ওড়িশার বিসমকটক ব্লকের বনবিভাগের এক আধিকারিক ২০১৮ সালে গ্রামবাসী এবং বনবিভাগের দীর্ঘদিনের পুরোনো বচসা নিয়ে আলোচনা করতে কান্ধুগুড়া গ্রামে গিয়েছিলেন। তিনি বোধহয় প্রবীণাদের নেতৃত্বে থাকা একটি পুরুষহীন মহিলা-সর্বস্ব জমায়েতের মুখোমুখি হয়ে রীতিমতো অবাক হয়েছিলেন। ভারতের অন্য যে কোনও গ্রামে গেলে তিনি সম্ভবত পুরুষ প্রধান জমায়েতে জনৈক পুরুষ সরপঞ্চের সম্মুখীন হতেন।

তবে এখানে, অর্থাৎ রায়াগাড়া জেলার সমতল ভূমিতে কোন্ধরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনজাতি (মোট জনসংখ্যা: ৯,৬৭,৯১১, যার মধ্যে ৫,৪১,৯০৫ জন বিভিন্ন তফসিলি জনজাতির অন্তর্গত), এখানে মহিলারা বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়িত্বে থাকেন। সমাজ মূলত পুরুষতান্ত্রিক হলেও নারী পুরুষ যাতে সমান অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারেন সেটা এখানে সুনিশ্চিত করা হয়। নিয়মগিরির কারান্দিগুড়া গ্রামের বছর পয়ষট্টির লোকনাথ নাউরি বুঝিয়ে বলছেন, “পাহাড়ে অধিষ্ঠিত নিয়ম রাজা (নিয়মগিরির দেবতা) হলেন পুরুষ আর আমাদের গ্রাম দেবতা হলেন নারী [গ্রামের প্রবেশপথে স্থাপিত টোটেম সদৃশ একটি কাঠের স্তম্ভ]। এই দুই দেব-দেবীর কৃপাদৃষ্টির বলেই আমাদের মঙ্গল সাধিত হয়। এঁদের কোনও একজন রুষ্ট হলেই আমাদের সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী।“

এই দর্শনই কোন্ধদের সমাজে শ্রমবিভাজনের ভিত্তি। কুটুম্ভ নামে পরিচিত গ্রামের প্রশাসন ব্যবস্থার সমস্ত কাজে নারীরা সব কাজে সমানভাবে যোগদান করেন এবং নিজেদের মতামত দেন। পুরুষেরা চাষাবাদ এবং শিকার করেন, আর বাদবাকি সব কৌম কাজকর্মের দায়ভার নারীরাই সামলান।

PHOTO • Parul Abrol

কোসা কুঙ্গারুকা (বাঁদিকে) এবং সিঙ্গারি কুঙ্গারুকা (ডানদিকে)। এই দুজন তাঁদের জমিতে বনবিভাগ থেকে জোর করে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন

কান্ধুগুড়া গ্রামে মহিলারা আদতে এই কাজটাই করছিলেন। গ্রামবাসীরা ইউক্যালিপটাস গাছ (১৯৮০ সালের কুখ্যাত সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের একটি অংশ) লাগাতে বাধা দিয়েছিলেন, কারণ ইউক্যালিপটাস স্থানিক বাস্তুতন্ত্রের অংশীদার নয় এবং মানুষ বা অন্য পশুপাখির তেমন কাজেও লাগে না। গ্রামবাসীরা বারংবার ইউক্যালিপটাস চারা রোপনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করায় বনবিভাগের আধিকারিক নিজেই এসেছিলেন। তিনি বোধহয় এই সম্প্রদায়ে নারীদের সামাজিক অবস্থানের বিষয়ে অবগত ছিলেন না, অগত্যা তিনি গাছ রোপনে বাধা দেওয়ার শোচনীয় পরিণতি সম্পর্কে গ্রামবাসীদের শুরুতে বোঝালেও পরে ভয় দেখাতে থাকেন, তবু গ্রামবাসীরা নিজেদের প্রতিরোধ থেকে একচুল সরেননি।

দুই প্রবীণ নারী, কোসা কুঙ্গারুকা ও সিঙ্গারি কুঙ্গারুকা ওই আধিকারিককে বোঝানের চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁরা আদৌ বৃক্ষরোপণের বিরোধী নন, শুধু এমন গাছ তাঁরা লাগানোর অনুরোধ জানাচ্ছেন যা গ্রামবাসী ও বন্য প্রাণী উভয়ের পক্ষেই মঙ্গলজনক হবে। কোসা জানালেন, সেই আধিকারিক তাঁদের কথা তো শোনেনইনি, বরং উল্টে তাঁদেরকেই ভীষণরকম হুমকি দেন। তিনি আরও বললেন, এর ফলে মহিলারা ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে দু’হাত নেন।

ওই আধিকারিক শেষে পালিয়ে রক্ষে পান, অতঃপর কোন্ধদের মহা-ডেঞ্জারাস লোকজন বলে দেগে দেন। পরেরদিন একগাড়ি পুলিশ এসে হাজির হয় গ্রামে। কান্ধুগুড়া এবং আশপাশের গ্রামের পুরুষেরাও এবারে মহিলাদের সঙ্গে যোগ দেন। সম্মুখ সমর দেখে পুলিশ পিছু হটে, ফলে গত বছরটি মোটের উপর শান্তিপূর্ণই ছিল।

সাধারণত একএকটি গ্রামে ২০-২৫ ঘর মিলে একটি কুটুম্ভ। গ্রামের প্রত্যেকেই যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের মতামত নিশ্চিন্তে জানাতে পারেন তাঁরা। এখানে কোনও দলপতি নেই এবং যোগ্যতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে কোন প্রস্তাব গৃহীত হয়।

PHOTO • Parul Abrol
PHOTO • Parul Abrol

বাঁদিক: ইন্দিরা আবাস যোজনার অধীনে বিসমকটক ব্লকে বাড়ি তৈরি হচ্ছে, আর এটা হচ্ছে কোন্ধ মহিলাদের দাবি মেনে তাঁদের পারম্পরিক কৌম পরিকল্পনা অনুসারেই ডানদিকে: কোন্ধ বাড়িতে শস্যবীজ সংরক্ষণ: এই সমাজে শস্যবীজ-ই হল মহার্ঘ্যতম বস্তু

সামাজিক অধিকার থেকে শুরু করে প্রাণের লালনপালনের মতো নানান দিক - রায়াগাড়ার নারীরা সবেতেই অগ্রগামী। বিয়ের ক্ষেত্রেও স্বাধীনভাবে সঙ্গী নির্বাচন করতে পারেন। তাছাড়া কোনও মহিলার স্বামী যদি তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, বা কোন বিবাহিত মহিলা যদি অন্য কারও প্রেমে পড়েন, তিনি অনায়াসে স্বামীকে ছেড়ে দিতে পারেন কোনওরকম নিন্দামন্দের ভয় ছাড়াই । গার্হস্থ্য হিংসা বা ঝগড়া বিবাদের ক্ষেত্রে কুটুম্ভ হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে, কিন্তু সেই বিয়েতে থাকা অথবা না থাকার সিদ্ধান্ত মহিলারাই নেন।

এই এলাকার একজন দোভাষী জগন্নাথ মাঞ্ঝি নিজের কিশোর বয়সের একটি ঘটনার কথা মনে করে বলছিলেন, রাতপাহাররা জন্য মাঠে যে মাচাখানা ছিল সেটির মেরামেতির জন্য তিনি জঙ্গলে পাতা সংগ্রহ করতে গেছিলেন। বনবিভাগের রক্ষীরা তাঁকে ধরে থানায় নিয়ে যায় এবং দাবি করতে থাকে তিনি যা করেছেন তা নাকি বেআইনি। মাঞ্ঝির মা এতে ভীষণ রেগে গিয়ে থানায় ধর্না দেওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের জড়ো করেন। যতক্ষণ না তাঁর ছেলেকে ছাড়া হচ্ছে, ততক্ষণ তিনি পুলিশদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা চালিয়ে গেছিলেন।

মহিলাদের সামাজিক অবস্থান গ্রামের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা থেকেও প্রতিফলিত হয়। গ্রামটির কাঠামো এমনই যাতে পরিবার এবং কৌম জীবনের মধ্যে নিরন্তর আদানপ্রদান বজায় থাকে। কয়েক বছর আগে সরকার ইন্দিরা আবাস যোজনার অধীনে পাকা (স্থায়ী) বাড়ি তৈরির ব্যবস্থা চালু করে, তখন সরকারি স্থপতিদের স্বতন্ত্র বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল যাতে সেগুলি পরস্পরের মুখোমুখি না হয়। মহিলারা আপত্তি তুললেন এই বলে এতে গ্রামের নিজস্ব যে প্রথাগত পরিকল্পনা আছে, সেটি নষ্ট হবে। সরকার পারম্পরিক গঠন অনুযায়ী বাড়ি বানানোর কাজে সম্মত হলে তবেই তাঁরা আবার গৃহনির্মাণের কাজ শুরু করার অনুমতি দেবেন।

কোন্ধ বাড়িতে মহার্ঘ্যতম জিনিসটি হল শস্যবীজ। এই ব্যাপারে সমাজের নারীদের একচেটিয়া এক্তিয়ার। মেয়েদের কাজের মধ্যে থাকে বীজ বাছাই, পরের বছরের জন্য বীজ সংরক্ষণ, দেবতার প্রতি বীজার্ঘ্য নিবেদন এবং পরের বছর বীজ বপনের সময় ঠিক মাপ মতো পুরুষদের হাতে বীজের জোগান দেওয়া। বীজের সঙ্গে মহিলাদের নিবিড় সম্পর্কটি কোন্ধ সমাজে নারীর মর্যাদা এবং বিশিষ্টতার একটি সূচক।

PHOTO • Parul Abrol

মুনিগুড়া ব্লকের দুলারি গ্রামের শ্রীমতি দুদুকা: খাদ্য এবং শস্যের বলেই নারীরা কোন্ধ সংস্কৃতি তথা বাস্তুতন্ত্রের রক্ষক হয়ে উঠেছেন

মুনিগুড়া ব্লকের দুলারি গ্রামের শ্রীমতি দুদুকা (৫৫) বলছেন, “প্রকৃতি মাতা সময়ে সময়ে আমাদের বীজ দেন – এ তাঁর ফল যা তিনি আমাদের দিচ্ছেন। আমরা পড়শি গ্রামের বীজের পুজো করি না – বীজ জন্মাবে আমাদের নিজের মাটিতে। এভাবেই তো মাটি নিজেকে শোধন করে আর ভবিষ্যতে পুনর্বার দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। আমরা মাটির অসম্মান করতে পারি না।“

খাদ্য এবং বীজের বলেই মহিলারা কোন্ধ কৃষ্টির রক্ষক হয়ে উঠেছেন। যেমন ধরুন মিলেট বা রাগি হল কোন্ধ খাদ্যতালিকার অত্যাবশ্যক উপাদান। এই অঞ্চলের স্থানীয় শস্যগুলির প্রসার ও সংরক্ষণের কাজে নিযুক্ত লিভিং ফার্মস নামের একটি অসরকারি সংস্থার সদস্য দেবজিৎ সারঙ্গী বললেন, “মহিলারা বহু বিপন্ন ও মূল্যবান খাদ্যশস্য নিয়মিত রান্না করে তাঁদের বাচ্চাদের খাইয়ে সেগুলিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাচ্ছেন, সন্তানদের সেসব শস্যের কদর বোঝাচ্ছেন এবং শস্যকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে আগামী কৃষিচক্রের জন্য সঞ্চয় করছেন। এভাবে, একদিকে যেমন তাঁরা বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত নির্দিষ্ট জাতের ফসল রক্ষা করছেন, তেমনই আবার এটি তাদের স্বনির্ভরতায় সহায় হচ্ছে।“

জানি, দেশারি, বেজুনি হলেন কুটুম্ভের তিনজন প্রধান প্রধান পদাধিকারী। প্রায় সর্বদাই কোনও মহিলাই থাকেন বেজুনির ভূমিকায়। জানি উৎসব এবং পুজোপাঠের সময় আচার অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনা করেন। দেশারি দেশজ ওষুধপত্র এবং আবহাওয়া চক্রের সব খবরাখবর রাখেন। বেজুনি গ্রামের ওঝা (উপরের প্রচ্ছদচিত্রে বাঁদিকে)। সময়ে সময়ে তাঁর ভর ওঠে, তখন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেবতার কাছ থেকে প্রাপ্ত বার্তার মাধ্যমে তিনি আসন্ন বিপদ ও মহামারি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেন এবং পুরুষদের শিকারে যাওয়ার আগে দিশানির্দেশ দেন।

আশ্চর্যের এটাই, যেখানে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মহিলাদের যাবতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, সেখানে কোন্ধ সমাজে মহিলারা দেবতার বার্তাবাহকের ভূমিকা পালন করেন।

অনুবাদ: দেবাদৃতা বিশ্বাস
অনুবাদ সম্পাদনা: স্মিতা খাটোর

Parul Abrol

پارل ابرول نئی دہلی میں مقیم ایک آزادی صحافی ہیں۔ وہ ہندوستان ٹائمز اور آئی اے این ایس کے علاوہ دیگر کئی تنظیموں کے ساتھ کام کر چکی ہیں۔ وہ تصادمی اور ترقیاتی امور پر لکھتی ہیں، اور اس وقت کشمیر کی سیاسی تاریخ پر ایک کتاب لکھ رہی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Parul Abrol
Editors : Laxmi Murthy
Editors : Sharmila Joshi

شرمیلا جوشی پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا کی سابق ایڈیٹوریل چیف ہیں، ساتھ ہی وہ ایک قلم کار، محقق اور عارضی ٹیچر بھی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز شرمیلا جوشی
Translator : Debadrita Biswas

Debadrita Biswas: Debadrita Biswas is a Post-Graduate in Comparative Indian Languages and Literatures from University of Calcutta. Her areas of interest include Translation Studies, Gender Studies, Feminism, Dalit literature, Partition literature and folk literature.

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Debadrita Biswas