কানে তোলেনি। তবে বিয়েটা কেবল কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে, তাই আজ মা-মেয়ে মিলে সে বিবাহ রদ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন।

শারদার এক বন্ধুও তাঁর মতো একা ছেলেমেয়েদের বড়ো করছেন। পাশের দোকানটি উঠে যাওয়ায় শারদা তাঁকেও বলে-কয়ে দর্জির দোকান খুলতে রাজি করান। “যদিও প্রতিমাসে সমান আয়-ইনকাম হয় না, তাও নিজের দু’পায়ে দাঁড়াতে পেরে বড্ড ভাল্লাগে।”

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Priti David

ப்ரிதி டேவிட் பாரியின் நிர்வாக ஆசிரியர் ஆவார். பத்திரிகையாளரும் ஆசிரியருமான அவர் பாரியின் கல்விப் பகுதிக்கும் தலைமை வகிக்கிறார். கிராமப்புற பிரச்சினைகளை வகுப்பறைக்குள்ளும் பாடத்திட்டத்துக்குள்ளும் கொண்டு வர பள்ளிகள் மற்றும் கல்லூரிகளுடன் இயங்குகிறார். நம் காலத்தைய பிரச்சினைகளை ஆவணப்படுத்த இளையோருடனும் இயங்குகிறார்.

Other stories by Priti David
Editor : Vishaka George

விஷாகா ஜார்ஜ் பாரியின் மூத்த செய்தியாளர். பெங்களூருவை சேர்ந்தவர். வாழ்வாதாரங்கள் மற்றும் சூழலியல் சார்ந்து அவர் எழுதி வருகிறார். பாரியின் சமூக தளத்துக்கும் தலைமை தாங்குகிறார். கிராமப்புற பிரச்சினைகளை பாடத்திட்டத்திலும் வகுப்பறையிலும் கொண்டு வரக் கல்விக்குழுவுடன் பணியாற்றுகிறார். சுற்றியிருக்கும் சிக்கல்களை மாணவர்கள் ஆவணப்படுத்த உதவுகிறார்.

Other stories by Vishaka George
Translator : Joshua Bodhinetra

ஜோஷுவா போதிநெத்ரா கொல்கத்தாவின் ஜாதவ்பூர் பல்கலைக்கழகத்தில் ஒப்பீட்டு இலக்கிய ஆய்வுப்படிப்பு முடித்திருக்கிறார். பாரியில் மொழிபெயர்ப்பாளராக இருக்கும் அவர், ஒரு கவிஞரும் கலை எழுத்தாளரும் கலை விமர்சகரும் சமூக செயற்பாட்டாளரும் ஆவார்.

Other stories by Joshua Bodhinetra