২০২০ সালের ১৯শে মার্চ মাসে কোভিড-১৯ অতিমারির প্রাদুর্ভাবের পর মহারাষ্ট্রের ওসমানাবাদে, অরুণ গায়কোয়াড়ের ১০ একর জমি ঊষর হয়ে পড়েছিল। “আমরা ওই সময়ে জোয়ার, চানা আর পেঁয়াজ ঘরে তুলেছিলাম,” ওসমানাবাদ তালুকের মহালিঙ্গি গ্রামে বসে বলছিলেন তাঁর স্ত্রী রাজশ্রী, বয়স ৪৮।
কিন্তু দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে সব বাজার বন্ধ ছিল। “আমরা আমাদের ফসল মাণ্ডি অবধি নিয়েই যেতে পারলাম না। ফলে সমস্ত ফসল আমাদের চোখের সামনে নষ্ট হয়ে গেল,” বললেন রাজশ্রী।
কৃষক দম্পতি অরুণ (৫৭) ও রাজশ্রী সেবার ঘরে তুলেছিলেন ১০ কুইন্টাল জোয়ার, ১০০ কুইন্টাল পেঁয়াজ, আর ১৫ কুইন্টাল চানা। সে সময়ে জোয়ারের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ছিল ২,৫৫০ টাকা, চানার প্রতি কুইন্টাল ৪,৮০০ টাকা আর পেঁয়াজ বিকোচ্ছিল প্রতি কুইন্টাল ১,৩০০ টাকায়। ফলে বীজ, সার, কীটনাশক ও অন্যান্য খরচা বাদ দিয়েও স্বামী-স্ত্রীর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াল ২২৭,৫০০ টাকায়।
তাছাড়া তাঁদের দীর্ঘ সময়ের হাড়ভাঙা পরিশ্রমও যুক্ত ছিল এই চাষের কাজে, জানালেন রাজশ্রী। “কোভিড শুরু হওয়ার ঠিক আগে ও একটা ট্রাক্টর কিনেছিল, তার মাসিক কিস্তি বাবদ ১৫,০০০ টাকা দেওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়ল। আমরা ব্যাঙ্ক থেকে চিঠি পেতে শুরু করলাম।”
কিন্তু অরুণ আশা করেছিলেন ২০২০ সালের খরিফ মরশুমে (জুলাই-অক্টোবর) এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। কোভিড-১৯ অতিমারির প্রথম ধাক্কার জের কমার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে লাগল। ও ভাবল এই বুঝি খারাপ সময় কেটে গেল। “ভাবলাম দুঃসময় কাটিয়ে আমরা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারব। বাজার-পত্তর আবার খুলতে শুরু করল,” বলনে অরুণের ৩০ বছর বয়সী জামাই, প্রদীপ ধাওলে।
গত বছর জুন মাসের শেষে, অরুণ আর রাজশ্রী নিজেদের জমিতে সোয়াবিন বুনলেন। কিন্তু অক্টোবরে, ফসল কাটার সময়ে, গোটা ওসমানাবাদে অকাল বর্ষণ নেমে এসে যাবতীয় সোয়াবিন ফসল একেবারে ধুয়ে-মুছে দিল। রাজশ্রীর কথায়, “আমাদের পুরো জমি জলে ভরে গেল। আমাদের ফসলের সামান্য কিছুও আমারা বাঁচাতে পারিনি। সে সময়ে ও আমাকে ক্ষতির আসল পরিমাণ জানতে দেয়নি, বোধহয় আমার দুশ্চিন্তা বাড়াতে চায়নি।” তাঁর মনে আছে অরুণ জানিয়েছিলেন যে ৪-৫ বছরের ধার জমে হয়েছিল ১০ লাখ টাকা।
এই ধারের কিছুটা নেওয়া ছিল তাঁদের তিন মেয়ের বিয়েতে। “কোভিডের আগেও আমাদের অবস্থা বেশ খারাপই ছিল। লকডাউন আর ভারি বৃষ্টির পর তা আরও কঠিন হয়ে যায়। মন্থন নামে আমাদের একটি ২০ বছরের ছেলেও আছে। ওর লেখাপড়ার জন্যেও আমাদের টাকা দরকার ছিল,” বলছিলেন রাজশ্রী।
অরুণ তাও আশা ছাড়েননি। ভেবেছিলেন খারাপ সময়ে অবশেষে কেটে গেল বলে। তিনি নতুন উদ্যমে নভেম্বর মাসে রবি মরশুমের চাষের জন্য কাজ করতে লাগলেন। জোয়ার আর চানা বুনলেন। প্রদীপ জানালেন, “কিন্তু ঠিক রবি ফসল তোলার সময়ে (মার্চ নাগাদ), এল কোভিড-১৯ অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ। আগের বারের তুলনায় এবারেরটা ছিল আরও ভয়াবহ। মানুষ এবার অনেক বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছিল। কেউ বাইরে বেরোতেই চাইছিল না।”
এইবার তাঁরা তুললেন ২৫ কুইন্টাল জোয়ার, আর মোটামুটি ২০ কুইন্টাল চানা। কিন্তু অরুণ আর রাজশ্রীর জীবনে ২০২০ সালের মার্চ মাসের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হল। দেশে চালু হল লকডাউন, সব বাজার বন্ধ হয়ে গেল এবং যাবতীয় মূল ফসলের দাম গেল পড়ে।
আবারও একটা বড়ো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে ভেবেই হয়তো অরুণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই বছর এপ্রিলের এক সকালে বাড়ির পাশের একটি চালা ঘরে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
অরুণ কোভিড-১৯-এর হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই দরুন যে ক্ষতি হয়েছিল তার গ্রাস থেকে রক্ষা পাননি।
২০২০ সালের মার্চ মাসে কোভিড-১৯ অতিমারির প্রাদুর্ভাব ঘটার এক বছরের মধ্যে ৭.৫ কোটি (৭৫ মিলিয়ন) মানুষ দারিদ্রের আঁধারে তলিয়ে যান — দিনে যাঁদের আয় নেমে দাঁড়িয়েছিল ২ ডলার অথবা তারও কমে। এই তথ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক পিইডাব্লিউ (PEW) গবেষণা কেন্দ্র তাদের মার্চ ২০২১-এর রিপোর্টে জানিয়েছে।
এই মন্দার স্বরূপ খুব স্পষ্টই ধরা পড়ে মহারাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান জেলা ওসমানাবাদে, এখানে কৃষিজীবীরা বিগত তিন দশক ধরেই ঋণ ও দুর্দশার সঙ্গে যুঝছেন।
এই রাজ্যের মধ্যে মারাঠওয়াড়াতেই ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে সবচেয়ে বেশি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই অর্থনৈতিক ভরাডুবির সঙ্গে দীর্ঘকালীন খরা, মন্দা ও জলবায়ুর বিবর্তনের ধাক্কা যুক্ত হয়ে কৃষকদের দুর্গতি বাড়িয়ে তুলেছে। অতিমারিকালীন পরিস্থিতি কৃষকদের চরম দারিদ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায় তাঁদের টিকে থাকার লড়াই সবদিক থেকেই দুর্বিষহ চেহারা নিয়েছে।
রমেশ চাউরে নামের ৪০ বছর বয়সী এক কৃষক অতিমারির দ্বিতীয় ধাক্কা আসার আগেই হার মেনে নেন —প্রথমটিই তাঁর মনোবল ভেঙে দিয়েছিল।
ওসমানাবাদের রঘুচিওয়াড়া গ্রামের তিন-একর জমির মালিক, রমেশ স্ত্রীর ডায়ালিসিসের জন্য টাকা ধার করেছিলেন — এই চিকিৎসার জন্য তাঁদের অন্তত মাসে একবার ৯০ কিলোমিটার দূরে লাতুর যেতে হত। “স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য অনেকটা টাকা খরচ হত,” বললেন রমেশের ৬১ বছর বয়সী কাকা, রামরাও। তিনি রমেশের পাশের বাড়িতেই থাকেন। “সেপ্টেম্বর ২০১৯-এ ওর স্ত্রী মারা যায়।”
স্ত্রীর মৃত্যুর পর রমেশ নিজের জমিতে জোয়ার ও সোয়াবিন চাষ করেছিলেন। পেটের দায়ে তিনি টেম্পোও চালাতেন আর নিজের ১৬ বছরের ছেলে রোহিতের দেখাশুনা করতেন। রামরাও জানালেন, “টেম্পো চালিয়ে মাসে ওর ৬,০০০ টাকা আয় হত। কিন্তু কোভিড-১৯-এর কারণে সেই কাজ চলে যায়। আবার চাষি হিসাবেও লোকসানের সম্মুখীন হয়েছিল।”
আর পাঁচজন কৃষকের মতো রমেশেরও নিজের ২৫ কুইন্টাল জোয়ার বেচতে না পেরে ৬৪, ০০০ টাকা লোকসান হয়ে যায়। রামরাওয়ের মতে একর প্রতি অন্তত ১২,০০০ টাকা চাষের জন্য বিনিয়োগ করায় রমেশের লোকসানে যোগ হয় আরও ৩০,০০০ টাকা।
