‘খেলা হবে’ আর ‘আবকি বার চারশো পার’-এর জব্বর টানাপোড়েনে পড়েছে বটে আমাদের রাজ্য। সরকারি যোজনা, সিন্ডিকেট মাফিয়া, ভাতা বনাম খয়রাতের রাজনীতি আর বিক্ষোভের বিরোধাভাসের চিরপরিচিত ছবি শুধু তো বাংলার না, ভারত নামের ভূগোলেও সমান প্রাসঙ্গিক।

কাজের তাড়নায় ঘরছাড়া দেশান্তরি মজুর, চাকরির দূরাশায় লাট্টুর মতো পাক খাওয়া যুবসমাজ, রাজ্য বনাম কেন্দ্রের ফাঁদে আটক আমজনতা, জলবায়ুর খামখেয়ালি মেজাজের ধাক্কায় পায়ের তলার মাটি হারানো চাষি, সংখ্যালঘুর খোয়াবনামায় মৌলবাদের চাষ — সব মিলিয়ে পুড়ছে স্বপ্ন, ভাঙছে শরীর। কৌম-ভাবনার চৌমাথায় আজ ভিড় জমিয়েছে বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ, ভাষা, জাতি, ধর্ম।

এই মহাভারতের অলিগলি হয়ে চলেছি আমরা, শুনছি হতভম্ব মানুষের অসহায় আর্তনাদ, প্রলাপ, বিলাপ। যাঁদের স্বর মসনদ দমাতে পারেনি, এই ঐক্যতানে এসে মিশেছে তাঁদেরও কণ্ঠ। সন্দেশখালি থেকে হিমালয়ের চা-বাগান, কলকাতার ভিড় থেকে অনেক দূরে বিস্মৃত রাঢ়, হেঁটে চলেছি আমরা — এক সাংবাদিক আর এক কবি। আমরা শুনছি, সঞ্চয় করছি, ছবি তুলছি, কথা বলছি।

জশুয়া বোধিনেত্রর কণ্ঠে মূল ইংরেজি কবিতাগুলি শুনুন

আমাদের এই কাফিলা গিয়েছিল সন্দেশখালি। পশ্চিমবঙ্গের নদীবিধৃত সুন্দরবন লাগোয়া এমন এক স্থান জমির লড়াই আর মেয়েদের শরীরকে রাজনীতির ঘুঁটি না করলে যা সবার অগোচরেই রয়ে যেত।

তামাশা

ভিনি ভিসি ভিডি
আইল রে ইডি,
পাশ ফিরে শুয়েছিল সন্দেশখালি —
ছিনিমিনি কেহ
মেয়েদের দেহ,
টিভিটা চেঁচায় শুধু, “রাম নাকি আলি?”

PHOTO • Smita Khator

মুর্শিদাবাদে তৃণমূল কংগ্রেসের আগমার্কা দেওয়াল-লিখন: ‘খেলা হবে’

PHOTO • Smita Khator

মুর্শিদাবাদের আরেকটি দেওয়াল-লিখন: ‘কয়লা খেলি, গরু খেলি খেলি, নদীর বালি, মেয়ে-বউদেরও বাদ দিলিনা — বলছে সন্দেশখালি’

PHOTO • Smita Khator
PHOTO • Smita Khator

বাঁদিকে: উত্তর কলকাতার এক পুজো-প্যান্ডেলে নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতন ভাষ্য: ফন্দি করে বন্দি করো। ডানদিকে: সুন্দরবনের বালি দ্বীপে প্রাথমিক স্তরের স্কুলপড়ুয়াদের একটি পোস্টার প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে নারী-নির্যাতনের কথা: আমরা নারী, আমরা নারী-নির্যাতন বন্ধ করতে পারি

*****

বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম আর পশ্চিম মেদিনীপুর জোড়া জঙ্গলমহলে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম চাষি ও পরিযায়ী খেতমজুরের কাজে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলা নারীদের।

ঝুমুর

চলেছে পেটের দায়ে ভিটেমাটি ছেড়ে,
কে-ই বা হিন্দু হেথা, বলো কেবা নেড়ে?
ব্যালট দিয়াছে ফাঁকি —
খিদেই পেহলা ঝাঁকি —
‘পানি’ বলা মহাপাপ, ‘জল’ বলো ‘জল’!
একুশে আইন গোনে জংলা মহল।

PHOTO • Smita Khator
PHOTO • Smita Khator

চরম জলাভাবে সঙ্কুচিত কৃষিক্ষেত্র ও জীবিকার সংকটে জর্জরিত পুরুলিয়ার চাষিরা – যাঁদের মধ্যে এক বিরাট অংশই নারী

*****

দেখলাম তামাম দুনিয়ার কাছে ‘শৈলরানি’ বলে পরিচিত দার্জিলিংয়ের নয়নাভিরাম চা-বাগান যে আদিবাসী নারীদের রক্তমাংসে সিঞ্চিত, সেখানে তাঁদেরই জন্য নেই কোনও শৌচাগার — প্রকৃতির ডাক এলে কোথায় যে যান তাঁরা… যুগ যুগ ধরে চূড়ান্ত অসমতার সঙ্গে যুঝছেন এই তল্লাটের মেয়েরা, তাঁদের ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ ফুটে উঠেছে দেওয়ালে।

বহ্নিমুখর

এক কাপ চায়ে যারা চায় না তোমাকে
উলঙ্গ ওলোংয়ের ধোঁয়া ওঠা বাঁকে,
উচ্চবিত্ত তারা লাশকাটা বং...
আদিবাসী মেয়েদের ছিঁড়ে আনা পাতা
তোমার ড্রয়িংরুমে লেখে না কবিতা,
উচ্চবর্ণ ওহে সমাজের জং।

PHOTO • Smita Khator

দার্জিলিংয়ের এক দেওয়ালে জেলার মেয়েদের চূড়ান্ত দুর্দশার কথা জানান দেবে এই দেওয়ালের লিখন

*****

কেবল ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে মুর্শিদাবাদ যে এই রাজ্যের মধ্যমণি তা নয়, তার নামডাক বরং কর্মসংস্থানহীনতা ঘিরেই বেশি। এখানে অবিরত কাটমানির দিন, ইস্কুলের চাকরি নিন! মহামান্য উচ্চ আদালতের হুকুমে রাজ্যচালিত ও রাজ্যের সহায়তাপ্রাপ্ত স্কুলের অসংখ্য শিক্ষক তথা অন্যান্য কর্মীর চাকরি খোওয়া গেছে, বলা হয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন অবৈধ ভাবে তাঁদের চাকরি দিয়েছিল — ফলে দ্বিধায় সংশয়ে ভরে উঠেছে যুবসমাজের মন। যারা ১৮টা বসন্তও দেখেনি এমন বহু কিশোর বিড়ি কারখানায় কাজ করে খায়, শিক্ষার জোরে যে তাদের নসীবের চাকা ঘুরতে পারে, সে বিশ্বাস তাদের কবেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। উল্টে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিনমজদুরির পথ ধরে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ছেলেপুলে।

কাটমানি

ধর্না ধর্মঘটে দিন হলে রাত,
‘চাকরি চাকরি কই, একমুঠো ভাত?’
কানুনের দিয়ে ছুতো
পুলিশের বুটজুতো
তলপেটে এঁকে দিলো জনগণতন্ত্র —
জানি জানি কাটমানি এযুগের মন্ত্র।

PHOTO • Smita Khator

মুর্শিদাবাদের বিড়ি কারখানায় কর্মরত স্কুলছুট ছেলেরা, অধিকাংশই কিশোর। ‘বড়ো বড়ো সব ডিগ্রি নিয়েও লোকে বেকার হয়ে বসে আছে। এসএসসির (স্কুল সার্ভিস কমিশন) তালিকায় নাম উঠেও যারা চাকরি পায়নি, তারা আজ রাস্তায় রাস্তায় বসে আন্দোলন করছে। আপনিই বলুন না, শিক্ষা নিয়ে করবটা কী?’

*****

কি শীত কি গ্রীষ্ম কি বর্ষা, কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পথচলতি শতসহস্র মুসাফিরের ভিড় ঠেলে এগোতেই দেখেছি কাতারে কাতারে মহিলা গর্জে উঠছেন প্রতিবাদে। মানুষখেকো যত আইন আর মূল্যবৃদ্ধির প্রতিরোধে রাজ্যের প্রতিটি প্রান্ত থেকে দলে দলে এসে জড়ো হচ্ছেন মানুষ।

নাগরিকনামা

কাগজ চাই গো কাগওওওজ...
ভিটেহারাদের কাগওওওজ...
ভাগ ভাগ হালা বাঙালের পোলা!
সিঁদ কেটে দেখি দরজাটা খোলা —
নাগরিকত্ব, মৃতের শর্ত,
দেশ দেশ দেশ কার?
কাগজ নেই গো কাগওওওজ...
সিএএ রাঙানো কাগওওওজ...

PHOTO • Smita Khator

বিভিন্ন মহিলা সংগঠন ২০১৯ সালের মার্চ মাসে একত্রিত হয়ে কলকাতায় সংগঠিত করেছিল অভূতপূর্ব উইমেন্স মার্চ-এর। তারই জন্য মেয়েদের বানানো কিছু কাট-আউট

PHOTO • Smita Khator

২০১৯ সালের উইমেন্স মার্চ, কলকাতা: ধর্ম, জাতপাত ও লিঙ্গমূলক বৈষম্য ও ঘৃণাকে পরাস্ত করার ডাক দিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মেয়েরা

PHOTO • Smita Khator

কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে মুসলিম মহিলাদের ঐতিহাসিক অবস্থান বিক্ষোভ, তখন সিএএ-এনআরসি আন্দোলনের আবহে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেমেছিল গোটা দেশ

*****

কৃষিনির্ভর বীরভূমের যে গাঁয়েই যান, সদাই কাজে ব্যস্ত আদিবাসী ভূমিহীন চাষি মহিলাদের মুখোমুখি হবেন। যে সকল নারীদের পরিবারের হাতে এক বা দুই ছটাক জমি আছে, সেখানেও পাট্টায় ব্রাত্য তাঁরা।

শূদ্রাণী

শুন্ বাবু মোর পাট্টা লিবি?
কাঁইবিচি চাল ভিক্ষে দিবি?
চাষ করি আমি নিজের মুরোদে, চাষিবৌ কস্ কারে?
একফালি জমি খরায় পুড়েছে,
উনুনের কোনে কর্জ জমেছে,
মজদুরি করি পরের ধূলায়, মুহাজির কস্ কারে?

PHOTO • Smita Khator
PHOTO • Smita Khator

‘নিজের বলতে কোনও জমি নেই। পরের খেত-খামারে ঘাম ঝরাই, অথচ একমুঠি আনাজের জন্য ভিখ মাগতে হয়,’ ধান কাটতে কাটতে জানিয়েছিলেন বীরভূমের খেতমজুরি করে দিন গুজরান করে চলা এক সাঁওতালি নারী

*****

ক্ষমতাসীনকে জন-আদালতের কাঠগড়ায় তুলতে নির্বাচনের পথ চেয়ে কোনও সাধারণ মানুষ এখানে বসে থাকেন না। ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে, দেশজোড়া আন্দোলনের সমর্থনে বারবার খোলা আসমানের নিচে একজোট হতে দেখেছি আমরা মুর্শিদাবাদ, হুগলি আর নদিয়ার চাষিদের – তাঁরা পুরুষ এবং অবশ্যই নারী।

আস্তে হাতুড়ি দাঁড়া

জুটমিলে হরতাল, প্রমোটার খোঁড়ে খাল,
কাঁদানে গ্যাসের নাকিকান্না —
সাদাকালোবাজারি, ন্যূনতম মজুরি
না দেওয়ার সরকারি বায়না।
টাকা-মাটি গেল তল, রাজা বলে কত জল?
মনরেগা ভেসে গেছে হায় রে!
আক্ষুটে রানি তার, মামাটিমা কারবার,
আর কত খেলা হবে ভাই রে?

PHOTO • Smita Khator
PHOTO • Smita Khator

বাঁদিকে: ১৮ জানুয়ারি ২০২১, সর্বভারতীয় কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির (এআইকেএসসিসি) মহিলা কৃষক দিবস মিছিল। ডানদিকে: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সর্বভারতীয় কৃষকসভার (এআইকেএস) একটি মিছিলে বিক্ষোভরত কৃষকরা বলেছিলেন: ‘বাবুরা তো আমাদের কাছে আসেন না। সুতরাং আমরা যে কী চাই, সেটা তেনাদের কানে তুলতে নিজেরাই এখানে এসেছি!’


কবিতা: জশুয়া বোধিনেত্র

Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کے ہندوستانی زبانوں کے پروگرام، پاری بھاشا کے کانٹینٹ مینیجر ہیں۔ انہوں نے کولکاتا کی جادوپور یونیورسٹی سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک کثیر لسانی شاعر، ترجمہ نگار، فن کے ناقد اور سماجی کارکن ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra
Smita Khator

اسمِتا کھٹور، پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کے ہندوستانی زبانوں کے پروگرام، پاری بھاشا کی چیف ٹرانسلیشنز ایڈیٹر ہیں۔ ترجمہ، زبان اور آرکائیوز ان کے کام کرنے کے شعبے رہے ہیں۔ وہ خواتین کے مسائل اور محنت و مزدوری سے متعلق امور پر لکھتی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز اسمیتا کھٹور
Illustration : Labani Jangi

لابنی جنگی مغربی بنگال کے ندیا ضلع سے ہیں اور سال ۲۰۲۰ سے پاری کی فیلو ہیں۔ وہ ایک ماہر پینٹر بھی ہیں، اور انہوں نے اس کی کوئی باقاعدہ تربیت نہیں حاصل کی ہے۔ وہ ’سنٹر فار اسٹڈیز اِن سوشل سائنسز‘، کولکاتا سے مزدوروں کی ہجرت کے ایشو پر پی ایچ ڈی لکھ رہی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Labani Jangi
Editor : Pratishtha Pandya

پرتشٹھا پانڈیہ، پاری میں بطور سینئر ایڈیٹر کام کرتی ہیں، اور پاری کے تخلیقی تحریر والے شعبہ کی سربراہ ہیں۔ وہ پاری بھاشا ٹیم کی رکن ہیں اور گجراتی میں اسٹوریز کا ترجمہ اور ایڈیٹنگ کرتی ہیں۔ پرتشٹھا گجراتی اور انگریزی زبان کی شاعرہ بھی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Pratishtha Pandya