মুদুমালাই ব্যাঘ্র প্রকল্পের বাসিন্দাদের চোখ বন্ধ থাকতে পারে, কান কিন্তু সবসময় খোলা। পশুপাখি যেসব শব্দের মাধ্যমে কথা বলে তা আমরা বুঝতে পারি না বিশেষ। এইসব দুর্বোধ্য শব্দের মধ্যে আছে তামিলনাড়ুর নীলগিরি পর্বতের বাসিন্দা নানান আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাষাগুলিও।
বেট্টাকুরুম্বারা বলেন, “নালাইয়াভোদুতু [কেমন আছেন]?” ইরুলাররা বলেন, “সান্ধাকিতাইয়া?”
প্রশ্ন একই, সম্ভাষণ শুধু আলাদা।
পশ্চিমঘাট পর্বতমালার দক্ষিণাঞ্চলে পশু-পাখি-মানুষের মুখের ভাষা সংগীতময়, আর তার একদম বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে গাড়ি আর যন্ত্রের কর্কশ আওয়াজ। এই আওয়াজ আমার বাড়ির আওয়াজ।
মুদুমালাই ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভিতর অবস্থিত পোক্কাপুরম (সরকারি খাতায় নাম বোক্কাপুরাম) গ্রামের কুরুম্বার পাডি নামের এক ছোট্ট গলিতে আমার বাড়ি। ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মার্চের গোড়ার দিকটা জুড়ে শান্ত গ্রামটা ভোল পালটে ছোটখাটো শহর হয়ে ওঠে একটা – ঠিক যেন থুঙ্গা নগরম [যে শহর কখনো ঘুমায় না], মাদুরাই নগরীর আর এক নাম যা। এই পরিবর্তনের কারণ হল গ্রামের দেবী পোক্কাপুরম মারিয়াম্মানের মন্দির উৎসব। ছয় দিন ধরে গোটা জায়গাটা গানবাজনা, হইহুল্লোড়, মানুষের ভিড়ে জমজমাট হয়ে থাকে। তবুও, আমার উর [গ্রাম]-এর জীবনের কথা যখন মনে পড়ে, উৎসবের দিনকটা সেই কাহিনির একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।
এই কাহিনি ব্যাঘ্র প্রকল্পের নয়, আমার গ্রামেরও নয়। এই কাহিনির মুখ্য চরিত্র এমন এক মানুষ যিনি আমার জীবনের কেন্দ্রস্থল – এক নারী, স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর যিনি একা হাতে পাঁচ সন্তানকে মানুষ করেছেন। এই কাহিনি আমার মায়ের।
*****
খাতায় কলমে আমার নাম কে. রবিকুমার, কিন্তু আমার জ্ঞাতি মানুষেরা আমায় মারন বলে চেনেন। আমার সম্প্রদায় নিজেদের নাম বলে পেট্টাকুরুম্বর, কিন্তু সরকারি তালিকায় আমরা বেট্টাকুরুম্বা হিসেবে নথিভুক্ত।
এই কাহিনির নায়িকা, আমার আম্মার [মা] নাম হল ‘মেতি’ – খাতায়-কলমে, লোকমুখে দুই জায়গাতেই। আমার আপ্পার [বাবা] নাম কৃষ্ণন, আমার সম্প্রদায় তাঁকে চেনে কেতন বলে। আমি পাঁচ ভাইবোনের একজন: সবচেয়ে বড়দি চিত্রা (এখানে বলে কিরকালি); আমার বড়দা রবিচন্দ্রন (মাদন); মেজদি শশীকলা (কেত্থি); আর আমার ছোটো বোন কুমারী (কিনমারি)। বড়ো দুই দাদা-দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, ওরা পরিবার নিয়ে তামিলনাড়ুর কুড্ডালোর জেলার পালাভাডি গ্রামে থাকে।
আমার ছোটোবেলার সবচেয়ে প্রথম স্মৃতি হল হয় আপ্পা নয় আম্মা আমায় নিয়ে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যাচ্ছে। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে কত না স্মৃতি – আনন্দ, খুশি, রাগ আর দুঃখ। দুপুর তিনটে নাগাদ বাবা-মা আমায় নিতে আসত, বাড়ি ফিরে যেতাম।
মদের নেশায় জীবন পর্যুদস্ত হয়ে যাওয়ার আগে আমার আপ্পা খুব স্নেহশীল মানুষ ছিলেন। কিন্তু মদের নেশা ধরার পর থেকে দায়িত্বজ্ঞানহীন, হিংস্র হয়ে যান। “বদসঙ্গে পড়েই এমনটা হয়েছে,” মা বলতেন।
বাড়িতে ঝামেলার আমার প্রথম স্মৃতি হল, একদিন আপ্পা মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে আম্মাকে গালিগালাজ করতে থাকেন। আম্মার গায়ে হাত তোলেন, তাঁর বাবা-মা, ভাইবোনদের অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করতে থাকেন – ঘটনাচক্রে তাঁরা সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এত কটূভাষণ সত্ত্বেও বিষয়টাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে গেছিলেন তাঁরা। ক্রমশ দৈনন্দিন রুটিন হয়ে ওঠে এইসব চিৎকার-চেঁচামেচি।
আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণি, তখনকার একটা ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে। রোজকার মতোই মদ খেয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বাড়ি ফেরেন আপ্পা, প্রথমে মাকে মারেন, তারপর আমায় আর আমার ভাইবোনেদের। আমাদের সব জামাকাপড়, জিনিসপত্র রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলতে থাকেন। সে রাতে রাস্তায় অন্ধকারে মাকে আঁকড়ে বসে ছিলাম আমরা, শীতকালে যেমন জীবজন্তুর ছানারা মায়ের গায়ের ওম নিতে গুটিশুটি হয়ে ঘেঁসে বসে।
জিটিআর মিডল স্কুল নামে যে সরকারি আদিবাসী স্কুলটায় আমরা পড়তাম, সেখানে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত ছিল। আমার বড়দা আর দিদি স্কুলের বোর্ডিং-এ চলে গেল। ওই সময়টা মনে হল, যেন সবকিছুরই অভাব হয়, খালি কান্না আর আর্তনাদ বাড়ন্ত যায় না কখনও। আমরা বাড়িতেই থেকে গেলাম, আপ্পা বেরিয়ে চলে গেলেন।
সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম, এই বুঝি আবার ঝগড়া শুরু হল। এক রাতে মাতাল অবস্থায় মায়ের ভাইয়ের সঙ্গে আপ্পার মারামারি শুরু হয়। ছুরি নিয়ে মামার কবজি কাটতে গেছিল আপ্পা। ছুরিতে ধার ছিল না বলে ভাগ্যক্রমে বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়নি। মামাকে বাঁচাতে পরিবারের অন্যরা আপ্পার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গোলমালের মধ্যে আম্মার কোল থেকে পড়ে যায় আমার ছোটো বোন, মাথায় আঘাত লাগে তার। আমি অসহায়, স্তব্ধ দাঁড়িয়েছিলাম, কী ঘটছে কিছুই মাথায় ঢুকছিল না।
পরের দিন সকালে সামনের উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে ছিল আপ্পা আর মামার শুকিয়ে যাওয়া কালচে-লাল রক্তের দাগ। মাঝরাতে আপ্পা টলতে টলতে এসে আমায় আর আমার বোনকে দাদু-দিদার বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে খেতের মাঝে তাঁর ছোট্ট ঘরটায় নিয়ে চলে গেলেন। কয়েক মাস বাদে চিরকালের মতো বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল।
গুদালুরের ফ্যামিলি কোর্টে আমরা ভাইবোনেরা আম্মার সঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করি। তারপর কিছুদিন ভালোই কেটেছিল দাদু-দিদার বাড়িতে, আমাদের বাড়ির গলিতেই তাঁদের বাসা।
কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন রইল না, সময় আবার কঠিন হয়ে উঠল। সবার খাবার জোটানো মুশকিল হয়ে পড়ছিল। আমার দাদুর প্রাপ্য যে ৪০ কেজি রেশন তা দিয়ে আমাদের সবার সঙ্কুলান হচ্ছিল না। বেশিরভাগ দিনই দাদু খালিপেটে থাকতেন যাতে আমরা দুটো খেতে পাই। মরিয়া হয়ে কখনও কখনও মন্দির থেকে প্রসাদম [প্রসাদ] নিয়ে এসে আমাদের খাওয়াতেন। এরপরেই আম্মা ঠিক করলেন, মজুরি করবেন।
*****
তৃতীয় শ্রেণিতেই স্কুল ছেড়ে যায় আম্মার, তাঁর পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। সারা ছোটোবেলা ভাইবোনেদের দেখাশোনা করেছেন, ১৮ বছর বয়স হতেই আমার বাবার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পোক্কাপুরম থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নীলগিরির গুদালুর ব্লকের সিঙ্গাড়া গ্রামে একটি বড়ো কফি এস্টেটের ক্যান্টিনে জ্বালানি কাঠ সরবরাহ করতেন আপ্পা।
আমাদের এলাকার প্রায় সবাই ওখানে কাজ করত। যতদিন বিয়েটা ছিল, মা বাড়িতে থেকে আমাদের দেখভাল করতেন। বিচ্ছেদের পর সেই সিঙ্গাড়া কফি এস্টেটেই ১৫০ টাকা রোজে দিনমজুরির কাজ নেন তিনি।
রোজ সকাল ৭টায় কাজে বেরোতেন, রোদ-জল যাই থাক না কেন। তাঁর সহকর্মীদের বলতে শুনেছি, “ও তো দুপুরে খাবার ছুটিতেও বিশ্রাম নেয় না।” টানা প্রায় আট বছর এই কাজের রোজগার দিয়ে সংসার টেনেছেন আম্মা। এক-একদিন আম্মা বাড়ি ফিরতেন প্রায় সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ, দেখতাম তাঁর শাড়ি ভিজে সপসপে, সর্বাঙ্গ কাঁপছে, মাথায় আচ্ছাদন বলতে খালি ভেজা গামছা একটা। এমন বর্ষার দিনে আমাদের ছাদের নানা জায়গা দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ত, আর মা এক কোণ থেকে আর এক কোণে ছুটে বেড়াতেন জল ধরার পাত্র বসাতে।
আমি প্রায়ই আম্মাকে আগুন জ্বালতে সাহায্য করতাম, তারপর পরিবারের সবাই মিলে আগুন পোহাতে পোহাতে গল্পগুজব করতাম, রাত সেই ১১টা পর্যন্ত।
এক-একদিন ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মা আমাদের তাঁর কষ্টের কথা বলতেন। মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতেন। কিন্তু আমরা যদি তাঁর কথা শুনে কাঁদতাম, তৎক্ষণাৎ চোখের জল মুছে কোনও একটা মজার চুটকি শুনিয়ে দিতেন আমাদের মন ভালো করার জন্য। পৃথিবীকে কোন মা আছে যে সন্তানের চোখের জল দেখে সহ্য করতে পারে?
এরপর আমি মাসিনাগুডির শ্রী শান্তি বিজয়া হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। মায়ের মালিকপক্ষের স্কুল ছিল সেটা, এস্টেটের শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য। ওখানে যেতে মনে হত জেলে যাচ্ছি। যতই কাকুতিমিনতি করি আম্মা জোর করে আমায় ওখানে পড়িয়েছিলেন, বেশি জেদ করলে চড়-থাপ্পড়ও খেয়েছি। এরও কিছুদিন পর আমরা দাদু-দিদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার বড়দি চিত্রার শ্বশুরবাড়ি চলে গেলাম, দুই-কামরা ছোট্ট কুঁড়েঘর সেটা। আমার সবচেয়ে ছোটো বোন কুমারী জিটিআর মিডল স্কুলেই থেকে গেল।
দশম শ্রেণির পরীক্ষার সময় অতিরিক্ত পড়ার চাপ সহ্য করতে না পেরে স্কুল ছেড়ে দিয়ে বাড়ির কাজে হাত লাগালো আমার মেজদি শশীকলা; মায়ের কষ্ট একটু লাঘব হল। বছরখানেক পর তিরুপুরের একটা কাপড়ের সংস্থায় চাকরি পেয়ে গেল মেজদি, বছরে দুয়েকবার দেখা করতে আসত। টানা পাঁচ বছর মেজদির ৬,০০০ টাকার মাসমাইনে দিয়ে আমাদের সংসার চলেছে। আম্মা আর আমি তিন মাস অন্তর অন্তর ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, প্রতিবারই সঞ্চয় করা টাকা আমাদের হাতে দিয়ে দিত। মেজদি চাকরি পাওয়ার এক বছর পর কফি এস্টেটের কাজটা ছেড়ে দেন আম্মা। তারপর তাঁর বেশিরভাগ সময়টাই কাটত বাড়ির কাজ এবং বড়দি চিত্রার বাচ্চার দেখাশোনা করে।
শ্রী শান্তি বিজয়া হাইস্কুলে দশ ক্লাসের পড়া শেষ করে উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনার জন্য কোটাগিরি সরকারি আবাসিক স্কুলে চলে গেলাম আমি। আমার পড়াশোনা চালাতে এবার ঘুঁটে বেচা শুরু করলেন মা; আমি যাতে আরও ভালো করে পড়তে পারি সেই লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন তিনি।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের বাড়ি ভাংচুর করে, বিজলির তার কেটে দিয়ে যান আপ্পা। বিজলি না থাকায় মদের বোতল দিয়ে তৈরি কেরোসিন বাতি ব্যবহার করতাম আমরা, পরে দুটো সেম্বু [তামা] বাতি কেনা হয়। দশ বছর এই ছোটো বাতিগুলো আমাদের জীবনে আলো দিয়ে গেছে। বিজলি অবশেষে ফেরত আনা গেল আমি যখন বারো ক্লাসে পড়ি।
বিজলি ফেরানোর জন্য প্রাণপাত করেছিলেন মা, নিজের বিজলির ভয়কে জয় করেছেন, সরকারি আমলাদের নানান প্যাঁচপয়জারের সঙ্গে লড়ে গেছেন। একা থাকলে আজও সব আলো নিভিয়ে দিয়ে ওই ছোটো বাতি জ্বালিয়ে থাকেন। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিজলিতে এত ভয় কেন। মা বলেছিলেন সিঙ্গাড়ায় এক মহিলা তড়িদাহত হয়ে মারা যাওয়ার এক ঘটনা শুনেছিলেন তিনি, সেই থেকেই ভয়।
উচ্চশিক্ষার জন্য জেলা সদর উধগামণ্ডলমের (উটি) আর্ট কলেজে ভর্তি হই। আমার কলেজের মাইনে জোগাতে, বইখাতা কিনে দিতে একাধিক ঋণ নেন মা। সেই ঋণ চোকাতে সবজির বাগানে কাজ করতেন, ঘুঁটে বেচতেন। প্রথম প্রথম আমাকেও টাকা পাঠাতেন। আমি অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই একটা কেটারিং সংস্থায় আধা-সময়ের চাকরি পেয়ে যাই আর নিজের দরকারের বাইরের টাকা বাড়িতে পাঠাতে শুরু করি। মায়ের বয়স এখন পঞ্চাশের কোঠায়। জীবনে কারও থেকে অর্থভিক্ষা করেননি। কাজ করতে মা সবসময় রাজি, সে যেমন কাজই হোক না কেন।
বড়দির বাচ্চারা একটু বড়ো হলে মা তাদের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে রেখে বনজঙ্গল থেকে ঘুঁটে তুলতে যেতেন। সারা সপ্তাহ ঘুঁটে তুলে এক-এক বালতি ৮০ টাকায় বেচতেন। সকাল ৯টায় কাজে বেরোতেন, বিকেল ৪টে নাগাদ ফিরতেন। দুপুরে কাডলিপাঢ়ম (একধরনের ক্যাকটাসের ফল) ইত্যাদি ফলমূল খেয়ে থাকতেন।
এত কম খেয়েও এত স্ফূর্তি কেমন করে পাও – জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা বললেন, “ছোটোবেলায় অনেক মাংস, শাকসবজি, বন থেকে তুলে আনা কন্দ এইসব খেয়ে নিয়েছি। তখন যে খাবার খেয়েছিলাম, তাতেই আজও আমার গায়ে জোর থেকে গেছে।” বুনো শাকসবজি ভীষণ প্রিয় তাঁর। মাকে নুন আর গরম জল দিয়ে চালের গুঁড়ো মেখে খেতেও দেখেছি আমি।
আশ্চর্য লাগে, মাকে আমি প্রায় কোনওদিনই বলতে শুনিনি, “আমার খিদে পেয়েছে।” আমরা, তাঁর সন্তানেরা খেলেই যেন তাঁর তুষ্টি হয়ে যেত।
বাড়িতে আমাদের তিনটে কুকুর আছে, দিয়া, দেও আর রসাতি। আরও আছে ছাগল, লোমের রং দিয়ে নাম সবার। এই পশুরা আমাদের মতোই এই পরিবারের অংশ। আম্মা আমাদের মতো করেই ওদের যত্ন করে, আর ওরাও আম্মাকে বড্ড ভালোবাসে। রোজ সকালে ওদের খাবার আর জল দেন আম্মা, আর ছাগলদের দেন শাক আর ভাতের মাড়।
মায়ের ঈশ্বরবিশ্বাস গভীর, আমাদের গ্রামদেবতার বদলে জেডাসামি আর আয়প্পনের পায়েই সব ভক্তি অর্পণ করেছেন তিনি। সপ্তাহে একবার সারা বাড়ি ভালো করে সাফ করে জেডাসামি মন্দিরে যান আম্মা, মনের ভিতর জমা দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেন দেবতার সঙ্গে।
মাকে কখনও নিজের জন্য একটা শাড়ি কিনতে দেখিনি। মোট আটখানা শাড়ি আছে, সবই মাসি আর বড়দির উপহার। ওইগুলোই বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরেন, কোনও অনুযোগ-অভিযোগ শুনিনি তাঁর মুখে।
আমার বাড়ির ঝুটঝামেলা নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে খুব চর্চা হত। এখন সবাই অবাক হয় দেখে যে এত কষ্ট সত্ত্বেও আমরা ভাইবোনেরা নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছি। আমাদের উপরে কোনও আঁচ আসতে না দিয়ে এত ভালোভাবে আমাদের মানুষ করার জন্য আজকাল মায়ের প্রশংসা করে সবাই।
পিছনে তাকালে এখন ভাবি, ভাগ্যিস মা আমায় জোর করে ওই শ্রী শান্তি বিজয়া হাইস্কুলে পাঠিয়েছিলেন। ওখানেই ইংরেজি শিখেছি আমি। ওই স্কুল আর মায়ের লেগে থাকা ছাড়া আমার উচ্চশিক্ষা লাভ সহজ হত না। আম্মা আমার জন্য যা যা করেছেন তা আমি কোনওদিন শোধ করতে পারব না। সারাজীবনের জন্য আমি তাঁর কাছে ঋণী।
রোজ দিনের শেষে মা যখন সব কাজ সেরে এসে হাত-পা ছড়িয়ে বসেন, আমি মায়ের পায়ের তলাটা খেয়াল করি। এতগুলো বছর ধরে উদয়াস্ত খেটে গেছে এই একজোড়া পা। কাজের জন্য যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলের মধ্যে দাঁড়িয়েও থাকতে হয় – যেটা প্রায়ই হয়ে থাকে – তা সত্ত্বেও মায়ের পায়ের তলাটা রুখা-শুখা মাটির মতো, অজস্র ফাটলে ভরা। আমাদের মানুষ করেছে এই ফাটলগুলোই।
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী