“ক্যামেরা তো একটা ধাতব পিণ্ডমাত্র, যার মাঝখানে একটা
গর্ত। ছবিটা আছে তোমার হৃদয়ে। তোমার উদ্দেশ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে ছবির বিষয়বস্তু।”
পি. সাইনাথ
ঝুঁকে, সামলে, টেনে, তুলে, ঝেড়ে, রেঁধে, বেড়ে, পশু চরিয়ে, পড়ে, লিখে, বুনে, গান গেয়ে, বাজিয়ে, নেচে, উৎসবে মেতে... জীবনের বিচিত্র ধারায় বিচিত্রগতিতে চলনশীল মানুষের ছবির সঙ্গে লিখিত শব্দের বুননে গ্রামীণ ভারতবাসীর দিনানুদিনের জীবন্ত একটা চিত্র তুলে ধরার প্রচেষ্টা করি আমরা।
পারি-র ছবিগুলি যৌথস্মৃতির বিপুল ভাণ্ডারকে দৃশ্যমাধ্যমে সঞ্চয় করে রাখার চেষ্টা করে। এগুলি আমাদের সমকালের নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্ত দস্তাবেজ নির্মাণ তো নয় শুধু, বরং এক-একটা খোলা দরজা, যার ভিতর দিয়ে আমরা নিজেদের অন্তর এবং বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করি। আমাদের ছবির সুবিশাল আকর এমন সব গল্প বলে যা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে না - প্রান্তিক মানুষ, জায়গা, জমি, জীবিকা, শ্রমের গল্প।
খুশি, আনন্দ, সৌন্দর্য, দুঃখ, শোক, বিস্ময় এবং অপ্রিয় সত্য - ক্যামেরার চোখে ধরা পড়ে মানবিক আবেগের রামধনু, মানুষকে সে পড়ে ফেলতে পারে তার সবচেয়ে অরক্ষিত, সবচেয়ে উন্মোচিত সত্তায়। প্রতিবেদনের কেন্দ্রে যে মানুষ তিনি তো শুধু ছবি তোলার মাধ্যমমাত্র নন। ছবির মানুষদের নাম জানাটা তাই সহমর্মিতার প্রথম পাঠের মধ্যেই পড়ে। একটি মানুষের একটা ছোট্ট গল্প অনেক বড়ো বড়ো সত্যের সামনে আয়না ধরতে পারে।
কিন্তু সেটা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন চিত্রগ্রাহক এবং চিত্রের বিষয় যে মানুষটি, তাঁদের মধ্যে একটা সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অপূরণীয় ক্ষতি এবং অভাবনীয় শোকের মাঝে দাঁড়িয়ে তাঁদের ছবি তোলার জন্য আমরা যথাযথ অনুমতি নিয়েছি তো? সবদিক থেকে সবচেয়ে প্রান্তিক যে মানুষেরা তাঁদের মর্যাদা বজায় রেখে কীভাবে ছবি তুলব? কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ছবি যখন তোলা হচ্ছে তার পিছনে প্রেক্ষাপট বা প্রসঙ্গটা কী? সাধারণ মানুষের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের ছবি দিয়ে কোনও একটা চিত্রমালা তৈরি করা হচ্ছে কোন উদ্দেশ্য থেকে?
কাজ করতে নেমে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বোঝাপড়া করে চলতে হয় আমাদের চিত্রগ্রাহকদের, সে তাঁরা কয়েকদিনের জন্য ছবি তুলতে যান বা কয়েক বছরের জন্য, স্বনামধন্য শিল্পীদের ছবি তোলার সময়, আদিবাসী উৎসব, বা বিক্ষোভরত কৃষকদের ছবি তোলার সময়, সব ক্ষেত্রেই এই বোঝাপড়া চলতে থাক।
বিশ্ব ফোটোগ্রাফি দিবসে আমরা পারি-র বিভিন্ন প্রতিবেদনের জন্য গৃহীত নানান চিত্রগ্রাহকের কয়েকটি ছবির সংগ্রহ এখানে সাজালাম। প্রত্যেক আলোকচিত্রী তাঁর নিজের নিজের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া বিষয়ে লিখেছেন, তাঁদের তোলা ছবিগুলির পিছনের কাহিনিগুলিকে তুলে ধরেছেন। নামের আদ্যাক্ষরের বর্ণানুক্রমিক ভিত্তিতে তাঁদের কাহিনিগুলি এখানে সাজানো হল:
আকাঙ্ক্ষা মুম্বই, মহারাষ্ট্র
এই ছবিটি নেওয়া হয়েছে মুম্বই লোকালে তারের জোরে ঝুলন্ত জীবন প্রতিবেদন থেকে, যেখানে আমি মুম্বইয়ের একটি লোকাল ট্রেনে কর্মরত সারেঙ্গিবাদক কিষাণ যোগীর বিষয়ে লিখেছিলাম। তাঁর ছয় বছরের মেয়ে ভারতী এই কাজে তাঁর সঙ্গী।
ছোটোবেলা থেকে যেসব ভ্রাম্যমাণ শিল্পীদের আমি দেখেছি, কোথাও গিয়ে তাঁদের কাহিনি মিলে যায় কিষাণ ও ভারতীর জীবনকথার সঙ্গে। আমি তাঁদের দেখেছি, তাঁদের বাদন শুনেছি, কিন্তু কোনওদিন তাঁদের শিল্পী হিসেবে উপলব্ধি করিনি। এবং ঠিক সেই কারণেই এই প্রতিবেদনটা আমার কাছে এত জরুরি ছিল।