চিকিৎসার খরচ আর চাষের কাজের জন্য ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ক্রমে বাড়তে থাকা এই ঋণের বোঝায় তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। রামরাও বলছিলেন, “ও বুঝে যায় যে সোয়াবিন চাষ ভালো হলেও ওর ধার এতো তাড়াতাড়ি মিটবে না।” গত সেপ্টেম্বর মাসে রমেশ আত্মঘাতী হন। রামরাও আরও জানালেন, “আমি চাষের খেতে গিয়েছিলাম বিকেলের দিকে, ফিরে দেখি ও পাখার থেকে ঝুলে (নিজের বাড়িতে) আত্মহত্যা করেছে। অক্টোবরের বৃষ্টি যে ওর সব ফসল ভাসিয়ে দিল তা অন্তত আর ওকে দেখতে হল না।”
এক বছরের মধ্যে মা-বাবা দুজনকে হারিয়ে রোহিত নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার তাগিদে রেশনের দোকানে কাজ করতে শুরু করে। তার কথায়, “আমি সবে ইস্কুল শেষ করেছি। এবার আমি কলেজে ভর্তি হয়ে কলা বিভাগে পড়াশুনা করতে চাই। তারপর দেখা যাক সামনে কী আছে।”
অর্থনৈতিক ভরাডুবির সঙ্গে দীর্ঘকালীন খরা, মন্দা ও জলবায়ুর বিবর্তনের ধাক্কা যুক্ত হয়ে কৃষকদের দুর্গতি বাড়িয়ে তুলেছে। অতিমারিকালীন পরিস্থিতি কৃষকদের চরম দারিদ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায় তাঁদের টিকে থাকার লড়াই সবদিক থেকেই দুর্বিষহ চেহারা নিয়েছে
কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ফল হয়েছে সুদূরপ্রসারী।
এর ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বীড জেলার ধারুর তালুকে কৃষি সেবা কেন্দ্রের মালিক, ৩১ বছর বয়সী শ্রীকৃষ্ণ বাধে। ওসমানাবাদ শহর থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরে, দেবদহিফল গ্রামে তাঁর দোকানে বীজ, সার, কীটনাশক বিক্রি হয়। তাঁর ২৪ বছর বয়সী তুতো ভাই খাণ্ডু পোটে বলছিলেন, “অনেক সময়ে কৃষকরা এগুলি ধারেই নিয়ে যান, চাষের মরশুম শেষ হলে ফসল বেচে ধার শোধ করে দেন।”
কিন্তু, পোটে জানালেন যে বেশিরভাগ কৃষকই অতিমারির প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বাধের ধার শোধ করতে পারেননি। “শ্রীকৃষ্ণের নিজেরও পাঁচ একর চাষের জমি আছে। কাজেই ও জানে কৃষকরা মিথ্যা বলছেন না। কিন্তু যাদের কাছে থেকে ও পণ্য নিয়ে এসেছে তাদের বকেয়া টাকা মিটিয়ে দিতেই হত। এই টাকা মেটানোর জন্য ধার করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তা সম্ভবপর হয়নি।”
বাধের উৎকণ্ঠা ক্রমে বাড়তে থাকে। ২০২১ সালের মে মাসে তিনি নিজের চাষের জমির একটি গাছ থেকে দড়ি বেঁধে গলায় ফাঁস লাগান। পোটে বলছিলেন, “আরও একটা লোকসান আর হতাশা ভরা মরশুম এগিয়ে আসছে বলে ও ভয় পাচ্ছিল। আসলে লোকসান মেটানোর জন্য চাষের কাজ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় চাষিদের কাছে নেই।”
রাজশ্রীরও সেই একই পরিকল্পনা। তাঁর কথায়, “আমরা সোয়াবিনের মরশুমের শুরুতে (২০২১) ১ লাখ টাকা ধার করেছিলাম। মরশুমের শেষে, ফসল তুলে ধার শোধ করব। ধীরে ধীরে ধার কমিয়ে আনা ছাড়া আর তো কোনও উপায় আমাদের নেই।”
সুতরাং রাজশ্রীকে এবার ভালো ফসল পেতেই হবে। ইতিমধ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর মেয়ে আর জামাইয়েরা। পরিস্থিতি ক্রমে বদলাচ্ছিল। কিন্তু গুলাব সাইক্লোনের ফলে মারাঠাওয়াড়ায় সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ভারি অকাল বর্ষণ হওয়ার পর পরিস্থিতি যে সত্যিই বদলাচ্ছে একথা রাজশ্রীর সন্ত্রস্ত মন বিশ্বাস করতে পারছে না।
এই প্রতিবেদনটি পুলিৎজার সেন্টারের সহায়তাপ্রাপ্ত একটি সিরিজের অংশ।
অনুবাদ: চিলকা