‘‘আমরা যৌনকর্মী, আর তাই ওরা ধরেই নেয়, যে কোনও কিছুর মূল্য চোকাবে আমাদের শরীর,” তিরিশ বছরের মীরা, উত্তরপ্রদেশের ফারুখাবাদ শহর থেকে দিল্লি এসেছিলেন ২০১২ সালে। সঙ্গে তিন সন্তান। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছিলেন স্বামী। রাগে, ক্লান্তিতে তিনি এখন বিধ্বস্ত।

সে সব ঘটনা মনে এলে ৩৯ বছরের অমিতার মুখ বিরক্তি আর অসহায়তায় বিকৃত হয়ে যায়। তিনি ভেঙিয়ে দেখান কেমন করে হাসপাতালের পুরুষ সহায়ক আর ওয়ার্ড অ্যাসিস্ট্যান্টরা তাঁর শরীরে হাত দেয়। তাঁর কথায়, “ওষুধপত্র দেওয়ার সময় এটাই তো ওরা করে।” এই অপমানে সন্ত্রস্ত বোধ করেন তিনি, কিন্তু তার পরেও চেক আপ বা ওষুধের জন্য তাঁকে সরকারি হাসপাতালেই ফিরে আসতে হয়।

‘‘এইচআইভি টেস্ট করাতে আসি যখন, তখন যদি ওরা ঘুণাক্ষরেও টের পায় যে আমরা যৌনকর্মী, তখন অদ্ভুতভাবে সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। বলে, ‘পিছে সে আ জানা, দাওয়াই দিলওয়া দুঙ্গা’। [‘পিছনের দরজা দিয়ে এসো, তোমার ওষুধ পাইয়ে দেব।’]। তারপর সেই সুযোগে ওরা আমাদের গায়ে হাত দেয়!” বলছিলেন ৪৫ বছরের কুসুম। তিনি অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক ফর সেক্স ওয়ার্কারস (ষোলোটি রাজ্যের যৌনকর্মীদের সংগঠনগুলির যৌথমঞ্চ) এর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। তাঁর সেই কথায় মাথা নাড়লেন অন্য যৌনকর্মীরাও। প্রসঙ্গত, (এআইএনএসডব্লু) সাড়ে চার লক্ষ যৌনকর্মীর প্রতিনিধিত্ব করে।

দিল্লির উত্তর পশ্চিমে রোহিনী এলাকায় পারি একটি কমিউনিটি শেলটারে এক দল যৌনকর্মীর সঙ্গে দেখা করে। তাঁদের বেশিরভাগই অতিমারির কারণে কর্মহীন। শীতের বিকেলে একসঙ্গে বসে তাঁরা খাবার ভাগ করে খাচ্ছিলেন। খাবার বলতে স্টিলের টিফিন বাক্সে করে বাড়ি থেকে রান্না করে আনা সবজি, ডাল, রুটি।

Sex workers sharing a meal at a community shelter in Delhi's North West district. Many have been out of work due to the pandemic
PHOTO • Shalini Singh

দিল্লির উত্তর পশ্চিমে একটি কমিউনিটি শেলটারে এক দল যৌনকর্মী একসঙ্গে বসে খাবার ভাগ করে খাচ্ছেন। তাঁদের বেশিরভাগই অতিমারির কারণে কর্মহীন

মীরা বলেন, একাকী যৌনকর্মীদের পক্ষে স্বাস্থ্যপরিষেবা পাওয়াটাই দুরূহ ব্যাপার।

‘‘ওরা আমাকে দুপুর দুটোর পর হাসপাতালে যেতে বলে। ‘আমি তোমার কাজ করে দেব,’ না, এমনি এমনি কাজ থোড়াই হয়! ওয়ার্ড বয়দের ডাক্তার বলে ভুল করেছিলাম, আমাকে তাদের সঙ্গেও আমাকে সেক্স করতে হয়েছে, এসব করলে তবেই ওষুধ জোটে’)। সময় বিশেষে আমাদের কিছুই করার থাকে না। মেনে নিতেই হয়। সব সময়ে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে পারি না, সময় নেই, বিশেষ করে যদি কোনও খদ্দেরের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে। সে তো তার নিজের সময় মতোই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবে। আমাদের হয় চিকিৎসা করাতে হবে, না হলে না খেয়ে মরতে হবে,” মীরা বলে উঠলেন, চোখ জ্বলছে রাগে, কণ্ঠস্বরে শ্লেষ। আর আমি যদি কিছু বলি, গলা তুলি, ‘‘হাম পর স্টিগমা লাগতা হ্যায়। আমাকে লোকে জেনে যাবে যে আমি যৌনকর্মী। তখন আরও অনেক দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।”

এলাকার দুটি সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন একটি ঘণ্টা এলাকার যৌনকর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টা। এই সময়টা যৌনকর্মীদের এইচআইভি ও অন্য যৌন সংক্রামক রোগের পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট থাকে। অলাভজনক সংস্থাগুলির তরফ থেকে এই অনুরোধ আসার পরেই এই পরিষেবা চালু করেছে হাসপাতাল।

দিল্লির অলাভজনক সংস্থা সাবেরার সঙ্গে যুক্ত স্বেচ্ছাকর্মী রজনী তিওয়ারি বললেন, “যৌনকর্মীরা অন্য নাগরিকদের সঙ্গে টেস্ট বা চিকিৎসার জন্য লাইনে দাঁড়াতে পারেন না। কারণ এতে অনেক বেশি সময় লাগে।” যদি সেই সময়ে কোনও খদ্দের ফোন করে, তাঁরা লাইন ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।

নির্দিষ্ট ওই এক ঘণ্টাতেও ডাক্তারের কাছে যাওয়া তাঁদের জন্য কঠিন বলে জানালেন তিওয়ারি। তাঁদের স্বাস্থ্যপরিষেবার সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে এটা প্রথম অন্তরায় মাত্র।

ডাক্তারররা তাঁদের শুধু এসটিআই (সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশন্স) সংক্রান্ত ওষুধ দেন। সাবেরার মতো সংস্থাগুলি দিল্লির স্টেট এইডস কনট্রোল সোসাইটি থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সহায়তায় যৌনকর্মীদের জন্য এইচআইভি ও সিফিলিস টেস্টিং কিট সংগ্রহ করে।

A room at the office of an NGO, where a visiting doctor gives sex workers medical advice and information about safe sex practices
PHOTO • Shalini Singh
A room at the office of an NGO, where a visiting doctor gives sex workers medical advice and information about safe sex practices
PHOTO • Shalini Singh

এনজিও অফিসের এই ঘরে পরিদর্শনকারী ডাক্তার যৌনকর্মীদের যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সুরক্ষাবিধি বিষয়ে পরামর্শ এবং তথ্যাদি দিয়ে থাকেন

জ্বর, বুকে ব্যথা, ডায়াবেটিসের মতো রোগেও অন্যদের মতোই ভোগেন যৌনকর্মীরা, জানালেন রজনী। তাঁর কথায়, “যৌনকর্মী জানতে পারলে ওয়ার্ড বয়রা তার সুযোগ নেবে, এমনটাই দস্তুর।” যৌনকর্মীদের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া গেল তাঁর কথায়।

পুরুষ কর্মীদের পক্ষে মহিলা রোগীদের মধ্যে কে যৌনকর্মী সেটা বুঝে নেওয়া মোটেই কঠিন নয়।

এই হাসপাতালের অদূরেই উক্ত কমিউনিটি শেল্টারটি, এখানেই দেখাসাক্ষাৎ করেন যৌনকর্মীরা। অতিমারির আগে, অমিতার খদ্দেররা তাঁকে পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীদের সামনেই হাসপাতালের গেট থেকে তুলে নিয়ে যেতেন।

“প্রহরীরাও জানে, যাদের কাছে এইচআইভি টেস্টের জন্য একটি বিশেষ স্লিপ থাকে, তারা যৌনকর্মী। পরে, আমরা যখন আবার টেস্ট করাতে যাই, ওরা চিনতে পারে আমাদের, নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে। অনেক সময়ে খদ্দেরকেও ধরতে হয়, যাতে ডাক্তার দেখাতে পারি লাইনে না দাঁড়িয়েই,” বলেন অমিতা। বস্তুত, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা, চিকিৎসা ও ওষুধ নেওয়া - প্রতিটির জন্যই আলাদা আলাদা লাইন থাকে।

স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে দুই দশক আগে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে পাটনা থেকে দিল্লি আসেন অমিতা। একটা কারখানায় দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ নিয়েছিলেন, কিন্তু মজুরির টাকা পাননি, সেই সময়ে এক বন্ধুর মাধ্যমে এই পেশায় আসেন। “কতদিন আমি কেঁদেছি। এই কাজে আসতে চাইনি। কিন্তু ২০০৭ সালে দিনে ৬০০ টাকা ছিল অনেক — এই টাকায় আমার দশদিনের খোরাকির ব্যবস্থা হয়ে যেত।”

অমিতা, মীরা ও অন্যান্য মহিলাদের কথা থেকে এটা সহজেই বোঝা গেল যে যৌনকর্মীরা এমন একটা তকমা নিয়ে বাঁচতে বাধ্য হন, যা তাঁদের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ন্যাশনাল নেটওয়ার্কস অফ সেক্স ওয়ার্কার্স এর অধীনে বিভিন্ন অ্যাডভোকেসি সংগঠন ও সেক্স ওয়ার্কারস কালেকটিভগুলি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ২০১৪ সালে যেখানে বলা হয়েছিল ঠিক এই কারণেই তাঁরা নিজেদের পেশাগত পরিচয় হাসপাতালে প্রকাশ করতে চান না। “নারী যৌনকর্মীদের অপমান করা হয়, সমালোচনা করা হয়, বহুক্ষণ লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, ঠিক করে তাঁদের পরীক্ষা করা হয় না। জোর করে এইচআইভি টেস্ট করানো হয়, প্রাইভেট হাসপাতালে বেশি টাকা নেওয়া হয়, পরিষেবা দিতে অস্বীকার করা হয়, গর্ভাবস্থায় প্রসূতির প্রাপ্য পরিষেবা দেওয়া হয় না; এবং তাদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হয়,” জানাচ্ছে ওই রিপোর্ট।

Left: An informative chart for sex workers. Right: At the community shelter, an illustrated handmade poster of their experiences
PHOTO • Shalini Singh
Right: At the community shelter, an illustrated handmade poster of their experiences
PHOTO • Shalini Singh

বাঁদিকে: যৌনকর্মীদের জ্ঞাতার্থে একটি তথ্যপূর্ণ তালিকা। ডানদিকে: কমিউনিটি শেল্টারে হাতে তৈরি একটি সচিত্র পোস্টার – এগুলি হল মহিলাদের অভিজ্ঞতার চিত্র

অমিতার অভিজ্ঞতা ওই রিপোর্টেরই আয়না বলা চলে। “এইচআইভি, গর্ভপাতের মতো বড়ো কোনও কারণ না হলে, বা স্থানীয় ভাবে কোনও কিছুর চিকিৎসা করিয়েও লাভ না হলে তবেই আমরা বড়ো হাসপাতালে যাই। এমনিতে আমরা যাই ঝোলা ছাপ ডাক্তারের কাছে (অনুমোদনহীন, হাতুড়ে চিকিৎসক)। যদি টের পায় যে আমরা ধান্দা (যৌনকর্ম) করি, ওরাও সুযোগ নিতে ছাড়ে না।

বস্তুত, প্রায় কেউই তাঁদের মর্যাদা দেয় না, সংযোজন কুসুমের। যেই মুহূর্তে পেশার কথা প্রকাশ্যে চলে আসে, সেই মুহূর্তে শুরু হয় সুযোগ নেওয়া। যদি যৌন সুবিধা না মেলে, তাহলে মুহূর্তের মজা বা তাঁদের অপমান করে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করে লোকে। “যেনতেনপ্রকারেন আমাদের শরীর ছুঁতে চায় শুধু।”

একটি অলাভজনক সংস্থার অফিসে বসে রোহিনী এলাকায় কর্মরত ডাক্তার সুমন কুমার বিশ্বাস বলেন, চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার জন্য যৌনকর্মীদের লোকজনকে কোনও না কোনও ভাবে তুষ্ট করতেই হয়। ডাক্তার বিশ্বাস মহিলাদের মধ্যে কন্ডোম বিতরণ করেন ও অন্যান্য স্বাস্থ্যপরিষেবা দেন।

কোভিড-১৯ অতিমারির জেরে যৌনকর্মীদের উপর অত্যাচার আরও বেড়েছে, তাঁদের অবস্থার সুযোগ নেওয়ার ফিকিরও বেড়েছে।

অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক ফর সেক্স ওয়ার্কারসের বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতুল সিং বললেন, “যৌনকর্মীদের সঙ্গে অস্পৃশ্যদের মতো ব্যবহার করা হয়। আমাদের রেশনের লাইন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, বার বার আধার কার্ডের জন্য নাকাল করা হয়েছে… আমাদের এক বোনের গর্ভাবস্থায় জটিলতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স আসতে চায়নি। শেষে কয়েক কিলোমিটারের জন্য ৫ হাজার টাকারও বেশি দিতে রাজি হলে তবে এসেছে। আমরা কোনওরকমে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানকার কর্মীরা তার চিকিৎসা করতে অস্বীকার করে। অদ্ভুত সব অজুহাত দেয়। শেষে একজন চিকিৎসক দেখতে রাজি হন। কিন্তু রোগীর থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।” তিনি জানালেন, যদিও তাঁরা তাকে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর বাচ্চাটি মারা যায়।

****

Pinki was left with a scar after a client-turned-lover tried to slit her throat. She didn't seek medical attention for fear of bringing on a police case.
PHOTO • Shalini Singh
A poster demanding social schemes and government identification documents for sex workers
PHOTO • Shalini Singh

বাঁদিকে: এক খদ্দেরের সঙ্গে পিংকির প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল, সেই প্রেমিক তাঁর গলা কাটার চেষ্টা করে। পিংকির গলায় সেই ক্ষতের দাগ৷ পুলিশ কেসের ভয়ে তিনি চিকিৎসা করাননি। ডানদিকে: যৌনকর্মীদের জন্য সামাজিক যোজনা এবং সরকারি পরিচয়পত্রের দাবি সম্বলিত একটি পোস্টার

যৌনকর্মীরা বলছিলেন, সরকারি না কি বেসরকারি - কোন স্বাস্থ্যপরিষেবার জন্য যাবেন, এটা ঠিক করাটাই জটিল ব্যাপার। “বেসরকারি হাসপাতালে ইজ্জত না খুইয়েও আমরা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে পারি,” বললেন অমিতা। কিন্তু এই বেসরকারি ক্লিনিকগুলো অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ, তাঁদের সাধ্যে কুলোয় না। গর্ভপাত করানোর জন্যই যেমন তিনগুণ বেশি টাকা নেয়। অন্তত ১৫ হাজার টাকা তো নেবেই প্রাইভেট ক্লিনিকে।

সরকারি হাসপাতালে অন্য আরেক সমস্যা হল, এখানে পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নথিপত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ।

২৮ বছরের পিংকি মুখ থেকে মাস্ক খুলে দেখান। এক খদ্দেরের সঙ্গে পিংকির প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল, সেই প্রেমিক তাঁর গলা কাটার চেষ্টা করে। পিংকির গলায় সেই ক্ষতের দাগ৷ “লক্ষ প্রশ্ন উঠবে, পরিচয় জেনে যাবে, পুলিশ কেস হবে। তার উপর আরও একটা ব্যাপার হল এই যে, যখন আমরা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসি, তখন বেশিরভাগ সময়েই রেশন কার্ড বা এই ধরনের নথিপত্র সঙ্গে নিই না,” সরকারি হাসপাতালে না যাওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে বলেন তিনি।

২০০৭ সালের মার্চে ইন্ডিয়ান উইমেনস হেলথ চার্টার বলেছিল, “জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হিসেবে যৌনকর্মীদের দেখা হয়।” তারপর এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়েছে, ধারণাটা বদলায়নি, এমনকি এই রাজধানী শহরেও না। আর অতিমারিতে তাঁদের অবস্থা আজ আরও বেহাল হয়েছে।

২০২০ সালের অক্টোবরে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন কোভিড-১৯ অতিমারির নিরিখে মহিলাদের অধিকার বিষয়ে মন্ত্রণা (অ্যাডভাইসারি অন দ্য রাইটস অফ উইমেন ইন দ্য কনটেক্সট অফ কোভিড-১৯) জারি করে। তাতে বলা হয়, যৌনকর্মীদের সমস্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। তাঁদের জীবিকা বিধ্বস্ত হয়েছে। যাঁরা এইচআইভি পজিটিভ ছিলেন, তাঁরা অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি নিতে পারেননি। পরিচয়পত্রের অভাবে বহু যৌনকর্মী সরকারি প্রকল্পের সুবিধাও নিতে পারেননি। ঘটনাচক্রে, পরবর্তীকালে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন তাঁদের বক্তব্য পুনর্বিবেচনা করে, এবং যৌনকর্মীদের অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করার গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশটি প্রত্যাহার করে, যেটি থাকলে তাঁরাও অন্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের প্রাপ্য সুবিধা ও জনকল্যাণ প্রকল্পের সুযোগ নিতে পারতেন। তার বদলে বলা হয়, যৌনকর্মীদের যাতে মানবিক জায়গা থেকে খানিক স্বস্তি দেওয়া হয়, তা দেখা দরকার।

At the NGO office, posters and charts provide information to the women. Condoms are also distributed there
PHOTO • Shalini Singh
At the NGO office, posters and charts provide information to the women. Condoms are also distributed there
PHOTO • Shalini Singh

এনজিও অফিসে, এইসব পোস্টার এবং চার্টগুলি মহিলাদের নানান তথ্য প্রদান করে। এখান থেকে কন্ডোমও বিতরণ করা হয়

দিল্লির হিউম্যান রাইটস ল নেটওয়ার্কের অ্যাডভোকেট স্নেহা মুখার্জি জানালেন, “কোভিডের সময়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। সরকারি হাসপাতালে যৌনকর্মীদের বলা হয়, ‘আমরা তোমাদের স্পর্শ করব না। তোমরা ভাইরাস ছড়াও’। ফলে তাঁরা না পেয়েছেন ওষুধ আর না পেয়েছেন চিকিৎসা।” স্নেহা মুখার্জির মতে, ট্র্যাফিকিং ইন পার্সনস বিল ২০২১ এর খসড়ার পর্যবেক্ষণ, সকল যৌনকর্মীই পাচারের শিকার। এবং বিল আইনে পরিণত হলে যৌনকর্মীদের জন্য কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। তাতে স্বাস্থ্যপরিষেবা থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্নতা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা তাঁর।

২০২০ সালের আগেই, দিনে এক-দুইজন খদ্দের আসতেন, ২০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হত দৈনিক, মাসে ৬-৮ হাজার টাকা। কিন্তু প্রথমবার দেশজোড়া লকডাউন (২০২০ সালের মার্চ মাসে) শুরু হতেই মাসের পর মাস কোনও খদ্দের নেই, অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মতোই যৌনকর্মীদেরও ত্রাণের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। সামান্য খাবার জোটানোও দুষ্কর ছিল। আর এমন অবস্থায় ওষুধের তো প্রশ্নই উঠছে না।

“২০২১ সালের মার্চে রেশনও বন্ধ হয়ে গেল। যৌনকর্মীদের সাহায্যের জন্য সরকার কোনও প্রকল্প নেয়নি। অতিমারির প্রায় দুইবছরের মধ্যে তাঁরা এখনও খদ্দের খুঁজতে হয়রান হয়ে যাচ্ছেন। খাবার তো নেই-ই, এর সঙ্গে দেখা দিয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাও। জীবিকা নেই, পাশাপাশি পরিবারও জানতে পেরে যাচ্ছে, তাঁদের পেশার কথা,” জানালেন অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক ফর সেক্স ওয়ার্কারসের কোঅর্ডিনেটর অমিত কুমার।

নেটওয়ার্ক ফর সেক্স ওয়ার্কারসের ২০১৪ সালের রিপোর্ট বলছে, ভারতে ৮ লক্ষেরও বেশি যৌনকর্মী আছেন। রজনী তিওয়ারির হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৩০ হাজার যৌনকর্মী থাকেন দিল্লিতে। ৩০টি অসরকারি সংস্থা তাঁদের সঙ্গে কাজ করে। প্রত্যেকেরই লক্ষ্য অন্তত ১০০০ বা ততোধিক যৌনকর্মীর নিয়মিত চিকিৎসা সংক্রান্ত পরীক্ষা করানো। মেয়েরা নিজেদের দিনমজুর হিসেবেই দেখেন। “আমরা এই কাজকে যৌন কর্ম হিসেবে দেখি, বেশ্যাবৃত্তি নয়। আমি রোজ আনি, রোজ খাই। আমার একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে। আমি দিনে এক বা দুইজন খদ্দের নিই। প্রত্যেকে ২০০-৩০০ টাকা দেয়,” বললেন ৩৪ বছরের রানি, এসেছেন উত্তরপ্রদেশের বদায়ুন জেলা থেকে। তাঁর স্বামী মারা গেছেন।

There are nearly 30,000 sex workers in Delhi, and about 30 not-for-profit organisations provide them with information and support
PHOTO • Shalini Singh
PHOTO • Shalini Singh

দিল্লিতে প্রায় ৩০,০০০ যৌনকর্মী রয়েছেন এবং প্রায় ৩০টি অলাভজনক সংস্থা তাঁদের মধ্যে তথ্য ও সহায়তা প্রদান করে থাকে

উপার্জনের মাধ্যমটা তাঁদের পরিচয়ের একটা মাত্র দিক। “এটা মনে রাখা দরকার যে যৌনকর্মীরা কিন্তু একা মেয়ে, একক অভিভাবক, দলিত নারী, নিরক্ষর নারী, পরিযায়ী নারী ইত্যাদি নানান পরিচয় বহন করেন, এবং এই পরিচয়গুলি তাঁদের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে, বলছিলেন মুম্বইয়ের সমাজকর্মী, নারীবাদী তাত্ত্বিক ও অফ ইন্টিমেট সিটি গ্রন্থের লেখিকা মঞ্জিমা ভট্টাচার্য। বইটিতে মঞ্জিমা দেখিয়েছেন, কেমনভাবে বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তি যৌন ব্যবসাকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর কথায়, “বহুক্ষেত্রেই মেয়েরা প্রয়োজনের তাগিদে একই সঙ্গে একাধিক অংগঠিত শ্রমভিত্তিক কাজ করেন। কখনও গৃহপরিচারিকার কাজ, আবার কখনও ইমারতি ক্ষেত্রের কাজ বা কখনও বা কারখানায়।”

যৌন পেশারও নিজস্ব শর্ত আছে। “আমরা কাজের জন্য কারও বাড়ি ব্যবহার করলে, বাড়ির মালিকও আমাদের থেকে কমিশন নেয়। খদ্দের আমার নিজের হলে, আমি মাসে ২০০-৩০০ টাকা ভাড়া দিই। কিন্তু খদ্দের যদি দিদির (বাড়িওয়ালি) হয়, তাহলে আমাকেই নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হয়,” বললেন রানি।

আমাকে এমনই একটা অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার আগে অবশ্য বাড়ির মালিক নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলেন, আমি তাঁদের পরিচয় প্রকাশ করে বিপদে ফেলব না। তারপর আমাকে দেখালেন নির্দিষ্ট ঘর। একটা খাট, একটা আয়না, দেবদেবীদের ছবি, আর গ্রীষ্মকালের জন্য একটা পুরানো কুলার। জনা দুয়েক তরুণী খাটে বসে মোবাইল ঘাঁটছেন। দুইজন পুরুষ চোখ সরিয়ে নিলেন, তাঁরা ব্যালকনিতে সিগারেট খাচ্ছিলেন।

‘পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা’, যেখানে শরীর একটি অর্থনৈতিক বিনিময়ের মাধ্যম, সেক্ষেত্রে বেছে নেওয়ার অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নটির উত্তর দেওয় বা পাওয়া বেশ জটিল। পছন্দ-অপছন্দের কথা বলা এখানে শক্ত, যেখানে সেই পছন্দকে নৈতিক বা ভালো বলে কেউ মনেই করে না, বলছেন মঞ্জিমা। “কোন মহিলা চায়, লোকে জানুক, সে যৌন পেশায় থাকতে চায়? ব্যাপারটা খানিক এইরকম, ‘বাজে মেয়ে’র তকমা লেগে যাওয়ার ভয়ে কোনও মেয়ে কি কখনও পরিষ্কার বলতে পারে যে পুরুষবন্ধু, প্রেমিক বা সঙ্গীর সঙ্গে যৌনতায় তার সম্মতি ছিল?”

এদিকে, রানির এখন একটাই চিন্তা। তাঁর দুই সন্তান বড়ো হচ্ছে। তাদেরকে কী বলবেন রানি? তাদের বাড়ি ভাড়া, খাওয়া, স্কুলের মাইনে, ওষুধের খরচ কেমনভাবে জোগাড় করে তাদের মা?

গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য যৌনকর্মীদের নামগুলি বদলে দেওয়া হয়েছে।

পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।

নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে

বাংলা অনুবাদ: রূপসা

Shalini Singh

Shalini Singh is a founding trustee of the CounterMedia Trust that publishes PARI. A journalist based in Delhi, she writes on environment, gender and culture, and was a Nieman fellow for journalism at Harvard University, 2017-2018.

Other stories by Shalini Singh
Illustration : Priyanka Borar

Priyanka Borar is a new media artist experimenting with technology to discover new forms of meaning and expression. She likes to design experiences for learning and play. As much as she enjoys juggling with interactive media she feels at home with the traditional pen and paper.

Other stories by Priyanka Borar
Translator : Rupsa

Rupsa is a journalist in Kolkata. She is interested in issues related to labour, migration and communalism. She loves reading and travelling.

Other stories by Rupsa