“ভারতে আরেকটি ভয়াবহ গণধর্ষণের ঘটনা ঘিরে সংবাদ শিরোনাম ছয়লাপ,” এভাবেই শুরু হয় গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে দি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সম্পাদকীয়। “এবার ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রাম পরিষদ শাস্তি হিসেবে ধর্ষণের নিদান দিয়েছে। অপরাধ: প্রেমে পড়ে বিয়ের পরিকল্পনা।” আইনের এই নির্লজ্জ অবমামনার বিরুদ্ধে ওই সম্পাদকীয়তে “কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে।” এর আগে, গত জানুয়ারিতেও একইরকম ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছিল।
কিছু হেডলাইনের নমুনা: “পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় ক্যাঙ্গারু কোর্ট ১২ জন আদিবাসী মহিলাকে ধর্ষণের নির্দেশ দিয়েছে” (হিন্দুস্তান টাইমস), “গণধর্ষণের রিপোর্টগুলো গ্রামীণ ভারতের খাপ প্রশাসনকে তুলে ধরছে” (ব্লুমবার্গ), “ভারতে প্রবীণ গ্রামবাসীরা দিচ্ছেন গণধর্ষণের নির্দেশ” (স্কাই নিউজ), “পশ্চিমবঙ্গ গণধর্ষণ মামলা: গোটা গ্রামের সামনে বাঁশের মাচায় আক্রান্ত এক তরুণী” (দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট) “ভারতীয় মহিলার গণধর্ষণে অভিযুক্ত তামাম গ্রাম” (বেইরুটিং.কম)। সংবাদমাধ্যমের এই রগরগে প্রতিবেদনগুলোর জেরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেকেই আদিবাসী এবং গ্রাম পরিষদগুলিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন – দ্বর্থ্যহীন ভাষায় বলা হচ্ছে এদের ‘আদিম’ রকমসকমই যাবতীয় বর্বরতার জন্য দায়ি।
আসল গল্পটা : এই সমস্ত রিপোর্টগুলোর মূল উপাদান সম্ভবত ভুয়ো। এই মামলায় অনেক আলগা মন্তব্য করা হয়েছে, যার অনেকগুলিই করেছে পুলিশ, সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টেও রকমফের আছে। ঘটনাগুলো সম্পর্কে নানা ধরনের বয়ান বাতাসে ভাসছে। এছাড়া জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে যে, গ্রামের মাঝি অর্থাৎ সাঁওতাল মোড়ল বলাই মার্ডি ঘটনার দিন রাতে গ্রামে আদৌ উপস্থিত ছিলেন না। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, যে সমস্ত প্রমাণগুলো মিলেছে তাতে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সুবলপুর গ্রামে বিমলা (আসল নাম নয়) নামে কোনও একজন মহিলাকে ধর্ষণের নির্দেশ দিয়েছিল জনৈক ব্যক্তি এই মর্মে ওঠা মূল অভিযোগটাই ধোঁপে টিকছে না।
ঘটনার দিন রাতে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী বয়ানের ফলে প্রকৃতপক্ষে কী হয়েছিল তা হয়তো কখনও জানা যাবে না। যাবতীয় বিষয় খতিয়ে দেখে এই প্রতিবেদক মনে করছেন, বিমলাকে সে রাতে খুব সম্ভব ধর্ষণ করা হয়েছিল, তবে এই ঘটনার পিছনে গ্রাম পরিষদের নির্দেশ ছিল না। এর বাইরে আরেকটা ব্যাপার হল – এইসব তথ্য থেকে এ কথা স্পষ্ট হচ্ছে যে কেমন করে উদ্বেগজনকভাবে ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলেছে এবং এর একটা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যাও হাজির করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিউ ইয়র্ক টাইমস নিছক একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ওই গণধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে একটি নিবন্ধও প্রকাশ করেছে । অথচ নিরাপত্তা বাহিনী এবং সহযোগী মিলিশিয়ার দ্বারা মধ্য ভারতে শত শত আদিবাসী মহিলার উপর যে যৌন নিপীড়নের ঘটনা চলছে, সংবাদমাধ্যম সচরাচর তা প্রকাশযোগ্য খবর হিসেবে গণ্যই করে না।
বীরভূমের ঘটনা এতটা নাড়িয়ে দিয়েছে কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তথাকথিত “ক্যাঙ্গারু কোর্ট” যা ভারতের গ্রামগুলোর অনগ্রসরতার নমুনা। অতএব সভ্যভব্য হয়ে ওঠার জন্য একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়নের আলো একান্তই জরুরি হয়ে পড়েছে। এনওয়াইটির সম্পাদকীয় এর ব্যাখ্যা দিচ্ছে: “ভারতের লাগাতার আধুনিকীকরণ তরুণীদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সুযোগ এবং মুক্তি যা কিনা পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্যের এইসব স্বঘোষিত অভিভাবকদের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
পশ্চিমবঙ্গে আদালতের শ্লথগতির জন্যে এই মামলার নিষ্পত্তি হতে মাসের পর মাস লাগবে অথবা হয়তো বছরের পর বছরও লাগতে পারে। এদিকে বৃদ্ধ মাঝি-সহ ১৩ জন অভিযুক্ত ইতিমধ্যেই কারাগারে। “আমাদের সম্প্রদায়কে বদনাম করতে রাজনীতিকরা গোটা ঘটনার অভিমুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে,” হতাশভাবে বললেন দিশম-মাঝি অর্থাৎ ভারতের সাঁওতালদের সর্বোচ্চ নেতা তথা ভারত জাকাত মাঝি মান্ডুয়ার (বিজেএমএম) প্রধান নিত্যানন্দ হেমব্রম। বিজেএমএম সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রধানদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন। “আমি জানি না কেমন করে আমাদের এই বদনাম ঘোচাবো।”
খুব কাছ থেকে দেখে পর্যবেক্ষকদের অভিমত, এতে নারীর ক্ষমতায়নের পরিবর্তে ভারতের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে উন্নয়নের অছিলায় আদিবাসী সমাজকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে ধর্ষণ, যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানো এবং পাচার চলছে স্থানীয় খনি এলাকাগুলোতে - এর ফলে এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে যৌন আগ্রাসন আশঙ্কজনকভাবে বাড়ছে। “কোনও সমাজ যখন আক্রান্ত হয়, সেসময়ে নিজেকেই আক্রমণ করতে শুরু করে সেই সমাজ, মহিলারা আক্রান্ত হন,” এই পর্যবেক্ষণ বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ ফেলিক্স প্যাডেলের। “আধুনিকতা, খনিখনন, সংবাদমাধ্যম, রাজনীতি এবং হিংসাত্মক সংঘাতও বিধ্বংসী চেহারা নেয় এক্ষেত্রে।” এধরনের হামলার ঘটনায় আশকারা না দিয়ে আদিবাসী সমাজের প্রথাগত শাসনতন্ত্র আদতে যৌন তথা অন্যান্য হিংসা যা সমসাময়িক ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোকে ক্ষতবিক্ষত করছে, তাতে রাশ টানার প্রয়াস-ই নিয়েছে।
* * *
বিমলা পুলিশ প্রহরায় রয়েছেন, এবং বর্তমানে তিনি সুবলপুরে নেই। ইতিমধ্যে, বীরভূমের ধর্ষণ ঘিরে অন্তত তিন ধরনের বয়ান পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিক বয়ান অনুসারে, ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি বীরভূম জেলার বোলপুরের নিকটবর্তী একটি থানায় দায়ের হয় বাংলায় লেখা ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) যেটিতে সুবলপুর গ্রামের বাসিন্দা সাঁওতাল তরুণী বিমলার টিপসই ছিল।
ওই এফআইআর অনুযায়ী, ২০ বছরের বিমলার বিয়ে ঠিক হয়েছিল শেখ খালেক নামে সাঁওতাল সম্প্রদায় বহির্ভূত এক যুবকের সঙ্গে। ইমারতি ক্ষেত্রে রাজমিস্ত্রি হিসেবে কর্মরত তিনি। ২০ জানুয়ারি সোমবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ তিনি বিমলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় সাঁওতাল গ্রামবাসীরা তাঁদের মাঝি বলাই মার্ডির নেতৃত্বে যুগলকে আটক করে বেঁধে রাখে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে জাতের বাইরে (কৌম, বর্ণ বা জাতি) বিয়ের পরিকল্পনার অভিযোগ তোলে। এজন্যে যুগলের ২৭ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য হয়, যা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না তাঁদের। এরপর মার্ডি গ্রামবাসী পুরুষদের নির্দেশ দেন: “তোরা ওকে ভোগ কর গিয়ে, যা ইচ্ছে তাই কর।” মার্ডি নিজে আরও ১২ জনের সঙ্গে বিমলাকে সেই রাতে ধর্ষণ করেন। পরদিন সকালে যুগলকে ছাড়া হয়, আর এই মর্মে হুমকি দেওয়া হয় যে, পুলিশকে ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানালে বিমলার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হবে। ফলে বুধবার পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি জানানোর সাহস পাননি বিমলা।
সামান্য তারতম্য ছাড়া মোটের ওপর এই কাহিনিই তামাম বিশ্বের সামনে উঠে এসেছে। সুবলপুরের অন্যান্য সাঁওতাল মহিলারা অবশ্য ঘটনা সম্পর্কে আলাদা কথা বলেছেন। প্রথমত তাঁদের দাবি, বিমলাকে তাঁর নিয়োগকর্তা তথা প্রেমিক, দুই সন্তানের পিতা এবং ইতিমধ্যেই বিবাহিত খালেকের সঙ্গে একত্রে পাকড়াও করার উদ্যোগ তাঁরাই নেন। “বেজাতের কোনও মরদকে আমরা আমাদের ঘরে ঢোকার অনুমতি দিই না,” রাখঢাক না করেই বলে দেন মল্লিকা টুডু। সেই সন্ধ্যায় তাঁরা যখন দেখলেন খালেক সাক্ষাৎ করতে এসেছেন, তখন মল্লিকার কথায়, “আমরা গাঁয়ের মায়েদের কাছে এই কথা চাউর করে দিই যে মুসলমান ঢুকেছে, তারপর আমরাই পুরুষদের ডেকে নিয়ে আসি।”
গ্রামবাসীরা বিমলার কুঁড়েঘরে ঢোকেন, প্রেমিক-প্রেমিকা তখন বিছানায় শুয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা তাঁদের টেনে বের করে মাঝির বাড়ির সামনে একটি খেজুরগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। মাঝি সেদিন এক বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গ্রামের বাইরে গিয়েছিলেন, এজন্যে গ্রামবাসীরা পরদিন সকালে তাঁর ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। টুডুর কথায়, “আমরা চেয়েছিলাম লোকটা ওকে বিয়ে করে আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যাক। (যদিও খালেক ইতিমধ্যেই বিবাহিত, তবু এই মহিলারা জানতেন যে ভারতীয় মুসলমান পুরুষ আইনত একাধিক স্ত্রী রাখতে পারেন) আমরা সারারাত সবাই মিলে ওদের পাহারা দিয়েছি। কিছুই হয়নি, ধর্ষণের কোনও ঘটনা ঘটেনি।“ গ্রামবাসীরাও একই কথা বলেছেন। ঘটনার খবর জানাজানির পরে তাঁরা একজন তদন্তকারীকে জানিয়েছেন, সেই রাতে ওঁরা বিমলাকে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য পাহারা দিতে পারেননি। পরে অবশ্য এই বক্তব্য তাঁরা প্রত্যাহার করে বলেছেন বিমলাকে সারারাত পাহারা দেওয়া হয়েছে।
গ্রামবাসীদের বক্তব্য অনুযায়ী, পরদিন সকালে, অর্থাৎ মঙ্গলবার মাঝি গ্রামে ফেরেন। ফিরে আসেন নির্বাচিত গ্রাম পরিষদ তথা পঞ্চায়েতের সদস্যরা। এঁদের সকলেই বাঙালি অর্থাৎ এঁরা কেউই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ নন এবং সকলেই তৃণমূল পার্টি করেন। গ্রামে আসেন খালেকের আত্মীয়রাও। (বীরভূমে অনেক গ্রামে সাঁওতাল পল্লি রয়েছে এবং এর সংলগ্ন এলাকায় আছে বাঙালি পল্লি। বাঙালিরাই সাধারণত গ্রাম পঞ্চায়েতগুলোর নিয়ন্ত্রক। তাছাড়া নির্বাচিত গোষ্ঠীই যেহেতু মহাত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন এবং অন্যান্য উন্নয়ন সংক্রান্ত যাবতীয় তহবিল বিতরণের দায়িত্বে, স্বভাবতই দরিদ্র সাঁওতাল মাঝিদের চেয়ে এই গোষ্ঠীর কর্মকর্তারা বহুগুণ ক্ষমতার অধিকারী।) পঞ্চায়েত সদস্যরা কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটা রফা করেন। খালেক যেহেতু বিমলাকে বিয়ে করতে রাজি হননি, তাই তাঁর ২৫ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়। জরিমানার টাকা খালেকের ভাই দিলে তা সাঁওতালদের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে স্থির হয়। বিমলার ক্ষেত্রেও ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হলেও প্রদেয় অর্থ বিমলার ছিল না। তবে অন্য এক গ্রামের বাসিন্দা, বিমলার দাদা টাকাটা দিতে এগিয়ে আসেন। “আমরা না কোনও মীমাংসা করেছি আর না আমরা টাকা চেয়েছি,” টুডু স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে খালেক বিমলাকে বিয়ে করতে না চাইলে, বাঙালিরাই তার হয়ে টাকা দিয়ে ঝামেলা মেটাতে উদ্যোগ নেন। তারপর, সেদিন দুপুরেই ধৃতদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
সুবলপুরের মহিলারা যতদূর জানতেন ইতিমধ্যেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছিল। অথচ পরদিন বুধবার, ২২ তারিখ পুলিশ গ্রামে এসে পৌঁছায় এবং পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। বাদবাকি গ্রামবাসীরা থানায় খবর নিতে এলে পুলিশ আরও আটজনকে ডেকে এনে গ্রেফতার করে। তিনটি খুনের মামলায় অভিযুক্ত তৃণমূলের কুখ্যাত এমএলএ মনিরুল ইসলাম সেদিনের শুনানিতে সভাপতিত্ব করেছিলেন বলে মহিলারা জানালেন। তাঁদের কথায়, “আমরা ওঁকে কাগজ দেখিয়েছিলাম [যা ছিল আমাদের কাছে]।“ এই প্রতিবেদক হাতে বিমলা ও খালেকের অবৈধ যৌনসম্পর্কজনিত গোলমালের মীমাংসা সংক্রান্ত হাতে লেখা ওই কাগজের অ্যাটেস্টেড করা একটি প্রতিলিপি স্বচক্ষে দেখেছেন। এটিতে তৃণমূলের দুই পঞ্চায়েত সদস্যের সই আছে, সেইসঙ্গে স্বাক্ষর আছে খালেক ও তাঁর ভাইয়ের। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, মঙ্গলবার সকালে বিচার হয়েছিল, যদিও এফআইআরের সঙ্গে বিষয়টি অসঙ্গতিপূর্ণ। “এ ব্যাপারে মনিরুলের বক্তব্য, ‘এর কোনও গুরুত্ব নেই। যদি বেশি বাড়াবাড়ি কর, তাহলে কারও ঘাড়ের উপর মাথা থাকবে না,’” টুডু জানালেন।
বিজেএমএম-এর জনৈক প্রতিনিধি তথা এই ঘটনার তদন্তকারী অন্য একটি প্ৰেক্ষিতও তুলে ধরেছেন। তাঁর বয়ান মাফিক, কয়েক বছর আগে বিমলা ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা একজন সাঁওতাল পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যান। সেই ব্যক্তি বিমলাকে বিয়ে না করে দিল্লিতে পাচার করে দেয়। এরপর বিমলাকে তাঁর সাঁওতাল অপহরণকারীর অন্য এক আত্মীয় উদ্ধার করেন (যিনি মর্মাহত হয়েছিলেন তাঁর পরিজনের আচরণে)। তিনি ঘটনার পূর্ববর্তী বর্ষার মরসুমে ২০১৩ সালে সুবলপুরে ফিরে আসেন। এরপর বিমলা খালেকের নির্মাণ সংস্থায় কাজ শুরু করেন। গ্রামবাসী মহিলাদের মনে ক্রমে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে যে বিমলা যৌনকর্মের সঙ্গে যুক্ত আর তাঁদের স্বামী ও সন্তানদের যৌন চাহিদা মেটান বিমলা। এরপর তাঁরা বিমলার সঙ্গ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে বহিরাগত খালেকের সঙ্গে বিমলার বিয়ে দেওয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি করেন। ২০ জানুয়ারি রাতে গ্রামের মাঝি অনুপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন বিজেএমএম-এর এক প্রতিনিধি। সুবলপুর গ্রামের বাসিন্দারা দাবি করেছেন, পাকড়াও করার পরে সেদিন রাতে বেশিরভাগ সময়ই ওঁদের পাহারা দিয়েছিলেন তাঁরা। তবে যে সমস্ত সাঁওতাল পুরুষ সেদিন বিমলাকে ধরে রেখে পাহারা দিয়েছিলেন, তাঁরা রাতে মদ্যপান করতে শুরু করেন এবং প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের জন্য মহিলাদের সরিয়ে দিয়েছিলেন ঘটনাস্থল থেকে। সেইসময়ে বিমলার ধর্ষণ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
যে ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম দেবরাজ মণ্ডল বাঙালি হলেও অন্য সকলেই সাঁওতাল (সন্দেহের অবকাশ থাকছে মণ্ডলকে নিয়ে যিনি একাধারে সুবলপুরের সাঁওতালদের রক্ষক ও শোষক। তিনি সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের সহায়তা করতেন এবং মনরেগায় কাজ করে পঞ্চায়েত থেকে মজুরি না পেলে বকেয়া পাওনার ব্যাপারে আদিবাসীদের হয়ে সওয়াল করতেন। কিন্তু তিনিই আবার বেআইনিভাবে গ্রামবাসীদের মদও সরবরাহ করতেন।) পুলিশ জানিয়েছে, তাদের কাছে একটি ক্যামেরা আছে যা দিয়ে মণ্ডল অন্তরঙ্গ অবস্থায় বিমলার দুটি ছবি তুলেছিলেন। একটি ছবি খালেকের সঙ্গে এবং আরেকটি অন্য এক পুরুষের সঙ্গে যাঁর মুখ অস্পষ্ট, তবে মণ্ডল তাকে চিহ্নিত করেছেন সুনীল কিস্কু হিসেবে। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। কলকাতাভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ ডেমোক্রেটিক রাইটসের (এপিডিআর) সদস্যরা বিমলা ও অন্যান্যদের সাক্ষাৎকার নেয়, আর জানা যায় এর আগেও কিস্কুর বিরুদ্ধে ওই গ্রামেই এক মহিলাকে ধর্ষণের অভিযোগ আছে। বিমলার প্রাথমিক মেডিক্যাল রিপোর্টে ধরা পড়েছে, ওঁর মুখে ও শরীরের নানা অংশে আঁচড় ও আঘাতের একাধিক চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু ধর্ষণ হয়েছে কি না সেসম্পর্কে চূড়ান্তভাবে কিছু বলা হয়নি। পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, ধর্ষণ হয়েছে। কিন্তু তারা ডিএনএ-সহ ফরেনসিক রিপোর্ট এবং অন্যান্য প্রমাণ দাখিল করেনি যার মাধ্যমে ধর্ষকদের চিহ্নিত করা যেতে পারে। এপিডিআরও এ যাবৎ রিপোর্ট পেশ করেনি।
বিজেএমএম আরও জানিয়েছে, খালেকের সঙ্গে মনিরুল ইসলামের আত্মীয়তা আছে। এমএলএ মনিরুল গত বছরে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছেন প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের একজন নেতার মাথা কেটে নেওয়ার হুমকি দেওয়ার পরে। বীরভূমের মানুষ বিশ্বাস করেন মনিরুল তিনটি খুন করেছেন (এখানে উল্লেখ করা দরকার ইসলাম আগে ওই খুনগুলোর কথা স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু পরে সেই স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে নেন। এরপর তাঁর নাম চার্জশিট থেকে বাদ যায়। এ নিয়ে কানাঘুষোয় অভিযোগ শোনা যায় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রক্ষা করছে)। শোনা যাচ্ছে মনিরুল আত্মীয়ের দুর্দশার কথা শুনে তৃণমূল পঞ্চায়েতের সদস্যদের নাকি সাঁওতালদের হাতে টাকা ধরিয়ে খালেককে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার হুমকি থেকে মুক্ত করতে নির্দেশ দেন এবং পরে নাকি তিনি ওঁদের সঙ্গে “বুঝে নেবেন”। গ্রামের মাঝিকে জড়িয়ে এই চাঞ্চল্যকর এফআইআরে তথ্য হাজির করার এটাও একটা কারণ হতে পারে।
“মাঝি পরিচালিত [শাসন] ব্যবস্থায় শাস্তি হিসেবে ধর্ষণের নিদান অশ্রুতপূর্ব” বলছেন রুবি হেমব্রম। তিনি একটি কলকাতায় আদিবাণী নামে একটি আদিবাসী প্রকাশনা সংস্থা চালান। এই ধরনের রায় সাঁওতালদের প্রচলিত আইনে অনুমোদিত নয়। সুবলপুর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে শ্রীকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা একাধিক সাক্ষী এই মর্মে বয়ান দিতে রাজি আছেন যে ২০ তারিখ গ্রামের মাঝি তাঁদের গ্রামে ছিলেন। গ্ৰেফতার হওয়া অভিযুক্ত পুরুষদের মেডিক্যাল রিপোর্টে ওঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে, কারণ যৌনসঙ্গম করার তাঁর সামর্থ্য তাঁর নাও থাকতে পারে, এটা বিমলার বর্ণিত সাক্ষ্যের বিপরীত।
* * *
গণপরিসরে এতটা চাউর হয়ে যাওয়া একটি ঘটনা হলেও বীরভূম নিবাসী সাঁওতাল সমাজে সাম্প্রতিককালে ঘটা এটাই সবচেয়ে বর্বর ঘটনা নয়। বিজেএমএম জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে সিউড়ির রাজনগর গ্রামে সাঁওতাল যুবকদের একাংশ নিজেদের গ্রামে ১৩ বছরের এক সাঁওতাল কিশোরীকে ধর্ষণ করার পরে গ্রামেরই একটি গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। এরপর অভিযুক্তরা ওই কিশোরীর পরিবারকে ভয় দেখাতে থাকে যাতে পরবর্তী কয়েকদিন তাঁরা গ্রাম না ছাড়েন। এই অবস্থা চলতে থাকে এফআইআর করার জন্যে বিজেএমএম সদস্যরা গ্রামে এসে তাঁদের থানায় নিয়ে যেতে উদ্যোগী হওয়া অবধি। “এতে কিছুই লাভ হয়নি,” বলছেন বিজেএমএম-এর সমাজকর্মী ঘাসিরাম হেমব্রম। এদিকে পুলিশ গ্রামের তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েতের চাপে পড়ে আত্মহত্যার রিপোর্ট পেশ করে এবং মামলাটিকে বন্ধ করে দেয়। মেয়েটির পরিবারের সকলে দুষ্কৃতিদের ভয়ে পুরোপুরি গ্রাম ছেড়ে চলে যায় বলে জানালেন হেমব্রম।
অতীতেও যে সাঁওতাল পুরুষ ধর্ষণ করেনি এমনটা নয়, তবে এত সংখ্যক যুবক এর আগে কখনও জোট বেঁধে নিজেদের সম্প্রদায়ের মহিলাদের উপর এমন হিংস্রতা ঘটায়নি। এক্ষেত্রে ট্র্যাজেডি আরও তীব্র, একথা বলেছেন ফেলিক্স প্যাডেল, বিশেষ করে মনে পড়ে যে “রোমান্স এবং ভালোবাসার ব্যাপারে আদিবাসী সংস্কৃতি অত্যন্ত পরিশীলিত।” প্রেমগীতির জন্য একসময়ে সাঁওতালরা সমাদৃত ছিলেন, বাঁশি বাজানোর ব্যতিক্রমী দক্ষতা ছিল তাঁদের আর নামডাক ছিল চাঁদের আলোয় তাঁদের প্রেমময় নৃত্যের জন্যে - যা কৃষ্ণলীলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নৃতাত্ত্বিক এডওয়ার্ড টি ডালটন ১৮৭২ সালে লিখেছিলেন, প্রতিটি সাঁওতাল গ্রামে কিছুটা খোলা জায়গা থাকত সান্ধ্যভোজনের পরে যেখানে এসে “বাঁশি ও ঢোকঢোল বাজিয়ে যুবকরা যুবতীদের আকৃষ্ট করতেন, যাঁরা পরিপাটি মসৃণ ও লম্বা চুলে একটি বা দুটি ফুল গুঁজে প্রফুল্ল মনে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতেন।“ নাচ শেষ হলে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট তরুণ তরুণী বনের ভিতরে উধাও হতেন।
খনি এবং মানবাধিকার বিষয়ে নিবেদিত ঝাড়খণ্ড থেকে প্রকাশিত ‘খান খনিজ অউর অধিকার’ নামে একটি নিউজলেটারের সম্পাদক জেভিয়ার ডায়াস বলেছেন, “আদিবাসীদের মধ্যে প্রেম ছাড়া যৌনতা দেখতে পাবেন না। আদিবাসী সংস্কৃতিতে যৌনতা শুধু লৈঙ্গিক স্পর্শেই সীমিত নয়। হো’দের মধ্যে যেমন, ‘আমি বাজারে গিয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এটা বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার।‘ ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা, কারণ বম্বে কিংবা ব্যাঙ্গালোরে যে সাংস্কৃতিক আবহে আমি বেড়ে উঠেছি, সেখানে আপনি যে কোনও নারীকে তাঁর দেহের গঠন অথবা যৌন আবেদনের নিরিখেই বোঝাবেন।”
আজ পর্যন্ত আদিবাসী সমাজ মূলস্রোতের ভারতীয়দের তুলনায় নারী-পুরুষ সাম্য রক্ষায় বৃহত্তর ভূমিকা পালন করেছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, তফসিলি জনজাতির মধ্যে নারী-পুরুষের অনুপাত সবচেয়ে ভালো — প্রতি ১,০০০ জন হাজার পুরুষ পিছু ৯৯০ জন নারী (বিশেষত তুলনামূলক ভাবে অগ্রবর্তী রাজ্য পঞ্জাব এবং হরিয়ানায় কন্যাভ্রূণ হত্যা এবং শিশুকন্যার প্রতি অবহেলার কারণে সর্বভারতীয় নিরিখে ভারতে ১০০০ জন পুরুষের অনুপাতে নারী মাত্র ৯৪৩ জন।) ৫৮টি জনজাতির মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, ২৭টি ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে মহিলার সংখ্যা বেশি। তবে আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ৬ বছর এবং তারচেয়ে কম বয়সের শিশুদের মধ্যে লিঙ্গ হার প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কম। শিশুপুত্রের প্রতি অগ্রাধিকারের পরিচায়ক এই উদ্বেগজনক প্রবণতার সম্ভাব্য কারণ মূলস্রোতে প্রচলিত পণপ্রথার কুফল, যার জেরে মেয়েরা সমাজে আর্থিকভাবে বোঝা হযে উঠছে, আর ক্রমশ বিয়েতে কনের দাবিকৃত অর্থপ্রদানের ক্ষেত্রে সাঁওতাল-সহ অন্য আদিবাসীদের ঐতিহ্য কোণঠাসা হচ্ছে। যদিও সাঁওতাল-সহ অন্যান্য থিতু আদিবাসীদের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো এবং ডাইনি সন্দেহে হত্যার মতো বৈষম্যমূলক প্রথাসমূহ থাকলেও ওড়িশার বোন্ডা আর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জারোয়াদের মতো কিছু যাযাবর জনজাতি নারী-পুরুষকে মোটের উপর সম-নজরেই দেখে। এই তথাকথিত “আদিম” সম্প্রদায়গুলোতে পুরুষদের হাতে ধর্ষণের ঘটনা শোনাই যায় না।
মধ্যপ্রদেশের আলিরাজপুরে ভীল জনজাতির মধ্যে কর্মরত সমাজকর্মী রাহুল ব্যানার্জী জানালেন, ভোক্তা বা কনজিউমার সংস্কৃতির দাপটে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক হিংসা বাড়ছে। টেলিভিশন তথা মহার্ঘ্য মোবাইল ফোনের মতো দ্রব্য কিনতে চান যেসকল আদিবাসী পুরুষরা, তাঁদের মধ্যে অনেকেই গুজরাট কিংবা অন্যান্য বিত্তবান রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। প্রায়শই তাঁরা হাতে বেশ বড়ো অংকের নগদ সঞ্চয় নিয়ে ফিরে আসছেন। ফলে আলিরাজপুরে এখন সম্পত্তির দাম ক্রমবর্ধমান আর তারই সঙ্গে অভাবনীয় হারে বাড়ছে ডাইনি সন্দেহে হত্যার ঘটনা। এসকল ক্ষেত্রে সম্পত্তির অধিকারিণী মহিলা তাঁর পরিজনদের লোভের শিকার হয়ে ডাইনি হত্যার বলি হচ্ছেন। আচমকা বড়োলোক বনে যাওয়া এই পুরুষদের একাংশ আবার মহিলাদের ধর্ষণের মতো অপরাধ করে শাস্তির হাত থেকে পারও পেয়ে যাচ্ছে পঞ্চায়েতকে জরিমানা দিয়ে। আগেকার সময়ে আচরণগত ব্যাপার-স্যাপারগুলো ঐতিহ্য অনুসারী আদিবাসী পরিষদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হত বলে আরও জানালেন রাহুল ব্যানার্জী। তাঁর কথায়, বর্তমানে পঞ্চায়েতের নির্বাচিত নেতারাই যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ”এর জোরে আপনি নিজের রেহাইয়ের রাস্তা কিনে নিতে পারবেন।”
আরেকটি ক্ষতিকারক প্রভাবের কথা প্রসঙ্গে রাহুল ব্যানার্জী এবং গ্রামীণ ভারত বিষয়ক অন্যান্য পর্যবেক্ষেকরা মোবাইলের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির বহুল বিস্তারের কথা বলছেন যেগুলোর একাংশ অত্যন্ত হিংসাত্মক। বিগত শতকের নয়ের দশকের গোড়ায় ঝাড়খণ্ডে ভিসিআরের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির আমদানি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন জেভিয়ার ডায়াস। গ্রামের যুবকরা একটা টিভি কিনে জেনারেটর ভাড়া করে সিনেমা দেখানোর পাশাপাশি এই “নীলছবি” দেখাত। এজন্যে একমুঠো চালের মতো যৎসামান্য চাঁদা নিত। আজ প্রতিটি ছোটো শহর, গঞ্জে এবং ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত অধিকাংশ গ্রামগুলোতেই মোবাইল ফোন সম্পর্কিত পরিষেবা দেওয়ার গুমটি রয়েছে, এখানে নগদ টাকা দিয়ে মোবাইলের মেমোরি চিপে পর্নোগ্রাফিক ভিডিও ডাউনলোড করা হচ্ছে। আর তারপর সেগুলো হাতবদল হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। পুরুষদের মধ্যে অনেকে নিজেরাই নিজেদের পর্নোগ্রাফিক ক্লিপ বানিয়ে সেগুলো সংশ্লিষ্ট মহিলাদের অনুমতি না নিয়েই ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বীরভূমের গড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা সাদি মুর্মু নামে জনৈক সাঁওতাল স্কুলশিক্ষিকা জানিয়েছেন, তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন ১০ বছরের বালকরাও এসব ভিডিও দেখছে।
পর্নোগ্রাফিক ফিল্মে যৌনক্রিয়া প্রেমহীন, কথা-কাহিনি-হীন শরীরের নানা অংশের ঘাত-প্রতিঘাত মাত্র যেখানে নারী নিছকই পুরুষের ভোগ্য বস্তু। আরও বলা যায়, ডায়াস দেখেছেন, অনেক আদিবাসী যুবক বিশ্বাস করছেন এই যে পর্নোগ্রাফিতে তাঁরা প্রেম-ভালোবাসাহীন আদানপ্রদান দেখছেন, তা আদতে দিকু (অ-আদিবাসী) সমাজের রীতি, এই রীতি তাঁদের কাঙ্খিত হয়ে উঠছে। ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছেন ডায়াস: “এক্ষেত্রে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে তাঁদের যাবতীয় ধারণাই হল দিকুদের জগতের অনুসারী।” একজন আদিবাসী তরুণ পর্নোগ্রাফি দেখে বিশ্বাস করতে থাকেন, “এটাই দিকুরা করে থাকে। দিকুরা এভাবেই যৌনক্রিয়া করে আর তাই যৌনতার এটাই সম্ভবত যথার্থ রাস্তা।” আদিবাসী তরুণরা এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, একথা বলছেন নিউজিল্যান্ডের ম্যাসি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ববিদ সীতা ভেঙ্কটেশ্বর। মনে গেঁড়ে বসছে “এই সমস্ত পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে ফুটে ওঠা পৌরুষের ছবি আর তার জেরে তাদের আত্মসত্ত্বা তথা অস্তিত্বের ধারণা আক্রান্ত হচ্ছে।“ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটানোর প্রবণতা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান যে সকল পুরুষের মনে, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে “রেপ পর্ন” হিসেবে চিহ্নিত পর্নগ্রাফিক ধারাটার অভিঘাতে ধর্ষণকে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হচ্ছে।
আদিবাসী সমাজে যৌন আগ্রাসনের উৎস মূলধারার সমাজ দ্বারা আদিবাসী সমাজের উপর সৃষ্ট প্রকাশ্য সহিংসতা। সিউড়ির কাছে একটি অসরকারি সংস্থার পরিচালক তথা সমাজকর্মী কুণাল দেব বলছেন, বিগত শতকের সাতের দশকে পাথর খাদানের আবির্ভাবের পরপরই বীরভূমের আদিবাসী সংস্কৃতিতে ভাঙন ধরতে থাকে। এই শিল্পক্ষেত্রের গ্রাসে ধুলো আর বোল্ডারে ঢেকে গেছে খেতজমি, মাঠঘাট, শস্য, খালবিল আর সোঁতা আর কার্যত লাটে উঠে যায় চাষাবাদ। সাঁওতালরা হয় নিজেদের জমিজোত বিক্রি করে এলাকা থেকে পালিয়ে গেছেন অথবা পাথরখাদান তথা ক্রাসারগুলোয় (যেখানে বোল্ডার ভেঙে স্টোন চিপস তৈরি করা হচ্ছে) মজুর হিসেবে কাজ করছেন। আর এখানকার খনিশিল্পের রমরমায় আকৃষ্ট হয়ে পাথরখাদানের মালিক, ম্যানেজার, ওভারসিয়ার কিংবা ট্রাকচালক ও তাদের দালালের পেশায় যোগ দেওয়া হাজার হাজার ভ্রাম্যমান পরিযায়ীদের (ফুটলুজ মাইগ্রেন্টস) হাতে সাঁওতাল মহিলারা নিয়মিত ধর্ষিত হচ্ছেন।
গড়িয়া গ্রামের সাঁওতাল স্কুলশিক্ষাক বাবুর্জি কিস্কু স্মৃতিচারণ করে বললেন, নয়ের দশকের গোড়ায় সিউড়ির কাছে একটি পরিত্যক্ত খনিতে জমা জল পাম্প করে বের করে দেওয়া হয়। জলস্তর কমার পরে একেবারে তলার দিকে ১০ থেকে ১৫ খানা বস্তা মেলে যাতে মানবদেহের অবশিষ্টাংশ ছিল। মৃত মানুষজনের পরিচয় কেউ জানতেন না বটে, কিন্তু সকলেই অনুমান করেছিলেন দেহাংশগুলি সাঁওতালদের: ওভারসিয়ারদের হাতে যে সকল মহিলাদের ধর্ষণ ও খুন হয়েছে, যে সমস্ত পুরুষ স্ত্রী অথবা বোনের ধর্ষণের প্রতিবাদ করেছেন তাঁদেরই হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া দূরবর্তী এলাকাগুলো থেকে আগত যে শ্রমিকদের খনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তাঁদের দেহ সেরেফ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কারণ খনির মালিকরা সকলেই যে মূলধারার দিকু সমাজের সদস্য আর তারা প্রকাশ্যে বুক চিতিয়ে বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং পুলিশ ও রাজনীতিকদের নিজেদের পকেটে রাখে। ফলে কেউই এইসব খুনগুলোর তদন্ত দাবি করার মতো সাহস ধরে না। বাবুর্জি কিস্কুর কথায়, “অনেক পুরুষ আমাকে বলেছেন, তাঁদের বোনেরা একেবারে তাঁদের চোখের সামনে ধর্ষিত হয়েছেন। আর কেউ এর কোনও প্রতিবাদ করেলে তাঁদের পিস্তল ঠেকিয়ে নিরস্ত করা হয়েছে।”
কেবল পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারতেই এই ধরনের আক্রোশ সীমাবদ্ধ নয়। সারা পৃথিবীর আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে খনি ও অন্যান্য ধরনের শিল্পায়ন অবিচ্ছেদ্যভাবে যৌন হিংসার সঙ্গে জড়িত। গত জানুয়ারিতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিবেদক জেমস আনায়া বলেছেন, “আদিবাসী নারীরা জানিয়েছেন উত্তোলন প্রকল্পগুলোর দৌলতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রমিকদের অন্তঃপ্রবাহের ফলে নারীর উপর ধর্ষণ ও অত্যাচার-সহ যৌনহেনস্থা ও হিংসার ঘটনা বাড়ছে।” এই ধরনের ঘটনার ফলে এইচআইভি সংক্রমণের ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ডায়াস বলছেন, ১৯৭৪ সালে তিনি যখন প্রথম সিংভূমে আসেন (অধুনা ঝাড়খণ্ড), “সেইসময়ে আমি বনরক্ষীর হাতে কেবল একটিমাত্র ধর্ষণের ঘটনার কথা শুনেছিলাম। এভাবেই এখানে ধর্ষণ-সংস্কৃতির সূত্রপাত হয়। ১৯৮৫ সালের আগে কোনও আদিবাসী কাউকে ধর্ষণ করেছে বলে আমি শুনিনি,“ ব্যাপক যন্ত্রায়নের দৌলতে খনিশিল্পে আসা রমরমার জেরে এ যাবৎ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত এলাকাগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়লে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। “২০০৫ সাল থেকে প্রতিদিন ২ হাজার ট্রাক আদিবাসীদের বাসভূমি সারান্ডা বনাঞ্চল এলাকায় আনাগোনা করতে থাকে,” ডায়াস তাঁর কথার রেশ টেনে বললেন। “প্রতিটি ট্রাকের সঙ্গে এলাকায় আসতে থাকে চালক, ক্লিনার এবং অন্যান্য লোকজন।” এর ধাক্কায় হাজার হাজার মুন্ডা, সাঁওতাল এবং হো মহিলা ধর্ষণের শিকার হন এবং বাধ্য হয়ে যৌনকর্মীতে পর্যবসিত হন। এই ধরনের নিপীড়নের বহুস্তরীয় যে ইতিহাস রয়েছে সে প্রসঙ্গে তিনি আরও বললেন, জামশেদপুর ও নোয়ামুণ্ডির মতো সুবিশাল ইস্পাত নগরীগুলোতে “আজাদ বস্তির” মতো স্থান আছে। এসব জায়গায় আধিকারিকরা আদতে বিনামূল্যে যৌনতা আদায়ের জন্যে নিজেদের পোষ্য আদিবাসী নারীদের কাছে হাজির হচ্ছে, ডায়াস বলেছেন।
ওড়িশা-ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাতা সূর্যশঙ্কর দাস পুরানো দিনের কথা মনে করে বললেন, লাঞ্জিগড় এলাকায় বহু কোন্ধ সম্প্রদায়ভুক্ত পরিবার বসবাস করত, ২০০২ সালে ব্রিটেনের খনি সংস্থা বেদান্ত রিসোর্সেস আসার আগে পর্যন্ত “সেখানে যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রায় শোনাই যেত না।” বিগত শতকের নয়ের দশকে ধর্ষণের যে ঘটনাগুলির কথা তিনি শুনেছিলেন, তার মধ্যে একটিতে ধর্ষক হিসেবে অভিযুক্ত ছিলেন সরকারি এক নৃতত্ত্ববিদ, যিনি ডোঙ্গরিয়া কোন্ধ ডেভলপমেন্ট এজেন্সির দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এছাড়া আরেকটি ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন লাঞ্জিগড়ের একটি অসরকারি সংস্থার জনৈক কর্মী। “এরপর বেদান্ত ওই এলাকায় অ্যালুমিনিয়াম শোধনাগার তৈরির পরে আমি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে স্থানীয় বাসিন্দা নাবালিকা ও মহিলাদের অপহরণ করে ট্রাকচালক, পরিযায়ী শ্রমিক এবং বেদান্তের ঠিকাদার ও কর্মীদের হাতে তাদের ধর্ষণের কথা শুনি,” বললেন তিনি। এমনই এক ঘটনায় স্থানীয় এক সমাজকর্মীর ৯ বছরের মেয়ে বেদান্তের মদতপুষ্ট “গুন্ডাদের” হাতে অপহৃত এবং অত্যাচারিত হয় বলেও জানালেন শ্রী দাস। আক্রান্ত মেয়েটি সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচেছিল। আজ এই লাঞ্জিগড়েই শত শত যৌনকর্মী রয়েছেন, জানাচ্ছেন এই চলচ্চিত্র নির্মাতা। শোধনাগার তৈরির জন্যে গ্রামগুলিকে বলপূর্বক প্রতিস্থাপিত করা হলে এই মহিলারা ছিন্নমূল হয়ে পড়েন। এছাড়াও আছেন পরিযায়ীদের হাতে ধর্ষিত মহিলারা অথবা প্রলোভনের শিকার হয়ে অবশেষে পরিত্যক্ত মহিলারা।
এ ব্যাপারে দাস এক অনন্ত তালিকা তুলে ধরলেন। “কোরাপুটে নালকো সংশোধনাগারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহর দমনজড়িতে এক হাজারের বেশি আদিবাসী নারী যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। সুকিন্দার ক্রোমাইট খনি এলাকায় আটক বীরহোড় সম্প্রদায়ের সব মহিলা-সহ কিশোরীদের পর্যন্ত যৌনকর্মী বানিয়ে দেওয়া হয়েছে ট্রাকচালক ও ঠিকাদারদের যৌন খিদে মেটাতে। কলিঙ্গ নগরের ট্রানসিট ক্যাম্পগুলিতে ভিটেহারা যে নাবালিকা মেয়েরা আছে, টাটার মদতপুষ্ট গুন্ডাদের হাতে তারা যৌন নিপীড়নের শিকার। কলিঙ্গ নগরে জিন্দালদের কারখানার সামনে যৌনকর্মীদের একটি বস্তি মাথা তুলছে।”
দাসের কথা অনুযায়ী, কোরাপুট জেলার বিচ্ছিন্ন পারোজা সম্প্রদায়ের জমি বিগত শতকের আটের দশকে কোলাব জলাধার নির্মাণের সময়ে নিমজ্জিত হয়ে পড়লে তার আর ভরণপোষণের সংস্থানও খোয়া যায়। এমতাবস্থায় জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা গ্রামবাসীদের হুমকি দেয় গ্রামবাসীদের আইনত প্রাপ্য হকের রেশন বন্ধ করে দেওয়া হবে যদি না মেয়েদের পরম্পরাগত কৌম আবাসে তাদের অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য এদের উদ্দেশ্য যৌনতা চরিতার্থ করা। এই কৌম আবাসে গ্রামের সাবালিকা মেয়েরা একত্রে রাত্রিবাস করে (ছেলেদের ডর্মিটরি আলাদা)। শিকার, রসদ সংগ্রহ, এবং ঝুমচাষ-নির্ভর আদিবাসীদের মধ্যে এটা বহুল প্রচলিত একটা যাপন রীতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নৃতত্ববিদের কথায় এই ব্যবস্থা আদতে আদিবাসীদের আগামী প্রজন্মকে “অতি সূক্ষ্ম কৌশলে সামাজিকতার পাঠ দেওয়ার পন্থা।”। নিজেদের চেয়ে সামান্য বড়ো মেয়েদের কাছ থেকে কিশোরী মেয়েরা গান রচনা, নাচ, শস্যের বাড়বৃদ্ধি, ঔষধি হিসেবে ভেষজের ব্যবহার (এমনকি পরবর্তীতে গর্ভ নিরোধক হিসেবে এর ব্যবহার), স্বহস্তে চিরুণী নির্মাণ এবং প্রেমিকের জন্য বানানো নানান উপহার বানানোর শিক্ষা নিত। নৃতত্ববিদ বলছেন, এটা “কারও সঙ্গে কখন যৌনতায় যাবেন অথবা কখন সেটা করবেন না – এই পুরো ব্যাপারটা ঘিরেই একটা বোধ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া এটা।” এইসব কৌম আবাসে পালাপরবের সময়ে অন্য গ্রাম থেকে আগত অবিবাহিত পুরুষ অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো হত। এইসকল উপলক্ষ যা কিনা গোষ্ঠীর ভিতর সংহতির ধারণাকে আরও জোরদার করে তুলত, প্রায়শই প্রেম এবং যৌনতার পরিসর তৈরি করত। সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষেরা আদতে এই প্রক্রিয়াকে প্রাকবৈবাহিক এক স্বাস্থ্যকর পর্ব হিসেবেই বিবেচনা করতেন।
যে দিকুরা এই সমস্ত এলাকায় বসবাস করছে, তারা প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর কৌম আবাস বা ডর্টিমরিগুলোকে লাগামহীন যৌনতার আখড়া হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত, যেখানে তারা প্রায়ই হানা দিয়ে নিজেদের যৌনচাহিদা চরিতার্থ করতে পারে। এই কারণে বহু জনজাতিই তাদের ডর্টিমরিগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে গোষ্ঠী সংস্কৃতিসঞ্জাত শিক্ষার হাত থেকে বঞ্চিত হয়েছে তারুণ্য, এমনকি প্রেম-ভালোবাসার শিল্পে পাঠ নেওয়া থেকেও তারা বঞ্চিত থাকছে। এই বিশেষ ঘটনাটির জেরে পরোজা গ্রামও তার ডর্মিটরিটি বন্ধ করে দেয় জেলা-আধিকারিকদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে। কিন্তু রেশনের জোগান পেতে তবুও আধিকারিকদের যৌনতা চরিতার্থ করতেই হচ্ছে গ্রামের নারীদের।
সন্ত্রস্ত হওয়ার মতো এক ঘটনা উঠে আসে ২০০৮ সালে ওড়িশার কেবিকে সমাচার কালেকটিভ থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনে। প্রতিবেদক মহম্মদ আসলাম জানাচ্ছেন, কালাহান্ডি জেলায় আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা নাচগান করছিলেন নিজেদের একটি পরম্পরাগত সমাবেশে, সেসময় পাচারকারীরা জিপ নিয়ে এলাকায় হানা দিয়ে আদিবাসী মেয়েদের টেনে নিয়ে যায়। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত বছর ওড়িশার রাউরকেল্লার আদিবাসী মহিলা সুরক্ষা মণ্ডলের পক্ষ থেকে লিলি কুজুর সিজিনেট স্বরা নামে একটি মোবাইল রিপোর্টিং সার্ভিসকে জানিয়েছেন যে ওড়িশার একটি জেলা সুন্দরগড় থেকেই ৪০ হাজার আদিবাসী মহিলাকে পাচার করা হয়েছে, এর মধ্যে ১৫ হাজার মহিলার কোনও হদিশই আর মেলেনি।
ঝাড়খণ্ডের সমাজকর্মী গ্ল্যাডসন ডুংডুংয়ের হিসেব অনুসারে, দিল্লিতে ৫ লক্ষ আদিবাসী নাবালিকা এবং মহিলা রয়েছেন, অধিকাংশই গৃহসহায়িকার কাজে নিযুক্ত, পাশাপাশি যৌনকর্মী হিসেবেও কাজ করেন। নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর দালালরা আদিবাসী গ্রামগুলোতে ঘুরতে থাকে, বিশেষত সেই সমস্ত গ্রামে যেখানে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজকর্ম খনির জেরে ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা শহরে মহিলাদের কাজের ব্যবস্থা করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলুব্ধ করে। ডুংডুংয়ের অভিযোগ এই কর্মী নিয়োগকারী এজেন্সিগুলো আদিবাসীদের পরব সরহুল ও করম চলাকালীন মেয়েদের নিলামের বন্দোবস্ত করে দালালদের কাছে বেচে দেয় অথবা সরাসরি সম্ভাব্য মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। পাচার হওয়া মহিলাদের অনেকেই যৌন নিপীড়নের শিকার, অনেকেই খুন হয়ে গেছেন এবং অনেকে শিশু কোলে করে ফিরে আসছেন অথচ স্বসম্প্রদায়েই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন। অনেকে আবার কোনও হদিশ না দিয়ে গুম হয়ে যাচ্ছেন। ডুংডুংয়ের কথায়, “সিমডেগা জেলায় আমি নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়ার পর মেয়েদের প্রায় দেখতেই পাইনি। সকলেই বাইরে চলে গেছে।”
ওদিকে, ছত্তিশগড়ের পরিস্থিতি আরও খারাপ যেখানে খনি খনন তথা ভিটেমাটি হারিয়ে ছিন্নমূল হয়ে পড়ার ধ্বংসাত্মক প্রভাবের জেরে সরকারি সেনাবাহিনী ও মাওবাদী গেরিলাদের মধ্যে হিংসাত্মক সংঘাতে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মোটামুটি ২০০৫ সাল থেকেই মাওবাদীদের সঙ্গে আদিবাসীদের সংস্রব ভাঙার জন্য সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স এবং রাষ্ট্রপোষিত জঙ্গি আদিবাসী গোষ্ঠী সালওয়া জুডুম প্রায় ৫০ হাজার আদিবাসীকে গায়ের জোরে ক্যাম্পে চালান করেছে। লাখো মানুষ অন্ধ্রপ্রদেশে পালিয়ে গিয়েছেন, এই হিসেব দিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ নন্দিনী সুন্দর। রাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিরা “নরহত্যা করছে, মহিলাদের ধরা মাত্র ধর্ষণ করছে এবং ক্যাম্পে থাকা মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করছে,” বললেন সুন্দর। উত্তর বস্তারে রাওঘাট খনি এলাকা ঘিরে সিআরপিএফের ২২টি ক্যাম্প রয়েছে খনি খননের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে এবং দান্তেওয়াড়ায় এই ধরনের ক্যাম্প আছে প্রতি ৫ কিলোমিটার অন্তর। এসব নিরাপত্তা কেন্দ্র স্কুলচত্বরগুলোতে অবস্থিত এবং এখানে পুরুষদের অবাধ ঘোরাঘুরির ফলে অনেক মেয়েই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে স্কুল ছড়ে দিয়েছে। পাছে পুলিশ ও সেনার মুখোমুখি পড়ে যায়, এই আতঙ্কে মেয়েরা বনের ভিতরে যেতে ভয় পায়।
তেহেলকা ম্যাগাজিনে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে, গত এক দশকে ৯ হাজার আদিবাসী মেয়েকে ছত্তিশগড় থেকে পাচার করা হয়েছে। যদিও সমাজকর্মীদের হিসেবে এর ১০ গুণ বেশি মেয়ে পাচার হয়েছে। আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ জানিয়েছেন, গত বছর সালওয়া জুডুমের হাতে ধর্ষণের ৯৯টি ঘটনা ঘটলেও একটির ক্ষেত্রেও এফআইআর দায়ের হয়নি - যদিও ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট ছত্তিশগড় সরকারকে এক্ষেত্রে বিস্তারিত এফিডেভিট অনুসারে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। ‘আইনের রক্ষকদের’ হাতে সংঘটিত হিংসার ব্যাপারে ভারতের এমন হিসেবি সহনশীলতা দেখে পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলছেন যে খনিশিল্পের পক্ষ নিয়ে আদিবাসীদের দমিয়ে রাখার তাগিদে রাষ্ট্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনাগুলো ঘটছে সে ব্যাপারে স্বভাবতই রাষ্ট্র উদাসীন।
৫০ বছর আগে নৃতত্ত্ববিদ ভেরিয়ার এলউইন পর্যবেক্ষণ করেছেন, ঘোটুল অথবা কিশোর-কিশোরীদের জন্যে মুরিয়া আদিবাসী সমাজের কৌম আবাস এই ভাবনাকে উদযাপন করত যে “তারুণ্যকে যতন করতে হবে; স্বাধীনতা এবং সুখ যে কোনও বস্তুগত মুনাফার চেয়ে মহার্ঘ্য; বন্ধুত্ব এবং সহমর্মিতা, আতিথেয়তা ও একতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে; এবং সর্বোপরি মানব প্রেম এবং তার শরীরী প্রকাশ সুন্দর, নির্মল এবং অমূল্য।“ আজ ভারতের সমস্ত ঘোটুলকে নির্মূল করা হয়েছে। আর তার বদলে, ডায়াস বলছেন, দিকুদের দৌলতে যে যৌন এবং অন্য আগ্রাসনগুলোর আমদানি হয়েছে, তার জেরে আদিবাসী যুবকেরা, “সংখ্যায় হাতে গোনা কয়েকজন হলেও, ভয়ানক ওই কয়েকজন হিংসাকে যৌন সম্পর্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করছে।”
* * *
ঔপনিবেশিক প্রভুর জায়গা নিতে চায় সকল প্রজাই – শুতে চায় তাঁর বিছানায়, পারলে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে, একথা লিখেছিলেন ফরাসি-আলজিরিয়ান বিপ্লবী ফ্রানৎজ ফানোঁ। এখন আর বাঁশি বাজানো আর কাব্য করার উদ্যম সাঁওতাল তরুণের নেই। সে চাইছে সেইসব কিছু দিকু সমাজ যাকে ‘সফল’ পুরুষের মানদণ্ড মনে হিসেবে গণ্য করে: একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্কর্পিও অথবা নিদেন পক্ষে একটা মোটরসাইকেল, জিনস, সানগ্লাস, মহার্ঘ্য সিগারেট, বিদেশি মদ, একটা ঝাঁ চকচকে মোবাইল ফোন এবং নারীর প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব। তাকে ঘিরে থাকা খনিশিল্পের মালিক ও ম্যানেজাররা এইসব উপাদানে ছেয়ে থাকা জীবনটাই তো যাপন করছে। কিন্তু একজন খাদানের মালিক দৈনিক লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়ে নিতে পারে, এদিকে তার অধীনে কর্মরত শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা এবং বহু আদিবাসী পুরুষ সস্তার মদ কিনে নিজেদের নবজাগ্রত আকাঙ্খাকে বাগে আনতে চাইছে।
কুণাল দেব এবং অন্যান্যদের মতে, বীরভূমের পুরুষ শ্রমিকরা প্রতি গ্রামে এবং প্রতিটি খনি সংলগ্ন এলাকা দেশি মদের দোকানে দৈনিক আয়ের এক-তৃতীয়াংশ খরচ করছেন। মহুয়া গাছের ফুল থেকে আগে সাঁওতালরা কষ্টসাধ্য মদ তৈরি করতেন, যা কেবল ধর্মীয় উৎসবের সময়েই পান করার রেওয়াজ ছিল। এখন সস্তার বাণিজ্যিক মদ মিলছে সর্বত্রই। অনেক পুরুষই দাবি করছেন, খনিতে কাজ করাটা একটা মস্ত শারীরিক শাস্তি, যে কারণে দিনের শেষে মদ না খেলে চলে না। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে মদের প্রতি আসক্তি গার্হস্থ্য হিংসার অন্যতম কারণ, যার শিকার মূলত মহিলা এবং শিশুরা। আরও বলা যেতে পারে, এর জেরে বিবাহযোগ্য সাঁওতাল পুরুষদের সুযোগ কমছে এবং সাঁওতাল মহিলাদের মধ্যে দিকু পাত্রদের আকর্ষণ বাড়ছে।
গোত্রের মেয়েরা ক্রমশ অধরা হয়ে পড়ায় আদিবাসী যুবকদের মধ্যে হতাশা এবং ক্রোধ বাড়ছে। দিকু পুরুষ এবং আদিবাসী মেয়েদের প্রকৃত প্রেমের বিয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি ছাড়াও বীরভূম ও ঝাড়খণ্ডের অনেক সাঁওতাল মহিলা বহিরাগতদের হাতে নিয়ন্ত্রিত, যত না যৌনতার জন্যে তার চেয়ে বেশি জমির মালিকানা আদায়ের জন্যে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে গোটা বীরভূমের খাদান এলাকার জমির মালিকানা একসময়ে ছিল সাঁওতালদের হাতে - কিন্তু এখন সমস্ত খনির মালিকই বহিরাগতরা। যাঁরা আদিবাসী নন তাঁদের কাছে আদিবাসীদের জমি বিক্রি করা বেআইনি, এজন্যে জমি দখলের তাগিদে দিকুরা ভুয়ো সাঁওতাল নাম নিয়ে অথবা কোনও সাঁওতাল মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে জমির মালিকানা হাসিল করছে। হয় সেই প্রেমিক ওই সাঁওতাল নারীকে বিয়ে করে অথবা বিয়ে না করে স্থায়ী সঙ্গিনী হিসেবে নিজের কাছে রাখে। “এরপর সেই নারীর জমিতে সে দব্যি খাদান খুঁড়তে অথবা সেই মহিলার নামে জমি কিনতে পারবে,” দেব বললেন। টাটা ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের ভার্জিনিয়াস খাখা বলছেন এধরনের বন্দোবস্ত ঝাড়খণ্ডেও প্রচলিত আছে, যেখানে আদিবাসী মহিলারা দিকুদের সঙ্গে কেবল জুটি-ই বাঁধছেন না, বরং তাঁরা আদিবাসীদের জমি অ-আদিবাসী সমাজের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘটকালিও করছেন।
এর ফলে সাঁওতাল পুরুষরা দেখছেন, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে খাদানের বাড়বাড়ন্তের জেরে তাঁরা সাবেক জীবিকা, সার্বভৌমত্ব এবং আত্মমর্যাদা হারাচ্ছেন – সঙ্গে হারাচ্ছেন সম্প্রদায়ের নারীদেরও। এর জেরে জন্মানো ক্রোধের জের পড়ছে তাঁদের আপন সমাজের নারীর ওপর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বীরভূমের সাঁওতাল যুবকরা তিনজন সাঁওতাল নারীকে নগ্ন করিয়ে হাঁটিয়েছে, এঁদের মধ্যে একজনকে তাঁর বাঙালি প্রেমিকের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল, অন্য দুজনের বিরুদ্ধে ছিল দিকু পুরুষের সঙ্গে নিছক মেলামেশার সন্দেহমাত্র।
ভুক্তভোগী মহিলাদের মধ্যে অন্যতম নিমপাহাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ফুলমনি (নাম পরিবর্তিত) বললেন নিজের কাহিনি। ২০১০ সালের গ্রীষ্মে তিনি তাঁর দুই বান্ধবীর সঙ্গে জামুন (জাম) ফল খেতে নিকটবর্তী বনে গিয়েছিলেন, এসময়ে তাঁর নিজের গ্রামের সাঁওতাল যুবকদের একাংশ তাঁদের পাকড়ে অভিযোগ করে যে তাঁরা নাকি নিজেদের প্রেমিকদের সঙ্গে গোপনে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। ফুলমনি জানালেন, সমাজের বেশি শিক্ষিত পুরুষেরাই তিনজনকে সারারাত আটকে রাখে আর পরিবারের সদস্য তথা গ্রামের মাঝি মধ্যস্থতা করতে এলেও তাঁদেরও হুমকি দেওয়া হয়। এলাকায় বসবাসকারী গ্রামবাসীদের কথায়, রবীন সোরেন নামে এক সাঁওতাল যুব নেতা যে খাদান মালিকদের থেকে টাকাপয়সা নিত যে ফতোয়া জারি করে যে অল্পবয়সি অবিবাহিত তরুণীদের কাছ থেকে যেন মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং দিকুদের সঙ্গে ধরা পড়লে তাদের শাস্তির প্রতিবিধানও জারি করে। ফুলমনির পরিজনদের বলা হয়, সোরেনকে তলব করা হয়েছে এবং সে এসে মেয়েদের “বিচার” করবে।
পরদিন সকালে সোরেন মোটরসাইকেলে সওয়ার হুঙ্কার দিতে থাকা সাঁওতাল যুবকদের বড়ো দল নিয়ে হাজির হয়। ফুলমনি এবং অন্যান্যদের কথা অনুসারে, সোরেন তার অনুগামীদের সংযত করতে তেমন উদ্যোগী না হওয়ায় শাকরেদরা তাঁকে এবং তাঁরই এক বান্ধবীকে নগ্ন করে পাশের গ্রাম অবধি টেনে নিয়ে গিয়ে ফের একইভাবে গ্রামে ফিরিয়ে আনে (তৃতীয়জনকে গ্রামবাসীরা উদ্ধার করেন)। এই বিভীষিকার প্রভাবে এখনও বিধ্বস্ত ফুলমনি জানালেন, তিনি এই ঘটনাকালে একসময় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেও, সেই পুরুষগুলোর এতটাই “নির্লজ্জ” যে তাঁর গোপনাঙ্গ স্পর্শ করতে থাকে। এরপর অভিযুক্তদের নাম পুলিশকে জানানোর জন্য তাদের থেকে আসা হুমকির জেরে তিনি গ্রাম ছেড়ে পালান। ইতিমধ্যে তাঁকে নগ্ন করে হাঁটানোর ছবি মোবাইলের মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ফুলমনি এলাকায় কাজের খোঁজ করতেও লজ্জিত বোধ করতে থাকেন। বর্তমানে ফুলমনি বন থেকে শালপাতা কুড়িয়ে এনে সেলাই করে থালা তৈরি করেন, তারপর রোদে শুকিয়ে প্রতি থালা ১০ পয়সায় বিক্রি করেন। রাখঢাক না করেই বললেন, “সূর্য উঠলে খেতে পাই, না হলে নয়।”
নগ্ন করে হাঁটানোর ঘটনা অন্যত্র ঘটেছে। ২০০৭ সালে অসমের গুয়াহাটিতে সাংবিধানিক অধিকারের দাবিতে সংগঠিত একটি মিছিলে হাঁটার সময়ে এক আদিবাসী মহিলাকে বিবস্ত্র করে শহরের মধ্যে তাড়া করানো হয়। যদিও, এর আগে কখনও এমনটা সাঁওতালদের মধ্যে হয়নি। নারীর প্রতি পুরুষদের আক্রোশের প্রকাশের ঘটনার অনুকরণে বীরভূমে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনাটি ঘটেছে, যে মেয়েদের গোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতক বলে দেগে দিয়েছিল সোরেন। লক্ষ্যণীয়, বাঙালি মহিলাদের নাগাল পাওয়ার উপায় সাঁওতাল পুরুষদের নেই - এদিকে স্বজাতীয় মহিলাকে ভোগ করার আশা বড়োই ক্ষীণ হওয়ায় যৌন হিংসার সম্ভাবনা বাড়ছে। এই ঘটনা ইতিহাস জুড়েই রয়েছে, উনিশ শতকের কুলি বাণিজ্যের চমকপ্রদ পরিসংখ্যান এর প্রমাণ। একটি সরকারি সমীক্ষা অনুসারে, ১৮৭১ সালে ভারত থেকে গায়ানায় যাওয়া চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের মধ্যে পুরুষ এবং নারী কুলির অনুপাত ছিল পাঁচ: দুই, অর্থাৎ পাঁচজন পুরুষ কুলি পিছু দুজন মাত্র মহিলা কুলি। এর জেরে যৌন আক্রোশ জনিত হত্যার ঘটনা সেখানে ভারতের তুলনায় ৯০ গুণ বেশি ঘনঘন ঘটত এবং সেই দুটি জেলার থেকে ১৪২ গুণ বেশি ছিল যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কুলিরা গায়ানা গিয়েছিলেন। প্রায় সবকটি ক্ষেত্রেই খুন হওয়া মানুষটি মহিলা ।
অবশ্যই, পরিবার, সম্প্রদায় ও ঐতিহ্যের নিরিখেও কুলি সমাজ ভয়াবহ ভাঙনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ভেঙ্কটেশ্বর বলছেন, সব সংস্কৃতিই পরিবর্তন অনুভব করছিল, “বিশেষত যখন এই পরিবর্তন যাদের ঘিরে তাদের যদি বিষয়টির উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকে, সেক্ষেত্রে মহিলারা হিংসা ও দমন-পীড়নের শিকার হন। কারণ নারীই তো সেই প্রতীক যাকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে হবে। নারী বংশের ধারকের পাশাপাশি ভবিষ্যতের আশা এবং নারী ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা গোটা সম্প্রদায়ের ক্ষতির সঙ্কেতবাহী।“
প্রসঙ্গত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও বিবস্ত্র করে হাঁটানোর এই ঘটনা “প্রবীণ গ্রামবাসীদের” নির্দেশে হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছে। সোরেনের দলবলের হাতে এমন বহু হেনস্থার শিকার সাঁওতালদের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্যে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে স্থানীয় একশো জনের বেশি মাঝি একটি পরিষদে সমবেত হন। তুলনায় ছোটো পরিষদগুলোর পর্যবেক্ষক প্যাডেল বলেছেন, “গণতন্ত্র যে ক্রিয়াশীল আছে, এগুলোকে তার সবচেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত হিসেবে মনে করি ... নারী-পুরুষ যে কেউ কথা বলার অধিকার ধরে, এবং একযোগে সকলে বক্তব্য রাখলে তার মধ্যে এক আশ্চর্য ছন্দ থাকে এবং যে মুহূর্তে কেউ বক্তব্য রাখছে, সকলে তখন নীরব থেকে পূর্ণ মনোযোগ সহকারে তার কথা শোনে।” এই পরিষদ সোরেন-সহ অন্য অপরাধীদের আদিবাসী সমাজ থেকে বহিষ্কার করে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সুবলপুরে বিমলার ঘটনার পরে সম্প্রতি আদিবাসী সমাজ পরিচালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করার কথা বলার প্রতিবাদে বিজেএমএম-এর ছাতার তলায় সংগঠিত হয়ে সাঁওতাল মাঝিরা যে সব সমাবেশের আয়োজন করেছেন তাতে হাজার হাজারে আদিবাসী সামিল হয়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, সাঁওতাল সমাজে একদা প্রচলিত প্রকৃত স্বশাসন ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনাটাই যৌন হিংসার ব্যাধিতে জর্জর আধুনিকতার ধংসাত্মক প্রভাব থেকে আদিবাসী সমাজের সংস্কৃতি ও সংহতি রক্ষার একমাত্র পথ।
সারাদেশের অবরুদ্ধ আদিবাসীরা বলছেন, তাঁদের সমাজের ভাঙনের গতি মন্থর করতে লড়তে হবে বহির্জগতের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে। ওড়িশার নিয়মগিরিতে পাহাড়ের পাদদেশে লাঞ্জিগড়ে আদিবাসী সংস্কৃতির বিকৃতি দেখে তিতিবিরক্ত ডোঙ্গরিয়া কোন্ধ আদিবাসীরা গতবছর যৌথভাবে পাহাড়ের উপরে বেদান্ত সংস্থার খনির কাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাংবাদিক অমিতাভ পাত্রকে ডোঙ্গরিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত জনৈক পুরুষ বলেছেন, সরকার ও কোম্পানি ওই এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী পাঠাচ্ছে যারা “আমাদের পেটাচ্ছে, আমাদের লম্বা চুল ধরে টানাহেঁচড়া করছে, অনুমতি না নিয়ে যখন-তখন আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ছে, ঘরের মহিলা ও নাবালিকাদের ওপর চড়াও হচ্ছে, পবিত্রস্থানে জুতো পরে ঢুকে আমাদের ঈশ্বরের অবমাননা করছে এবং আমাদের মূল্যবান সামগ্রী লুঠ করছে। শিক্ষিত লোকেরা বুঝি এইসব কাজ-ই করে?”
এর উত্তরে সারাদেশের আদিবাসীরা অন্তত জোর দিয়েই বলবেন, “হ্যাঁ।”
সুবলপুরে যা ঘটেছে, বহু সংবাদপত্র সেই ঘটনাকে ‘মধ্যযুগীয়’ বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করায় দিশম-মাঝি হেমব্রম অত্যন্ত ব্যথিত। সাঁওতাল সমাজ সর্বদাই মহিলাদের ক্ষেত্রে এমন কিছু অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে যা মূলধারার সমাজে এখনও পুরোপুরি অনুমোদন পায়নি, একথা তিনি তুলে ধরলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উনিশ শতকের অন্যতম সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক সাঁওতাল গ্রামের একমাত্র বাঙালি পরিবারে, যেখানে তিনি সাঁওতাল বিধবাদের পুনর্বিবাহ দেখেছিলেন যা পরবর্তীতে তিনি হিন্দু সমাজে চালু করতে চেয়েছিলেন। হেমব্রম বললেন বিদ্যাসাগর কখনও তাঁর এই ভাবনার উৎস খোলসা করেননি, কারণ আজকের মতোই ঠিক তখনও বেশিরভাগ দিকু-ই যেহেতু আদিবাসীদের অসভ্য জ্ঞানে হেয় করত, ফলে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত প্রয়াসকে বাতিল করার যুতসই কারণ পাওয়া যেত। “সুবলপুরে যা-ই ঘটে থাক, ওই ঘটনা মোটেই মধ্যযুগীয় বর্বরতা নয়, বরং আধুনিক বর্বরতা,” বলে নিজের কথা শেষ করলেন হেমব্রম।
তথাকথিত অনগ্রসর সমাজে মেয়েদের প্রতি যে আচরণ করা হয় বারংবার তাকেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে সমাজটিকে সুসভ্য করার মহান প্রয়াস বাস্তবায়িত হয়েছে। এর অন্যতম আদর্শ উদাহরণ হল সতী, ১৯ শতকে যার সচিত্র এবং রগরগে বিবরণ ব্রিটিশ প্রকাশনাগুলো তুলে ধরেছে। শত বছর পরে মাদার ইন্ডিয়া (১৯২৭) নামে সর্বাধিক-বিক্রিত বই, যাতে হিন্দু পুরুষদের শিশুকামী [পিডোফাইল] হিসেবে উপস্থাপনা করা হয়, তার গবেষণা ব্রিটিশ গোয়েন্দাসংস্থার অর্থানুকুল্যেই সম্পন্ন হয়। এই দুই প্রচারে কিছু আংশিক সত্য থাকলেও, মহিলা এবং নাবালিকাদের রক্ষা করার যুক্তির আড়ালে আদতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের স্বপক্ষে মত গড়ে তোলাটাই ছিল প্রকৃত উদ্দেশ্য। ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন, রাজস্ব আদায়ের জন্যে ব্রিটিশরা যে ভূমি আইন প্রবর্তন করেছিল, তার জেরে সতীদাহ তীব্রতর হয়েছিল: বিধবাদের মালিকানাধীন জমি হাতিয়ে নেওয়ার জন্যে তাঁদের খুন করাটা অকস্মাৎ বেশ লাভজনক হয়ে উঠেছিল। যে উপসর্গের জেরে এই রোগের এতটা বাড়বাড়ন্ত, সেই উনিবেশবাদই শেষে কিনা রোগের মহৌষধি হিসেবে সমাদৃত হয়ে উঠল!
প্যাডেল-সহ অন্যান্যরা এই সন্দেহ পোষণ করছেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সুবলপুরের ঘটনা সম্পর্কে মিথ্যা খবর পরিবেশনের মাধ্যমে ভারতের আদিবাসী পরিষদের বর্বরতার অভিযোগ তুলে ধরা হচ্ছে সেই একই উদ্দেশ্যসাধন করতে। ভারতে আদিবাসীরা যে প্রতিরোধ চালাচ্ছেন, তার জেরে খনি প্রকল্পগুলিতে ইতিমধ্যেই লগ্নি করা প্রায় ১০ বিলিয়ন এবং আগামীদিনে শত শত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। গত বছর ডোঙ্গরিয়া কোন্ধ পরিষদগুলির গৃহীত সিদ্ধান্তের জেরে নিয়মগিরি পাহাড় থেকে খনন করা আকরিক পরিশোধন করার জন্য নির্মিত লাঞ্জিগড় কমপ্লেক্সে বেদান্ত সংস্থার লগ্নি করা ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে। একদিকে গণধর্ষণের একটা ঘটনার অভিযোগকে খতিয়ে না দেখেই মেনে নেওয়া হচ্ছে যে তা নাকি একটি আদিবাসী পরিষদের নির্দেশেই সংঘটিত হয়েছে, আর অন্যদিকে উন্নয়নের নামে যেভাবে সমগ্র আদিবাসী সমাজকে ধ্বংস করা হচ্ছে, তাকে দিব্যি মেনে নেওয়াটা প্রকৃতপক্ষে নব্য-ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করতেই: উক্ত ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে উন্নয়নের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ানো গ্রামসভাগুলোকে নিষিদ্ধ করে দিকুদের লাভের জন্যে আদিবাসী জল-জঙ্গল-জমির পুরোপুরি দখল নেওয়া।
প্রথম প্রকাশ: গ্রিস্ট মিডিয়া
অনুবাদ:
অর্ণব দত্ত
অনুবাদ সহায়তা ও সম্পাদনা: স্মিতা খাটোর