লোকসভা নির্বাচন ২০২৪। বাবলু কৈবর্তের ভোট দেওয়ার দ্বিতীয় সুযোগ।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যখন বাবলু কৈবর্ত ভোট দিতে যান, তখন তাঁকে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। পুরুলিয়ার পলমা গ্রামের পোলিং বুথে ঢুকে তো পড়লেন বাবলু, কিন্তু ভেতরে গিয়ে দেখেন ভোট দেবেন কেমন করে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না।

২৪ বছর বয়সি বাবলু দৃষ্টিশক্তিরহিত প্রতিবন্ধী। যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট হচ্ছিল, সেখানে না ছিল ব্রেইল ব্যালট। না ছিল ব্রেইল ইভিএম।

“কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে ভোট দিতে সাহায্য করবেন যে ব্যক্তি, তিনি যদি প্রতীকগুলো নিয়ে মিথ্যে কিছু বলেন?” প্রশ্ন করলেন দ্বিতীয় বর্ষের স্নাতক ছাত্র বাবলু। আর যদি বা সত্যি কথাই বলেন, গোপন ব্যালটের অধিকার তবু তো খর্বই হচ্ছে, বললেন বাবলু। একটু ভয়ে ভয়েই শেষ অবধি বোতাম টিপেছিলেন বাবলু। তারপর বাইরে এসে যাচাই করে নিয়েছিলেন। “ভাগ্য ভালো, উনি আমাকে মিথ্যে বলেননি,” জানাচ্ছেন বাবলু।

ভারতের নির্বাচন কমিশান জানাচ্ছে প্রতিবন্ধী-বান্ধব বুথে ব্রেইল ব্যালট এবং ইভিএম-এর বন্দোবস্ত থাকতে হবে। “ব্যবস্থা তো অনেকই আছে,” বলছেন শম্পা সেনগুপ্ত, কলকাতার শ্রুতি ডিজেবিলিটি রাইট্‌স সেন্টারের ডিরেক্টর। “কিন্তু কার্যকরী হচ্ছে কই?”

চার বছর পেরিয়ে এসে আবার ভোট দেওয়ার পালা। কিন্তু বাবলু ২০২৪ সালের নির্বাচনে ২৫ মে ভোট দিতে বাড়ি ফিরবেন কিনা তা এখনও ঠিক করে উঠতে পারেননি।

PHOTO • Prolay Mondal

২৫ মে ভোট দিতে বাড়ি যাবেন কিনা এখনও স্থির করেননি বাবলু কৈবর্ত। তবে দৃষ্টি-প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের জন্য ভোট দেওয়ার অব্যবস্থাই তার একমাত্র কারণ নয়। টাকা-পয়সার কথাও মাথায় রাখতে হবে তাঁকে

তবে এই অনিশ্চয়তার একমাত্র কারণ বন্দোবস্তের অভাব এমনটা নয়। কলকাতায় হস্টেলে থাকেন বাবলু। পুরুলিয়া যেতে ট্রেনে লাগে ছ-সাত ঘণ্টা।

“টাকা-পয়সার দিকটাও ভাবতে হবে। টিকিট কাটতে হবে, স্টেশনে যাওয়ার বাসের ভাড়াও আছে,” বললেন বাবলু। ভারতবর্ষে ২৬.৮ মিলিয়ন মানুষ প্রতিবন্ধী। তার মধ্যে ১৮ মিলিয়নের বাস গ্রামীণ ভারতে। উনিশ শতাংশ প্রতিবন্ধকতা দৃষ্টি-সংক্রান্ত (আদমসুমারি ২০১১)। তাঁদের জন্য যতটুকু পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তা বেশিরভাগই শহর-কেন্দ্রিক, জানালেন শম্পা সেনগুপ্ত। তাঁর মতে, “এই ধরনের সচেতনতা তৈরি করার জন্য নির্বাচন কমিশানকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে রেডিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, সেটাকে ব্যবহার করতে হবে।”

“কাকে ভোট দেব সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না,” যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পার্সেন্স উইথ ডিসেবিলিটিস-এর ঘরে বসে বললেন বাবলু।

“আমি হয়তো পার্টির কাজ বা নেতাদের কাজ বিবেচনা করে প্রার্থীকে ভোট দিলাম। ভোটের পর দেখলাম সে অন্য দলে চলে গেছে।” কিছুটা অভিযোগের সুর বাবলুর গলায়। গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০২১-এর বিধান সভা নির্বাচনের আগে, পশ্চিমবঙ্গের বহু নেতা দলবদল করেছেন, অনেকে একাধিকবার।

*****

স্কুল বা কলেজে পড়ানোর স্বপ্ন দেখেন বাবলু – সরকারি চাকরির নিশ্চিন্তি।

সম্প্রতি খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে রাজ্যের স্কুল সার্ভিস কমিশন। কারণগুলি খুব একটা ভালো নয়। হায়ার সেকেন্ডারি কাউন্সিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গোপা দত্ত নিজেও অধ্যাপনা করতেন। তিনি বলছেন, “চাকরি দেওয়ার প্রশ্নে একটা আশা-ভরসার জায়গা ছিল এই কমিশন, কারণ গ্রামেগঞ্জে, মফস্বলে, শহরে – সব জায়গাতেই স্কুল আছে। অনেকেই স্কুলে পড়াতে চাইতেন।”

PHOTO • Prolay Mondal

বাবলু বলছেন, ‘কাকে ভোট দেব সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না।’ তাঁর চিন্তা, যাঁকে ভোট দেবেন, সেই নেতা হয়তো ভোটের পর দলবদল করবেন। বিগত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এমন ঘটনা আকছার হচ্ছে

গত সাত-আট বছরে নিয়োগ প্রক্রিয়াতে দুর্নীতির কাহিনি চোখের সামনে দেখেছেন রাজ্যবাসী। ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছে টাকার বান্ডিল, মন্ত্রীরা জেল খাটছেন। প্রার্থীরা মাসের পর মাস বসে থেকেছেন শান্তিপূর্ণ অবস্থানে – তাঁদের দাবি, স্বচ্ছ ভাবে নিয়োগ হোক। সম্প্রতি প্রায় ২৫,০০০ চাকরি বাতিল করে দিয়েছে কলকাতার উচ্চ আদালত। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সেই রায়তে স্টে অর্ডার জারি করেছে বটে, কিন্তু একথাও বলা হয়েছে যে যোগ্য এবং অযোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করতে হবে।

“এসব দেখে ভয় হয়,” বলছেন বাবলু। “আমি শুনেছি ১০৪ জন দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী প্রার্থী ছিলেন। তাঁদের কথা কেউ ভাবছেন কি?”

তবে শুধু স্কুল সার্ভিস কমিশনের চাকরির ক্ষেত্রেই নয়, বাবলুর মতে সার্বিকভাবে প্রতিবন্ধকতা-যুক্ত মানুষের সম্পর্কে উদাসীনই থেকেছেন কর্তাব্যক্তিরা। “পশ্চিমবঙ্গে দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধীদের জন্য যথেষ্ট স্কুল নেই,” বলছেন বাবলু, “আমাদের ভিতটা শক্ত করার জন্য স্পেশাল স্কুল দরকার।” সুযোগের অভাবে বাড়ি ছেড়ে থাকতে হয়েছে বাবলুকে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তির সময় ভেবেছিলেন পুরুলিয়া ফিরবেন। কিন্তু সেটাও হয়ে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত। “আমি কোনও সরকারকেই কখনও প্রতিবন্ধকতা-যুক্ত মানুষের কথা বলতে বা ভাবতে শুনিনি,” বাবলু বললেন।

কিন্তু তবু আশাবাদী বাবলু। “চাকরি খোঁজার জন্য আমার হাতে এখনও কয়েক বছর সময় আছে,” তিনি বললেন, “আমি আশা রাখি দিন বদল হবে।”

২০১২ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাবলুর বাবা। ১৮ বছর বয়স থেকে পরিবারের হাল ধরেছেন বাবলুই। কৈবর্ত (রাজ্যে তফসিলি জাতি তালিকাভূক্ত) পরিবারের ছেলে বাবলুর বাড়িতে রয়েছেন মা সন্ধ্যা আর বোন বুনুরানি। তাঁদের প্রথাগত পেশা মাছ ধরা। বাবা মাছ ধরে বিক্রি করতেন। কিন্তু যেটুকু টাকা জমাতে পেরেছেন তার সবটাই চলে যায় চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে।

“মা আগে সবজি বেচতেন। কিন্তু এখন বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, আর পারেন না,” বাবলু বলছেন। মাসে মাসে এক হাজার টাকা করে বিধবা ভাতা পাচ্ছেন সন্ধ্যা। “গত বছরের অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস থেকে পেতে শুরু করেছেন,” বাবলু জানালেন।

PHOTO • Antara Raman

‘আমি কোনও সরকারকে কখনও প্রতিবন্ধকতা-যুক্ত মানুষের কথা বলতে বা ভাবতে শুনিনি’

নিজের উপার্জনের উৎস বলতে ট্যুইশনি আর পুরুলিয়ার স্টুডিওর জন্য সুর বেঁধে দেওয়া। এছাড়া মানবিক পেনশন স্কিমে মাসে মাসে হাজার টাকা। ছোটোবেলা থেকে গান শিখেছেন বাবলু। বাঁশি আর সিন্থেসাইজার বাজাতে পারেন। পরিবারেই সংগীত চর্চার একটা ধারা ছিল। “আমার ঠাকুর্দা রবি কৈবর্ত পুরুলিয়ার বেশ নামকরা লোকশিল্পী ছিলেন, বাঁশি বাজাতেন।” যদিও বাবলুর জন্মের অনেক আগেই তিনি মারা গেছে, বাবলু কিন্তু মনে করেন সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ঠাকুর্দার থেকেই পাওয়া। বাবলু বলছেন, “আমার বাবাও একই কথা বলতেন।”

পুরুলিয়ায় থাকার সময়েই প্রথম বাঁশি শুনেছিলেন বাবলু। রেডিওতে। “আমি বাংলাদেশের খবর শুনতাম। খুলনা স্টেশনে খবর পড়ার আগে একটা বাজনা বাজাত। সেটা শুনে মাকে জিজ্ঞাসা করি ওটা কী বাজনা,” বাবলু বললেন। মায়ের উত্তর শুনে বাবলু তো হতবাক! বাঁশি! এতদিন বাঁশি বলতে জানা ছিল ভেঁপু – প্যাঁ প্যাঁ করে আওয়াজ হয়। ছোটোবেলার খেলার সামগ্রী। কয়েক হপ্তা পরে মেলা থেকে ২০ টাকা দিয়ে তাঁকে একখানা বাঁশি কিনে দেন সন্ধ্যা। কিন্তু শেখানোর কেউ ছিল না।

২০১১ সালে প্রথম পুরুলিয়া ছেড়ে আসা। নরেন্দ্রপুরে ব্লাইন্ড বয়েজ আকাডেমিতে ভর্তি হন বাবলু। তার আগে পড়তেন পুরুলিয়ারই ব্লাইন্ড স্কুলে। “এক রাতে ওখানে একটা বড়ো রকম দুর্ঘটনা ঘটে। ওই স্কুলে কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। রাত্রিবেলা ছাত্র-ছাত্রীরা একা থাকত। ওই ঘটনার পর আমি বাবা-মাকে বলি আমাকে নিয়ে যেতে,” বলছেন বাবলু। তারপর দু’বছর কেটে যায় বাড়িতেই।

নতুন স্কুলে বাবলুকে গান-বাজনা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়। এখানেই বাঁশি আর সিন্থেসাইজার শেখেন তিনি। যোগ দেন স্কুলের অর্কেস্ট্রাতে। এখন এদিক-সেদিক নানা ফাংশানে বাজিয়ে থাকেন বাবলু। এছাড়া পুরুলিয়ার আঞ্চলিক গানের সঙ্গেও বাজান। স্টুডিও রেকর্ডিং পিছু আয় হয় ৫০০ টাকা। কিন্তু এই টাকার কোনও স্থিরতা নেই, বাবলু জানাচ্ছেন।

“আমি পেশা হিসেবে গান-বাজনাকে বেছে নিতে পারব না,” তিনি বললেন। “এর পেছনে যে সময় দিতে হয়, তা আমার নেই। পয়সার অভাবে আমার বেশি দূর শেখাও হয়নি। এখন পরিবারের দায়িত্ব আমার কাঁধে।”

Sarbajaya Bhattacharya

سربجیہ بھٹاچاریہ، پاری کی سینئر اسسٹنٹ ایڈیٹر ہیں۔ وہ ایک تجربہ کار بنگالی مترجم ہیں۔ وہ کولکاتا میں رہتی ہیں اور شہر کی تاریخ اور سیاحتی ادب میں دلچسپی رکھتی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Sarbajaya Bhattacharya
Editor : Priti David

پریتی ڈیوڈ، پاری کی ایگزیکٹو ایڈیٹر ہیں۔ وہ جنگلات، آدیواسیوں اور معاش جیسے موضوعات پر لکھتی ہیں۔ پریتی، پاری کے ’ایجوکیشن‘ والے حصہ کی سربراہ بھی ہیں اور دیہی علاقوں کے مسائل کو کلاس روم اور نصاب تک پہنچانے کے لیے اسکولوں اور کالجوں کے ساتھ مل کر کام کرتی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Priti David
Illustration : Antara Raman

انترا رمن سماجی عمل اور اساطیری خیال آرائی میں دلچسپی رکھنے والی ایک خاکہ نگار اور ویب سائٹ ڈیزائنر ہیں۔ انہوں نے سرشٹی انسٹی ٹیوٹ آف آرٹ، ڈیزائن اینڈ ٹکنالوجی، بنگلورو سے گریجویشن کیا ہے اور ان کا ماننا ہے کہ کہانی اور خاکہ نگاری ایک دوسرے سے مربوط ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Antara Raman
Photographs : Prolay Mondal

Prolay Mandal has an M.Phil from the Department of Bengali, Jadavpur University. He currently works at the university's School of Cultural Texts and Records.

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Prolay Mondal