"লোকে আমার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করে, 'সেকি জনাব, আপনার বাড়ির এক অওরত বাইরে গিয়ে টাকা রোজগার করছে?' আসলে আমি তো এই শহরের মানুষ নই, তাই নিয়মকানুনগুলো যেন একটু বেশিই কড়া আমার জন্য," কথাগুলো ফাতিমা বিবির।

কথা বলতে বলতেই বাড়িতে ঢুকে এক ঝটকায় তাঁর নিক্বাবটি খুলে সদর দরজার পাশে একটি খুঁটে টাঙিয়ে রাখলেন তিনি। "ছোট্টবেলায় ভাবতাম, আমার দৌড় বোধহয় সেই রান্নাঘর অবধিই – রাঁধা-বাড়া, ঘরকন্না সামলানো, এসব করেই জিন্দেগিটা কেটে যাবে।" স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হেসে ফেললেন ফাতিমা, "কিন্তু যখন ঠিক করলাম যে নাহ্, কিছু একটা করতেই হবে, তখন বাইরে বেরিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আজাদি আমি পেয়েছিলাম বাড়ির লোকের থেকে। হ্যাঁ, আমি মুসলিম মহিলা, বয়সটাও অল্প, কিন্তু করতে পারি না এমন কোনও কাজ এ দুনিয়ায় নেই," স্পষ্ট হয়ে উঠল মেয়েটির লড়াকু স্বভাব। সাঁঝের আলোয় ঝিলমিলিয়ে উঠছিল তাঁর দুপাট্টায় বসানো রুপোলি চুমকির সারি।

উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ (পূর্বতন এলাহাবাদ) জেলার মাহেওয়া শহরে থাকেন ফাতিমা। এ মুলুকের মৃদু মন্থর জীবন, আর পাশেই বইতে থাকা ধীরতোয়া যমুনার স্রোত, দুটি যেন পরস্পরের প্রতিচ্ছবি। তবে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকাটা তাঁর চরিত্রে নেই, দক্ষ কারিগর হওয়ার পাশাপাশি একজন সফল হস্তশিল্প ব্যবসায়ী তিনি, মুঞ্জ দিয়ে দৈনন্দিন ব্যবহারের টুকিটাকি নানান সামগ্রী বানিয়ে বিক্রি করেন তিনি। সরপৎ নামে একধরনের ছুঁচালো খাগড়া ঘাস পাওয়া যায় এ অঞ্চলে, তারই পাতার বাইরের অংশটার নাম 'মুঞ্জ', এ দিয়ে হরেক রকমের জিনিস বানানো হয় – সেগুলিও মুঞ্জ নামেই পরিচিত।

বড়ো হয়ে কী করবেন না করবেন সেটা হয়ত অল্প বয়সে ঠিক বুঝে উঠতে পারতেন না ফাতিমা। তবে মোহাম্মদ শাকিলের সঙ্গে নিকাহ করে মাহেওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে আসার পর নতুন এক দরজা খুলে যায় তাঁর সামনে। হবে না-ই বা কেন? শাশুড়ি আয়েশা বেগম যে একজন অভিজ্ঞ মুঞ্জ-কারিগর।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: মুঞ্জ দিয়ে বানানো টুকরির ঢাকনা বুনছেন আয়েশা বেগম। শুকনো খাগড়া দিয়ে ঝুড়ি, টুকরি, কোস্টার, গয়না এবং ঘর সাজানোর জিনিস ইত্যাদি বানান তিনি। ডানদিকে: তৈরি করা সামগ্রী সাজিয়ে বসে আছেন আয়েশার পুত্রবধূ ফাতিমা বিবি, এগুলি দোকানে তথা হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে বিক্রি হবে

দুচোখ ভরে নবোঢ়া এই বধূ দেখতেন, আয়েশার সুদক্ষ হাতে সেই জংলা ঘাসের পাতা কেমন পোষ মানছে, আর তৈরি হয়ে চলেছে একের পর এক গৃহস্থালির বস্তু: ঢাকনা দেওয়া বা ঢাকনাহীন টুকরি, একেকটার আকার ও প্রকার একেক রকমের, পেয়ালা-পোশ (কোস্টার), বারকোশ, কলমদানি, বটুয়া, আবর্জনা ফেলার ঝুড়ি তথা খুদে খুদে দোলনা, ট্রাক্টর এবং আরও রকমারি খেলনা। এসব বেচে যেমন রোজগারটা ভালো হত, তেমনই সেই টাকাটা বাড়ির মহিলাদের হাতেই থাকত।

"পিপিরাসায় এ কাজটা [মুঞ্জ দিয়ে নানান সামগ্রী বানানোর কারিগরি] আমার আম্মিকেও করতে দেখেছি বটে," জানালেন ফাতিমা। দেখতে না দেখতেই এই কাজে হাত পাকিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। দুই সন্তানের এই মায়ের কথায়: "গিন্নি বটি, ঘরদোর সব সামলাতে হত, কিন্তু এর চাইতে ঢের বেশি করার জুনুন ছিল আমার। আজ দেখুন, মাস গেলে কেমন সুন্দর [মুঞ্জশিল্পের মাধ্যমে] ৭,০০০ টাকা কামাচ্ছি।" মেয়ে আফিয়া আর ছেলে আলিয়ানের বয়স যথাক্রমে ৯ আর ৫।

এমনকি যখন মুঞ্জের জিনিসপত্র বানাচ্ছেন না, সেইসময়েও কেমনভাবে এ শিল্পের কথা লোকমাঝে আরও বেশি বেশি করে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সে ব্যপারে সজাগ থাকেন ফাতিমা - মুঞ্জের সামগ্রী জোগাড়যন্তর করে তা বিক্রিবাটার ব্যবস্থা করা, প্রশিক্ষণমূলক কর্মশালা চালানো, অথবা এই শিল্পকে ঘিরে চলতে থাকা নীতি যাতে বদলায়, সে ব্যপারে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে লেগে থাকেন। এ জগতে এমনও সাহসী ও দয়াময়ী মহিলারা আছেন যাঁরা অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে পথ চলায় বিশ্বাসী – তাঁদেরই দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে 'এঞ্জেল' নামে মহিলা-সর্বস্ব একটি আত্মনির্ভর গোষ্ঠী (সেল্ফ হেল্প গ্রুপ বা এসএইচজি) বানিয়েছেন ফাতিমা। "আমার ঠিক কোন ধরনের ফিল্ম ভাল লাগে জানেন? যেখানে মেয়েরা একে অপরের সঙ্গে রেষারেষি না করে বরং শান্তিতে বাঁচতে ভালবাসে," বুঝিয়ে বললেন তিনি।

এই যে আজ তিনি পরিচিতি ও সম্মান দুটোই পাচ্ছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙে দেখা-সাক্ষাতও হচ্ছে, এ নিয়ে রোমাঞ্চের শেষ নেই তাঁর। "আগে আগে আমার শোহর [মোটরগাড়ি মেরামতির কাজ করেন তিনি] তো ভেবেই পেত না যে আমি এমন ইতিউতি যাচ্ছিটা কোথায়, কিন্তু আজ এত মানসম্মান পাচ্ছি দেখে আমাকে নিয়ে ফখরের অন্ত নেই মানুষটার। গেল দুই বছর হল হপ্তায় দিন দুয়েকের বেশি থাকতেই পারি না বাড়িতে," আজাদি ঘেরা তাঁর জিন্দেগির কথা বলছিলেন ফাতিমা। এসএইচজির সদস্য তথা খদ্দেরের সঙ্গে মোলাকাত, অন্যদের প্রশিক্ষণ এবং নিজের বাচ্চাদের দেখভাল, এসব করতে গিয়েই পুরো সময়টা বেরিয়ে যায় তাঁর।

মুঞ্জশিল্পের এই প্রচার দুহাত পেতে গ্রহণ করেছেন মাহেওয়ার ব্যবসামনস্ক মহিলারা, উপরি খানিক রোজগারের এ সুযোগটা হাতছাড়া করতে নারাজ তাঁরা

ভিডিও দেখুন: প্রয়াগরাজের সবুজ শ্যামল ঘাস

তা সত্ত্বেও থেকে থেকে দুকথা শোনাতে ছাড়ে না লোকে। "ধরুন কোনও প্রশিক্ষণ সভায় গেছি, সেখানে পুরুষ মানুষ রয়েছে, তা সবার সঙ্গে তো দুয়েকটা ফোটো তুলতেই হয়, তখন লোকজন এসে আমার শাশুড়িমাকে বলে, 'দেখুন দেখি, কেমন পুরুষ মানুষের সঙ্গে ছবি তুলছে মেয়েটা!" উত্তরপ্রদেশের এই ছোট্ট শহরে থেকেও সামাজিক সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চিপে মোকাবিলা করে যাচ্ছেন ফাতিমা, তাঁকে ঝোঁকায় কার সাধ্যি?

ইউপিতে সেন্সাস (জনগণনা ২০১১) শহর রুপে চিহ্নিত মাহেওয়া পট্টি পশ্চিম উপরহারে ৬,৪০৮জন মানুষের বাস, তবে স্থানীয়দের মুখে এটি 'মাহেওয়া গাঁ' হিসেবেই পরিচিত। কর্ছনা তেহসিলে যেখানে যমুনার জল গিয়ে মেশে গঙ্গায়, সেই হিন্দু তীর্থরূপী সঙ্গমের মাইলটাক দূরেই দাঁড়িয়ে আছে মাহেওয়া।

মাহেওয়াবাসীদের জীবন ও জীবনযাত্রা দুই-ই একসুত্রে বাঁধা পড়েছে যমুনার জলে। সঙ্গমে এসে ফুলফল নৈবেদ্য ভরা তালপাতার যে টুকরিগুলি ব্যবহার করেন তীর্থযাত্রীর দল, সেগুলিও এখানকার মহিলা কারিগরদের হাতে গড়া। বাড়ির পুরুষরা কাজ করতে যান প্রয়াগরাজ নগরে, সে মেকানিকের কাজই হোক বা বা গাড়ি চালানো কিংবা খাবারের দোকানে কাজ, এছাড়াও ছোটখাটো কিছু গুমটি চালান কয়েকজন।

মজার বিষয় হচ্ছে, প্রয়াগরাজ জেলার মোট জনসংখ্যার (জনগণনা ২০১১) ১৩ শতাংশ মুসলিম হলেও মাহেওয়ায় তাঁরা মোটে ১ শতাংশ। অথচ মুঞ্জের এই শিল্প যাতে লুপ্ত না হয়ে যায়, সে ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা কিন্তু সেই আয়েশা ও ফাতিমার মতো মুসলিম মহিলাদেরই নিতে হয়েছে। "আমরা তো সব মহিলাদেরই শেখাই, কিন্তু এ কারবারে যারা যারা আছে, তাদের অধিকাংশই তো একটা বেরাদরির মানুষ। বাকিরা তো আধা-আধুরা রেখেই কেটে পড়ে। ওরা বোধহয় অন্যান্য কামকাজে ব্যস্ত," বলে উঠলেন ফাতিমা।

*****

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: চিলেকোঠার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফাতিমা ও আয়েশা, এখানেই মজুত করা হয় শুকনো খাগড়ার বাণ্ডিল। ডানদিকে: সদ্য-কাটা মুঞ্জ এক সপ্তাহ ধরে শুকানো হয় কড়া রোদে, যতক্ষণ না ঘিয়ে রং ধরছে। তারপর কাসা নামক এক ধরনের সরু সরু ঘাস দিয়ে বাঁধা হয় মুঞ্জের বাণ্ডিল

মাহেওয়ায় তাঁর বাড়ির চিলেকোঠার দরজা খুলে দিলেন ফাতিমা, সংসারের হাজারগণ্ডা বাতিল জিনিসের স্তূপের উপর থরে থরে সাজানো রয়েছে অমূল্য মুঞ্জের গোছা, এটাই তাঁর গুদামঘর। "শীতের মরসুম [নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি] না এলে মুঞ্জ পাই না আমরা। সবুজ ঘাসগুলো ফালা ফালা করে ছিঁড়ে শুকিয়ে নিই, তারপর মজুত করে রাখি এখানে। গেরস্থালির সবচাইতে শুখা কামরা এটাই, হাওয়া ঢোকে না বিশেষ। বৃষ্টির জল বা হাওয়া লাগলে এই খাগড়ার রং পাল্টে কেমন যেন হলদেটে হয়ে যায়," জানালেন তিনি।

হলদেটে খাগড়ার কোনও দাম নেই, কারণ সেগুলো মুচমুচে ভঙ্গুর তো বটেই, উপরন্তু রাঙানোও যায় না ঠিক করে। মুঞ্জের ফালি হাল্কা ঘিয়ে রঙের হলে তবেই সেগুলো ইচ্ছেমতো রং করতে পারেন কারিগর। তবে সেটা করার আগে সদ্য-কাটা খাগড়া বাণ্ডিল বেঁধে শুকোতে হয় হপ্তাখানেক ধরে – এর জন্য রোদ আসে অথচ হাওয়া নেই এমন উন্মুক্ত জায়গা দরকার।

মজুত করা মুঞ্জের হিসেব নিতে আমাদের পিছু পিছু ছাদে উঠে এসেছিলেন আয়েশা বেগমও। ওস্তাদ এই শিল্পীর বয়স আজ পঞ্চাশের কোঠায়, তাঁর মনে পড়ে এককালে কেমন দু-পা হেঁটে যমুনার তীরে গেলেই দিব্যি গোছা গোছা খাগড়া নিয়ে আসা যেত। বিগত কয়েক দশক ধরে উন্নয়ন এবং নগরায়নের গ্রাসে ক্রমশই এই গাঙধারের খোলা জমিন সঙ্কুচিত হতে থাকায় মুঞ্জও মহার্ঘ্য হয়ে উঠছে।

"এখন তো মুঞ্জ কেবল মাঝি-মাল্লাদের কাছেই মেলে, যমুনার পাড় থেকে গাট্টা [মোটামুটি ২-৩ কিলো ওজন] বেঁধে নিয়ে আসে, একেকটা গাট্টা ৩০০-৪০০ টাকায় খরিদ করি আমরা," সিঁড়ি দিয়ে আমাদের সঙ্গে নামতে নামতে বলেছিলেন আয়েশা। নিচের এই উঠোনটাই তাঁর কর্মক্ষেত্র। এক গাট্টা মুঞ্জ থেকে ১২ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চির দুখানা টুকরি বানান কারিগরেরা, এ দুটো বেচলে হাজার দেড়েক টাকা জোটে। এমন টুকরিতে হয় গাছ লাগানো হয়, অনেকে আবার জামাকাপড়ও ভরে রাখেন।

মুঞ্জশিল্পের চাবিকাঠি লম্বায় ৭-১২ ফুট সরপৎ প্রজাতির ঘাস। এছাড়াও কাসা নামক আরেক ধরনের অপেক্ষাকৃত পাতলা ঘাস পাওয়া যায়, এই শিল্পে তার ভূমিকাও নেহাত কম নয়। মুঞ্জের পোক্ত পাতা বাঁধতে গেলে কাসার প্রয়োজন, তবে জিনিসপত্রগুলো একবার তৈরি হয়ে গেলে কাসার পাতা আর দেখা যায় না বললেই চলে। নদীর পাড়ে ঝাঁক বেঁধে গজায় কাসা, শক্ত করে বাঁধা বাণ্ডিল ৫-১০ টাকায় বিক্রি হয়।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: সিরাহি নামে তীক্ষ্ণাগ্র ছুঁচ দিয়ে গিঁট বাঁধছেন আয়েশা বেগম। ডানদিকে: হিলহিলে কাসার দেহে মোটা করে মুঞ্জের পাত্তি পাকান তিনি, যাতে কাঠামোটা দড় হয়

ঘরের উঠোনে বসে কাজে ডুবে গেলেন আয়েশ। টুকরির ঢাকনার উপর লাগাবেন বলে সরপতের গিঁট বাঁধছিলেন। সরঞ্জাম বলতে কাঁচি আর একখান ধারালো ছুরি, ও দিয়েই মুঞ্জের সুক্ষ্মতম পাত্তিগুলো কেটেছেঁটে, গুঁজে, আঁটোসাঁটো করে বাঁধতে দেখলাম তাঁকে। কয়েকটা পাত্তি অবশ্য নাছোড়বান্দা, ভাঙবে তবু মচকাবে না, তাদের বাগে আনতে এক বালতি জলে চুবিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি।

"শাশুড়িকে দেখে দেখেই তো শিখেছি [এই কাজের খুঁটিনাটি]। ৩০ বছর আগে হাতেখড়ি হয় আমার, রুটি রাখার ডাব্বা দিয়ে শুরু, তখন সবে সবে নিকাহ্ করে এসেছি এ বাড়িতে," জানালেন আয়েশা। জন্মাষ্টমীর পরবে নাড়ুগোপালকে রাখার জন্য খুদে একখান দোলনাও বানিয়েছিলেন তিনি এককালে।

রুক্ষ দুহাত তাঁর অজস্র কাটাছেঁড়ার দলিল: "ঘাসগুলো ছুরির মতন, পাতলা অথচ ভীষণ শক্ত, এগুলো নাড়াচাড়া করতে গেলে হাতদুটো ফালা ফালা হয়ে যায়।" শুরুর দিকের কথা মনে করতে গিয়ে বলে উঠলেন: "[তখনকার দিনে] বাড়ির সব্বাই এসে হাত লাগাত এ কাজে – মেয়ে আর বাচ্চারা মুঞ্জ দিয়ে এটাসেটা বানাত, তারপর সেসব নিয়ে বাজারে বেচে আসত মর্দরা। গেরস্থালির জনা দুই-তিন মহিলা যদি একসঙ্গে মিলে কাজ করত, হেসেখেলে ৩০ টাকা আসত হররোজ, ও দিয়ে ঘরকন্না চালানো বেশ আসান ছিল তখন।"

এক দশক হতে চলল ভাঁটা পড়েছে মুঞ্জের চাহিদায়, মহিলারা আর এ শিল্পে হাত দিতে চান না, হাজার খুঁজলেও গুটিকয়েকের বেশি সামগ্রী আর মেলে না বাজারে। তবে ঘটনাচক্রে বেশ অদ্ভুতভাবেই বরাত খুলেছে এ কারিগরির। ২০১৩ সালে 'এক জেলা এক পণ্য' (ওডিওপি) যোজনাটি শুরু করে ইউপি সরকার, এবং প্রয়াগরাজ জেলার বরাতে লেখা ছিল মুঞ্জের নাম, কারণ নয় নয় করেও এই শিল্পের ইতিহাস অন্তত সাত দশক পুরানো।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: বছর পঞ্চাশের আয়েশা একজন অভিজ্ঞ মুঞ্জ-কারিগর। 'শাশুড়িকে দেখে দেখে শিখেছি। ৩০ বছর আগেকার কথা, রুটি রাখার একটা বাক্স বানিয়ে মুঞ্জের জগতে পা রাখি আমি।' ডানদিকে: দিনকতক আগেই এই টুকরি ও ঝুড়িগুলি বানিয়েছেন আয়েশা

প্রয়াগরাজ জেলার শিল্প উপাধ্যক্ষ অজয় চৌরাসিয়ার কথায়: "[মুঞ্জ দিয়ে বানানো দ্রব্যের] চাহিদা ও বিক্রিবাটা, দুটোই বেড়ে গেছে ওডিওপির তকমা লাগার ফলে, সে পুরানো কারিগরই বলুন বা নতুন প্রজন্মের কারিগর, অনেকেই এসে কড়া নাড়ছে [এ শিল্পের দুয়ারে]।" ইনি জেলা উদ্যোগ কেন্দ্রের প্রধানও বটেন। ওডিওপির সুযোগ-সুবিধা যাতে কারিগর মহিলারা পান, সেটা বাস্তবায়িত করার দ্বায়িত্ব এই রাজ্যস্তরের সংগঠনটির উপরেই বর্তায়। "যে যে মহিলারা এগিয়ে আসছেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ এবং সাজ-সরঞ্জাম, দুটোরই বন্দোবস্ত করছি আমরা। আমাদের লক্ষ্য, বছর গেলে যাতে ৪০০ জনকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারি," জানালেন তিনি। এছাড়াও রাজ্য এবং দেশজুড়ে নিয়মিত মেলার আয়োজন করে এই কেন্দ্রটি।

মুঞ্জশিল্পের এই প্রচার দুহাত পেতে গ্রহণ করেছেন মাহেওয়ার ব্যবসামনস্ক মহিলারা, খানিক উপরি রোজগারের এ সুযোগটা হাতছাড়া করতে নারাজ তাঁরা। হোয়াটসঅ্যাপের দ্বারা কীভাবে কাজের বরাত আসে, মেহনত ও রোজগার কেমন করে ভাগ করে দেওয়া হয় সকল মহিলাদের মধ্যে, এসব কথা জানতে পারলাম আয়েশার কাছে।

ওডিওপি যোজনার সুবাদে এঁদের চৌকাঠ অবধি এসে পৌঁছেছে তহবিল। "এই যোজনাটার ফলে টাকা ধার করতে অসুবিধা হয় না। কামকাজ শুরু করবেন বলে আমার এসএইচজির অনেকেই ১০-৪০ হাজার টাকার লোন তুলেছেন," বললেন ফাতিমা। ঋণ নিলে এ যোজনার আওতায় ২৫ শতাংশ অবধি ভর্তুকি মেলে, অর্থাৎ কর্জের ২৫ শতাংশ মকুব হয়ে যায়। বাকি যেটুকু পড়ে থাকল, সেটা তিনমাসের মধ্যে চুকিয়ে দিলে এক পয়সাও সুদ লাগে না। সেটা না পারলে তার পরের মাস থেকে বাৎসরিক ৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়।

এই যোজনার ফলে অন্যান্য জায়গার মহিলারাও আকৃষ্ট হবেন বলে ভাবা হচ্ছে। আয়েশার মেয়ে নাসরীন বিয়েথা করে ফুলপুর তেহসিলের আন্দাওয়া গ্রামে থাকেন, মাহেওয়া থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। শিক্ষা ও মনস্তত্ত্বে এই ২৬ বছর বয়সী স্নাতকের কথায়: "এ খাগড়ার ইস্তেমাল এখানেও [আন্দাওয়া] হয়, তবে স্রেফ ছাদ ছইতে, টালিগুলো বসানোর আগে সরপৎ বিছিয়ে দিই আমরা, বরসাতের পানি যাতে না ঢোকে।" মুঞ্জের আর্থিক সম্ভাবনা যে কতখানি সেটা মায়ের কাছে দেখে আজ আন্দাওয়াতেও এ সনত চালু করতে উঠেপড়ে লেগেছেন নাসরীন।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

আয়েশা বেগম ও ফাতিমা বিবির পড়শিও একজন ওস্তাদ মুঞ্জশিল্পী, এঁর নামও আয়েশা। তিনি যা-ই বানান না কেন, সামগ্রী-পিছু ১৫০-২০০ টাকার কমে রোজগার হয় না তাঁর। 'বেকার বসে খালি খালি সময় নষ্ট না করে কি সুন্দর সময় কাটছে, টাকাকড়িও আসছে হাতে'

বছর কুড়ি আগে মুঞ্জ দিয়ে বানানো রুটি রাখার ঝুড়ি মোটে বিশ টাকায় বিক্রি হত। আজ তার দাম ১৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতির কথা মাথায় রাখলেও আজও এ অঞ্চলে ১৫০ টাকার মূল্য যে অনেকখানি, একথা না মেনে উপায় নেই। ঠিক এই কারণেই হয়ত ৬০-এর কোঠায় পা রেখেও এই কাজে আগ্রহী ফাতিমার পড়শিও, মজার বিষয়, তাঁর নামও আয়েশা বেগম। একটানা বেশিক্ষণ কাজ করলে চোখ জ্বালা করে বটে, তবে উৎসাহে ভাঁটা পড়েনি একফোঁটাও: "যা যা সামান বানাই, একেকটার থেকে ১৫০-২০০ টাকা রোজগার হয়। বেকার বসে খালি খালি সময় নষ্ট না করে কি সুন্দর সময় কাটছে, টাকাকড়িও আসছে হাতে।" বাড়ির সামনের উঠোনে ফরাস পেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিলেন তিনি, দেখতে না দেখতেই টুকরির একখান ঢাকনা বানিয়ে ফেললেন, এমনই ক্ষিপ্র তাঁর দুহাতের ভোজবাজি।

আয়েশার কথা শুনে পাশ থেকে ফুট কাটলেন শোহর মোহাম্মদ মাতিন: "এসব বলছে তো? একটু পরেই দেখবেন পিঠ ব্যথা করছে বলে নালিশ করবে।" কিন্তু এই কাজ কি আদৌ পুরুষের পক্ষে সম্ভব? অবসরপ্রাপ্ত এই চায়ের দোকানের মালিককে এটা জিজ্ঞেস করায় মুচকি না হেসে পারলেন না তিনি: "কয়েকজন মরদ পারে তো বটেই, তবে আমার দ্বারা হয় না এসব।"

সাঁঝ ঘনিয়ে আসছিল মাহেওয়ার দ্বারে, প্রস্তুত কিছু সামগ্রী নিয়ে মেয়ের বাড়ি এসে পৌঁছলেন ফাতিমার আম্মি আসমা বেগম। আগামীকাল প্রয়াগরাজের সার্কিট হাউজে একটা ছোট্ট প্রদর্শনী আছে, এগুলো সেখানেই নিয়ে যাবেন ফাতিমা। নিজের দক্ষতার প্রমাণস্বরূপ অপূর্ব কাজ করা একটি টুকরির ঢাকনা তুলে দেখালেন আসমা। "গরমাগরম খানা রাখার একটা পেয়ালা-পোশ বানাতে দিন তিনেক তো লাগেই। রয়ে-সয়ে না করলে ঘাসগুলো ছিঁড়ে যাবে যে," বুঝিয়ে বললেন তিনি। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঠুনকো জিনিসপত্র বানাতে সরু খাগড়ার পাত্তি ইস্তেমাল করেন কারিগরেরা, তাতে অনেক সময় লাগে বটে, তবে দাম অনেকটাই বেশি পাওয়া যায়।

বছর পঞ্চাশেকের আসমার বেশ নামডাক আছে এই হস্তশিল্পের জগতে। এই তো, দিনকতক আগেই মাহেওয়া থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে পিপিরাসায় তাঁর বাড়িতে ৯০ জন মহিলাকে মুঞ্জশিল্পে প্রশিক্ষিত করে তুলেছেন = তাঁদের বয়স ১৪ থেকে ৫০-মধ্যে মধ্যে। "এই কাজটা বহুত উমদা। যে কেউ তালিম নিয়ে, রুজিরুটির পথ খুঁজে জিন্দেগিতে অনেক দূর যেতে পারে," বলছিলেন তিনি, "যতদিন দুহাত চলছে ততদিন এই কাজ ছাড়ছিনে। ফাতিমার কাজে আমি বেজায় খুশি।"

PHOTO • Priti David
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: অভিজ্ঞ মুঞ্জশিল্পী ফাতিমার আম্মি আসমা বেগম অসংখ্য মাহিলাকে তালিম দিয়ে থাকেন। 'এই শিল্পে যে কেউ তালিম নিয়ে, রুজিরুটির পথ খুঁজে জিন্দেগিতে অনেক দূর যেতে পারে।' ডানদিকে: আসমা বেগম, হাতে তাঁর নিজের বানানো ঢাকনাসহ রংদার টুকরি

ক্লাস ফোরের বেশি পড়তে পারেননি আসমা, ১৮ বছর বয়েসেই ফাতিমার আব্বুর সঙ্গে নিকাহ্ হয়ে যায় তাঁর। শোহর পেশায় ছিলেন চাষি, একর দুয়েক জমি ছিল তাঁর। মাস গেলে প্রশিক্ষণ দিয়ে জেলা উদ্যোগ কেন্দ্র থেকে ৫,০০০ টাকা পান তিনি। তালিমের একেকটা দফা মাস ছয়েক চলে, সেখানে অংশগ্রহণ করলে মাসিক ৩,০০০ টাকা করে পান মহিলারা। আসমার জবানে: "মেয়েগুলো তো [এমনিতে] টো-টো করে ঘুরে বেড়াত, তার বদলে এখন কি সুন্দর শিখতে পারছে, বাড়িতে বসে বসেই রোজগার করছে। এমনকি কয়েকজন তো এই টাকাটা দিয়ে পড়াশোনাও চালাচ্ছে দিব্যি।"

এই মুঞ্জ কারিগরেরা একটা যাদুঘর এবং কর্মশালা গড়ে তোলার কথা ভাবছেন। "একখান যাদুঘরের আশায় দিন গুনছি, লোকজন দেখতে আসবে, আমাদের কামকাজের নাম করবে। সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলো সাজানো থাকবে, এমনকি বানানোর পদ্ধতিটাও দেখতে পাবেন," ফাতিমা জানালেন। যাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত কর্মশালার ফলে বেশি বেশি সংখ্যায় মহিলারা এগিয়ে আসতে পারবেন। চৌরাসিয়ার কাছ থেকে জানা গেল, কারিগরদের জন্য একটি গ্রাম বানাবে বলে কেন্দ্রীয় সরকার ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে গতবছর। উক্ত যাদুঘরটি এই গ্রামের মাঝেই খাড়া করা হবে। "প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে বটে, তবে খানিক সময় তো লাগবেই," বলে উঠলেন তিনি।

"কর্মশালায় কেউ শুধু বুনবে, কেউ বা শুধুই রং করবে – কামকাজ সব ভাগাভাগি করে দেওয়া হবে। বেশ আয়েস করে বসে বসে কাজ করব সবাই মিলে, মুঞ্জশিল্পে নিযুক্ত মেয়ে কারিগরদের নিজের দুনিয়া, বেশ মজা হবে!" উৎসাহের অন্ত ছিল না ফাতিমার কণ্ঠে, শক্তপোক্ত খাগড়ার পাতায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিল তাঁর খোয়াবরঙা ভবিষ্যৎ।

এই প্রতিবেদনটি লিখতে সাহায্য করেছেন স্যাম হিগিনসন ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচার, টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সের (এসএইচইউএটিএস) অধ্যাপকদ্বয় জাহানারা ও আরিফ ব্রডওয়ে, তাঁদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন লেখক।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Reporter : Priti David

ಪ್ರೀತಿ ಡೇವಿಡ್ ಅವರು ಪರಿಯ ಕಾರ್ಯನಿರ್ವಾಹಕ ಸಂಪಾದಕರು. ಪತ್ರಕರ್ತರು ಮತ್ತು ಶಿಕ್ಷಕರಾದ ಅವರು ಪರಿ ಎಜುಕೇಷನ್ ವಿಭಾಗದ ಮುಖ್ಯಸ್ಥರೂ ಹೌದು. ಅಲ್ಲದೆ ಅವರು ಗ್ರಾಮೀಣ ಸಮಸ್ಯೆಗಳನ್ನು ತರಗತಿ ಮತ್ತು ಪಠ್ಯಕ್ರಮದಲ್ಲಿ ಆಳವಡಿಸಲು ಶಾಲೆಗಳು ಮತ್ತು ಕಾಲೇಜುಗಳೊಂದಿಗೆ ಕೆಲಸ ಮಾಡುತ್ತಾರೆ ಮತ್ತು ನಮ್ಮ ಕಾಲದ ಸಮಸ್ಯೆಗಳನ್ನು ದಾಖಲಿಸುವ ಸಲುವಾಗಿ ಯುವಜನರೊಂದಿಗೆ ಕೆಲಸ ಮಾಡುತ್ತಾರೆ.

Other stories by Priti David
Editor : Sangeeta Menon

ಸಂಗೀತಾ ಮೆನನ್ ಮುಂಬೈ ಮೂಲದ ಬರಹಗಾರು, ಸಂಪಾದಕರು ಮತ್ತು ಸಂವಹನ ಸಲಹೆಗಾರರು.

Other stories by Sangeeta Menon
Translator : Joshua Bodhinetra

ಜೋಶುವಾ ಬೋಧಿನೇತ್ರ ಅವರು ಪೀಪಲ್ಸ್ ಆರ್ಕೈವ್ ಆಫ್ ರೂರಲ್ ಇಂಡಿಯಾ (ಪರಿ) ಯ ಭಾರತೀಯ ಭಾಷೆಗಳ ಕಾರ್ಯಕ್ರಮವಾದ ಪರಿಭಾಷಾ ವಿಷಯ ವ್ಯವಸ್ಥಾಪಕರು. ಅವರು ಕೋಲ್ಕತ್ತಾದ ಜಾದವಪುರ ವಿಶ್ವವಿದ್ಯಾಲಯದಿಂದ ತುಲನಾತ್ಮಕ ಸಾಹಿತ್ಯದಲ್ಲಿ ಎಂಫಿಲ್ ಪಡೆದಿದ್ದಾರೆ ಮತ್ತು ಬಹುಭಾಷಾ ಕವಿ, ಅನುವಾದಕ, ಕಲಾ ವಿಮರ್ಶಕ ಮತ್ತು ಸಾಮಾಜಿಕ ಕಾರ್ಯಕರ್ತರೂ ಹೌದು.

Other stories by Joshua Bodhinetra