গরিব হও বা বড়োলোক, বুড়ো বা বাচ্চা, জুতো-টুতো খুলে মহারাজের পা ছোঁয়ার নিয়মটা সক্কলের জন্য খাটতো। অথচ শীর্ণ সেই যুবকটি ঝুঁকবেন না বলে দেন, মহারাজের চোখে চোখ রেখে শালপ্রাংশু-সম দাঁড়িয়েছিলেন। রাজাবাবু দোর্দণ্ডপ্রতাপ, গায়ের জোরে ভিন্নমত গুঁড়িয়ে দেওয়ায় বিশেষ নামডাক আছে, তেনার সামনে এমন বেপরোয়া হিম্মত দেখানোয় পঞ্জাবের জোগা গাঁয়ের মোড়লদের রাতের ঘুম ছুটে গেছিল। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন রাজাধিরাজ।

যুবকের নাম জাগির সিং জোগা। তাঁর সেই নির্ভীক একক বিদ্রোহের নয় দশক পর আজ সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সের (সিআইএসএফ) কনস্টেবল কুলবিন্দর কৌর সপাটে চড় কষালেন মান্ডির (হিমাচল প্রদেশ) সাংসদ কঙ্গনা রানৌতের গালে। ওদিকে জোগা সাহেব যাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি ছিলেন পাতিয়ালার রাজা ভুপিন্দর সিং — এঁর অধীনে থাকা সামন্তরা গরিব চাষাভুষোর জমিজমা সব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাত। সেটা ছিল ১৯৩০-এর দশক। তার ঠিক পরপর যা ঘটেছিল তা লোককথা ও প্রামাণ্য ইতিহাসের দোলাচলে বিলীন। তবে জাগির সিং জোগার লড়াইটা কিন্তু সেখানেই থেমে যায়নি।

এক দশক পর, তৎকালীন লাল পার্টির কমরেডদের সঙ্গে মিলে কিষাণগড়ে (অধুনা সাঙ্গরুর জেলার অংশ) এক যুগান্তকারী বিপ্লব সংঘটিত করেন জোগা সাহেব — মহারাজ ভুপিন্দর সিংয়ের ছেলের হাত থেকে ৭৮৪টি গ্রামের হাজার হাজার একর জমিন কেড়ে তাঁরা ভূমিহীনদের বিলিয়ে দেন। সেই রাজবংশের বর্তমান কুলপ্রদীপ, পঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কাপ্তান অমরিন্দর সিং হলেন ভুপিন্দর সিংয়ের আপন নাতি।

সালটা ১৯৫৪, উপরোক্ত জমি-আন্দোলন তথা নানান বৈপ্লবিক কার্যকলাপের খেসারত স্বরূপ তখন নভা জেলে কয়েদ জাগির সিং জোগা — আটক অবস্থাতেই তিনি বিধানসভা নির্বাচন জেতেন। তারপর ১৯৬২, ১৯৬৭ ও ১৯৭২ সালেও বিধায়ক পদ জিতে অব্যাহত থাকে তাঁর জয়যাত্রা।

PHOTO • Jagtar Singh

বাঁদিকে: ১৯৩০-এর দশকে জাগির সিং জোগা পাতিয়ালার রাজা ভূপিন্দর সিংয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন — রাজার অধীনে থাকা সামন্তরা গরিব চাষাভুষোর জমিজমা সব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাত। ডানদিকে: জুন ২০২৪, সদ্য নির্বাচিত সাংসদ কঙ্গনা রানৌতের বিরুদ্ধাচরণ করলেন সিআইএসএফ কনস্টেবল কুলবিন্দর কৌর

“পঞ্জাবের জল-মাটি ইনকিলাবে পুষ্ট। পঞ্জাবে ব্যক্তিগত বিদ্রোহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বতঃস্ফূর্ত, আর এ সিলসিলায় কুলবিন্দর কৌর সাম্প্রতিকতম নজির — এ সিলসিলার শুরু যেমন জোগা সাহেবকে দিয়ে হয়নি, কুলবিন্দর কৌরকে দিয়ে তা শেষও হবে না,” জাগির সিং জোগার জীবনচরিতকার জগতার সিং জানাচ্ছেন। ইনকিলাবি যোদ্ধা: জাগির সিং জোগা গ্রন্থের রচয়িতা জগতার সিং একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।

মূলত ছাপোষা পরিবারের সাধারণ মানুষেরাই পঞ্জাবের এই স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তিগত বিদ্রোহের উৎস। সিআইএসএফ কনস্টেবল কুলবিন্দর কৌর এক সাদামাটা চাষিবাড়ির মানুষ, ভদ্রাসন কাপুরথালা জেলার মাহিওয়াল গ্রামে। কুলবিন্দরের মতে কঙ্গনা রানৌত যাঁকে নিয়ে অসভ্যের মতো ঠাট্টা করেছেন, সেই বীর কৌর, অর্থাৎ কুলবিন্দরের মা আজও চাষ করেন।

জোগা সাহেবের আগে এ সিলসিলায় সামিল ছিলেন প্রেমদত্ত বর্মা। ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯-৩০) চলাকালীন আদালতের ভিতর জয় গোপাল নামে এক বিশ্বাসঘাতক প্রাক্তন কমরেডকে চপ্পল ছুঁড়ে মারেন বর্মা সাহেব। “ঘটনাটা মোটেও পরিকল্পিত ছিল না, বর্মা সাহেব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। মামলা চলাকালীন ব্রিটিশরা অন্যান্য অভিযুক্তদের সঙ্গে বর্মা সাহেবের উপরেও অকথ্য অত্যাচার চালায়,” ভগৎ সিং রিডারের লেখক অধ্যাপক চমন লাল জানালেন।

মামলার নামে প্রহসন শেষ হওয়ায়, ২৩ মার্চ ১৯৩১ সালে দুই কমরেড-সহ ভগৎ সিংকে ফাঁসিতে চড়ানো হয়। (ওই দলের কনিষ্ঠতম ছিলেন প্রমদত্ত বর্মা, তাঁর পাঁচ বছরের জেল হয়েছিল)। এর ঠিক একবছর পর, শাহাদাতের প্রথম বার্ষিকী যাপন ও ইংরেজদের জারি করা শুট-অ্যাট-সাইট আদেশের চরম প্রতিবাদে হোশিয়ারপুর জেলা আদালতের চূড়া থেকে ব্রিটিশদের পতাকা ছিঁড়ে ফেলে তেরঙ্গা উড়িয়েছিলেন ১৬ বছর বয়সি হরকিষণ সিং সুরজিৎ।

“আদতে ইউনিয়ন জ্যাক উপড়ে ফেলার ডাকটা কংগ্রেস পার্টি দিলেও সেটাকে বাস্তবায়িত করতে তারা গড়িমসি করছিল। সুরজিৎ এই কাজটা স্বেচ্ছায় করেছিলেন, বাদবাকিটা আজ ইতিহাসের অংশ,” স্থানীয় এক ইতিহাসবিদ আজমের সিধু জানাচ্ছেন পারিকে। বহু দশক বাদে স্মৃতিচারণ করতে করতে হরকিষণ সিং সুরজিৎ বলেছিলেন: “সেদিন যেটা করেছিলাম, তা নিয়ে আমার আজও গর্ব হয়।” সে ঘটনার ছ’দশক পর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী) সাধারণ সম্পাদক হন হরকিষণ সিং সুরজিৎ।

PHOTO • Daily Milap / courtesy Prof. Chaman Lal
PHOTO • Courtesy: Prof Chaman Lal

লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ঘিরে দ্য ডেইলি মিলাপে ১৯৩০এর দশকে ছাপা পোস্টার (বাঁদিকে)। ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে কোর্ট-কেস চলাকালীন বিশ্বাসঘাতক প্রাক্তন কমরেড জয় গোপালকে চপ্পল ছুঁড়ে মারেন প্রেমদত্ত বর্মা (ডানদিকে)

PHOTO • Courtesy: Amarjit Chandan
PHOTO • P. Sainath

বাঁদিকে: ১৯৩২ সালে, মোটে ১৬ বছর বয়সে হোশিয়ারপুর জেলা আদালতের চূড়া থেকে ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে তেরঙ্গা উড়িয়েছিলেন হরকিষণ সিং সুরজিৎ। এই ছবিটি ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭-এ তোলা, তখন সবে সবে পঞ্জাবের ফিল্লৌর বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন কমরেড সুরজিৎ। ডানদিকে: ঝুগ্গিয়াঁ সাহেবের সঙ্গে তাঁর রামগড়ের বাড়িতে কিংবদন্তি বিপ্লবী শহীদ ভগৎ সিংয়ের ভাগ্নে অধ্যাপক জগমোহন সিং (নীল পোশাকে)

১৯৩২ সালের পতাকা-কাণ্ডের কয়েক বছর পর, সুরজিতের এক অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সি কমরেড মোটে ১১ বছর বয়সে অত্যন্ত নাটকীয় এক ব্যক্তিগত বিদ্রোহের উদাহরণ দেন। তাঁর নাম ভগৎ সিং ঝুগ্গিয়াঁ। ক্লাস থ্রিয়ে প্রথম হয়ে প্রাইজ পেয়েছেন ঝুগ্গিয়াঁ সাহেব, শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদস্থ এক বাবু এসেছেন তাঁকে পুরস্কার দিতে। কিন্তু বাধ সাধে অফিসারবাবু তাঁকে চিৎকার করে ‘ব্রিটানিয়া জিন্দাবাদ, হিটলার মুর্দাবাদ’ বলতে বলায়। তার বদলে ছোট্ট ঝুগ্গিয়াঁ দর্শকদের দিকে ফিরে গর্জে ওঠেন: “ব্রিটানিয়া মুর্দাবাদ, হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ!”

পত্রপাঠ তাঁকে মেরেধরে বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, এ জীবনে আর কখনও স্কুলমুখো হননি। তবে জিন্দেগির অন্তিম লগ্ন অবধি সে প্রতিবাদের জন্য গর্ব বোধ করেছেন ভগৎ সিং ঝুগ্গিয়াঁ। ২০২২ সালে, ৯৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার বছরখানেক আগে তিনি পারি’র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক পি. সাইনাথের সঙ্গে কথা বলেছিলেন — তাঁর কাহিনি জানতে হলে পড়ুন: হাজারো মুক্তি সংগ্রামের শরিক ভগৎ সিং ঝুগ্গিয়াঁ

এই একই আবেগ প্রতিফলিত হল এবছর ১২ জুন, কুলবিন্দর কৌরের দাদা শের সিং মাহিওয়াল (ছ’একর জমির মালিক) যখন বোনের সঙ্গে মোহালিতে দেখা করার পর মিডিয়ার সম্মুখীন হয়ে জোরগলায় জানান দিলেন: “বোন বা আমরা - কেউই বোনের কাজে লজ্জিত নই। সুতরাং ক্ষমা চাওয়ার কোনও সওয়ালই নেই।”

পঞ্জাবের সাম্প্রতিক ইতিহাসও অনুরূপ ব্যক্তির একক বিদ্রোহে জারিত। ২০১৪ সালে কৃষক আত্মহত্যা, মাদকের বাড়বাড়ন্ত ও লাগামছাড়া বেকারত্বে ধুঁকছিল পঞ্জাবের তুলো-বলয়। কোত্থাও কোনও আশার আলো না দেখতে পেয়ে শেষমেশ নিজের গাঁ থেকে ১০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে খান্না শহরে পৌঁছন বিক্রম সিং ধানৌলা — কথা ছিল, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদল ১৫ অগস্ট সেখানে পতাকা উত্তোলন করবেন।

PHOTO • Courtesy: Vikram Dhanaula
PHOTO • Shraddha Agarwal

২০১৪ সালে, কর্মহীন যুবসমাজ ও সংকটাপন্ন চাষিদের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলার প্রতিবাদে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদলকে লক্ষ্য করে জুতো ছুঁড়ে মারেন বিক্রম সিং ধানৌলা (বাঁদিকে)। ২০২০-২১-এর কৃষক-আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন পঞ্জাবের মহিলা চাষিরা (ডানদিকে)

মুখ্যমন্ত্রী সবে সবে তাঁর ভাষণ আরম্ভ করেছেন, তাঁকে লক্ষ্য করে জুতো ছুঁড়ে মারেন ধানৌলা সাহেব। “খুব সহজেই ব্যাটার মুখে মারতে পারতাম, তবে ইচ্ছে করেই জুতোটা মঞ্চে ছুঁড়েছিলাম। অগুনতি বেকার যুবক-যুবতী, আর নকল বীজ ও কীটনাশকের বিক্রি যেসব চাষিদের বাধ্য করেছে আত্মহননের পথ বেছে নিতে, আমি চেয়েছিলাম উনি যেন তাঁদের অব্যক্ত কথাগুলো কান পেতে শোনেন।”

সে ঘটনায় ২৬ দিন জেল খাটা বিক্রম সিং ধানৌলা আজও বার্নালা জেলার ধানৌলা গ্রামে বাস করেন। তিনি বুঝি তাঁর কার্যকলাপের জন্য অনুতপ্ত? “কুলবিন্দর কৌর যেটা করেছেন, বা আমি যা ১০ বছর আগে করেছিলাম, ইনসান কোত্থাও কোনও উমিদ খুঁজে না পেলে তবেই গিয়ে এরকম একটা পদক্ষেপ নেয়,” পারিকে জানালেন তিনি। ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে বর্তমানের বিজেপি সরকার, সময় পাল্টালেও একক কিছু মর্মভেদী কণ্ঠস্বর বেঁচে থাকে যারা ফলাফলের পরোয়া না করে নিজ নিজ লক্ষ্যে অনড়, প্রত্যেকেই নিজের মতো করে অঙ্গীকারবদ্ধ।

২০২০ সালে পঞ্জাবের সঙ্গে কঙ্গনা রানৌতের সমীকরণটা নতুন ভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কৃষক-আন্দোলন তুঙ্গে, শেষ অবধি ১৯ নভেম্বর ২০২১-তারিখে রদ হওয়া তিনটি বিতর্কিত কৃষি-আইনের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মহিলারা তখন প্রতিরোধে নেমেছেন — আর সেসকল মেয়েদের অভব্য ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন কঙ্গনা। “হাহাহা ও তো সেই দাদি যার কিনা টাইম পত্রিকায় ছবি বেরিয়েছিল সবচাইতে ক্ষমতাশালী ভারতীয় হিসেবে...আর ওর দাম তো মোটে ১০০ টাকা,” টুইট করেছিলেন মাণ্ডির বর্তমান সাংসদ।

বোঝাই যাচ্ছে, কঙ্গনার কথাগুলো পঞ্জাবের জনসাধারণ একটুও ভোলেনি। “ওর [কঙ্গনা রানৌত] বক্তব্য ছিল যে চাষিদের ১০০-২০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে বলেই তাঁরা দিল্লিতে প্রতিবাদ করছেন। সেসময় আমার আম্মাও সেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছিলেন,” ৬ জুন কুলবিন্দর কৌর এই কথাটা বলায় দু’বছর আগে কঙ্গনার সেই কটুক্তিগুলি আবারও জনপরিসরে ঘুরপাক খেতে থাকে। মজার কথা, কুলবিন্দর কঙ্গনাকে ঠাঁটিয়ে চড় মারছেন, এই ভিডিও ফুটেজটা কিন্তু আজ অবধি কেউ স্বচক্ষে দেখেছে বলে দাবি করেননি। তবে হ্যাঁ, যা-ই হয়ে থাক না কেন, সেটা কিন্তু ৬ জুন মোটেও শুরু হয়নি।

ডিডিওটি দেখুন: কঙ্গনার কদর্য কথায় রেগে যাওয়ার আগের কাহিনি

মূলত ছাপোষা পরিবারের সাধারণ মানুষেরাই পঞ্জাবের এই স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তিগত বিদ্রোহের উৎস

৩ ডিসেম্বর ২০২১, চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে ঘটিত ‘চপেটাঘাত’ বা ‘স্ল্যাপগেট’-এর বহু আগে কঙ্গনা রানৌত মানালি থেকে ফেরার পথে পঞ্জাবে ঢোকামাত্র এ রাজ্যের মহিলা চাষিরা তাঁর গাড়ি আটকে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। উপরোক্ত বক্তব্যের জন্য মাফি চাওয়া ছাড়া কঙ্গনার কাছে আর কোনও উপায় ছিল না। আজকের এই চলতি ঝামেলাতেও ইজ্জত তথা পারিবারিক মর্যাদার মতো গুরুগম্ভীর বিষয়ের সঙ্গে যুঝছেন কুলবিন্দর কৌর, দাদা শের সিং মাহিওয়াল ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনেরা।

শের সিং পারিকে জানাচ্ছেন: “বহু প্রজন্ম ধরেই আমার পরিবার সুরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। কুলবিন্দরের আগে আমার ঠাকুর্দা-সহ ওবাড়ির পাঁচজন সদস্য সেনাদলে চাকরি করেছেন। ঠাকুর্দার পাঁচ ছেলের মধ্যে তিনজন ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিলেন। এদেশের জন্য তাঁরা ১৯৬৫ আর ১৯৭১-এর যুদ্ধে লড়েছেন। এতকিছুর পরও আপনার মনে হয় যে কঙ্গনার মতো কোনও লোকের থেকে দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট লাগবে আমাদের, যে কিনা কথায় কথায় আমাদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেয়?”

কুলবিন্দর কৌরকে তাঁর কর্মদায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া হয়েছে। ৩৫ বছরের কুলবিন্দরের স্বামীও সিআইএসএফ কনস্টেবল, তাঁদের দুটি সন্তান আছে — মেয়ের বয়স ৯, ছেলের ৫। যে কোনও মুহূর্তে তাঁর চাকরি যেতে পারে। অথচ পঞ্জাবকে যাঁরা জানেন তাঁরা একটা কথা হলফ করে বলবেন: ব্যক্তিগত বিদ্রোহে সামিল ইনসান তার নিজ সংগ্রামের শত খেসারত দিলেও উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের বীজ বপন করে যায়। “জোগা এবং কৌর দুজনেই আমাদের জীবন্ত খোয়াবের প্রতীক,” সিপিআই পার্টির প্রাক্তন বিধায়ক হরদেব সিং অর্শি বললেন, ইনি ছয় দশক আগে প্রথম জাগের সিং জোগার সংস্পর্শে এসেছিলেন। হরদেব সাহেব দাতেওয়াস গাঁয়ের মানুষ, জোগা থেকে যেটা ২৫ কিলোমিটার দূরে। দুটো গ্রামই আজ মানসা জেলার অন্তর্গত।

নভা জেলে থাকতে থাকতেই ১৯৫৪ সালে ভোটে জিতে পঞ্জাবের বিধানসভায় যান জোগা সাহেব। হরকিষণ সিং সুরজিৎ, ভগৎ সিং ঝুগ্গিয়াঁ, প্রেমদত্ত বর্মা প্রত্যেকেই পঞ্জাবের ব্যক্তির একক বিদ্রোহের সুদীর্ঘ ইতিহাস তথা সংগ্রামী লোককথার শরিক।

ভিডিওতে দেখুন: চড়কাণ্ড নিয়ে বক্তব্য রাখছেন কুলবিন্দর কৌরের দাদা শের সিং মাহিওয়াল

ব্যক্তিগত বিদ্রোহে সামিল ইনসান তার নিজ সংগ্রামের শত খেসারত দিলেও উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের বীজ বপন করে যায়

কুলবিন্দর কৌরের সমর্থনে ইতিমধ্যেই পঞ্জাব ও হরিয়ানা জুড়ে একাধিক মিছিল ও পদযাত্রা সংঘটিত হয়েছে, এখনও হয়ে চলেছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউ চড় মারাটাকে উদযাপিত করছেন না, কেউ এটাও বলছেন না অমনটা করা সঠিক ছিল। বরং পঞ্জাবের কৃষক সমাজের সম্মান ও সততা রক্ষার্থে এক প্রভাবশালী তারকা ও সাংসদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন এক সামান্য কনস্টেবল — মানুষ এভাবেই ঘটনাটাকে দেখছেন। সহজ ভাষায় বলতে গেলে তাঁদের নজরে কুলবিন্দরের চড় মারাটা পঞ্জাবের ব্যক্তির একক বিদ্রোহের সুদীর্ঘ পরম্পরার মধ্যেই পড়ে।

রাজ্য জুড়ে এই ঘটনার জেরে জন্ম নিয়েছে সংখ্যাতীত কবিতা, গান, মিম ও কার্টুন। আজ এ প্রতিবেদনের সঙ্গে তেমনই একটি কবিতা প্রকাশ করছে পারি। কবি স্বরাজবীর সিং, একজন বিখ্যাত নাট্যকার তথা পঞ্জাবি ট্রিবিউনের প্রাক্তন সম্পাদক।

খেতাব, আইনি সহায়তা ও প্রতিবাদের মধ্যেই কুলবিন্দর কৌর হয়তো সিআইএসএফে তাঁর চাকরিটা খোওয়াবেন। কিন্তু রাজ্যের পাঁচ-পাঁচটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন আসন্ন, জোগা সাহেবের মতো হয়তো তাঁর জন্যও পঞ্জাবের বিধানসভায় আরও বড়ো একটি কাজ পথ চেয়ে বসে আছে। পঞ্জাবের বহু মানুষের আশা, কুলবিন্দর কৌর ভোটে লড়বেন।

PHOTO • PARI Photos

বাঁদিকে: চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে কুলবিন্দর কৌর, চড়কাণ্ডের ঠিক পরেই। ডানদিকে: ৯ জুন ২০২৪, কঙ্গনার বিরুদ্ধে ও কুলবিন্দরের স্বপক্ষে মোহালিতে মিছিল

___________________________________________________

আম্মা আমার আম্মা

স্বরাজবীর

আম্মা আমার আম্মা —
তুঁহার হিয়ায় কীই বা আছে, বল্ না আমায় আম্মা।
আমার ভিতর আগুন পাহাড় ঝলসে ওঠে দ্যাখ্ না।

বল্ না কারা আসতে যেতে চাপড় মেরে যাচ্ছে?
সড়ক-গলি লুটছে কারা,
পর্দা জুড়ে কাদের আওয়াজ দু’কান জুড়ে ফাটছে?

খ্যামতাবানের চড়-চাপাটি সহ্য করে বাঁচা।
কাঙাল মোরা, দুনিয়াজোড়া দুঃখজ্বালার খাঁচা।
রাষ্ট্র, তাহার প্রতিশ্রুতি, ঝুঠাই সেতো জানা,
রাষ্ট্র যদি দেয় গো কথা, রাখতে সে পারবে না।

কিন্তু জানি কয়েকসময়,
হাজার যুগের শেষে
গর্জে ওঠে কাঙাল মেয়ে, হাজার মারের দেশে।
পাঁজর জুড়ে ছুটছে আবেগ, উঠছে তাহার মুঠি,
দুহাত নেড়ে শয়তানেরে দিচ্ছে এবার ছুটি।

চাপড়, ঘুষি — হিংসা তো নয়
আম্মা ওরে আম্মা।
বুকভরা মোর কান্না এ যে,
গর্জে ওঠার বায়না এ যে, এইটুকুনি বোঝ্ না।

কেউ বা বলে এটাই জায়েজ,
কেউ বা বলে গুনাহ্।
ভদ্র, নাকি বেআব্রু সে? নেইকো আমার জানা।
হৃদয়খানি কাঁদছে আমার, কাঁদছে অঝোর ঝরে,
কাঁদছে আমার হৃদয়খানি, কাঁদছে তুঁহার তরে।

খ্যামতাবানের হুমকি ধমক, হাজার জোরাজুরি,
খ্যামতাবানের চাঁদমারিতে তুঁহার বেরাদরি।
সেই তাদেরই খলনুড়িতে আমার হৃদয়খানি
ধানের মতো গুঁড়িয়ে গেল, রক্ত হল পানি।

আম্মা, এটাই হৃদয় আমার,
পাঁজর ভরা কান্না,
কেউ বা বলে সঠিক তারে
কেউ বা বলে গুনাহ্।
কাঁদছে সেতো কাঁদছে জানি, কাঁদছে তুঁহার তরে।
কেউ বা দাগায় হারাম তারে,
কেউ বা হালাল বলে।

কিন্তু এ যে হৃদয় আমার, আম্মা ওগো আম্মা।
স্পর্ধা, সাহস, বড্ড ব্যথা,
বলছে তুঁহার হকের কথা, দু’কান খুলে শোন্ না!

(পঞ্জাবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন চরণজিৎ সোহাল)

স্বরাজবীর একজন নাট্যকার, সাংবাদিক এবং পঞ্জাবি ট্রিবিউনের প্রাক্তন সম্পাদক।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Vishav Bharti

وشو بھارتی، چنڈی گڑھ میں مقیم صحافی ہیں، جو گزشتہ دو دہائیوں سے پنجاب کے زرعی بحران اور احتجاجی تحریکوں کو کور کر رہے ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Vishav Bharti

پی سائی ناتھ ’پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا‘ کے بانی ایڈیٹر ہیں۔ وہ کئی دہائیوں تک دیہی ہندوستان کے رپورٹر رہے اور Everybody Loves a Good Drought اور The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom کے مصنف ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز پی۔ سائی ناتھ
Illustration : Antara Raman

انترا رمن سماجی عمل اور اساطیری خیال آرائی میں دلچسپی رکھنے والی ایک خاکہ نگار اور ویب سائٹ ڈیزائنر ہیں۔ انہوں نے سرشٹی انسٹی ٹیوٹ آف آرٹ، ڈیزائن اینڈ ٹکنالوجی، بنگلورو سے گریجویشن کیا ہے اور ان کا ماننا ہے کہ کہانی اور خاکہ نگاری ایک دوسرے سے مربوط ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Antara Raman
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کے ہندوستانی زبانوں کے پروگرام، پاری بھاشا کے کانٹینٹ مینیجر ہیں۔ انہوں نے کولکاتا کی جادوپور یونیورسٹی سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک کثیر لسانی شاعر، ترجمہ نگار، فن کے ناقد اور سماجی کارکن ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra