“এককালে পাটনায় সপ্তাহভর তিলাঙ্গির [ঘুড়ি ওড়ানো] প্রতিযোগিতা হত। সুদূর লখনউ, দিল্লি আর হায়দরাবাদ থেকে পতঙ্গবাজদের আমন্ত্রণ জানানোর রেওয়াজ ছিল। জিনিসটা পুরো উৎসবের মতন ছিল,” গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন সৈয়দ ফৈজান রাজা। আদিগন্ত জলরাশির আয়নায় খোলা আসমানের প্রতিবিম্ব, সৈয়দের সাহেবের কথায় সে যুগে হাজার হাজার ঘুড়ি ভিড় জমাতো তাতে।

পাটনার এই বয়স্ক বাসিন্দার ভিটে গঙ্গার তীরবর্তী দূলিঘাট মহল্লায়। তিনি বলছেন যে তখনকার দিনে তিলাঙ্গির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নবাব-জমিদার থেকে তাওয়াইফ, অর্থাৎ সমাজের সব শ্রেণিই। মন্ত্রের মতো কয়েকটা নাম আওড়ে গেলেন সৈয়দ সাহেব: “বিসমিল্লাহ জান [তাওয়াইফ বা বাইজি] পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, আর মির আলি জামিন ও মির কেয়াফত আলি ছিলেন পতঙ্গসাজি [ঘুড়ি বানানো] আর পতঙ্গবাজির দুই নামজাদা ওস্তাদ।”

এই খেলায় ইন্ধন জোগাতে হামেশা তৈরি থাকতেন ঘুড়ি কারবারির দল, পাটনার গুরহাট্টা থেকে অশোক রাজপথে অবস্থিত খ্বাজাকালান অঞ্চল ঘুড়ির দোকানে ভরে থাকত, আর বাইরে পতপতিয়ে ঝুলতে থাকা রংবেরঙের ঘুড়ি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত। “পাটনার ঘুড়ির সুতোগুলো আর পাঁচটা সুতোর চাইতে বেশ মোটা হত, সুতি আর রেশম মিশিয়ে বানানো, লোকমুখে সুতোর নাম পড়েছিল নাখ,” সৈয়দ ফৈজান রাজা জানাচ্ছেন।

পাটনা যে সেযুগে ঘুড়ির জন্য কতখানি বিখ্যাত ছিল তার উল্লেখ মেলে বালু সাহেবের মাসিক পত্রিকার ১৯৬৮ সালের কিস্তিতে: “এ মুলুকে কেউ যদি চটজলদি বড়োলোক হতে চায়, তার উচিত পাটনার ঘুড়িতে সড়গড় হওয়া। এখানকার বাজারে প্রতি দশটা দোকানের একটা ঘুড়ির দোকান, আপনি হয়তো বা ভেবে বসবেন যে এখানকার মেয়েমরদ ছেলেবুড়ো সব্বাই পতঙ্গ ওড়ায়। ঘুড়ির আকার বরফির মতন, পালকের মতো হালকা, কোনও ল্যাজ নেই, পলকা রেশমে সুতো বেঁধে ওড়ানো হয়।”

দেখতে দেখতে এক শতাব্দী কেটে গেছে, বদলেছে বহুত কিছুই, তবে পাটনার তিলাঙ্গিরা তাদের বৈচিত্র্য ধরে রেখেছে — তারা ল্যাজহীন ঘুড়ি। “দুম তো কুত্তে কা না হোতা হ্যায় জি, তিলাঙ্গি কা থোড়ে [ল্যাজ তো কুকুরের হয় গো, ঘুড়ির হয় না থোড়াই],” সহাস্য বক্তব্য ঘুড়ি কারিগর শাবিনাজির। বছর সত্তরের শাবিনা দিনকতক আগেও পতঙ্গ বানাতেন, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসায় বাধ্য হয়েছেন ও কাজে ইতি টানতে।

PHOTO • Ali Fraz Rezvi
PHOTO • Courtesy: Ballou’s Monthly Magazine

বাঁদিকে: ছবিতে দেখা যাচ্ছে ঘুড়ির বিভিন্ন অংশ। বালু সাহেবের মাসিক পত্রিকা থেকে ১৮৬৮ সালের একটি উদ্ধৃতি

PHOTO • Ali Fraz Rezvi

একদা পাটনার অশোক রাজপথ এলাকায পতঙ্গ ব্যাপারীদের ভিড়ে গিজগিজ করত, দোকানের বাইরে টাঙানো রংবেরঙের ঘুড়ি হাওয়ার তালে তালে হাতছানি দিয়ে ডাকত

পাটনা আজও ঘুড়ি নির্মাণ ও সরবরাহের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র — পতঙ্গ ও তার আনুষঙ্গিক মালমশলা এখান থেকে বিহারের আনাচেকানাচে তথা পড়শি রাজ্যে চালান হয়। পারেটি ও তিলাঙ্গি দুই-ই শিলিগুড়ি, কলকাতা, মালদা, রাঁচি, হাজারিবাগ, জৌনপুর, কাঠমান্ডু, উন্নাও, ঝাঁসী, ভোপাল, এমনকি সুদূর পুণে ও নাগপুরে গিয়ে ওঠে।

*****

“তিলাঙ্গি বানানে কে লিয়ে ভি টাইম চাহিয়ে আউর উড়ানে কে লিয়ে [ঘুড়ি বানানো ও ওড়ানো দুটোটেই সময় দাবী করে],” অশোক শর্মার মুখে প্রয়াত পিতার উক্তি। “আজ এ শহরে সময়ের মতো দুর্মূল্য বস্তু আর একটিও নেই।”

অশোক বাবু তৃতীয় প্রজন্মের তিলাঙ্গি কারিগর ও বিক্রেতা। পাটনার ঠিক মধ্যিখানে তাঁর শতাব্দী প্রাচীন দোকানটির দেওয়াল মাটির, উপরে টালি ছাওয়া, ১০০ মিটার দূরেই অশোক রাজপথে দাঁড়িয়ে আছে বিহারের সবচাইতে পুরোনো গির্জা — পাদ্রি কি হাভেলি। মাঞ্জা বা নাখ, সে যে নামেই ডাকুন না কেন, ঘুড়ির সুতো আজ চিনদেশের কারাখানায় তৈরি হয়ে আসে, আগের চাইতে ঢের পাতলা ও হালকা।

দোকানের ঠিক সামনে বসে আছেন অশোক বাবু, হাতদুটো তাঁর ক্ষিপ্রগতিতে ঘুড়ি বানিয়ে চলেছে — ১৫০ খানা পারেটির বরাত এসেছে এক গাঁ থেকে, মোটে এক ঘণ্টায় সব তৈরি করে পাঠাতেই হবে।

পারেটি, অর্থাৎ চিমোড় কাঠি বেঁকিয়ে একে অপরের সঙ্গে বাঁধার কাজটা ঘুড়ি বানানোর চেয়ে আলাদা, এটা অশোক শর্মার মতো হাতে গোনা কয়েকজনই পারেন — এ বিদ্যেয় তাঁর বেশ সুখ্যাতি আছে। আর পাঁচজন তিলাঙ্গি কারিগরের মতন তিনি ঘুড়ি বা সুতোর বাণ্ডিল অন্যদের দিয়ে ঠিকেয় কাজ করান না, নিজেই বানিয়ে বেচেন।

PHOTO • Ali Fraz Rezvi
PHOTO • Ali Fraz Rezvi

পারেটি ও তিলাঙ্গির জন্য কাঠি তৈরি করছেন অশোক শর্মা। পারেটি (লাটাই) বানানোয় তাঁর মতো দক্ষ খুব কমই আছে

PHOTO • Ali Fraz Rezvi
PHOTO • Ali Fraz Rezvi

বাঁদিকে: অশোক বাবুর কর্মশালায় সদ্য নির্মিত কিছু পারেটি। ডানদিকে: দোকানে বসে আছেন অশোক শর্মার বন্ধু তথা প্রবীণ কারিগর

অন্ধকার একটা ঘুপচি ঘরে থরে থরে সাজানো আছে তিলাঙ্গি ও পারেটি, পিছন দিকে একটুখানি ফাঁক দিয়ে একচিলতে আলো আসছে — অশোক বাবুর নাতি কৌটিল্য কুমার শর্মা সেখানে বসে হিসেবের খাতা দেখছেন। বহু প্রজন্ম ধরে শর্মা পরিবার এই কারিগরি বজায় রেখেছে। তবে অশোক বাবুর ভয়, তাঁর ছেলেপুলে ও নাতিরা এ পেশা ছেড়ে দিতে পারে।

মাত্র ১২ বছর বয়সে ঘুড়ি আর পারেটি (লাটাই) বানানোয় হাতেখড়ি হয় তাঁর। বরিষ্ঠ এই ঘুড়ি কারিগরের জবানে: “দুকান পে আ কর ব্যাঠ গয়ে, ফির ক্যাসা বচপন ক্যাসি জওয়ানি? সব ইয়াহাঁ বীত গয়া। তিলাঙ্গি বনায়ি বহুৎ মগর উড়ায়ি নহিঁ [দোকানে এসে বসে পড়লাম, তারপর থেকে কীসের শৈশব, কীসেরই বা যৌবন? সব তো এখানেই কেটে গেল। অসংখ্য ঘুড়ি বানিয়েছি, অথচ একটাও ওড়াইনি]।”

“সে আমলে এই শহরের অভিজাত গোষ্ঠী আর রাজাগজারা ঘুড়ি বানানো তদারকি করতেন। তিলাঙ্গি কারিগরদের জন্য তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল আশীর্বাদ-স্বরূপ,” বললেন তিনি, “মহাশিবরাত্রি পর্যন্ত পাটনার ঘুড়ি-মরসুম তুঙ্গে থাকত। অথচ আজকাল তো সংক্রান্তির [ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথাগত সময়] সময়েও খদ্দের জোটে না।”

*****

ঘুড়ির আকার রম্বস বা বরফির মতন। বহু দশক আগে কাগজ দিয়ে বানানো হত, তবে আজকাল উৎপাদনের পুরোটাই প্লাস্টিকের দখলে, দরও আধা হয়ে গেছে। কাগজের তিলাঙ্গি সহজেই ছিঁড়ে-ফেটে যায়, কাগজ নাড়াচাড়া করাও কঠিন, তাই তার দামও বেশি। সাদামাটা একপিস কাগজের পতঙ্গ যেখানে ৫ টাকায় বেচা হয়, সেখানে প্লাস্টিকের ঘুড়ির দাম মোটে ৩।

তিলাঙ্গি সাধারণত ১২ বাই ১২ বা ১০ বাই ১০ ইঞ্চির হয়, তবে ১৮ বাই ১৮ ও ২০ বাই ২০ ইঞ্চির ঘুড়িও নির্মিত হয়। আকার ও নকশা জটিল হলে তার দামও বাড়ে — বিশেষ কোনও কার্টুন বা সিনেমার চরিত্র কিংবা সংলাপ ছাপা থাকলে ২৫ টাকাও দর ওঠে, তবে বাইরের রাজ্য থেকে বরাত এলে ৮০-১০০ টাকাও হয় — তাতে প্লাস্টিক শীটের নকশা আলাদা করে বানানো হয়, এমনকি তীলি, খাড্ডা ও লেই-এর (ভাতের আঠা) গুণমানও বৃদ্ধি পায়।

সঞ্জয় জৈসওয়ালের কর্মশালায় তিলাঙ্গি নির্মাণে ইস্তেমাল হয় কাঠ-কাটার যন্ত্র ও একাধিক বাঁশের কাঠি সহ নানান সামগ্রী। জানলাবিহীন ৮ বর্গফুটের কামরা, চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে ঘুড়ির সাজ-সরঞ্জাম।

PHOTO • Ali Fraz Rezvi
PHOTO • Ali Fraz Rezvi

নিজের কর্মশালায় চেয়ারে বসে বসে মজুরদের তদারকি করছেন মান্নান বাবু। ডানদিকে: প্লাস্টিকের পরত গুনছেন মহম্মদ আরমান, এগুলো মহিলা মজুরদের কাছে পাঠানো, তাঁরা তারপর এই প্লাস্টিকের গায়ে বাখারির খাড্ডা চিপকাবেন

PHOTO • Ali Fraz Rezvi
PHOTO • Ali Fraz Rezvi

বাঁদিকে: কাঠির বাণ্ডিল বাঁধছেন ঘুড়ি-শ্রমিকরা। ডানদিকে: যন্ত্রে বাঁশ কাটাই চলছে

লোকমুখে মান্নান নামে পরিচিত সঞ্জয় বাবু জানাচ্ছেন, “এই ওয়ার্কশপটার কোনও নাম নেই।” তবে এ বিষয়ে তিনি বিশেষ চিন্তিত নন, কারণ সম্ভবত তিনিই পাটনার সর্ববৃহৎ ঘুড়ি সরবরাহক। “বেনাম হ্যায়, গুমনাম থোড়ে হ্যায় [অনামা হতে পারে, তবে অজানা নয় মোটেও],” হাসতে হাসতে বলে উঠলেন মান্নান বাবু, তাঁর চারিপাশের শ্রমিকরাও মনিবের হাসিতে যোগ দিলেন।

মোহল্লা দিওয়ানের গুরহাট্টা এলাকা, মান্নান বাবুর কর্মশালার চারিধার খোলামেলা, বাঁশের খুঁটির উপর ভর করে আছে অ্যাসবেস্টসের চালা। খোলামেলা এই চালাঘরটা লাগোয়া একখান ঘুপচিমতন কামরাও আছে। ১১ জন মজুর কাজ করেন তাঁর অধীনে, উপরন্তু খানিক খানিক কাজ মহিলাদেরকেও সাব-কন্ট্রাক্টে দেন মান্নান বাবু “যাঁরা জরুরত মাফিক কাজ করেন নিজের নিজের বাড়ি থেকে।”

এই ওয়ার্কশপের বরিষ্ঠতম কারিগর মহম্মদ শামিম, বয়স ৫৫। বাড়ি তাঁর পাটনার ছোটি বাজার অঞ্চলে। কলকাতার এক ওস্তাদের থেকে পতঙ্গসাজি শিখে এসেছেন, জানালেন তিনি। কলকাতা, এলাহাবাদ, মুম্বই ও বেনারসে লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে শেষে এ শহরে এসে থিতু হন পাকাপাকি কর্মক্ষেত্রের সন্ধানে।

কথা বলতে বলতেই তীলি সাঁটতে থাকা শামিম সাহেব বললেন গত ২২ বছর ধরে এখানে রয়েছেন। লোকে বলে, চিমোড় বাখারির কাঠি বেঁকিয়ে আঠা দিয়ে চিপকানোয় শামিম সাহেব ওস্তাদ। নিরন্তর ছুটে চলা এ অনন্ত দৌড়ে হররোজ অন্তত হাজার দেড়েক ঘুড়ি তো তিনি বানিয়েই থাকেন।

“কোশিস হোতা হ্যায় কি দিন কা ২০০ রুপিয়া তক্ কামা লেঁ তো মহিনে কা ৬০০০ বন্ যায়েগা [দিনে ২০০ টাকা কামানোর লক্ষ্য থাকে, তাতে মাস গেলে ৬০০০ টাকা হয়ে যায়],” শামিম সাহেব বললেন। ১,৫০০টা ঘুড়ির তীলি চিপকানোর পর সন্ধ্যাবেলা সব টেপ এঁটে বসিয়ে দেন। “ইস হিসাব সে ২০০-২১০ রুপিয়া বন্ যাতা হ্যায় [তাতে করে দৈনিক ২০০-২১০ টাকা রোজগার হয়]।”

এবছর মে মাসে পারি গিয়ে দেখে যে ঘরের বাইরে তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ফ্যান চালানো মানা, নইলে ঘুড়ি বানানোর ফিনফিনে প্লাস্টিকগুলো উড়ে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হবে!

PHOTO • Ali Fraz Rezvi
PHOTO • Ali Fraz Rezvi

বাঁদিকে: তিলাঙ্গির জন্য কাঠি কাটছেন শ্রমিকরা। ডানদিকে: ঘুড়ির গায়ে কাঠি চেটাচ্ছেন অশোক পণ্ডিত (কালো গেঞ্জি পরিহিত), প্লাস্টিকের শীট কাটছেন সুনীল কুমার মিশ্র

PHOTO • Ali Fraz Rezvi
PHOTO • Ali Fraz Rezvi

বাঁদিকে: তীলি আঁটার কাজ করছেন মহম্মদ শামিম। ডানদিকে: প্লাস্টিকের পরত নিয়ে কাজে ব্যস্ত সুনীল বাবু

ছোটো ছোটো চৌকো আকারে প্লাস্টিক কাটতে কাটতে ঘেমে উঠেছিলেন সুনীল কুমার মিশ্র, রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে আমাদের জানালেন, “ঘুড়ি বানিয়ে যেটুকু আয়-ইনকাম হয়, তা দিয়ে সংসার টানা না-মুমকিন। এখানকার কোনও মজুরই মাস গেলে ১০,০০০ [টাকা] কামায় না।”

হাজিগঞ্জ মহল্লার বাসিন্দা সুনীল বাবু পতঙ্গসাজি দেখে দেখে বড়ো হয়েছেন, কারণ এককালে এই পাড়াটাই পাটনার পতঙ্গসাজ সম্প্রদায়ের কেন্দ্র ছিল। ছোটোবেলায় ঘুড়ি বানানো দেখতে দেখতে নিজে হাতে বানানোর অভিজ্ঞতাটা পরে কাজে আসে যখন কোভিড-১৯-এর সময় তাঁর ফুলের ব্যবসাটা লাটে ওঠে, তখন চটজলদি পতঙ্গসাজি শুরু করে দেন তিনি।

সুনীল বাবু স্থায়ী কর্মী হলেও ঘুড়ি-পিছু মজুরি পান। “হররোজ সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা অবধি সব্বাই মিলে হাজার হাজার তিলাঙ্গি বানানোয় জুটে আছি,” জানালেন তিনি।

*****

এখানকার অসংখ্য মুসলিম মহিলা বাড়িতে বসে ঘুড়ি বানান — হয় পুরোটা কিংবা আংশিক ভাবে। চার সদস্যের পরিবার চালানোর দায়িত্ব ছিল একা আয়েশা পারভিনের ঘাড়ে, তাই পতঙ্গসাজি শিখেছেন। শোহর ও দুই সন্তানের সঙ্গে একটা কামরায় থাকেন তিনি, আছে একটা রান্নাঘরও। গত ১৬ বছর ধরে এখানেই তিনি ঘুড়ি বানিয়ে চলেছেন। “এই তো কদিন আগেও সপ্তাহে ৯,০০০টার মতো তিলাঙ্গি বানাতাম,” মনে করে বললেন আয়েশা, “এখন ২,০০০টা ঘুড়ির বরাত জোটাও বিশাল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

“একেকটা তিলাঙ্গিতে সাতটা অংশ থাকে, প্রতিটার জন্য আলাদা আলাদা কারিগর রয়েছে,” বুঝিয়ে বলেন তিনি। একজন ঘুড়ির মাপ মোতাবেক বরফির আকারে প্লাস্টিক শীট কাটেন। আরও দুজন মিলে বাঁশ কেটে কেটে ছোট্ট ছোট্ট তীলি আর খাড্ডা বানান — একটা লম্বাটে সরু, অন্যটা অপেক্ষাকৃত মোটা ও ছোটো। চতুর্থজন সেই রম্বস প্লাস্টিকে খাড্ডা চিপকে দেন, তারপর আরেকজন তাতে বাঁকানো তীলি চেটান।

তারপর আরও দুজন কারিগর মিলে পুরোটা খতিয়ে দেখে একপ্রস্থ টেপ এঁটে শেষেরজনের হাতে তুলে দেন যিনি প্লাস্টিকে ফুটো করে কান্না নামক সুতো জোড়েন।

PHOTO • Ali Fraz Rezvi
PHOTO • Ali Fraz Rezvi

প্লাস্টিকের পরতে খাড্ডা সাঁটতে ব্যস্ত তামান্না (বাঁদিকে)। এ কাজ হয়ে গেলে একটা একটা করে ঘুড়ি তুলে সূর্যের আলোয় যাচাই করে নেন তিনি

প্লাস্টিক-কাটা কারিগররা ১,০০০টা ঘুড়ির জন্য ৮০ টাকা পান, একই সংখ্যক ঘুড়ির জন্য বাঁশ-কাটা কারিগরদের পকেটে আসে ১০০ টাকা, বাদবাকি পাঁচজন মাথা-পিছু ৫০ টাকা করে পান। একদল কারিগর মিলে একদিনে হাজারটা তিলাঙ্গি বানান, এর জন্য সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ঘাম ঝরাতে হয়, মাঝে ছোটো ছোটো বিরতি থাকে কেবল।

“বাজারে যে ঘুড়ি ২-৩ টাকায় মেলে, সেটা বানাতে মোট ৭ জন দরকার,” আয়েশা পারভিন বোঝালেন আমাদের। ১,০০০টা ঘুড়ি বানাতে খরচ পড়ে ৪১০ টাকা, টাকাটা সাতজনের মধ্যে ভাগ করা হয়। “আমি চাই না রুখসানা [তাঁর মেয়ে] এই পতঙ্গসাজির জগতে পড়ে থাকুক,” বললেন তিনি।

অসংখ্য মহিলা কারিগরের মতো উনিও বাইরে না বেরিয়ে ঘরে বসে কাজ করতে পেরে খুশি, তবে রোজগার বড্ড কম। “গোড়ার দিকে তাও তো রোজরোজ কাজ জুটত।” ২,০০০টা তিলাঙ্গির খাড্ডা চিটিয়ে কান্না বাঁধার জন্য ১০০ টাকা পেতেন আয়েশা — ১০০ ঘুড়িতে এদুটো কাজ করতে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা লাগত তাঁর।

তামান্নাও এই দিওয়ান মহল্লায় থাকেন, তিনিও একজন পতঙ্গসাজ। “ঘুড়ি শিল্পে এটাই সবচাইতে কম মজুরির কাজ, তাই এটা [মূলত] মেয়েরা করে,” তামান্না (২৫) জানাচ্ছেন। “খাড্ডা বা তীলি চিপকানো এমন কিছু হাতিঘোড়া কাজ নয়, অথচ ১,০০০টা খাড্ডা চিটিয়ে মেয়েরা পাচ্ছে ৫০ টাকা আর ১,০০০টা তীলি এঁটে মরদরা পাচ্ছে ১০০ টাকা।”

PHOTO • Ali Fraz Rezvi

নিজের হাতে বানানো একখান তিলাঙ্গি প্রদর্শন করছে রুখসানা

পাটনা আজও ঘুড়ি নির্মাণ ও সরবরাহের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র — পতঙ্গ ও তার আনুষঙ্গিক মালমশলা এখান থেকে বিহারের আনাচেকানাচে তথা শিলিগুড়ি, কলকাতা, মালদা, রাঁচি, হাজারিবাগ, জৌনপুর, কাঠমান্ডু, উন্নাও, ঝাঁসী, ভোপাল, এমনকি সুদূর পুণে ও নাগপুরে গিয়ে ওঠে

আয়েশা ১৭ বছরের মেয়ে রুখসানা খাড্ডার চিপকানোয় ওস্তাদ — পিচ্ছিল প্লাস্টিকের পরতে সুপটু হাতে সরু সরু বাঁশের কাটি এঁটে দেয় তরুণীটি। ক্লাস ১১-এ কমার্স নিয়ে পড়ে রুখসানা, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে পতঙ্গসাজির কাজে মাকে সাহায্য করে।

১২ বছর বয়সে মায়ের কাছে এ শিল্পে হাতেখড়ি নিয়েছে রুখসানা। আয়েশার কথায়: “ও ছোটোবেলায় দারুণ ঘুড়ি ওড়াত।” তবে খেলাটা মূলত ছেলেদের কিনা, তাই আজ তিনি মেয়েকে বকেঝকে ঘুড়ি ওড়াতে বারণ করেন।

মহল্লা দিওয়ানের শিশমহল এলাকায় একটা ভাড়াবাড়িতে থাকে আয়েশা পারভিনের পরিবার, দরজার সামনে সদ্য বানানো তিলাঙ্গি সাজাচ্ছেন তিনি। ঘুড়িতে শেষ টান দিতে ব্যস্ত রুখসানা। ঠিকেদার শাফিক কখন ঘুড়ি নিতে আসবেন, সে অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে মা-মেয়ে।

“২,০০০টা তিলাঙ্গির বরাত পেয়েছিলাম, কিন্তু মেয়েকে বলতে ভুলে গেছিলাম, তাই দেখুন ও পড়তি-ঝড়তি কাঁচামাল দিয়ে অতিরিক্ত ৩০০টা বানিয়ে বসে আছে,” জানালেন আয়েশা।

আমাদের কথোপকথন শুনে রুখসানা বলে উঠল, “কিন্তু চিন্তার তো কিছু নেই আম্মি, এগুলো পরের বরাতে কাজে লেগে যাবে।”

“আরেকটা বরাত পেলে তো,” বলে ওঠেন আয়েশা পারভিন।

প্রতিবেদনটি মৃণালিনী মুখার্জী ফাউন্ডেশন (এমএমএফ) প্রদত্ত একটি বৃত্তির সহায়তায় লিখিত।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Ali Fraz Rezvi

علی فراز رضوی ایک آزاد صحافی اور تھیٹر آرٹسٹ ہیں۔ وہ سال ۲۰۲۳ کے پاری-ایم ایم ایف فیلو ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Ali Fraz Rezvi
Editor : Priti David

پریتی ڈیوڈ، پاری کی ایگزیکٹو ایڈیٹر ہیں۔ وہ جنگلات، آدیواسیوں اور معاش جیسے موضوعات پر لکھتی ہیں۔ پریتی، پاری کے ’ایجوکیشن‘ والے حصہ کی سربراہ بھی ہیں اور دیہی علاقوں کے مسائل کو کلاس روم اور نصاب تک پہنچانے کے لیے اسکولوں اور کالجوں کے ساتھ مل کر کام کرتی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Priti David
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کے ہندوستانی زبانوں کے پروگرام، پاری بھاشا کے کانٹینٹ مینیجر ہیں۔ انہوں نے کولکاتا کی جادوپور یونیورسٹی سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک کثیر لسانی شاعر، ترجمہ نگار، فن کے ناقد اور سماجی کارکن ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra