বন্ধু কষ্ট দিলে কেমন ভাবে সে ব্যথা ভোলার তরে পরিবার তথা মায়ের কাছে বারবার ফিরে যান , সেটাই গানের মাধ্যমে তুলে ধরছেন মুলশি তালুকের শাহু কাম্বলে

বন্ধু যদি বিশ্বাসঘাতক হয়, হৃদয় যদি ভেঙে ছারখার করে দেয় সই, তাহলে এক নারী কী করে জানেন? গ্রামীণ মহারাষ্ট্র হলে, কয়েক দশক আগে অবধি বন্ধুর হাতে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া সে বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসত খানকতক ওভি। সেদিনকার ভাগের শস্যদানা জাঁতাকলে গুঁড়ো করতে করতে গেয়ে উঠতেন দোহার ওই গুচ্ছটি। ঠিক এমনটাই করেছিলেন শাহু কাম্বলে।

এক পড়শি মহিলা, যিনি তাঁর সখীও বটে, তার দুর্ব্যবহারের জ্বালা ২৬টি গানের মাঝে তুলে ধরেছিলেন প্রয়াত শাহু কাম্বলে। নিজেই সুরও দিয়েছিলেন। তারই প্রথমটায় বলা আছে:

বেকার বলি গোপন কথা পড়শি কাকির সনে,
আম্মা হলে রাখতো সেসব বাইন্ধা বুকের কোণে।

শুধুই বিশ্বাসঘাতকতা নয়, সখীর ক্ষুরধার কথায় ভিতরটা ফালা-ফালা হয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙেছে দুটি চোখে তাঁর, দিন কেটে রাত গড়ালেও কিছুতেই থামছে না সে অশ্রুধারা। ওভির তালে পড়শিকে তাই জানাচ্ছেন:

ভালো নাহি লাগে তোর তিতকুটে কথা,
দুলকি হাওয়ার টানে ছেঁড়া কলাপাতা।

পড়শির সম্পদের জেল্লা বিরাট, গলায় আর দু'হাতে মহার্ঘ্য সোনার গয়না পরে ঘুরে বেড়ায় সে। তাই গয়িকা জানাচ্ছেন, তাঁর কাছে তাঁর ছেলে-মেয়ের মূল্য ও ঔজ্জ্বল্য যে কোনও গয়নার চেয়ে শতসহস্র গুণ বেশি। দুই সখীর বন্ধুত্বে বোধহয় ফাটল ধরেছে, হয়ত বা এর জন্য দায়ী তাঁদের শ্রেণিগত পার্থক্য।

বন্ধু কষ্ট দিলে বাড়ির লোকজনই হয়ে ওঠে হৃদয়ের মলম। ফেলে আসা সমুদ্রবিহারের কথা মনে পড়ে তাঁর, একবার খুঁজে পেয়েছিলেন "মাছে ভরা ঝিলমিলি ঝুড়ি", আরেকবার "আঁজল তলে মুক্তা" এসেছিল ভেসে। এমনতর রূপকেই ফুটে ওঠে খুকি-খোকার প্রতি মায়ের ভালোবাসা।

Shahu Kamble's sons, daughters-in-law and grandchildren in Nangaon village. Her sister-in-law and friend Kusum Sonawane, who also sings grindmill songs, is standing third from the left
PHOTO • Samyukta Shastri

নন্দগাঁও গ্রামে শাহুবাই কাম্বলের পুত্র, পুত্রবধু এবং নাতিনাতনিরা। বাঁদিক থেকে তৃতীয় ব্যক্তিটি হলেন শাহুবাইয়ের ননদ তথা সই কুসুম সোনাওয়ানে, তিনি নিজেও জাঁতা পেষাইয়ের গান করেন

গানে গানে অন্যের মুখাপেক্ষি হতে নিজেকে বারণ করছেন বটে, তবে সারা দুনিয়ায় একমাত্র মায়ের কাছেই নির্দ্বিধায় যে হাত পাতা যায়, একথাটাও বলতে ছাড়ছেন না গীতিকার। সাগর শুকায়ে যায়, তৃষা নাহি মেটে হায়, তখনই স্বর্গ হতে গঙ্গারূপে নেমে আসে আম্মা। পরবর্তী ওভিতে পূর্ণতোয়া চন্দ্রভাগা নদীর সঙ্গেও মায়ের তুলনা টানছেন কবি। মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলা দিয়ে বয়ে চলা এই নদীটি ভীমা নামেই বেশি পরিচিত। 'মাঝে মাহের পন্ধরি ' অভঙ্গ দ্বারা এই নদীটিকে 'পাপহর' রূপে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর ভক্তিবাদী কবি সন্ত একনাথ।

এই ওভি গুচ্ছের শেষ ১০টি দোহায় মায়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও অটুট বিশ্বাস অমর করে রেখেছেন গায়িকা। একটি ওভিতে বলছেন, পড়শির থেকে কর্জ করলে যতদিন না শোধ হচ্ছে তার পাই-পাই হিসেব রাখতে হয় ঠিকই, তবে মায়ের ক্ষেত্রে এমনটা করার কোনও প্রয়োজন নেই। আরেকটি ওভিতে আমসুল, অর্থাৎ শুকনো কোকুমের (ম্যাঙ্গোস্টিন জাতীয়) সঙ্গে তুলনা করছেন মায়ের। স্বাদবর্ধক হিসেবে টকমিষ্টি এই উপকরণটি খাবারদাবার তথা পানীয়র সঙ্গে মেশানো হয়।

"মায়ের হাতের রান্নার জন্য বড্ডো মন-কেমন করে," বলে উঠছেন গায়িকা, বিয়ের পর মা-বাবাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট আজও ভোলেননি। দক্ষ হাতে ঘরকন্না সামলানো, যাতে অযথা অপচয় না হয় – এসব তিনি মায়ের থেকেই শিখেছেন। শস্য কেমন করে মিহি করে গুঁড়ো করতে হয়, যাতে পরিমাণটাও বাড়ে, আর বেশি করে ভাকরও (হাতে গড়া একপ্রকারের রুটি) বানানো যায় – মায়ের কাছে শেখা সুখী গেরস্থালির রহস্য এটাই।

ওভির এই গুচ্ছে শাহুবাইয়ের বার্তাটি বেশ পরিষ্কার: বাইরের জগৎ এক নারীকে যতই আঘাত দিক না কেন, তাঁর সে ক্ষতে মলম লাগানোর জন্য সর্বদা হাত বাড়িয়ে আছে তাঁর পরিবারের ভালোবাসা ও মায়ের স্নেহ।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পারি জিএসপি টিম শাহুবাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর গ্রামে (নন্দগাঁও) গিয়েছিল বটে, কিন্তু গীতিকারের দেখা মেলেনি; তার ঠিক আগের বছরই তিনি মারা গিয়েছিলেন যে। তবে শাহুবাইয়ের বাঁধা কিছু সুরের কথা জানতে পারি তাঁর ননদ, প্রিয়সখী ও জাঁতাপেষাইয়ের গানের আরেকজন ওস্তাদ কুসুমতাই সোনাওয়ানের থেকে। "নিত্যনতুন ওভি লিখে মিঠে সুর বসাতে ওস্তাদ ছিলেন তিনি। কোন ওভিতে কোন গালা-টা [সুর] যাবে, এটা আপনা থেকেই বুঝে যেতেন। এমনটা মোটেও সব মহিলার দ্বারা হয় না," বলেছিলেন কুসুমতাই।

পরতে পরতে সাজানো রূপকের মায়া তো আছেই, তবে 'নেসালে গা বাই, আজ শালু বানারসি ' বলে জনপ্রিয় একটি গৌলানের সুরে গেয়ে উঠেছিলেন শাহুবাই, তাই যেন সোনায় সোহাগা হয়ে উঠেছে ওভির এই গুচ্ছটি। পরবর্তী যে ওভিটি গাওয়া হবে, তাতে অসামান্য নিজস্বতার সঙ্গে সুর বসিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি।

শাহু কাম্বলের কণ্ঠে ওভিগুলি শুনুন:

বেকার বলি গোপন কথা পড়শি কাকির সনে,
আম্মা হলে রাখতো সেসব বাইন্ধা বুকের কোণে।

গোপন কথা সবার মাঝে ফাঁস করে দেয় পড়শি রে,
আম্মা, তাহার নামটি কশী, বাইন্ধা পাঁজর রাখবে সে।

আগডুম বাগডুম যা যা বলেছিলি, আঁশটে কুচুটে তোর জ্বলনের বুলি,
ঝগড়ুটি ঠোঁটে তোর করাতের ধার, আমার ভিতর পুড়ে হ'ল ছারখার।

হিংসুটে বুলি তোর মাকড়ের জাল, আমার পাঁজর কেটে হ'ল ফাল-ফাল,
একে একে দিন যায় রাতের অতল, থামিতে না চাহে দেখি নোনা আঁখিজল।

ভালো নাহি লাগে তোর তিতকুটে কথা,
দুলকি হাওয়ার টানে ছেঁড়ে কলাপাতা।

হাড় জিরজির চুড়ের ছিরি পড়শি রে তোর হাতখানি,
আয় লো সখী আমার বাড়ি, দেখ্ রে সোনার ঝলকানি।

ওই তো গহনা তোর, নাই ছিরিছাঁদ, তাতেও গুমর বড়ো ভাঙিলা রে বাঁধ,
খোকা-খুকি সোনা মোর, দেখবি তো আয়, ক্যামনে দুয়ার পারে ঝিকিমিকি যায়।

চান্দেরি শাড়ি আর গয়না দুলায়ে, বসিস না পাশে মোর ঠেস দিয়া গায়ে,
সাতরাজা ধন মোর খোকা-খুকি দুই, এমন ব্রকেড পাড় দেখেছিস তুই?

মোহর জোড়া সোনার তোড়া মন গেলে সই পরি,
চন্দ্র যে হার খোকাই আমার, আপসে নয়ন ভরি।

বেজেড়া* দুনিয়া হতে মুক্তি যে চায়, একটি বিটির তরে ন'মাস কাটায়,
সাতরাজা ধন ওগো মাইয়া আমার, দুলিছে গলায় যেন চন্দ্র সে হার।

গলায় বাঁধা সোনার পুঁতি, সাতরাজা সব ধন্যি যে,
চাঁদিম সে হার খোকাই আমার, গলায় দোদুল দুলছে রে।

সিঁথির তরে দিস রে সিঁদুর, দেওতা রে তুই প্রার্থনার,
অনন্তকাল না চাই আমি, এক-দুটো দিন থাক না আর।

ভ্যাবলা রে মন পরের তরে মুখ চেয়ে আর থাকিস নে,
আর্তি বেলার বুদ্ধ আমার, খোকনকে দিস শক্তি রে।

পরের দুয়ার তলে রইলি আশার ছলে, হায় রে জিওনপাখি আলভোলা বোকা,
বুদ্ধ তোঁহার পায়ে, আর্তি রাখিলা ঠায়ে, পায় গো শকতি যেন সোনা মোর খোকা।

একটি পোলার তরে পাতিয়া মাগন, অকূল দরিয়া পারে গিয়াছিল মন,
আঁচল করিয়া আলো আইলো রে ছুঁড়ি, ঠিক যেন মাছে ভরা ঝিলমিলি ঝুড়ি।

এই তো সেদিন ইচ্ছা হ'ল সাত সাগরের পার... ডুবকি দিয়া ফিরবো নাহয় একলা গাঁয়ের ধার,
হঠাৎ দেখি আঁজল তলে মুক্তা এলো ভেসে... আর কেহ নয়, খোকন রে মোর, ঢেউছড়ানির বেশে।

মেটে না তেষ্টা ওগো মেটে না তেষ্টা, গেছে সাগর শুকায়ে...
আসমানি দার ভেদি আম্মা আমার নামে ভাগীরথী পায়ে।

শুখা সে দরিয়া তল, আঁজলা ভরিয়া জল কোথা বলো পাই?
পিপাসা মেটার দেশে চন্দ্রভাগার বেশে আমাদের আই**।

ইতিউতি ডাক দিলে "আম্মা গো আম্মা", মন রে সে জন কভু আম্মা কি হয়?
পড়শি মাসির সনে যতই তুলনা করি, মন রে সে জন তবু আম্মা তো নয়।

মোড়ক ভরা কোকুম যেন মিত্তি আমার মা,
জন্ম নিছি আমসুলেতেই, ভেল্কি দেখে যা!

আই বলি আই ধন্যি মা গো চন্দ্র সোনার হার...
রাখ দেখি তোর কষ্টিপাথর, নাই প্রয়োজন আর।

পড়শি সে জন কর্জ দিলে হিসেব কতই করি,
মায়ের থেকে চাইতে গেলে রাখতে হিসেব নারি।

পড়শি সে জন কর্জ দিলো, পাই গুনে পাই রাত পোহালো, নামলো দেনার ভার...
চাই রে যদি মায়ের থেকে, হিসাব তাহার কেই বা রাখে জীবন মোহনার?

চৌকাঠে বসে রই, পড়শি সে গে'ল কই? চাইতে হবে রে দুটো পয়সা আবার...
জনম লগন হতে নিয়াছি দু'হাত পেতে, হিসাব না রাখিলা গো আম্মা আমার।

সই রে একটু দাঁড়া, মিহি করে কর গুঁড়া, একটি ভাকার বেড়ে হবে দেড়খান,
মায়ের আঁচল ধরে, শিখেছি যতন করে, কাঙালির সংসারে জাঁতা ভগবান।

মিহি সে জনার গুঁড়ি, বেলে রাখি তাড়াতাড়ি, গোলচে ভাকার হবে বড়ই সোঁদর...
মেয়েবেলা বড*** দূর, মায়ের হাতের সুর, উনানে বাঁধিয়া দিতো গেরস্থ ডোর।

* বেজেড়া: বিটকেল/কষ্টকর (বাঁকুড়া জেলার কথ্য ভাষা)

** আই: মা (মারাঠি)

*** বড: বড্ডো (বাঁকুড়া জেলার কথ্য ভাষা)


Shahu Kamble

গায়িকা/পরিবেশিকা : শাহু কাম্বলে

গ্রাম : নন্দগাঁও

তালুক : মুলশি

জেলা : পুণে

জাতি : নববৌদ্ধ

বয়েস : ৭০ (জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালের অগস্ট মাসে মারা যান তিনি)

সন্তান : দুটি মেয়ে ও দুটি ছেলে

পেশা : চাষি ও জন্ম সহায়িকা ধাত্রী

তারিখ : ওভি ও তার সঙ্গে প্রকাশিত গদ্যাংশের তথ্যবিশেষ রেকর্ড করা হয় ৫ই এপ্রিল, ১৯৯৯ সালে। ১১ই সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে ছবিগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে।

পোস্টার: উর্জা

হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ ' র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

नमिता वाईकर लेखक, अनुवादक आणि पारीच्या व्यवस्थापकीय संपादक आहेत. त्यांची ‘द लाँग मार्च’ ही कादंबरी २०१८ मध्ये प्रकाशित झाली आहे.

यांचे इतर लिखाण नमिता वाईकर
PARI GSP Team

पारी-जात्यावरच्या ओव्या गटः आशा ओगले (अनुवाद), बर्नार्ड बेल (डिजिटायझेशन, डेटाबेस डिझाइन, विकास, व्यवस्थापन), जितेंद्र मैड (अनुलेखन, अनुवाद सहाय्य), नमिता वाईकर (प्रकल्प प्रमुख, क्युरेशन), रजनी खळदकर (डेटा एन्ट्री)

यांचे इतर लिखाण PARI GSP Team
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र यांनी जादवपूर विद्यापीठातून तुलनात्मक साहित्य या विषयात एमफिल केले आहे. एक कवी, कलांविषयीचे लेखक व समीक्षक आणि सामाजिक कार्यकर्ते असणारे जोशुआ पारीसाठी अनुवादही करतात.

यांचे इतर लिखाण Joshua Bodhinetra