ছবিটা তুলেছিলাম ট্রেনের দুর্দম গতির সঙ্গে যুঝতে যুঝতে, ভিড়ে ঠাসা চলন্ত গাড়িতে এক কামরা থেকে আর এক কামরা করতে করতে।
কিষাণ দাদার দ্রুতগতির সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে হাঁফ ধরে যাচ্ছিল, অভ্যস্ত ছন্দে যখনই কোথাও দাঁড়িয়ে ছড় টানেন আমার নতুন সমস্যা ক্যামেরা কোথায় রাখব। এক কামরা থেকে আর এক কামরা ঘুরতে ঘুরতে একবারের জন্যও থামে না তাঁর সংগীত; গোটা ট্রেনটাই তো তাঁর মঞ্চ।
ভিউফাইন্ডারের ভিতর দিয়ে তাঁকে দেখতে দেখতে প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ক্যামেরার কারণে অপ্রস্তুত হয়ে পড়বেন, কিন্তু না - শিল্পী তখন তাঁর শিল্পে নিমগ্ন।
তাঁর সুরে খেলা করছিল এক সংক্রামক স্ফূর্তি, চারপাশের ক্লান্ত, বিধ্বস্ত যাত্রীদের মাঝে এক মূর্তিমান বৈপ্যরীত্য। ছবির ভিতরে এই দ্বৈততাটিকেই ধরার চেষ্টা করেছি আমি।
*****
বিনাইফার ভারুচা পশ্চিম কামেং, অরুণাচল প্রদেশ
এই ছবিটি তুলেছিলাম কয়লাখনিতে বিপন্ন ক্যানারি: অরুণাচলের পাখিকূল প্রতিবেদনের জন্য।
ঐতি থাপার (ছবিতে) পিছন পিছন অরণ্যে ঠাসা সর্পিল পাকদণ্ডি পথে চলেছি চড়াই-উতরাই বেয়ে; পিছল কাদায় ফসকে যাচ্ছে পা, মনের মধ্যে ভয় - জোঁকে ধরল বুঝি! থেকে থেকে ঘন সবুজ নিস্তব্ধতা ভেঙে বেজে ওঠে পাখির ডাক। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে একটি প্রতিবেদনের জন্য গিয়েছিলাম অরুণাচল প্রদেশের ইগলনেস্ট অভয়ারণ্যে।
২০২১ সাল থেকে এখানে নানা পক্ষী প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করা একটি রিসার্চ দলের সঙ্গে রয়েছেন ঐতি। জঙ্গলের ভিতর কুয়াশা-জাল বা মিস্ট নেট লাগিয়ে পাখি ধরা হয়। তাদের সযত্নে সেই জাল ছাড়িয়ে বার করার কাজে যেমন দক্ষতা প্রয়োজন তেমনই সাবধানতাও, ঐতি সে কাজ সম্পন্ন করেন অভ্যস্ত দ্রুততায়, কিন্তু পূর্ণ সতর্কতা বজায় রেখেই।
ক্যামেরার শাটার ফেলেই এক মুহূর্ত থমকে যাই। সদ্য বার করা একটি রুফাস-ক্যাপ্ড ব্যাবলার-এর ক্ষীণ শরীরটির দিকে পরম মমতায় তাকিয়ে আছেন ঐতি; অরণ্যপ্রকৃতির মাঝে মানুষ আর পাখির ভিতরে বিশ্বাস ও যোগাযোগে গড়ে ওঠা এই ক্ষণমুহূর্তটি জাদুময়। মূলত পুরুষ সদস্যদের নিয়ে গড়া এই সংরক্ষণ দলটির দুইজন মাত্র মহিলা সদস্যের অন্যতম ঐতি।
দৃঢ় কিন্তু মমতাময়ী, নিঃশব্দে লিঙ্গবৈষম্যের বেড়া ভেঙে চলা ঐতির এই ছবিটি এই প্রতিবেদনে যোগ করে বৃহত্তর এক তাৎপর্য।
*****
দীপ্তি আস্থানা রামনাথপুরম, তামিলনাড়ু
তামিলনাড়ুর জনপ্রিয় তীর্থস্থান রামেশ্বরম থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ধনুষকোডি। একদিকে বঙ্গোপসাগর, আর একদিকে ভারত মহাসাগর, মাঝখানে সমুদ্রের বুক চিরে একফালি ভূমিভাগ - ভারি নয়নাভিরাম! গ্রীষ্মের ছয় মাস বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরেন স্থানীয় মানুষজন, তারপর হাওয়ার গতিমুখ পালটে গেলে ভারত মহাসাগরে যান মাছ ধরতে।
ভগ্ন ধনুক: ধনুষকোড়ির বিস্মৃত মানুষেরা প্রতিবেদনটির কাজে এখানে আসা। আসার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম এই এলাকায় তীব্র জলসংকট চলছে।
দুই দিকে সমুদ্র-পরিবেষ্টিত এই স্থলভূমিতে পানীয় জল খুঁজে বার করা এক দুষ্কর কাজ। মেয়েদের প্রায়শই দেখা যায় হাতে করে মাটি খুঁড়ে জল বার করছেন দৈনন্দিন কাজের জন্য।
এ হল এক অনন্ত দুষ্টচক্র, কারণ খুঁড়ে বের করা জল অল্পদিনেই নোনা হয়ে যায়।
এই ছবিটিতে বিরাট ভূপ্রকৃতির প্রেক্ষাপটে একদল মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, যা ছবিটিকে একটা নান্দনিক মাত্রা দেয়। একইসঙ্গে, তা মানবজীবনের একদম বুনিয়াদি একটি প্রয়োজনের অভাবকেও তুলে ধরে, যা কিনা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার।
*****
ইন্দ্রজিৎ খাম্বে সিন্ধুদুর্গ, মহারাষ্ট্র
গত ৩৫ বছর ধরে দশাবতার পালায় মহিলা চরিত্রে অভিনয় করে চলেছেন ওমপ্রকাশ চভন। প্রায় ৮,০০০টি নাট্যের অভিনেতা ওমপ্রকাশ বর্তমানে এই শিল্পধারার অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী। চমকপ্রদ দশাবতার নাট্য আঙ্গিকে বুঁদ এক নিশি প্রতিবেদনে দেখতে পাবেন, কীভাবে দশাবতার পালার গৌরবময় ঐতিহ্যকে আজও দর্শকের চোখে অক্ষুণ্ণ রাখার কাজটি করে চলেছেন তিনি।
গত এক দশক ধরে তাঁর জীবন ও কাজকে নথিবদ্ধ করে চলেছি আমি, তাঁর কাহিনিকে জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য একটা এমন ছবির দরকার ছিল যা তাঁর প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরতে পারে। কয়েক বছর আগে সাতারদায় তাঁর একটি অভিনয়ের সময়ে সেই সুযোগ পেলাম। (উপরের) ছবিটিকে তাঁকে দেখা যাচ্ছে অভিনয়ের আগে একটি মহিলা চরিত্রের সাজে প্রস্তুত হতে।
ছবিটিতে তাঁর দুই সত্তাই পরিস্ফূট হয়েছে। পুরুষ হয়ে নারী চরিত্রে অভিনয় করে চলার তাঁর যে পরম্পরা, তার কথাই বলে ছবিটি।
*****
জয়দীপ মিত্র রায়গড়, ছত্তিশগড়
রামদাস লাম্ব রচিত র্যাপ্ট ইন দ্য নেম বইটি আমি এমন একটা সময়ে পড়েছিলাম যখন ভারতবর্ষ জুড়ে ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি করছে রামচরিত্রের এক সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাখ্যান - যে ব্যাখ্যান গত কয়েক দশক ধরে একটু একটু করে গড়ে তুলেছে দেশের হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী শক্তি।
এই সংখ্যাগুরুর আখ্যান-রাজনীতির এক বিকল্প বয়ানের খোঁজ করা জরুরি মনে হয়েছিল, আর সেই খোঁজ আমায় নিয়ে গেল রামনামীদের দ্বারে। তারপর বহু বছর ধরে আমি চেষ্টা করেছি তাঁদের অন্তরঙ্গ ভাবে জানার, তাঁদের অংশ হয়ে ওঠার।
‘আমরাই সাক্ষাৎ রামায়ণ’ প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রকাশিত এই ছবিটি সেই নিম্নবর্গীয় মানুষগুলির একটা প্রতিচ্ছবি, যাঁদের ক্ষমতায়ন হয়ে থাকলে হয়তো ভারত তার বর্তমান অবক্ষয়ের গহ্বরে এতটাও তলিয়ে যেতে পারত না।
*****
মুজামিল ভট শ্রীনগর, জম্মু ও কাশ্মীর
জিগর দেদের মুখের এই ছবিটা আমার প্রতিবেদন জিগর দেদের দুঃখ গাথা -এর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ছবিটা এই প্রবীণার জীবনের অনেকটা সময়কে ফুটিয়ে তুলেছে।
জিগর দেদের নাম আমি প্রথম দেখি স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে, যারা কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে তাঁর জীবনসংগ্রাম নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিল। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করার, তাঁর গল্প শোনার ইচ্ছা তৈরি হয়।
ডাল লেকে তাঁর হাউসবোটে যেদিন দেখা করতে গেলাম, একটা কোণায় বসে ছিলেন, গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। পরের ৮-১০ দিন ধরে রোজ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। গত ৩০ বছর ধরে একা থাকার লড়াইয়ের কাহিনি তিনি আমায় শুনিয়েছিলেন।
কাজটা করতে গিয়ে সবচেয়ে বড়ো যে সমস্যাটায় আমায় পড়তে হয়েছিল সেটা হল বহুবার করে একই কথা পুনরাবৃত্তি করতে থাকা, যেহেতু তিনি ডিমেনশিয়ার রোগী ছিলেন। কিছুই প্রায় মনে রাখতে পারতেন না, মাঝে মাঝে আমায় চিনতেও পারতেন না।
তাঁর এই ছবিটা আমার সবচেয়ে প্রিয় কারণ এটায় তাঁর মুখের বলিরেখাগুলি খুব সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। আমার কাছে, এই প্রতিটি বলিরেখা এক-একটা গল্প বলে ওঠে।
*****
পালানি কুমার তিরুভাল্লুর, তামিলনাড়ু
গোবিন্দাম্মাকে নিয়ে খবর করা আমার দীর্ঘমেয়াদী ভাবনা ছিল। প্রায় ২-৩ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলেছি, লকডাউনের আগে এবং পরে। তাঁর পরিবারের তিন প্রজন্মের ছবি তুলেছি আমি - গোবিন্দাম্মা, তাঁর মা, তাঁর ছেলে এবং নাতনি।
আমার প্রতিবেদন গোভিন্দাম্মা: ‘সারাটা জীবন জলেই কাটল আমার’ যখন প্রকাশিত হয় প্রচুর মানুষ সেটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন, কারণ প্রতিবেদনটির মূল বিষয় ছিল উত্তর চেন্নাইয়ের পরিবেশ-সংক্রান্ত সমস্যাগুলি নিয়ে।
তিরুভাল্লুরের কালেক্টর নিজে এসে সবাইকে পাট্টা দিয়ে যান, পেনশন চালু করা হয় অনেকের। বহু মানুষের জন্যও নতুন বাড়িও তৈরি করে দেওয়া হয়। এই কারণেই এই ছবিটা আমার কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা বিষয়টাকে একটা আলাদা উচ্চতায় তুলে দিয়েছিল।
বলতে পারেন আমার জীবন বদলে দিয়েছে এই ছবিটা।
*****
পুরুষোত্তম ঠাকুর রায়গড়া, ওড়িশা
নিয়মগিরির এক বিবাহ বাসরে প্রতিবেদনের কাজ করার সময় টিনা নামের ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে আমার আলাপ হয়। বিয়েবাড়িতে এসেছিল সে। ছবিটা যখন তুলি, তখন ওদের মাটির বাড়ির দাওয়ায় বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে।
মেয়েটি গুড়াকু [তামাক আর জারানো গুড়ের তৈরি মাজন] দিয়ে দাঁত মাজছিল। ছবি তোলা নিয়ে ওর কোনও জড়তা ছিল না, আর আমার সেটা খুব ভালো লেগেছিল।
এই ছবিটা আমাকে আদিবাসীদের জীবনদর্শনের কথাও মনে পড়ায়। তাঁরা যে শুধু তাঁদের নিজেদের জমি এবং নিয়মগিরি পর্বত বাঁচানোর জন্যও লড়ছেন তা-ই নয়, তাঁদের লড়াই এই গোটা অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করারও, যার উপরে তাঁদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনের সিংহভাগ নির্ভর করে।
মানবসভ্যতার জন্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব কতটা, তার দিকেই নির্দেশ করে এই ছবিটি।
*****
রাহুল এম পূর্ব গোদাবরী, অন্ধ্রপ্রদেশ
এই ছবিটা তুলেছিলাম আমার ২০১৯ সালের ‘ও, ওই বাড়িটা? সে তো এখন সমুদ্রের পেটে!’ এর জন্য। উপ্পাডার এই মাছধরা বস্তিটা এককালে কেমন দেখতে ছিল সেটা ধরে রাখতে চেয়েছিলাম।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে খবরের খোঁজে বেরিয়ে আমি বুঝতে পারছিলাম, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জেরে বহু উপকূলবর্তী গ্রাম ইতিমধ্যেই বিপন্ন। ছবির বাঁদিকে ভেঙে পড়া যে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, ওটা আমায় বহুদিন ধরেই আকর্ষণ করত, এবং ক্রমশ আমার ছবি এবং প্রতিবেদনগুলির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠছিল।
এককালে হইচই, কলকাকলিতে গমগম করত বাড়িটা। ৫০ বছর আগে যে পরিবারটি ওই বাড়িতে এসেছিলেন, তাঁরা এখন তার পাশের রাস্তাটির উপরে বিভিন্ন ঠিকানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন। উপ্পাডার যা কিছু পুরনো, প্রায় সবকিছুই সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গেছে।
আমার মনে হচ্ছিল এবার হয়তো বাড়িটার পালা, আর ওখানেও অনেকে সেটাই বলছিলেন। তাই আমি বারবার ফিরে যেতাম ওই বাড়িটায়, ছবি তুলতাম, লোকজনকে বাড়িটার বিষয়ে প্রশ্ন করতাম নানারকম। ২০২০ সালে অবশেষে সমুদ্র এসে নিয়ে গেল তাকে, যা ভেবেছিলাম তার অনেক আগেই।
*****
ঋতায়ন মুখার্জী দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ
আমার প্রতিবেদন সুন্দরবনে বাঘের ছায়ায় এক বিবাহবাসর -এ বিবাহে আমন্ত্রিতদের নাচে-গানে মাতিয়ে রেখেছিলেন নিত্যানন্দ সরকার, আর আমি চেয়েছিলাম আমার ছবিগুলোতে যেন সেই বিষয়টা ধরা পড়ে।
রজত জুবিলি গ্রামে এদিনের বিয়ের আসরে ছায়া ফেলে থাকে কনের বাবা অর্জুন মণ্ডলের মৃত্যুর স্মৃতি; ২০১৯ সালে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের এই প্রত্যন্ত এলাকায় বাঘের আক্রমণে মারা যান তিনি।
পেশায় কৃষক নিত্যানন্দ নানান লোকশিল্পের সঙ্গেও যুক্ত আছেন, যেমন ঝুমুর গান, মা বনবিবি পালা, অন্যান্য পালাগান ইত্যাদি। ৫৩ বছর বয়সি নিত্যানন্দ পালাগানের সঙ্গে যুক্ত আছেন আজ প্রায় ২৫ বছর। আলাদা আলাদা পালার জন্য আলাদা আলাদা দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কাজ করেন তিনি।
*****
রিয়া বেহল মুম্বই, মহারাষ্ট্র
২৪ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে সময়ুক্ত শেতকরি কামগার মঞ্চের ডাকে দুইদিনব্যাপী অবস্থান বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করতে মহারাষ্ট্রের নানান প্রান্ত থেকে হাজার হাজার কৃষক এসে দক্ষিণ মুম্বইয়ের আজাদ ময়দানে জড়ো হয়েছিলেন। মুম্বইয়ে কৃষক ধর্না: ‘কালা কানুন ফিরিয়ে নাও’ প্রতিবেদনে এই বিক্ষোভ সমাবেশের খবর আমি লিখেছি।
আমি বেশ সকাল সকালই পৌঁছে গেছিলাম বিক্ষোভমঞ্চে, আর ছোটো ছোটো দলে কৃষকরা ততক্ষণে এসে পৌঁছতে শুরু করেছেন। আমরা সাংবাদিকরা সবাই তবুও অপেক্ষা করছিলাম সন্ধের দিকে একটা বড়ো দলের এসে পৌঁছনোর, যাতে সবচেয়ে ভালো ছবিটা তোলা যেতে পারে। রাস্তার ডিভাইডার, আশপাশের গাড়ির মাথায়, এবং আরও নানা বিচিত্র জায়গায় অবস্থান নিয়ে তৈরি ছিলেন চিত্রগ্রাহকরা, নিজেদের লেন্সের পাল্লা অনুযায়ী - ময়দানে ঢোকার সরু রাস্তাটা পাখির চোখ, অপেক্ষা, কখন পথ ছাপিয়ে উপচে পড়বে কৃষকদের জনস্রোত।
পারি-র সঙ্গে আমার প্রথম কাজ ছিল সেটা, আর আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যুৎসই একটা ছাপার যোগ্য ছবি তোলার জন্যও হয়তো-বা ৫ মিনিটেরও কম সময় পাব। একদম ঠিকঠাক জায়গায় গিয়ে দাঁড়ানোটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু শহর আমায় সেদিন নিরাশ করেনি। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার ঠিক উল্টোদিকে ঐতিহাসিক ছত্রপতি শিবাজী বাস টার্মিনাস সেজে উঠেছিল উজ্জ্বল হলুদ, নীল আর সবুজ আলোয়। আমি তখনই জানতাম, আমার ছবির প্রেক্ষাপট হবে এটাই।
হঠাৎ করেই আমার সামনের রাস্তাটা ভরে উঠল হনহন করে হেঁটে চলা শয়ে শয়ে কৃষকে, অনেকের মাথাতেই সুপরিচিত লাল রঙের এআইকেএসএস টুপি। এই ছবিটা আমার সবচেয়ে পছন্দের, কারণ এটা দুই তরুণীর মধ্যে একটা একান্ত নিভৃতির মুহূর্তকে ধরতে পেরেছে, যাঁরা হয়তো প্রথমবার এই শহরে এসেছেন, অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখছেন চারদিকে। সারাদিন যাত্রায় কেটেছে তাঁদের, ভারি ব্যাগ, খাবারদাবার সব ঘাড়ে করে; আর তাঁদের এই থমকে যাওয়া বড়ো দলটার গতিকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে, যাঁরা সবাই হয়তো এতক্ষণের যাত্রায় ক্লান্ত এবং যত দ্রুত সম্ভব ময়দানে গিয়ে বসতে চান। মেয়েদু’টি কিন্তু নিজেদের জন্য ওই একটা মুহূর্ত নিয়েই নিলেন, আর সেই অমোঘ ক্ষণের সাক্ষী থাকার সৌভাগ্য আমার হল ।
*****
পি সাইনাথ রায়াগড়া, ওড়িশা
ভারতের ছবি
জমিদার খুব খুশি, ছবি উঠছে বলে। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, আর অন্যপাশে সার দিয়ে মাঠের উপর ঝুঁকে আছেন নয় নারী, জমিদারের খেতে আগাছা তুলছেন। এই কাজের দিনমজুরি যা হওয়া উচিত তার ৬০ শতাংশ কম এই মহিলাদের দেন উক্ত জমিদার।
২০০১ আদমসুমারি তখন সদ্য প্রকাশিত হয়েছে, ইতিহাসে প্রথমবার ভারতের জনসংখ্যা নয়-অংক ছাড়িয়েছে। ভারতের বাস্তবতার বহুস্তরীয় চরিত্রটিকে এক নজরে পড়ে নিতে চাইছিলাম আমরা।
পুরুষ জমিদার বুক চিতিয়ে দণ্ডায়মান। নারী শ্রমিকরা মাঠের উপর ঝুঁকে। ছবিতে উপস্থিত সবকিছুর মধ্যে দশ শতাংশ সোজা দাঁড়িয়ে আছে। বাকি ৯০ শতাংশ মাটিতে ঝুঁকে পড়ছে।
ক্যামেরার লেন্সের ভিতর দিয়ে মনে হচ্ছিল যেন একটা ‘১’-এর পরে সার দিয়ে ৯টা শূন্য। ১ বিলিয়ন - এটাই ভারত।
*****
সংকেত জৈন কোলাপুর, মহারাষ্ট্র
আমার প্রতিবেদন কোলহাপুরের কুস্তিগিরদের ‘খোরাক’ তথা অন্যান্য ওজনদার সমস্যা থেকে এই ছবিটি নেওয়া।
লড়াই বা মহড়ার সময়ে যে-কোনও কুস্তিগীরই চরম মনোসংযোগে থাকেন; ক্রমাগত প্রতিপক্ষের সমস্ত গতিবিধির দিকে খেয়াল রাখতে হয়, মুহূর্তের ভগ্নাংশে স্থির করতে হয় আত্মরক্ষা করব নাকি আক্রমণ।
অথচ এই ছবিতে কুস্তিগীর শচীন সালুঙ্খেকে বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত দেখায়। বারংবার বন্যা আর কোভিড লকডাউন গ্রাম্য কুস্তিগীরদের জীবনে বিপর্যয় নামিয়ে এনেছে, বাধ্য করেছে কুস্তি ছেড়ে অন্য কাজ ধরতে, বা খেতমজুরি করতে। ধাক্কাটা এতই গভীর ছিল যে, এতদিন পর কুস্তিতে ফেরত আসার প্রয়াসেও মনোসংযোগ করতে পারছেন না শচীন।
এক কুস্তিগীরের চরম অস্তিত্বসংকটের মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করে ফেলে এই ছবি, যা গভীরতর হচ্ছে জলবায়ু সংকট এবং তজ্জনিত নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে।
*****
এস. সেন্থালির হাভেরি, কর্ণাটক
হাভেরি জেলার কোনান্তালে গ্রামে রত্নাভ্যার বাড়ি যখন আমি প্রথম যাই তখন ফসল কাটার মরসুম চলছে। রত্নাভ্যা টমেটো তুলছিলেন, তোলার পর যেগুলোকে পিষে ফেলে বীজ বার করা হবে। এই বীজগুলো তারপর শুকিয়ে নিয়ে পাঠানো হবে জেলা সদরের বড়ো বড়ো বীজ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিতে।
হাতে করে পরাগসংযোগ করানোর কাজ চলে যে মরসুমে তার জন্য আমায় আরও তিন মাস অপেক্ষা করতে হল। ভোর ভোর উঠে পরাগসংযোগের কাজ শুরু করেন মেয়েরা।
আমি রত্নাভ্যার সঙ্গে খেতে যেতাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর পিছন পিছন হাঁটতাম গাছের সারি ধরে ধরে, যে বিষয়ে আমি লিখেছি আশার বীজ বুনে চলে পরাগ-মিলনে আজন্ম অভ্যস্ত রত্নাভ্যার দুই হাত প্রতিবেদনে।
এই প্রতিবেদনের জন্য রত্নাভ্যার বিশ্বাস অর্জন করতে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রায় প্রতিদিন তাঁর বাড়ি গেছি আমি।
এই ছবিটা আমার অন্যতম প্রিয়, কারণ এখানে তাঁর কাজের ভঙ্গিটি খুব সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। সংকর বীজ তৈরিতে যে হাড়ভাঙা খাটুনি যায়, এবং মেয়েরা কীভাবে এই শ্রমসাধ্য কাজ সম্পন্ন করেন, তার অনেকটাই ধরা পড়ে এই ভঙ্গিমাটিতে। এক-একবারে তিন থেকে চার ঘণ্টা একনাগাড়ে কাজ করে চলেন তিনি, ঝুঁকে ঝুঁকে হাতে করে ফুলে পরাগসংযোগ করান, যা কিনা বীজ উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া বলে ধরা হয়।
*****
শ্রীরঙ্গ স্বর্গে মুম্বই, মহারাষ্ট্র
ক্ষত পায়ে, অক্ষত প্রত্যয়ে আগুয়ান এক অনন্য লং মার্চ প্রতিবেদনের এই ছবিটি আমার সবচেয়ে প্রিয়, কারণ এটা কৃষক মিছিলের সত্তাটিকে এবং তার ইতিহাসকে খুব সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করে।
নেতারা যখন কৃষকদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন, আমার চোখে পড়ে একজন চাষি একটা ট্রাকের উপর চড়ে বসে পতাকা দোলাচ্ছেন। তক্ষুনি আমি ট্রাকের পিছন দিয়ে বড়ো রাস্তার উপর গিয়ে দাঁড়াই যাতে ফ্রেমের মধ্যে চাষিদের সমাবেশের বিশালত্বটাও ধরা পড়ে, কারণ আমি জানতাম বেশি দেরি করলে এই ফ্রেমটা আর নাও থাকতে পারে।
এই ছবিটা মিছিলের সত্তাটিকে ধরেছে। পার্থের লেখা প্রতিবেদনটির সারমর্মটি এতে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, এবং কৃষকদের হার-না-মানা মনোভাবের এক ঝলকও ধরা পড়েছে। প্রকাশিত হওয়ার পর কৃষক মিছিলের ছবি হিসেবে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে ছবিটি, অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল, পুনঃপ্রকাশিতও হয়।
*****
শুভ্রা দীক্ষিত কার্গিল জেলা, জম্মু ও কাশ্মীর
তাইসুরু-র পুর্গিতে মুখের যে ভাষা, সেই ভাষায় স্কুলে পড়ানো হয় না। স্কুলে শুধু ইংরেজি আর উর্দু পড়ানো হয়। শিশুদের কাছে দুই ভাষাই দুর্বোধ্য, বিশেষ করে ইংরেজি পাঠ্যবইগুলো। শুধু ভাষাই নয়, দৈনন্দিন জীবনের যেসব ঘটনা বা গল্পের উল্লেখ আছে এই বইগুলোতে, সেগুলোও এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা থেকে বহু যোজন দূরে অবস্থিত।
আমার মহরমের বিষাদ-শোকে জারিত সুরু উপত্যকার ফুল-বাগিচা প্রতিবেদনে হাজিরা আর বাতুলকে দেখি সৌরজগত সম্পর্কে জানতে। পাঠ্যবইতে তাদের খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও, দুই ছাত্রী কিন্তু চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, তারা সম্পর্কে যথেষ্টই আগ্রহী, আর তাই পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে নিজেদের মতো করে একটা সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে তারা।
ছবিটা মহরমের মাসে তোলা, তাই মেয়েদুটি কালো পোশাকে সজ্জিত। পড়াশোনা শেষ করেই একসঙ্গে ইমামবাড়ায় যাবে তারা।
*****
স্মিতা তুমুলুরু তিরুভাল্লুর, তামিলনাড়ু
রসালো ফলটায় একটা কামড় বসিয়ে একগাল হাসে কৃষ্ণন। গোটা মুখ উজ্জ্বল লাল-গোলাপি রঙে ভর্তি। সেই দেখে বাকি কচিকাঁচারা ভারি উত্তেজিত, তারাও ফলের খোঁজে লেগে পড়ে। নাধেল্লি পাঢ়ম নামে ফলটা বাজারে দেখা যায় না, কিন্তু কচিরা ঠিক জোগাড় করে ফেলেছে এক কোঁচা। এটাকে ‘লিপস্টিক ফল’ বলে ডাকে ওরা, কারণ খুবই স্পষ্ট। আমরা সবাই এক-এক কামড় খেলাম, আর গোলাপি ঠোঁট নিয়ে সেলফি তুললাম।
আমার প্রতিবেদন বাঙ্গালামেডুর মাটিতে লুকোনো যক্ষের ধনের সন্ধানে থেকে নেওয়া এই ছবিটা। জনাকয়েক ইরুলা পুরুষ ও বাচ্চাকাচ্চা মিলে বস্তির কাছের ঝোপজঙ্গলে ফল খুঁজতে যাওয়ার অভিযান থেকে এই মজাদার মুহূর্তটা ধরা।
আমার কাছে, সবার পিছনে মনসাঝোপ আর লম্বা ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে ফলের খোঁজে উৎসুক ছোট্ট ছেলেটিকে ছাড়া এই ছবি অসম্পূর্ণ থেকে যেত। ইরুলা গোষ্ঠীর শিশুরা অল্প বয়স থেকেই তাদের চারপাশের অরণ্য সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে শুরু করে, যা আমার এই প্রতিবেদনটির কেন্দ্রীয় বিষয়।
ইরুলাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতায় এই ‘লিপস্টিক ফল’ মুহূর্তটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
*****
শ্বেতা দাগা উদয়পুর, রাজস্থান
ছবি তোলায় তখনও আমি শিক্ষানবিশ, তাই বীজ-রক্ষক চমনীবাই প্রতিবেদনের কাজে গিয়ে অসংখ্য ছবি তুলেছিলাম।
এখন পিছনে ফিরলে ভাবি, অনেক কিছুই অন্যরকম ভাবে করা যেত, কিন্তু এটাই তো জীবন - ভুল না করলে, উন্নতি করা যায় না।
চমনী মীণার হাসিমুখের প্রথম ছবিটি এতই নয়নাভিরাম, আমার সৌভাগ্য যে ওই হাসিটির সঙ্গে ছবিটা ঠিক সময়ে তুলতে পেরেছিলাম!
*****
উমেশ সোলাঙ্কি দহেজ, গুজরাত
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসের শুরুর দিক। গুজরাতের দাহোড় জেলার খারাসানা গ্রামে ছিলাম। এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় আগে এখানে একটি বিষাক্ত নিকাশি নালা পরিষ্কার করতে নেমেছিলেন পাঁচ আদিবাসী ছেলে, তাদের মধ্যে তিনজন মারা যায়। গুজরাত: বিষাক্ত নর্দমা কেড়ে নিল আদিবাসী প্রাণ প্রতিবেদনের জন্য মৃতদের পরিবার এবং যারা বেঁচে ফিরেছে তাদের সাক্ষাৎকার নিতে আমার যাওয়ার কথা।
থাকার কথা ছিল ভাবেশের বাড়িতে, সেই ‘ভাগ্যবান’ ২০ বছর বয়সি তরুণ বেঁচে ফিরলেও, চোখের সামনে নিজের দাদা ২৪ বছর বয়সি পরেশ-সহ তিন সহকর্মী মরতেও দেখেছেন যে। পরিবারের পুরুষদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তার পর বাড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম, চোখে পড়ল পরেশ কাটারার মা স্বপ্না বেন, মাটির বাড়িটার সামনে শুয়ে আছেন। আমায় দেখে উঠে বসলেন, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, একটা ছবি নিতে পারি? অল্প ঘাড় নাড়লেন, সম্মতিসূচক।
সোজা তাকালেন ক্যামেরার দিকে, চোখ ভরা শোক, ক্ষোভ, অসহায়তা নিয়ে। তাঁর চারপাশে হলুদের নানা শেড যেন তাঁর অসহায় অবস্থাকেই আরও মূর্ত করে তুলছিল। আমার তোলা সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ছবিগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। আমার মনে হয়েছিল, এই ছবিটাই সবকিছু বলে দিচ্ছে। চারটি পরিবারের পুরো গল্পটা এই একটি ফ্রেমে ধরা পড়েছে।
*****
জিশান এ লতিফ নন্দুরবার, মহারাষ্ট্র
নিজ স্থান থেকে সরে আসা জরায়ুর চিকিৎসা করানো হয়নি, চরম যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছিলেন পল্লবী (নাম পরিবর্তিত)। যে তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা তাঁকে প্রতি মুহূর্তে সহ্য করতে হচ্ছে, তাঁর আশপাশের পুরুষরা তার ধারণাও করতে পারেন না। খাড়া পাহাড়ের গায়ে দুই ঘরের ছোট্ট বস্তিতে তাঁর কুঁড়েঘরে যখন পল্লবীর ছবি তুলছি, তাঁর চরম সহ্যক্ষমতার এক মূর্ত নিদর্শন হয়ে উঠেছিল তা। যে চিকিৎসায় তাঁর যন্ত্রণা লাঘব হতে পারে তা পেতে হলে দুই ঘণ্টার রাস্তা উজিয়ে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে। সেটাও ক্ষণস্থায়ী উপায় মাত্র, দীর্ঘমেয়াদী উপশম সেখানে হবে না। ‘আমার জরায়ু কেবলই বেরিয়ে আসে’ প্রতিবেদনের জন্য তোলা এই ছবিটিতে আমার ক্যামেরায় ধরা পড়েছেন চরম যন্ত্রণাতেও ঋজু এক আদিবাসী ভীল নারী, অসুস্থ শরীর নিয়েও যিনি আলো ছড়ান নিজগৃহে, নিজ গোষ্ঠীতে।
কভারচিত্র: সম্বিতি আইয়ার
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী