লিম্বডি রাজপথ থেকে একখান পিচ-ঢালা পথ বেরিয়ে ১০-১২ কিলোমিটার দূর মোটা টিম্বলা গাঁয়ের দিকে গেছে। গ্রামের একপ্রান্তে দলিত জাতির তাঁতিরা থাকেন, পাড়ার নাম বনকারবাস। খট-খটাং-খট...খট-খটাং-খট...সরু সরু গলিঘুঁজি জুড়ে ছুটতে থাকা মাকুর প্রতিধ্বনি, দুধারের টালিছাওয়া বাড়িগুলো সেকেলে, খানকতক খড়ে ছাওয়া কুঁড়েও আছে। থেকে থেকে তাঁতযন্ত্রের আওয়াজে যতিচিহ্নের মতন শোনা যাচ্ছে লোকজনের গলা। কান পেতে শুনলে মেহনতের শব্দও ঠাহর হবে। আরেকটু মন দিয়ে শুনলে এখানকার এই ইঁদুরকলের পদাবলির মাঝে আফসোসের ক্ষীণ ধুয়োও কানে আসবে, ঠিক যেন রেখা বেন বাঘেলার আখ্যানের গৌরচন্দ্রিকা।

“তখন সবে তিনমাস হয়েছে ক্লাস থ্রিয়ে উঠেছি। লিম্বডির একটা ছাত্রাবাসে থাকতাম, স্কুলের প্রথম পরীক্ষার পর সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছি কিনা মা বলে দিলো যে আমায় আর পড়তে হবে না। আমার বড়দা গোপাল ভাইয়ের মদত করতে হবে। রুজিরুটির তাগিদে বড়দাও গ্র্যাজুয়েশনের ঠিক আগে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। আমার দুই দাদার [শিক্ষাদীক্ষার] খরচা চালানোর সামর্থ্য আমার বাড়ির লোকের কোনদিনও ছিল না। এভাবেই আমি পাটোলার কাজ শুরু করি।” দারিদ্র্যের শানানো আর পাঁচটা জিনিসের মতো রেখা বেনের কথাগুলোও সোজাসাপ্টা আর তীক্ষ্ণ। বছর চল্লিশের রেখা বেন গুজরাতের সুরেন্দ্রনগর জেলার মোটা টিম্বলা গাঁয়ের ওস্তাদ বুনকর।

“আমার বরটা পাঁড় মাতাল। মদ, জুয়া, পানমশলা, তামাক, সবকিছুর নেশায় বুঁদ,” বিয়ের পরের জীবন থেকে আরেক খি সুতো টেনে বলে উঠলেন তিনি। এ জীবনে দুঃখেরই ঠাসবুনন। হামেশাই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপমায়ের কাছে চলে যেতেন রেখা বেন, কিন্তু ওঁরা মেয়েকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার ফেরত পাঠাতেন। অসহ্য ঠেকলেও মুখ বুজে সব সহ্য করতেন। “লোকটা নিতান্তই বদচরিত্রের ছিল,” জানালেন তিনি।

“প্রায়ই আমার গায়ে হাত তুলত, এমনকি আমার পেটে বাচ্চা আসার পরেও।” রেখা বেনের কথা শুনলে বোঝা যায়, ক্ষতগুলো আজও কেমন দগদগে হয়ে আছে তাঁর মনের জমিনে। “মেয়েটা হওয়ার পর জানতে পারি যে আমার বর অন্য আরেক সম্পর্কে জড়িয়েছে। ওভাবেই গোটা একটা কেটে যায়। ঠিক তখনই [২০১০ সালে] গোপাল ভাই দুর্ঘটনায় মারা যায়। ওর পাটোলার কাজগুলো সব মুলতুবি হয়ে পড়েছিল। বড়দা যে বেনিয়ার থেকে কাঁচামাল নিয়েছিল, তার কাছে টাকা বাকি ছিল। তার পরের পাঁচটা মাস আমি বড়দার ফেলে যাওয়া কাজ খতম করব বলে ওখানেই [বাবা-মায়ের বাড়িতে] থেকে যাই। তারপর বর আমায় নিতে আসে,” রেখা বেন বললেন।

বাচ্চার দেখভাল আর মরমে মরতে মরতে আরও কয়েক বছর কেটে যায়, বোধহয় নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিতেন ‘ভালো আছি’ এই বলে। “শেষমেশ মেয়েটা সাড়ে চার বছরের হতেই এ নরক যন্ত্রণা আর সহ্য না করতে পেরে বরের ঘর ছাড়লাম,” রেখা বেন বাঘেলা জানালেন। স্কুল ছাড়ার পর পাটোলা বুননে সেই যে হাত পাকিয়েছিলেন, শ্বশুরবাড়ি থেকে মুক্তি পাওয়ার সেটা কাজে আসে। দারিদ্র্যের দংশনে মলম হয়ে দেখা দেয় পাটোলাশিল্প, নতুন ভাবে এক মজবুত জীবন শুরু করার সুযোগ মেলে।

PHOTO • Umesh Solanki
PHOTO • Umesh Solanki

কৈশোরে পাটোলা বোনা আরম্ভ করেছিলেন রেখা বেন। আজ চল্লিশের কোঠায় দাঁড়িয়ে তিনি লিম্বডি জেলার মূলত পুরুষপ্রধান এই শিল্পে সবেধন মহিলা কারিগর যিনি যুগ্ম ও একক পাটোলা বোনায় পারদর্শী

কদিন বাদেই লিম্বডি এলাকায় সবেধন মহিলা পাটোলোশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রেখা বেন। যিনি কিনা এক পোড় খাওয়া ওস্তাদের মতো অনায়াস দক্ষতায় টানা আর পোড়েনের সুতো মাপে মাপে বুনতে সক্ষম।

“শুরুতে দন্ডির কাজ করতে এক পড়শির কাছে যেতাম, আমাদের উল্টোদিকের বাড়িটায়। অন্তত মাসখানেক তো লেগেইছিল শিখতে,” রেখা বেন জানাচ্ছেন। কথা বলতে বলতে মাকুটা যুত করে বসাচ্ছিলেন তিনি, কনুইদুটো ঠেস দেওয়া ছিল তাঁতে, থেকে থেকে অভিজ্ঞতায় ভারাক্রান্ত খসখসে গালদুটো ঘসছিলেন হাত দিয়ে। টানা (আড়াআড়ি) আর পোড়েনের (লম্বালম্বি) জালে সন্তর্পণে বসিয়ে দিচ্ছিলেন সুতোর বাহারি নকশা।

মাকুর ফুরিয়ে যাওয়া নাটাই বদলে নতুন একখান ফিট করে তাঁতের দুটো পা-দান চাপ দিলেন, তাতে নকশার চাহিদা মোতাবেক টানার একটা পরত উঠে এল, যাতে মাকুটা তার ফাঁক দিয়ে ছুটতে পারে। টানার নড়নচড়ন নিয়ন্ত্রণে রাখতে এক হাতে ধরা আছে তাঁতের দণ্ড, আরেক হাতে চটজলদি বাটাম টেনে টানা-সুতোটা তার জায়গায় বসিয়ে রাখলেন। একাহাতে পাটোলু বুনে চললেন রেখা বেন, দুচোখ স্থির তাঁতযন্ত্রে, মনে মনে গাঁথা আছে নকশা। একনিঃশ্বাসে বলে চললেন নিজের জীবন ও কারিগরির দাস্তান।

প্রথাগত কায়দায় পাটোলু বুনতে ন্যূনতম দুজন দরকার। “দন্ডির কাজ করে সহায়ক, সে বাঁদিকে বসে, আর তাঁতি বসে ডানদিকে,” রেখা বেন বুঝিয়ে বললেন। কোন ধরনের পাটোলু বোনা হচ্ছে, সেটা অনুযায়ী দন্ডির কাজে আগে-থেকে রং করা সুতো হয় টানা অথবা পোড়েন বরাবর কিংবা দুটোতেই বোনা হয়।

একেক পিস পাটোলু বুনতে যে পরিমাণ সময় আর মেহনত লাগে সেটা দেখলেই বুঝে যাবেন যে এ বয়ন প্রক্রিয়া কতখানি শ্রমনিবিড়। তবে রেখা বেন বাঘেলার দক্ষতা আর নৈপুণ্যে পুরোটাই সাঙ্গ হয় অবলীলাক্রমে। যেন বুননের হাজার জটিলতা নিছকই তাঁর চোখে এক জাদুস্বপ্ন, যা আঙুলের ডগায় ফুটে উঠছে পরতে পরতে।

“সিঙ্গেল ইকতে নকশাটা কেবল টানা বরাবর হয়। ডাবল ইকতে টানা আর পোড়েন দুটোতেই নকশা থাকে,” পাটোলার দুটি আলাদা আলাদা কিসিমের কথা বোঝালেন তিনি।

নকশা দিয়েই একক ও যুগ্ম ইকতের তফাৎ বুঝতে হয়। বেঙ্গালুরুর সূক্ষ্ম খি রেশমনির্মিত ঝালোয়াড়ের পাটোলা একক ইকতের হয়, ওদিকে পাটানের পাটোলা হয় যুগ্ম ইকতের — এক্ষেত্রে আসাম কিংবা ঢাকার মোটা খিয়ের রেশম ইস্তেমাল হয়ে থাকে। উপরন্তু এখানকার বুনকরদের দাবি যে ডাবল ইকতের রেশম সুদূর ইংল্যান্ড থেকেও আসে।

PHOTO • Umesh Solanki
PHOTO • Umesh Solanki

বুননের সময় ও শ্রমের নিরিখে পাটোলুবয়ন অত্যন্ত নিবিড় এক প্রক্রিয়া। তবে রেখা বেন বাঘেলার দক্ষতা আর নৈপুণ্যে পুরোটাই সাঙ্গ হয় অবলীলাক্রমে। যেন আঙুলের ডগায় ডগায় বাস্তব হয়ে উঠছে কোনও জাদুস্বপ্ন

PHOTO • Umesh Solanki
PHOTO • Umesh Solanki

প্রথাগত কায়দায় পাটোলু বুনতে ন্যূনতম দুজন কারিগর দরকার। সহায়ক বাঁদিকে বসে টানাপোড়েনের সঙ্গে নকশা মেলাতে থাকেন, আর তাঁতি বসেন ডানদিকে। অথচ রেখা বেন পুরোটা একাই করেন — প-দানে পা, এক হাতে দণ্ড, অন্যহাতে বাটাম

তেলেঙ্গানা বা ওড়িশার মতো ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের তাঁতিরা যুগ যুগ ধরে ইকত বুনে আসছেন — এই শিল্পের বুনন ও সুতোয় রং চড়ানোর প্রক্রিয়া দুটি বেশ কঠিন। তবে ভৌগলিক অবস্থানের পাশাপাশি জটিল ও সুস্পষ্ট নকশা, এবং রেশমের চোখ ধাঁধানো রঙে গুজরাতের পাটোলা অনন্য। এখানে তৈরি হওয়া পাটোলার দাম যেমন চড়া, তেমনই রাজারাজড়ার পৃষ্ঠপোষকতার সুদীর্ঘ ইতিহাসও জড়িয়ে আছে।

পাড়ি পাটোলে ভাত, ফাটে পন ফেটে নাহি। জনপ্রিয় এই গুজরাতি প্রবাদ বলে যে পাটোলা ছিঁড়েফেটে গেলেও তার নকশা কখনও জেল্লা হারায় না। পাটোলা-নকশার গল্পটা অবশ্য বেশ জটিল, আরেকদিন বলব নাহয়।

বরের ঘর ছাড়ার পর রেখা বেনের জীবনটা বড্ড কষ্টের মধ্যে দিয়ে কেটেছিল। বহুদিন তাঁতে হাত লাগাননি, ফলে আবার করে শুরু করাটা বেশ কঠিন ছিল। “দু’তিনজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, কিন্তু কেউই ভরসা করে আমায় কাজ দিতে চায়নি। শেষে সোমাসারের জয়ন্তী ভাই আমায় বাঁধা মজুরির বিনিময়ে ছ’টা শাড়ি বুনতে দিলেন। তবে চারবছর পর এ কাজে হাত দিয়েছিলাম তো, তাই ফিনিশিংটা ততটাও ভালো হয়নি। আমার বুননটা নেহাতই কাঁচাহাতের লেগেছিল ওঁনার — দ্বিতীয়বার আর সুযোগ দেননি। প্রতিবারই কোনও না কোন অজুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিতেন,” বুনতে বুনতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন রেখা বেন বাঘেলা। হঠাৎই মনে হল, এই দীর্ঘশ্বাসটুকুর জন্য এবারও টানা সুতোর সমান সমান মাপে কোনও গড়বড় হয়ে যাবে না তো? এটাই তো পুরো নকশাটার শিরদাঁড়া।

‘চাইব-কি-চাইব-না’-র দোটানায় বেকারত্বের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো, ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছিল দারিদ্র্যের ছোপ। কাজের জন্য কারও হাতেপায়ে ধরতে পিছপা হননি রেখা বেন, তবে সরাসরি টাকা চাইতে সম্মানে লাগত। “আমার ফুইয়ের [পিসি] ছেলে, মনুভাই রাঠোরের সঙ্গে কথা বললাম। ও কিছু কাজ দিল। আগের চাইতে এবারের কাজটা খানিক বেহতর হয়েছিল। মনুভাইয়ের বেশ ভাল্লেগেছিল। বছর দেড়েক মজুরির বদলে বুনেছিলাম। ওগুলো সিঙ্গেল ইকত ছিল, একেকটা পাটোলা শাড়ির বিনিময়ে ৭০০ টাকা পেতাম,” মনে করে বললেন রেখা বেন। “আমি আর ননদ [গোপাল ভাইয়ের স্ত্রী] মিলে একসঙ্গে বুনলে একেকটা শাড়ি তৈরি করতে তিনদিন লাগত।” অর্থাৎ হররোজ ১০ ঘণ্টারও অধিক খেটে মরা। সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অন্যান্য কামকাজ তো ছিলই।

তবে এই টানাপোড়েনের জীবন থেকেই সাহস পেয়েছিলেন তিনি। “তারপর ভাবতে লাগি,” বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে লাগলেন, “একা কাজ করলে আরও ভালো হবে, নিজে নিজে বুনতে লাগলে আর্থিক অবস্থাটা ফিরবে। কাঁচামাল কিনলাম, আর বাইরে থেকে তাঁত বানিয়ে আনলাম। তাঁতটা তৈরি হতেই টানা সুতো ঘরে এনে বুনতে আরম্ভ করে দিই।”

“কোনও বরাতি কাজ নয়,” সহাস্যে যোগ করলেন রেখা বেন, “নিজেই পাটোলা বুনতে লাগি। এমনকি ঘরে বসে বিক্রিও করতাম। ধীরে ধীরে উৎপাদনটা বাড়াতে থাকলাম।” অসহায়তা থেকে আজাদির এই যাত্রাটা তাক লাগানো তো বটেই। তবে মনের গভীর একটাই জিনিস খুঁতখুঁত করত — যুগ্ম ইকত বুননে নিজের জ্ঞান ও পারদর্শিতার অভাব।

PHOTO • Umesh Solanki
PHOTO • Umesh Solanki

নকশার রকমফের দেখে পাটোলার প্রকার বোঝা যায়। আগে থেকে রং-করা সুতোর উপর নির্ভর করে নকশা। একক বা সিঙ্গেল ইকতে (বাঁদিকের চিত্রে যেটা রেখা বেন বুনছেন) কেবল টানা-সুতোয় নকশার কাজ থাকে, আর যুগ্ম বা ডাবল ইকতের (ডানদিকে) বেলায় টানা ও পোড়েন দুটোতেই নকশা থাকে

“শেষমেশ আমার বড়জ্যাঠার কাছে দেড় মাস ডাবল ইকতে তালিম নিলাম,” তিনি জানাচ্ছেন। মেয়ে তখনও বেশ ছোটো, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন, আর্থিক অনটনে হাবুডুবু অবস্থাখানায় একটা ফোঁটাও বদল আসেনি। তবে রেখা বেনের জেদও ষোল আনা, আদা-জল খেয়ে লেগে পড়লেন। “জমানো পুঁজির পুরোটাই কাঁচামাল আর রেশমে ঢেলে দিলাম। নিজেই ষোলটা পাটোলার নকশা ফেঁদে সুতো প্রস্তুত করলাম।”

“এ কাজে নয় নয় করেও অন্তত তিনজন দরকার, এদিকে আমি পুরো একা। মাথাটা ঘেঁটে যাচ্ছিল। পাসি বিচার‍্যু জে কর্ভানু ছে এ মরজ কর্ভানু সে। মন মক্কম করি লিধু পাসি [কিন্তু তারপর নিজেকে বলি যে যা যা করতে হবে তার জন্য আমি বাদে আর কেউ নেই। তাই মনস্থির করে ফেলি]।” তা সত্ত্বেও যখন যখন মদত লাগত, তাঁর বেরাদরির মানুষজন নির্দ্বিধায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন — রং ছোপানো টানা-সুতো পোক্ত করতে রাস্তার দুটো বৈদ্যুতিক খাম্বায় টানটান করে বেঁধে মাড় দেওয়া, সঠিক অনুক্রমে টানাপোড়েনের সুতো ফেনের মধ্যে (হেডেল বা তারের ফাঁস) দিয়ে গলিয়ে তাঁতের বাটামে বাঁধা, বুননের আগে তাঁতযন্ত্রটা তৈরি করা।

মাড়ের মাঞ্জা দেওয়াটা বড্ড ফ্যাসাদের। সুতোর গায়ে অতিরিক্ত ময়দা লেগে থাকলে ঝাঁকে ঝাঁকে ইঁদুর আর টিকটিকি এসে জুটবে তাঁতে।

“ডাবল ইকত মোটেই মুখের কথা নয়। ভুলচুক হত। যেমন ধরুন টানা আর পোড়েনের সুতো সমান সমান করে বসানো। বাইরে থেকে লোক ডাকতেও বাধ্য হতাম, যাতে শিখতে পারি। একবার ডাকলে কেউই আসে না। চার-পাঁচবার করে গিয়ে গিয়ে ডাকতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরোটাই খাপে খাপ হয়ে গেল!” রেখা বেনের হাসিটায় তুষ্টির সঙ্গে মিশে ছিল অনিশ্চয়তা, ডর, বিভ্রান্তি, সাহস আর নাছোড়বান্দা মনোভাব। ‘খাপে খাপ’ হয়ে যাওয়ার অর্থ টানা-সুতোর সঙ্গে পোড়েনের সামঞ্জস্য, যাতে কাপড়ের গায়ে নকশাটা নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে — নইলে খদ্দেরের চাইতে বুনকরের খরচাটাই বেশি পড়ে।

এককালে বাহারি যুগ্ম ইকত পাটোলা কেবলমাত্র পাটান থেকেই আসত। “পাটানের তাঁতিরা ইংল্যান্ড থেকে রেশম আনায়, আমরা আনাই বেঙ্গালুরু থেকে। অনেক বেনিয়াই রাজকোট বা সুরেন্দ্রনগর থেকে পাটোলা কিনে পাটানের শিলমোহর মেরে দেয়,” এ গাঁয়ের আরেক বুনকর বিক্রম পারমার (৫৮) তাঁর স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন।

“আমাদের থেকে যেগুলো পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর হাজার টাকা দিয়ে কেনে, সেগুলোই আরও চড়া দামে বেচে। ওঁনারা নিজেরাও বোনেন বটে, তবে এগুলো অপেক্ষাকৃত সস্তা পড়ে,” বললেন তিনি। ঝালোয়াড়ের স্বল্পমূল্য পাটোলায় পাটানের শিলমোহর দিয়ে বড়ো বড়ো শহরে লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হওয়ার গল্পটা এখানকার একাধিক তাঁতির জবানে শুনতে পেলাম। এই কাণ্ডটা আজ বেশ অনেকদিন ধরেই চলছে।

PHOTO • Umesh Solanki
PHOTO • Umesh Solanki

বৌদি যমনা বেন ও দাদা জয়সুখ বাঘেলার সঙ্গে হায়ড্রোক্লোরাইড দিয়ে হলদে তসর ব্লিচ করছেন রেখা বেন, পরে এটা একটা কোনও রঙে রাঙানো হবে। এমনতর বহু ধাপ পেরিয়ে তবেই বোনার জন্য তৈরি হয় রেশমের সুতো

PHOTO • Umesh Solanki
PHOTO • Umesh Solanki

বাড়ি লাগোয়া রাস্তার দুটো বৈদ্যুতিক খাম্বায় সদ্য রাঙানো সুতো টানটান করে টাঙাচ্ছেন রেখা বেন, তন্তু পোক্ত করতে এবার মাড়ের মাঞ্জা দেওয়া হবে। এইসব কাজে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন বেরাদরির মানুষজন

প্রায় ৪০ বছর আগে, লিম্বডি তালুকায় পাটোলাশিল্প নিয়ে এসেছিলেন রেখা বেনের আগের প্রজন্মের বুনকর হামীর ভাই (৭০)।

লিম্বডির কাটারিয়া গাঁয়ে যাত্রার কথা মনে করে হামীর ভাই জানালেন, “অর্জন ভাই আমায় ভয়াভদর থেকে রাজকোটে নিয়ে গেছিলেন। এক-দুমাস ধরে আমায় নিয়ে এ কারখানা থেকে সে কারখানায় নিয়ে নিয়ে ঘুরল। একবার তো মালিক আমায় সওয়াল করেই বসল: ‘চেওয়া সো? [তুমি কোন জাতের হে?]’ আমি বললাম ‘ওয়নকর’। ব্যাস, সব গোলমাল হয়ে গেল। ঝটপট জবাব এল: ‘কাল থি নো আওতা, তামারা ভেগু পানি নাথ পিভু [কাল থেকে আর আসিস না, তোর হাতের পানিটুকুও আমি ছোঁব না]।’ তারপর মোহন ভাই মাকওয়ানা আমায় জিজ্ঞেস করলেন যে আমি পাটোলা বানানো শিখতে চাই কি না, তারপর পাঁচটাকা রোজে কাজ শুরু করে দিলাম। ছ’মাস ধরে নকশা বানানো শিখলাম, পরের ছ’মাস কাটল বোনা শিখতে।” এরপর তিনি কাটারিয়ায় ফিরে আসেন, তবে বুননকার্য ছাড়েননি, বরং অন্যান্য অনেকের মাঝে নিজের দক্ষতা বিলিয়ে দেন।

“গত পঞ্চাশ বছর ধরে বুনে চলেছি,” পুঞ্জা ভাই বাঘেলা জানাচ্ছেন, পেশায় ইনিও তাঁতি। “যদ্দূর মনে হয় তখন ক্লাস থ্রিয়ে পড়তাম যখন বুনতে আরম্ভ করি। গোড়ায় খাদির কাজ করতাম। পাটোলা পরে ধরি। পাটোলার কাজে আমার কাকার থেকে হাতেখড়ি। তারপর থেকে শুধু এটাই করে চলেছি। সবই সিঙ্গেল ইকত, সাত-আট হাজার টাকার শাড়ি। বর-বউ দুজন মিলেই,” স্ত্রী জসু বেনের দিকে ইঙ্গিত করে বলে চললেন পুঞ্জা ভাই, “সুরেন্দ্রনগরের প্রবীণ ভাইয়ের জন্য কাজ করতাম, আর আজ ৬-৭ মাস হতে চললো রেখা বেনের হয়ে কাজ করছি।”

জসু বেনের কথায়, “ওঁনার পাশে যদি বসি [মাপসই সুতো বসানোর কাজে সাহায্যে], দিন গেলে ২০০টা করে টাকা পাই। দু-চারটে নকশা-টকশার কাজ করে দিলে ৬০-৭০ টাকার মতো আয় হয়। আমার বেটি উর্মিলা সুতোয় রং ছোপাতে রেখা বেনের বাড়ি যায়। ওর দিনমজুরি ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে মোটের উপর আমাদের কুলিয়ে যায়।”

“এসব তাঁত-টাঁত সবই রেখা বেনের নিজের,” সেগুনকাঠের তাঁতযন্ত্রে হাত বোলাতে বোলাতে কথা বলছিলেন পুঞ্জা ভাই। খালি তাঁতেরই দাম ৩৫-৪০ হাজার টাকা। “আমাদের আছে শুধু গায়েগতরে মেহনত। সবার ভাগেরটা যোগ করলে মাসে হাজার বারো টাকার মতো হয়,” কথায় কথায় দারিদ্র্য ঢাকার যারপরনাই চেষ্টা করছিলেন মনে হল।

PHOTO • Umesh Solanki
PHOTO • Umesh Solanki

রেখা বেনের অধীনে কাজ করেন স্বামী-স্ত্রী জসু বেন বাঘেলা ও পুঞ্জা ভাই বাঘেলা। তাঁত সাজানো (উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে), রেখা বেনের পাশে বসে নকশাটা মাপসই করে বসানো, নকশা সংক্রান্ত ছোটোখাটো কাজ, এমনকি মজুরির বিনিময়ে বুনন — এমন অনেক কিছুই করেন তাঁরা

PHOTO • Umesh Solanki
PHOTO • Umesh Solanki

লিম্বডি তালুকে পাটোলাশিল্প চালু করেছিলেন হামীর ভাই কর্ষণভাই গোহিল (৭০) ও তাঁর স্ত্রী হংসা বেন। আজ এখানকার বোনা পাটোলায় পাটানের শিলমোহর (ডানদিকে) দিয়ে লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে দুনিয়াভর

কারবার ফুলে ফেঁপে ওঠায় খানিক খানিক কাজ পুঞ্জা ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন রেখা বেন বাঘেলা। “ভোর পাঁচটায় চোখ খুলি,” তিনি জানাচ্ছেন, “রাতে শুতে শুতে ১১টা বেজে যায়। ঘরকন্নার সমস্ত কামকাজ আমার একার ঘাড়ে। ঘর বাদে বাইরেটাও আমাকে দেখতে হয়, যেমন ধরুন বেরাদরির লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা। গোটা ব্যবসাটাও আমি একা টেনে নিয়ে যাচ্ছি,” এই বলেই টানা-সুতোর নাটাই সমেত মাকুটা ডাইনে থেকে বাঁয়ে চালান করে দিলেন।

মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মাকুর ছোটাছুটি দেখছিলাম — ডাইনে থেকে বাঁয়ে, বাঁ থেকে ডাইনে। দেখছিলাম কেমন অবলীলাক্রমে টানা আর পোড়েনের সামঞ্জস্যে অনন্য সাধারণ এক নকশি পাটোলা বানিয়ে ফেলছে রেখা বেনের পোড় খাওয়া দুটি হাত। আর এসবের পিছনে, মনের অতলে কোথাও যেন গুনগুনিয়ে গাইছিলেন সন্ত কবীর:

‘नाचे ताना नाचे बाना नाचे कूँच पुराना
करघै बैठा कबीर नाचे चूहा काट्या ताना'

‘নাচছে টানা নাচছে পোড়েন, নাচছে বুরুশ* বুড়ো
নেংটি ইঁদুর কাটছে সুতো, নাচছে কবীর খুড়ো’

*কুঁচ নামে যে নরম বুরুশ দিয়ে সুতো সাফ করা হয়

এই প্রতিবেদনটি লেখায় সাহায্য করার জন্য জয়সুখ বাঘেলাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন লেখক।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Umesh Solanki

اُمیش سولنکی، احمد آباد میں مقیم فوٹوگرافر، دستاویزی فلم ساز اور مصنف ہیں۔ انہوں نے صحافت میں ماسٹرز کی ڈگری حاصل کی ہے، اور انہیں خانہ بدوش زندگی پسند ہے۔ ان کے تین شعری مجموعے، ایک منظوم ناول، ایک نثری ناول اور ایک تخلیقی غیرافسانوی مجموعہ منظرعام پر آ چکے ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Umesh Solanki
Editor : Pratishtha Pandya

پرتشٹھا پانڈیہ، پاری میں بطور سینئر ایڈیٹر کام کرتی ہیں، اور پاری کے تخلیقی تحریر والے شعبہ کی سربراہ ہیں۔ وہ پاری بھاشا ٹیم کی رکن ہیں اور گجراتی میں اسٹوریز کا ترجمہ اور ایڈیٹنگ کرتی ہیں۔ پرتشٹھا گجراتی اور انگریزی زبان کی شاعرہ بھی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Pratishtha Pandya
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کے ہندوستانی زبانوں کے پروگرام، پاری بھاشا کے کانٹینٹ مینیجر ہیں۔ انہوں نے کولکاتا کی جادوپور یونیورسٹی سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک کثیر لسانی شاعر، ترجمہ نگار، فن کے ناقد اور سماجی کارکن ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra