উত্তর-পশ্চিম মহারাষ্ট্রের সাতপুরা পাহাড়ে ঘেরা ফালাই গ্রাম, খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে বড়সড় একটা কাঁচি, ছিটকাপড় আর ছুঁচসুতো নিয়ে তার 'পড়ার টেবিলে' বসে আছে আট বছরের শর্মিলা পাওরা।

পুরোনো একটা সেলাইকলও রয়েছে টেবিলটার উপর, আর আছে আধ-তৈরি একটা জামা, শর্মিলার বাবা এটা আর শেষ করে উঠতে পারেননি গতকাল রাত্রে। বাপের কাজ শেষ করছে এই বয়েসেই দক্ষ হয়ে ওঠা মেয়ে, ভাঁজগুলো ধরে ধরে দড় হাতে বসিয়ে দিচ্ছে সেলাই।

নন্দুরবার জেলার প্রত্যন্ত তোরনমল অঞ্চলের এই গ্রামের স্কুলে অতিমারি-লকডাউনের কারণে ২০২০ সালের মার্চে তালা পড়ে যায়, সেই থেকে এই টেবিলটাই খুদে শর্মিলার ক্লাসরুম। "সেলাই-ফোঁড়াই আমি নিজে নিজেই শিখেছি, মন দিয়ে দেখতাম মা-বাবা কেমন করে এসব করে," জানায় সে।

তবে স্কুলে সে যা যা শিখেছিল, ১৮ মাসের দীর্ঘ ছেদের জেরে তার বেশিটাই ভুলে গেছে।

ফালাই গ্রামে কিন্তু স্কুল বলে কিছুই নেই। বাচ্চারা যাতে শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে, তাই ২০১৯ সালের জুনে শর্মিলার মা-বাবা তাকে গ্রাম থেকে ১৪০ কিমি দূরে নন্দুরবার শহরের অটল বিহারী বাজপেয়ী আন্তর্জাতিক আবাসিক স্কুলে ভর্তি করেন। মহারাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক শিক্ষা পরিষদের অধিভুক্ত তথা জেলা পরিষদের অধীনে এরকম ৬০টি স্কুল রয়েছে। মহারাষ্ট্রের তফসিলি জনজাতির বাচ্চাদের জন্য বিশেষ ভাবে বানানো এই বিদ্যালয়গুলি 'আশ্রমশালা' নামেও পরিচিত। উক্ত পরিষদটি গঠিত হয় ২০১৮ সালে। স্থানীয়ভাবে রূপায়িত তাদের পাঠ্যক্রম পড়ানো হয় মারাঠি ভাষায়, তবে শিক্ষাগত মান নাকি আন্তর্জাতিক স্তরের – অন্তত এমনটাই দাবি ছিল পরিষদের। (তবে এই পরিষদটি আজ আর নেই, উক্ত স্কুলগুলির দ্বায়িত্ব তুলে নিয়েছে খোদ রাজ্য শিক্ষা পরিষদ।)

Sharmila Pawra's school days used to begin with the anthem and a prayer. At home, her timetable consists of household tasks and ‘self-study’ – her sewing ‘lessons’
PHOTO • Jyoti
Sharmila Pawra's school days used to begin with the anthem and a prayer. At home, her timetable consists of household tasks and ‘self-study’ – her sewing ‘lessons’
PHOTO • Jyoti

বন্দনা আর প্রার্থনা দিয়ে শুরু হত শর্মিলা পা ওরার ইস্কুলের দিনগুলি। তবে বাড়িতে তার পাঠ্যক্রম একেবারেই অন্যরকম – সংসারের টুকিটাকি কাজ আর নিজে নিজে শেখা সেলাই-ফোঁড়াই

স্কুল-জীবন শুরু হয় শর্মিলার, তবে তার কাছে মারাঠি ছিল আনকোরা একটা নতুন ভাষা। পাওরা জনজাতির মানুষ সে, বাড়িতে পাওরি ভাষায় কথা বলাতেই অভ্যস্ত। আমার নোটবইয়ে লেখা মারাঠি কিছু শব্দ দেখে তার মনে পড়ে গেল স্কুলে শেখা অক্ষরমালার কথা। কিন্তু সে হিন্দিতে জানাল: "সবকটা মনে পড়ছে না তো..."

মেরেকেটে ১০ মাস স্কুলে যেতে পেরেছিল শর্মিলা। লকডাউন এসে পড়ায় আক্রানি তালুকের এই ইস্কুলটির ৪৭৬ জন বাচ্চাকে যখন বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ত সে। "কে জানে আবার কবে ইস্কুল খুলবে," বলল মেয়েটি।

জাতীয় সংগীত আর প্রার্থনা দিয়ে শুরু হতো তার ইস্কুলের দিনগুলি। তবে বাড়িতে তার রোজনামচা এক্কেবারে আলাদা: "প্রথমে ওই বোরটা [বাড়ির বাইরে যে বোরওয়েলটি রয়েছে] থেকে জল ভরে আনি। তারপর মা যতক্ষণ রান্নাবান্না করে ততক্ষণ রিঙ্কুকে [তার এক বছরের খুদে বোন] আগলে আগলে রাখি। ওর সঙ্গে হেঁটে বেড়াই, জিনিসপত্র চিনতে শেখাই।" সেলাইমেশিনটা ফাঁকা পেলেই শুরু হয়ে যায় তার ‘স্ব-শিক্ষা’ – অর্থাৎ নিজে নিজে সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কসরত শেখা।

চার ভাইবোনের মধ্যে শর্মিলাই সবার বড়ো। ছোটোভাই রাজেশের বয়স ৫, মেজবোন ঊর্মিলা ৩, আর রিঙ্কু তো আছেই। "মেয়েটা কি সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করত, লিখতেও [মারাঠি হরফ] শিখে গিয়েছিল," জানালেন ওর বাবা রাকেশ (২৮)। বাকি তিন সন্তানের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই তাঁর – ছ'বছর বয়স না হলে রাজেশ আর ঊর্মিলাকে তো কোথাও ভর্তি করাও যাবে না। "মেয়েটা যদি ঠিকমতো লিখতে-পড়তে জানত, তাহলে ভাইবোনদের ও নিজেই শিখিয়ে দিত। দো সাল মেঁ বাচ্চে কি জিন্দেগি কা খেল বন গয়া হ্যায় [এই দু'বছরে আমার মেয়ের জীবনটা নিছকই একটা খেলায় পরিণত হয়েছে]," শর্মিলাকে দক্ষ হাতে সেলাইকল চালাতে দেখে বললেন তিনি।

Classmates, neighbours and playmates Sunita (in green) and Sharmila (blue) have both been out of school for over 18 months
PHOTO • Jyoti
Classmates, neighbours and playmates Sunita (in green) and Sharmila (blue) have both been out of school for over 18 months
PHOTO • Jyoti

একাধারে সহপাঠী , পড়শি এবং খেলার সঙ্গী সুনীতা (সবুজ জামা গায়ে) আর শর্মিলা (নীলচে পোশাক পরিহিত)। আজ ১৮ মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে স্কুলের মুখদর্শন করেনি তারা

"আমারা চাই মেয়েটা যেন পড়শোনা করে আফসার [অফিসার] হতে পারে বড়ো হয়ে, আমাদের মতো দর্জি যাতে না হয়। লিখতে-পড়তে না জানলে বিন্দুমাত্র সম্মানটুকুও কেউ করে না," বলছিলেন শর্মিলার মা সরলা (২৫)।

সরলা আর রাজেশ একত্রে দর্জির কাজ করে মাস গেলে ৫-৬ হাজার টাকা রোজগার করেন। বছর কয় আগেও তাঁরা খেতমজুরির কাজে গুজরাত বা মধ্যপ্রদেশে যেতেন। "শর্মিলার জন্মের পর সেটা বন্ধ হয়ে গেল, আসলে মেয়েটা যে বড্ডো ভুগতো [পরিযানের মাসগুলোয় ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে]। তাছাড়াও আমরা ঠিক করেছিলাম, ওকে ইস্কুলে পড়াবই," বলছিলেন রাকেশ।

তাঁর কাকা গুলাব ওই একই গ্রামে থাকতেন (২০১৯এ মারা যান তিনি), কৈশোরে তাঁর কাছেই দর্জির কাজ শিখেছিলেন রাকেশ। কাকা না সাহায্য করলে সেলাইকল কেনা বা সরলাকে হাতে ধরে সেলাই-ফোঁড়াই শেখানো, এসবের কোনওটাই করতে পারতেন না তিনি।

"জমিজমা তো নেই আমাদের, তাই ১৫,০০০ টাকা দিয়ে দুইখান পুরোনো সেলাইমেশিন কিনেছিলাম ২০১২ সালে," বললেন সরলা। এটা করতে গিয়ে সে যাবৎ জমানো টাকার পুরোটাই বেরিয়ে যায়, এছাড়াও রাকেশের মা-বাবা আজীবন খেতমজুরি করে যেটুকু জমাতে পেরেছিলেন, খরচা হয়ে যায় সেটাও। কাকা গুলাব তাঁর জনাকয় বাঁধা খদ্দেরকে পাঠান রাকেশ আর সরলার কাছে।

"রেশন কার্ড নেই আমাদের; মাসে ৩-৪ হাজার টাকা রেশনের পিছনেই বেরিয়ে যায়," জানিয়েছিলেন রাকেশ। মুখে মুখে ফর্দ বানিয়ে দিলেন সরলা – গমের আটা, চাল, ডাল, নুন, লংকা গুঁড়ো... "আমার সোনারা তরতর করে বেড়ে উঠছে তো, ওদের খানা-পিনা নিয়ে হাতটান রাখলে চলবে না," বলছিলেন তিনি।

'If she could read and write, she could have taught her younger siblings. In these two years, my child’s life has turned into a game', Rakesh says
PHOTO • Jyoti
'If she could read and write, she could have taught her younger siblings. In these two years, my child’s life has turned into a game', Rakesh says
PHOTO • Jyoti

রাকেশের কথায়: ' মেয়েটা যদি ঠিকমতো লিখতে-পড়তে জানতো , তাহলে ভাইবোনদেরকে ও নিজেই শিখিয়ে দিত। এই দু বছরে ওর জীবনটা নিছকই একটা খেলায় পরিণত হয়েছে '

পয়সা জমিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ানো তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, তাই আশ্রমশালাগুলির প্রতি তাঁরা চিরকৃতজ্ঞ। "নিদেনপক্ষে ওখানে শিক্ষা আর খাবারদাবার দুটোই তো পায় বাচ্চারা," বললেন সরলা। তবে ক্লাস ১-৭এর জন্য আপাতত স্কুল বন্ধ।

আক্রানি তালুকের এই যে প্রত্যন্ত পাণ্ডববর্জিত এলাকাটি, এখানে অনলাইন শিক্ষা জিনিসটা কেবলই বিজাতীয় এক প্রহসন। আশ্রমস্থলের ৪৭৬ জন পড়ুয়ার মধ্যে শর্মিলা-সহ ১৯০ জনের সঙ্গে শিক্ষকেরা কোনও রকমের যোগাযোগ করে উঠতে পারেননি, ফলত প্রথাগত শিক্ষায় ঢ্যাঁড়া পড়ে গেছে তাদের।

"স্মার্টফোন ছাড়ুন, ৯০ শতাংশেরও বেশি মা-বাবার কাছে একটা সাধারণ মোবাইল ফোন পর্যন্ত নেই," জানালেন আশ্রমশালার শিক্ষক নন্দুরবার-নিবাসী সুরেশ পডভি (৪৪)। তিনি ওই স্কুলটির সেই নয় শিক্ষকের একজন যাঁরা অতিমারির গোড়া থেকে আক্রানি তালুকের এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে ঘুরে ঘুরে পড়ুয়াদের খোঁজ করছেন যাতে তাদের পড়াশোনা অব্যাহত থাকে।

"[সপ্তাহে] তিন দিন করে আসি এখানে, গ্রামেরই কারও একটা বাড়িতে রাতগুলো কাটাই," বলছিলেন সুরেশ। এই তিনটে দিন তাঁরা ক্লাস ১-১০এ পড়া ১০-১২ জন বাচ্চাদের ক্লাস নেন। তাঁর কথায়: "একটা বাচ্চা ধরুন ক্লাস ওয়ানে পড়ে, আরেকজন সেভেনে। কিন্তু একইসঙ্গে পড়াতে হয় ওদের, অন্য কোনও উপায় নেই আর।"

তবে শিক্ষকদের এই দলটি কিন্তু আজ অবধি শর্মিলার খোঁজ নিয়ে উঠতে পারেনি। "অনেক বাচ্চাই দূর-দূরান্তে এমন সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকে যেখানে যাওয়ার রাস্তা বা ফোনে যোগাযোগের ব্যবস্থা - দুটোর কোনওটাই নেই। ওদের নাগাল পাওয়াটা খুব মুশকিল," জানালেন সুরেশ।

Reaching Sharmila’s house in the remote Phalai village is difficult, it involves an uphill walk and crossing a stream.
PHOTO • Jyoti
Reaching Sharmila’s house in the remote Phalai village is difficult, it involves an uphill walk and crossing a stream.
PHOTO • Jyoti

প্রত্যন্ত ফালাই গ্রামে শর্মিলার বাড়িতে পৌঁছনোটা এক প্রকার অসাধ্য সাধন ; পাহাড় ভেঙে , নদীনালা ডিঙিয়ে যেতে হয় সেখানে

প্রত্যন্ত ফালাই গ্রামে শর্মিলার বাড়িতে পৌঁছনোটা এক প্রকার অসাধ্য সাধন। পাহাড় ভেঙে, নদীনালা ডিঙিয়ে যেতে হয় সেখানে। ঘুরপথে আরেকটা রাস্তাটা আছে বটে, তবে সেটা জলকাদায় ভর্তি, তাছাড়া সময়ও অনেকটা বেশি লাগে। "বড্ডো ভিতরে বাড়ি তো," বলছিলেন রাকেশ, "টিচাররা তাই এতদূর আসতে পারেন না।"

এর ফলে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শর্মিলার মতো বহু পড়ুয়াদের জীবন থেকে পড়াশোনার পাট চুকে গেছে চিরতরে। কোনও একটা ছবি বা নিজস্ব অভিজ্ঞতার মৌখিক বর্ণনা, চেনা শব্দ পড়ে পড়ে শোনানো, বুঝে পড়া, কিংবা পুরানো কোনও ছবির উপর দুয়েকটা সাধারণ বাক্য রচনা করা – জানুয়ারি ২০২০এর একটি গবেষণায় জানা গেছে যে অতিমারির কারণে স্কুল বন্ধ হওয়ার ফলে ৯২ শতাংশ বাচ্চারা উক্ত দক্ষতাগুলির মধ্যে একটা না একটা হারিয়ে ফেলেছে।

*****

আট বছর বয়সী সুনীতা পাওরে জানাচ্ছে: "জানো জানো ইস্কুলে আমি পেন্সিল দিয়ে নিজের নাম লিখতে শিখেছিলাম!" একাধারে শর্মিলার পড়শি ও খেলার সঙ্গে সুনীতাও ক্লাস ওয়ানে পড়ত, গতবছর স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারও পড়াশোনার পালা চুকতে বসেছে।

"এই দ্যাখো, এই জামাটা পরে ইস্কুলে যেতাম। এখন বাড়িতেই পরে বসে থাকি মাঝে মাঝে," তার স্কুলের উর্দিটি কুঁড়েঘরের বাইরে একটি দড়ি থেকে ঝুলছিল, অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সেটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সুনীতা। "বাই [শিক্ষক] আমাদের কতরকমের ফলের ছবি দেখাত একটা [ছবির] বই থেকে। রংবেরঙের ফল। ওই যেন কি একটা, লাল লাল রঙ...নামটা মনে নেই," ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করছিল বাচ্চা মেয়েটি। তার কাছে স্কুল যেন শুধুই কিছু ফিকে হয়ে আসা স্মৃতি।

Every year, Sunita's parents Geeta and Bhakiram migrate for work, and say, 'If we take the kids with us, they will remain unpadh like us'
PHOTO • Jyoti
Every year, Sunita's parents Geeta and Bhakiram migrate for work, and say, 'If we take the kids with us, they will remain unpadh like us'
PHOTO • Jyoti

সুনীতার মা-বাবা গীতা আর ভাকিরাম প্রতিবছরই কাজের খোঁজে বাইরে যান , তাঁ রা বলছিলেন , ' বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে গেলে ওরা আমাদের মতোই আনপঢ় [নিরক্ষর] রয়ে যাবে '

নোটবইটা তার ফাঁকাই পড়ে থাকে আজকাল, না লেখালিখি না ছবি, একটা আঁচড়ও আর কাটে না সুনীতা। তবে খড়খড়ি পাথর দিয়ে পিচঢালা রাস্তায় চৌখুপি বানাতে মেয়েটা ওস্তাদ, কিৎকিৎ খেলতে হবে তো শর্মিলার সঙ্গে! তার সইয়ের মতো সে-ও চার ভাইবোনের সবার বড়ো – বোন অমিতার বয়স ৫ আর দুই ভাই দিলীপ আর দীপক যথাক্রমে ৬ আর ৪। আট বছরের সুনীতা একাই স্কুল পড়ুয়া, তবে মা-বাবার ইচ্ছে একে একে ওর ভাইবোনদের সবাইকেই স্কুলে ভর্তি করানোর।

বর্ষা নামলে পাহাড়ি ঢালের গায়ে এক একর জমিতে জোয়ার চাষ করে মোটামুটি ২-৩ কুইন্টাল শস্য পান গীতা আর ভাকিরাম, বিক্রি করা তো দূর অস্ত, পরিবারের খোরাকটুকুও পুরো মেটে না তাতে। "শুধু এই দিয়ে পেট চালানো অসম্ভব। কাজ করতে বাইরে যেতেই হয়," জানালেন গীতা (৩৫)।

অক্টোবরের ফসল তোলা হয়ে গেলে তাঁরা বেরিয়ে পড়েন গুজরাতের তুলো খেতে কাজের ধান্দায়, এপ্রিল-মে আসার আগে বছরে মোটামুটি ২০০ দিনের দিনমজুরি করেন, দৈনিক মাথাপিছু পান ২০০-৩০০ টাকা। "বাচ্চাদের সঙ্গে করে নিয়ে গেলে ওরা আমাদের মতোই আনপঢ় [নিরক্ষর] রয়ে যাবে। যেখানে যাই সেখানে তো ইস্কুল-টিস্কুল নেই তেমন," বলছিলেন ভাকিরাম (৪২)।

"আশ্রমশালাগুলোয় বাচ্চারা দিব্যি থাকে, পড়াশোনা করে, খায়-দায়," গীতা বললেন, "সরকারের উচিত এই ইস্কুলগুলো চট করে খুলে দেওয়া।"

'I used to wear this dress in school. I wear it sometimes at home', Sunita says. School for her is now a bunch of fading memories
PHOTO • Jyoti
'I used to wear this dress in school. I wear it sometimes at home', Sunita says. School for her is now a bunch of fading memories
PHOTO • Jyoti

' এই জামাটা পরে ইস্কুলে যেতাম। এখন বাড়িতেই পরে বসে থাকি মাঝে মাঝে ', ছোট্ট সুনীতার কাছে স্কুল যেন শুধুই কিছু ফিকে হয়ে আসা স্মৃতি

২০২১ সালের ১৫ই জুলাইয়ের শেষ সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল: "অগস্ট ২, ২০২১ থেকে এ রাজ্যের কোভিড-মুক্ত এলাকায় সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত আবাসিক তথা একলব্য মডেল আবাসিক স্কুলগুলি খোলা হবে, তবে শুধু ক্লাস ৮ থেকে ১২ অবধি।"

নন্দুরবার জেলা পরিষদের সদস্য গণেশ পারাডকের আন্দাজ: "নন্দুরবারে প্রায় ১৩৯টা সরকারি আবাসিক ইস্কুল আছে, পড়ুয়ার সংখ্যা ওই ধরুন সব মিলিয়ে ২২ হাজার হবে।" এদের সিংহভাগই আক্রানি তালুকের পাহাড়ি অরণ্যসংকুল অঞ্চলের বাসিন্দা। তবে এখন কিন্তু "অনেকেই পড়াশোনার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েছে, আর মেয়েদের তো বেশিরভাগই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে," বলছিলেন তিনি।

*****

শর্মিলার বাড়ি থেকে কিলোমিটার চল্লিশেক দূরে, আক্রানি তালুকের সিন্দিদিগর গ্রামের কাছে দুই বন্ধুর সঙ্গে ১২ খানা ছাগল আর খান পাঁচেক গরু চরাচ্ছে রাসিদাস পাওরা (১২)। পশুগুলি তাদের নিজেদেরই। "এখানটায় এসে খানিক জিরিয়ে নিই। খুব ভাল্লাগে এই জায়গাটা। এখানে দাঁড়ালে দূর দূরান্তের পাহাড়, গাঁ, আকাশ... সবকিছূ কি সুন্দর দেখা যায়," জানালো রাহিদাস। অবশ্য গতবছর স্কুল-টুল সব বন্ধ না হয়ে গেলে এখন ওর ১৫০ কিমি দূরে নবপুর তালুকে কাই ডি. জে. কোকানি আদিবাসী ছাত্রালয় শ্রাবণীর ক্লাসরুমে বসে ইতিহাস বা অঙ্ক বা ভূগোল পড়ার কথা। ক্লাস সিক্সে পড়ত ছেলেটি।

বর্ষা এলে তার মা-বাবা শীলা (৩২) আর পিয়ানে (৩৬) তাঁদের দু-একরের জমিটায় জোয়ার আর ভুট্টা চাষে লেগে পড়েন। "বড়দা রামদাস সাহায্য করে খেতিবাড়ির কাজে," বলছিলো রাহিদাস।

Rahidas Pawra and his friends takes the cattle out to grazing every day since the school closed. 'I don’t feel like going back to school', he says.
PHOTO • Jyoti
Rahidas Pawra and his friends takes the cattle out to grazing every day since the school closed. 'I don’t feel like going back to school', he says.
PHOTO • Jyoti

স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিদিনই গরুছাগল চরাতে যায় রাহিদাস পাওরা। 'ইস্কুলে ফিরে যেতে আর ইচ্ছেও করে না,' জানায় সে

প্রতিবছর ফসল কাটার মরসুমের পর পিয়ানে, শীলা আর রামদাস পাশের রাজ্য গুজরাতের নভসারি জেলায় যান আখের খেতে কাজ করতে। ১৯ বছরের রামদাসের পড়াশোনা ক্লাস ফোর পর্যন্ত। ডিসেম্বর থেকে মে, অর্থাৎ মেরেকেটে ওই ১৮০ দিনের মতো ঘাম ঝরিয়ে দৈনিক ২৫০ টাকা জোটে মাথাপিছু।

"মা-বাবা গতবছর করোনার ভয়ে বাইরে যায়নি। তবে এবছর আমিও যাচ্ছি ওদের সঙ্গে," বলছিলেন রামদাস। চরাতে নিয়ে আসা গবাদি পশুগুলির থেকে কিন্তু একটা টাকাও জোটে না; ছাগলের দুধটুকু বাড়িতে খেয়েই শেষ হয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যে, তখন অভাবে অনটনে যখন নাভিশ্বাস উঠে যায়, তখন স্থানীয় কসাইয়ের কাছে একটা করে ছাগল বেচে আসেন তাঁরা। পশুটির আকার আর স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে তার দাম, তবে মোটামুটি পাঁচ থেকে দশ হাজারের মধ্যেই দর ঘোরাফেরা করে।

গরুছাগল চরাতে আসা এই তিন বন্ধু কিন্তু একই স্কুলে আর একই ক্লাসে পড়ে। "চরাতে আমি [অতিমারির] আগেও বেরোতাম বটে, ওই ধরুন গরমের ছুটি বা দিওয়ালির ছুটিতে যখন বাড়ি আসতাম," বলল রাহিদাস, "এটা মোটেই নতুন কিছু নয়।"

তবে ছেলেটার মনোবল যেন ভেঙে খানখান হয়ে গেছে, নতুন বলতে শুধু এটাই যা। "ইস্কুলে ফিরে যেতে আর ইচ্ছেই করে না।" যে কোনওদিন খুলতে পারে তাদের স্কুল, এটা শুনে তাপ উত্তাপ কিছুই প্রকাশ করল না ছেলে তিনটি। তার কথায়, "কিচ্ছুটি মনে নেই আর। তাছাড়া যদি আবারও বন্ধ করে দেয়?"

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

ಜ್ಯೋತಿ ಪೀಪಲ್ಸ್ ಆರ್ಕೈವ್ ಆಫ್ ರೂರಲ್ ಇಂಡಿಯಾದ ಹಿರಿಯ ವರದಿಗಾರರು; ಅವರು ಈ ಹಿಂದೆ ‘ಮಿ ಮರಾಠಿ’ ಮತ್ತು ‘ಮಹಾರಾಷ್ಟ್ರ1’ನಂತಹ ಸುದ್ದಿ ವಾಹಿನಿಗಳೊಂದಿಗೆ ಕೆಲಸ ಮಾಡಿದ್ದಾರೆ.

Other stories by Jyoti
Translator : Joshua Bodhinetra

ಜೋಶುವಾ ಬೋಧಿನೇತ್ರ ಅವರು ಪೀಪಲ್ಸ್ ಆರ್ಕೈವ್ ಆಫ್ ರೂರಲ್ ಇಂಡಿಯಾ (ಪರಿ) ಯ ಭಾರತೀಯ ಭಾಷೆಗಳ ಕಾರ್ಯಕ್ರಮವಾದ ಪರಿಭಾಷಾ ವಿಷಯ ವ್ಯವಸ್ಥಾಪಕರು. ಅವರು ಕೋಲ್ಕತ್ತಾದ ಜಾದವಪುರ ವಿಶ್ವವಿದ್ಯಾಲಯದಿಂದ ತುಲನಾತ್ಮಕ ಸಾಹಿತ್ಯದಲ್ಲಿ ಎಂಫಿಲ್ ಪಡೆದಿದ್ದಾರೆ ಮತ್ತು ಬಹುಭಾಷಾ ಕವಿ, ಅನುವಾದಕ, ಕಲಾ ವಿಮರ್ಶಕ ಮತ್ತು ಸಾಮಾಜಿಕ ಕಾರ್ಯಕರ್ತರೂ ಹೌದು.

Other stories by Joshua Bodhinetra