ঘড়ির কাঁটা ধরে ফি মাসে ঘুরেফিরে আসে তলপেটের যন্ত্রণা, কুঁকড়ে ওঠেন গায়ত্রী কাচ্ছারাবি। বছর খানেক আগে থমকে যাওয়া ঋতুচক্রের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে তিনদিন ধরে চলা এই যন্ত্রণা।
“একফোঁটাও রক্ত পড়ে না বটে, তবে এভাবেই টের পাই যে আমার মাসিকের সময় হয়েছে। মনে হয় তিনটে বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পর একরত্তিও রক্ত নেই শরীরে, তাই বোধহয় আর মাসিক-টাসিক কিছু হয় না,” বলছিলেন ২৮ বছরের গায়ত্রী। অ্যামেনোরিয়া বা মাসিক থমকে যাওয়া সত্ত্বেও প্রতিমাসে তলপেটে ও পিঠে এসে হানা দেয় মরণযন্ত্রণা, সে ব্যথা এমনই ভয়াবহ যেন প্রসবযন্ত্রণার দোসর, জানালেন গায়ত্রী। “উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারি না।”
লম্বাটে রোগা মানুষটার চোখদুটি বেশ আকর্ষণীয়, কথা বলেন কেটে-কেটে। কর্ণাটকের হাভেরি জেলার রানিবেন্নুর তালুক, আসুন্দি গ্রামের একপ্রান্তে অবস্থিত মাডিগারা কেরিতে নিবাস তাঁর। এই জনপদটিতে দলিত সম্প্রদায়ের মাডিগা জাতির মানুষজন থাকেন। খেতমজুরির পাশাপাশি হাতে করে ফসলের পরাগ মিলনেও দক্ষ গায়ত্রী।
বছরটাক আগে প্রস্রাব করার সময়েও যন্ত্রণা হতে শুরু করল, তখন আর থাকতে না পেরে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হন গায়ত্রী। গ্রাম থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূর ব্যাদগির একটি বেসরকারি ক্লিনিকে যান তিনি।

আসুন্দি গ্রামের দলিত জনপদ, বাচ্চাদের সঙ্গে নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন গায়ত্রী কাচ্ছারাবি
“সরকারি হাসপাতালে তো একদম দেখভাল করে না, তাই ওদের চৌকাঠ মাড়াই না আমি। বিনিপয়সায় চিকিৎসা করাতে গেলে যে কার্ড লাগে, সেটা নেই আমার।” তিনি প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনার কথা বলতে চাইছেন, আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের অন্তর্গত এই স্বাস্থ্যবিমাটির আওতায় হাসপাতালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ভুক্ত খরচাপাতির জন্য পরিবার-পিছু প্রতিবছর ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়।
বেসরকারি ক্লিনিকে যেতেই তাঁকে রক্তপরীক্ষা ও পেটের আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান করাতে বলেন ডাক্তার।
এরপর কেটে যায় গোটা একটি বছর, পরীক্ষানিরীক্ষা কিছুই আর করানো হয়নি তাঁর। নয় নয় করেও ২,০০০ টাকা লাগত, যেটা বহন করা সম্ভব ছিল না গায়ত্রীর পক্ষে। “আমার দ্বারা হল না। রিপোর্ট ছাড়া ডাক্তারবাবুর কাছে গেলে উনি বকাঝকা করতেন। তাই আর ফিরে যাইনি,” জানালেন তিনি।
তার বদলে ওষুধের দোকান থেকে ব্যথার দাওয়াই কিনে আনেন — সস্তায় নির্ঝঞ্ঝাটে মুশকিল আসান! তাঁর জবানে, “এন্থা গুলিগে আডাভো গোটিল্লা [কোন ট্যাবলেট ছিল তা মনে নেই]। দোকানে গিয়ে পেট ব্যথা করছে বললেই ওষুধপত্তর পেয়ে যেতাম।”
আসুন্দির জনসংখ্যা ৩,৮০৮, এতগুলো মানুষকে সামলানো এখানকার সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার সাধ্যের অতীত। চিকিৎসাকর্মী রয়েছেন বটে, তবে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী নন কেউ। উপরন্তু এখানে কোনও বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমও নেই।


বাঁদিকে: আসুন্দির মাডিগারা কেরি, মাডিগা জাতির মানুষের বাস এখানে। ডানদিকে: ঘরের ভিতর পর্যাপ্ত পরিমাণে জায়গার অভাব, তাই কলোনির অপরিসর গলিতেই জামাকাপড় কাচার মতো দৈনন্দিন কাজগুলি করতে বাধ্য হন এখানকার বাসিন্দারা
রানিবেন্নুরের মাদার অ্যান্ড চাইল্ড (এমসিএইচ) নামের সরকারি হাসপাতালটি থেকে আসুন্দির দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। খাতায় কলমে দুইজন প্রসূতি তথা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ (ওবিজি) থাকার কথা ঠিকই, তবে বহাল রয়েছেন মোটে একজন। কাছাকাছির মধ্যে সরকারি চিকিৎসালয় বলতে হীরেকেরুরে আরেকটি আছে, কিন্তু সেটা আবার গ্রাম থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। এখানে অবশ্য ওবিজির টিকিটিও দেখতে পাবেন না, যদিও একজন বহাল থাকার কথা। তাঁদের দেখা মিলতে পারে একমাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে হাভেরির জেলা সদর হাসপাতালে, তাও আবার একসঙ্গে ছয়জন। তবে হ্যাঁ, জেনারেল চিকিৎসা আধিকারিকের ২০টি পদ ও নার্সিং সুপারিন্টেন্ডেন্টের ৬টি পোস্টের কিন্তু প্রত্যেকটিই খালি।
হঠাৎ করে কেন যে এমন মাসিক বন্ধ হয়ে গেল, কেনই বা নিয়মিত মোচড় দিয়ে ওঠে তলপেটটা, তা আজও জানেন না গায়ত্রী। “শরীরটা কেমন যেন ভারী-ভারী ঠেকে,” বলে উঠলেন তিনি, “কেন যে পেটে এমন ব্যথা হয় তা ভেবে পাই না, হয়ত কদিন আগে কেদারা থেকে পড়ে গেছিলাম, বা কিডনিতে পাথর জমেছে, কিংবা মাসিকের সমস্যা — এসবের জন্যই হচ্ছে বোধহয়।”
হীরেকেরুর তালুকের চিন্নামূলাগুন্ড গাঁয়ে বড়ো হয়েছেন গায়ত্রী, ক্লাস ৫ অবধি পড়ে ইস্কুল জীবনে ঢ্যাঁড়া পড়ে যায় চিরতরে। অচিরেই শিখে নেন হাতে করে পরাগ মিলনের কায়দা, যাতে বছরের ছয়মাস জুড়ে অন্তত ১৫-২০ দিন কাজ পেতে অসুবিধা না হয়। খানিক নিশ্চয়তা আসে রোজগারেও। তাঁর কথায়: “ক্রসিংয়ের [হাতে করে পরাগ মিলন] কাজে ২৫০ টাকা মেলে।”
১৬ বছর হতেই বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। মানুষটির খেতমজুরির জীবনে নিরাপত্তার বড্ড অভাব। পড়শি গাঁয়ের ভূমিদার সম্প্রদায়গুলি (বিশেষত লিঙ্গায়ত জাতি) ভুট্টা, রসুন বা পেঁয়াজের ফসল কাটতে খেতমজুর না ভাড়া করলে কাজ জোটে না গায়ত্রীর। “দিন গেলে কুলি [মজুরি] বাবদ ২০০ টাকা পাই আমরা,” বললেন তিনি। তিন-তিনটে মাস জুড়ে ৩০-৩৬ দিন খেতমজুরির কাজ জোটে, “জমির মালিক ডাক পাঠালে তবেই কাজ পাই, নাহলে পেটে কিল মেরে পড়ে থাকি।”


বাঁদিকে: এক পড়শির সঙ্গে নিজের বাড়িতে বসে আছেন গায়ত্রী। ৭.৫ বাই ১০ হাতের এই জানালাহীন ঘরটিতে একখান শৌচাগার বানানোর মতো জায়গাটুকুও নেই, ফলত উত্তরোত্তর অবনতি হয়েছে তাঁর স্বাস্থ্যের, তলপেটে দেখা দিয়েছে অসহ্য যন্ত্রণা। ডানদিকে: বাসনকোসন মাজার জন্য কেবল এই ঘুপচি গলিটুকুই রয়েছে
কৃষিশ্রম এবং হাতে করে পরাগ মিলন করিয়ে প্রতি মাসে গায়ত্রী ২,৪০০-৩,৭৫০ টাকা পান বটে, তবে চিকিৎসা বাবদ যতটা খরচাপাতি লাগে, তা কুলোয় না। গ্রীষ্মকাল এলে কামকাজে দেখা দেয় ভাঁটা, তখন আরোই ভয়াবহ হয়ে ওঠে আর্থিক অনটন।
পেশায় খেতমজুর তাঁর স্বামী চূড়ান্তভাবে মদে আসক্ত, সংসারের ভাঁড়ারে তাঁর অবদান নেই বললেই চলে। এছাড়াও ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি, গতবছর টাইফয়েড ও দুর্বলতার জন্য মাস ছয়েকের বেশি কাজ করতে পারেননি। তার উপর ২০২২ সালের গরমকালে দুর্ঘটনায় একটি হাত ভেঙে যায়, ফলত গায়ত্রীও বাধ্য হন বাড়িতে বসে থাকতে, স্বামীর সেবা-শুশ্রুষায় কেটে যায় তিনমাস। সব মিলিয়ে মোট ২০,০০০ টাকা খরচা হয়েছিল স্বামীর চিকিৎসায়।
এক মহাজনের থেকে ১০ শতাংশ সুদে টাকা ধার করেন গায়ত্রী, মূল তো দূরের কথা, সুদটুকু মেটাতে গিয়ে উল্টে আরও ধার করতে হয়েছিল। এছাড়াও তিনটি ক্ষুদ্রসঞ্চয় সংস্থার কাছে লাখ খানেক টাকা ঋণ আছে তাঁর, মাস গেলে ধার শোধ করতেই ১০,০০০ টাকা বেরিয়ে যায়।
“কুলি মাদিরাগে জীভনা আগোলরি মাথে [শুধু দিনমজুরির ভরসায় পেট চালানো যায় না],” জোরগলায় বললেন গায়ত্রী, “অসুখ-বিসুখ কিছু হলে বাধ্য হই টাকাপয়সা ধার করতে। মাসে মাসে ঋণের কিস্তি না মেটালে বিপদ। হাঁড়ি না চড়লেও ফি হপ্তায় হাটে যাই না। সপ্তাহের পর সপ্তাহ সংঘের [ক্ষুদ্রসঞ্চয় সংস্থা] টাকা মিটিয়েই চলেছি। সেসবের পর কিছু টাকা পড়ে থাকলে তবেই সবজি-টবজি কিনি।”

![Standing in her kitchen, where the meals she cooks are often short of pulses and vegetables. ‘Only if there is money left [after loan repayments] do we buy vegetables’](/media/images/05b-IMG_2803-SS-The_private_torment_of_Asu.max-1400x1120.jpg)
বাঁদিকে: কেন যে মাসিক ঋতুচক্র থমকে গেছে, কেনই বা তলপেটে এমন অসহ্য যন্ত্রণা হয়, ভেবেই পান না গায়ত্রী। ডানদিকে: হেঁশেলে দাঁড়িয়ে আছেন গায়ত্রী, সংসারের যা-কিছু রান্নাবান্না এখানেই করেন বটে, তবে হামেশাই দেখা যায় যে ডাল আর সবজি বাড়ন্ত। ‘সেসবের পর [ধার শোধ করে] কিছু পড়ে থাকলে তবেই সবজি-টবজি কিনি’
হামেশাই দেখা যায়, গায়ত্রীর আহারে ডাল বা সবজির চিহ্নটুকুও নেই। টাকাপয়সা হাতে না থাকলে পড়শির থেকে চেয়ে-চিন্তে টমেটো আর লঙ্কা এনে ঝোল রাঁধেন।
সেন্ট জনস্ মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহ অধ্যাপক ডাঃ শৈবিয়া সালদানহার মতে এটি আদতে “স্টার্ভেশন ডায়েট”, অর্থাৎ উপোস-সম আহার। তাঁর কথায়: “উত্তর কর্ণাটকের অধিকাংশ মহিলা খেতমজুরই এমন স্টার্ভেশন ডায়েটের উপর বেঁচে আছেন। ভাত আর ডাল দিয়ে বানানো পাতলা সারটুকুই [ঝোল] সম্বল, যাতে জল আর লঙ্কাগুঁড়োর পরিমাণটাই বেশি। নিয়মিত অনশনের ফলে শরীরে দানা বাঁধে রক্তাল্পতা, ফলে অল্পেতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন তাঁরা।” ডাঃ সালদানহা এনফোল্ড ইন্ডিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা, এই সংস্থাটি শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সুস্বাস্থ্যের জন্য লড়ছে। বলপূর্বক জরায়ু কেটে বাদ দেওয়ার জন্য এই অঞ্চলটি কুখ্যাত। তাই ২০১৫ সালে কর্ণাটকের স্টেট কমিশন ফর উইমেন থেকে একটি কমিটি গঠিত হয়, যার অন্যতম সদস্য ছিলেন ডাঃ সালদানহা।
মাথা ভোঁভোঁ করা, হাতে-পায়ে অসাড়তা, পিঠব্যথা ও পিছু না-ছাড়া ক্লান্তির কথা জেনেছিলাম গায়ত্রীর কাছে। ডাঃ সালদানহার কথায় এইগুলি সবই লাগাতার অপুষ্টি ও রক্তাল্পতার উপসর্গ।
২০১৯-২০ সালের পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী গত চার বছরে কর্ণাটকের ১৫-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার ৪৬.২ শতাংশ (২০১৫-১৬) থেকে বাড়তে বাড়তে ৫০.৩ শতাংশে (২০১৯-২০) এসে ঠেকেছে। হাভেরি জেলার ছবিটা আরও মর্মান্তিক, ১৫-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের অর্ধেকের বেশি রক্তাল্পতার শিকার।
গায়ত্রীর অসুস্থতা ছাপ ফেলেছে তাঁর মজুরিতেও। “শরীরটা বড্ড খারাপ। একদিন কাজে বেরোলে তার পরদিন আর পারি না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন তিনি।

একই কলোনিতে তাঁর স্বামী সহ পরিবারের ১৯জন সদস্যের সঙ্গে দুই-কামরার একটি ঘরে থাকেন মঞ্জুলা মহাদেবাপ্পা। দিনের বেলায় যেটা রান্নাঘর, রাত্তিরে সেটাই রূপান্তরিত হয় মঞ্জুলা ও তাঁর স্বামীর শোয়ার ঘরে
মঞ্জুলা মহাদেবাপ্পা কাচ্ছারাবিও সারাটাক্ষণ যন্ত্রণার সঙ্গে ঘর করছেন। মাসিকের সময় দুমড়ে মুচড়ে ওঠে শরীর, মাসিক কাটলেই তলপেটে এসে বাসা বাঁধে ব্যথা, একই সঙ্গে শুরু হয় যোনিস্রাব।
“মাসিকের পাঁচটা দিন বড্ড কষ্ট হয়,” জানালেন মঞ্জুলা। পেশায় খেতমজুর এই মানুষটি দিন গেলে ২০০ টাকা পান। “গোড়ার দু-তিন দিন তো উঠে দাঁড়াতেও পারি না। পেটটা এমন কামড়ে ধরে যে হাঁটা-চলার ক্ষমতা থাকে না। কামকাজ শিকেয় ওঠে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শুধু পড়ে পড়ে জিরোই।”
যন্ত্রণার বারমাস্যা ছাড়া আরও একটি মিল রয়েছে গায়ত্রী ও মঞ্জুলার জীবনে - সুরক্ষিত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের অভাব।
১২ বছর আগে, বিয়ের পর আসুন্দির দলিত জনপদে একটি জানালাহীন ৭.৫ বাই ১০ হাত বাড়িতে এসে সংসার পাতেন গায়ত্রী। ঘরখানা তাঁর একটি টেনিস কোর্টের এক-চতুরাংশের চেয়ে খানিকটা বড়ো, তারই ভিতর দুটি দেওয়াল তুলে রান্নাঘর, থাকার ঘর ও স্নানঘর বানানো হয়েছে। শৌচাগারের জন্য এক ছটাক জায়গাও পড়ে নেই।
ওই একই কলোনিতে স্বামী সহ পরিবারের ১৯জন সদস্যের সঙ্গে একটি দুই কামরার ভিটেয় থাকেন মঞ্জুলা। মাটির দেওয়াল ও পুরানো শাড়ি কেটে বানানো পর্দা দিয়ে ছয়ভাগে বিভক্ত হয়েছে কামরা দুটি। “এনুক্কু ইম্বিলরি [কোনকিছুর জন্যই আর জায়গা নেই], বলে উঠলেন তিনি, “পালা-পার্বণের সময় বাড়ির সবাই একজোট হলেই চিত্তির, বসার জায়গাটুকুও মেলে না আর।” ওই দিনগুলোয় তখন কম্যুনিটি হলঘরে গিয়ে মাথা গুঁজতে বাধ্য হন বাড়ির পুরুষেরা।


স্নানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মঞ্জুলা, বাড়ির মহিলারা মাঝেমধ্যে এটিকে শৌচালয় রূপেও ব্যবহার করেন। মাসিক চলাকালীন পেটে যন্ত্রণা ও ঋতুস্রাবের শেষে তলপেটে ব্যথার ফলে হাতে-পায়ে জোর পান না তিনি। ডানদিকে: বাড়ির ভিতর, আত্মীয়দের সঙ্গে মিলে রান্নাবান্না করছেন মঞ্জুলা, একই সঙ্গে নজরও রাখছেন বাচ্চাদের উপর
ভিটের ঠিক বাইরেই শাড়ি-ঘেরা একটি ছোট্ট স্নানঘর বানানো আছে। বাড়ির মহিলারা এখানেই প্রস্রাব করেন বটে, তবে ঘরভর্তি লোক থাকলে সেটা আর সম্ভব হয় না। কদিন ধরেই বেশ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এই জায়গাটা থেকে। জনপদের ঘলিঘুঁজি খুঁড়ে পাইপ বসানোর পর থেকে জল জমতে শুরু করেছে, দেওয়াল জুড়ে ফুটে উঠেছে ছত্রাক। মাসিকের সময় এখানেই স্যানিটারি প্যাড বদলান মঞ্জুলা। “সারাদিনে মোটে দুইবার প্যাড বদলানোর সুযোগ পাই — সকালে, কাজে যাওয়ার আগে, তারপর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে।” যে খামারে কাজে যান, সেখানে কোনও শৌচালয়ের নামগন্ধ নেই।
একঘরে করে রাখা আর পাঁচটা দলিত জনপদের মতো আসুন্দির মাডিগারা কেরিও দাঁড়িয়ে রয়েছে গাঁয়ের একপ্রান্তে। ৬৭টি ঘরে মাথা গুঁজেছেন আনুমানিক ৬০০ মানুষ, অর্ধেক বাড়িতেই তিনটিরও বেশি পরিবারের ঠাঁই।
সে আজ ৬০ বছর আগেকার কথা, আসুন্দির মাডিগা জাতির মানুষদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ১.৫ একর জমি। তারপর থেকে ধীরে ধীরে বেড়েছে এই কলোনিটির জনসংখ্যা। ভিটেমাটির জন্য একধিক আন্দোলন হয়েছে ঠিকই, তবে লাভ কিছুই হয়নি। নতুন প্রজন্ম ও তাদের পরিবারের জন্য জায়গা বানাতে গিয়ে মানুষজন বাধ্য হয়েছেন ঘরের মাঝে দেওয়াল তুলতে কিংবা শাড়ি টাঙাতে।
এভাবেই গায়ত্রীর ২২.৫ বাই ৩০ হাতের বাড়িটি আজ তিনটি ছোটো কামরায় বিভক্ত। তিনি, তাঁর স্বামী, দুই ছেলে ও শশুর-শাশুড়ি মিলে একটি ভাগে থাকেন। স্বামীর বৃহত্তর পরিবারের ঠাঁই বাকি দুটো ভাগে। কাপড়জামা কাচা, বাসন মাজা, ৭ ও ১০ বছর বয়সী দুই ছেলেকে স্নান করানোর মতো যে দৈনন্দিন কাজগুলো তাঁর এই অপরিসর গৃহে করা সম্ভব হয় না, সেগুলোর জন্য রয়েছে বাড়ির সামনের ঘুপচি গলিটা। ঘরে জায়গার অভাব, তাই ৬ বছরের মেয়েকে চিন্নামূলাগুন্ড গ্রামে নিজের মা-বাবার কাছে রেখে এসেছেন গায়ত্রী।


বাঁদিকে: আসুন্দির মাডিগারা কেরিতে গায়ত্রীর বাড়িতে তাঁর শাশুড়ি পেরমাভ্ভা কাচ্ছারাবি ও শ্বশুর (বাঁদিকে)। ডানদিকে: ক্রমশ বেড়ে চলেছে কলোনির জনসংখ্যা, অথচ পর্যাপ্ত পরিমাণে জায়গা পাচ্ছে না এখানে বসবাসকারী পরিবারগুলি
এনএফএইচএস ২০১৯-২০ অনুযায়ী কর্ণাটকের ৭৪.৬ শতাংশ গেরস্থালিতে ‘উন্নত শৌচ ব্যবস্থার’ ব্যবহার দেখা যায়, অথচ হাভেরি জেলার ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যানটি ৬৮.৯ শতাংশে আটকে আছে। এনএফএইচএসের মতে উন্নত শৌচ ব্যবস্থার অর্থ: “নল-বসানো বর্জ্য ব্যবস্থা (সেপটিক টাঙ্কি কিংবা কুয়ো-পায়খানা), যেখানে যান্ত্রিক উপায়ে কিংবা হাতে করে জল ঢালা যায়; উন্নতমানের কুয়ো-পায়খানা, যেখানে হাওয়া-চলাচলের ব্যবস্থা আছে; পা-দানি যুক্ত কুয়ো-পায়খানা; কিংবা কম্পোস্টিং শৌচাগার।” এর একটারও দেখা মেলে না আসুন্দির মাডিগারা কেরিতে। গায়ত্রীর কথায়, “হোলডাল্গা হোগবেকরি [মাঠেই মলমূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হই আমরা]। খেতের মালিকেরা বেড়া বসিয়ে দেয়, অকথ্য গালিগালাজ করে।” তাই ভোররাত থাকতে থাকতেই মাঠের পানে রওনা দেন কলোনির মানুষ।
এসবের থেকে বাঁচতে গিয়ে জল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। আশেপাশে জমির মালিক থাকলে প্রস্রাব করতে পারেন না, অগত্যা তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। “খানিক পরে আবার গেলে প্রস্রাব করতে পাক্কা আধা ঘণ্টা লেগে যায়। বড্ড কষ্ট হয়।”
ওদিকে তলপেটের ব্যথায় কাতর মঞ্জুলাও, তবে তাঁর ক্ষেত্রে কারণটা যোনির সংক্রমণ। ফি মাসে ঋতুস্রাব কাটতে না কাটতেই শুরু হয় যোনিস্রাব। “আবারও মাসিক না শুরু হওয়া অবধি (পরের ঋতুচক্র) এটা চলতে থাকে। যতক্ষণ না রক্ত পড়া শুরু হচ্ছে, ততদিন পেট আর পিঠের ব্যথায় কাবু হয়ে থাকি। অসম্ভব যন্ত্রণা হয়। হাতে-পায়ে একরত্তি জোর পাই না।”
এখনও পর্যন্ত ৪-৫টি বেসরকারি ক্লিনিকের দ্বারস্থ হয়েছেন মঞ্জুলা। হাজারটা স্ক্যানেও কিছু ধরা পড়েনি। “আমায় বলা হয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা না হওয়া অবধি আমি যেন আর ডাক্তার দেখাতে না যাই। ওই জন্যই তো আমি আর কোনও হাসপাতালের চৌকাঠ ডিঙোইনি তারপর থেকে। কস্মিনকালেও কোনও রক্তপরীক্ষা হয়নি আমার।”
ডাক্তারবাবুদের পরামর্শে অখুশি এই মানুষটি শেষে বাধ্য হয়েছেন প্রথাগত জড়িবুটি ও স্থানীয় পুরোহিতদের সাহায্য নিতে। কিন্তু ব্যথা ও যোনিস্রাব সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।


না আছে বাড়িতে শৌচাগার, না আছে কলোনিতে কোনও সরকারি শৌচালয়ের চিহ্ন, ফলত প্রকৃতির ডাক পড়লে আশেপাশের খোলা মাঠের দিকেই রওনা দেন মহিলারা। এঁদের অধিকাংশই খেত-খামারে দিনমজুরি এবং হাতে-করে পরাগ মিলনের কাজ করেন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রেও ওঁদের জন্য কোনও শৌচ ব্যবস্থা নেই
ডাঃ সালদানহার মতে অপুষ্টি, ক্যালশিয়ামের ঘাটতি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটুনির সঙ্গে অপরিশোধিত জল ও খোলা আসমানের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করার ফলে জন্ম নিতে পারে যোনিস্রাব, নাছোড়বান্দা পিঠব্যথা, তলপেটে যন্ত্রণা ও শ্রোণির প্রদাহ।
“সমস্যাটা যে শুধুই হাভেরি কিংবা বিক্ষিপ্ত কিছু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ, তা নয় মোটেও,” জানালেন টিনা জেভিয়ের। উত্তর কর্ণাটকের এই সমাজকর্মীটি একদা কর্ণাটক জনারোগ্য চালুভালির (কেজেএস) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৯ সালে উক্ত অঞ্চলে ঘটতে থাকে প্রসূতি মৃত্যু নিয়ে কর্ণাটকের উচ্চ আদালতে পিটিশন দায়ের করেছিল এই সংগঠনটি। “দুর্বল জনগোষ্ঠীর মহিলাদের প্রত্যেকেই বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের শিকার।”
অথচ কর্ণাটকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য কাঠামোয় ডাক্তার, আয়া ও প্যারামেডিক্যাল কর্মীর অভাব এতটাই ভয়ঙ্কর যে গায়ত্রী ও মঞ্জুলার মতো মহিলারা বাধ্য হন বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের কড়া নাড়তে। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন থেকে ২০১৭ সালে প্রজনন সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যের উপর একটি অডিটের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল — এ দেশের স্বাস্থ্য কাঠামোর বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় যে কর্ণাটকে ডাক্তার, আয়া ও প্যারামেডিক্যাল কর্মীর অবিশ্বাস্য রকমের ঘাটতি।
তবে এসব পরিকাঠামোগত সমস্যা বিষয়ে অবগত নন গায়ত্রী, উদ্বিগ্ন এই মানুষটির একটামাত্র আশা — তাঁর জ্বালা-যন্ত্রণার কারণ একদিন না একদিন বোঝা যাবেই। ব্যথার দিনগুলোয় মাথা-চাড়া দেয় উৎকন্ঠা, তিনি বলে ওঠেন, “কী হবে গো আমার? একটিবারের জন্যও রক্তপরীক্ষা করাইনি। যেভাবেই হোক ধারদেনা করে পরীক্ষা-টরীক্ষা করাতে হবে। আমার শরীরে কোথায় গড়বড় রয়েছে, এটুকু যে না জানলেই নয়।”
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)