"২০২০ সালে লকডাউন চলছে তখন। আমাদের ১.২০ একর জমির চারদিকে সীমানা তোলার ফিকিরে কতকগুলো লোক এসে হাজির হল," স্পষ্ট মনে করতে পারেন বছর তিরিশ-পঁয়ত্রিশের আদিবাসী কৃষক ফাগুয়া ওরাওঁ। বলতে বলতেই এক টুকরো খোলা জমি ঘিরে গজিয়ে ওঠা ইঁটের আখাম্বা দেওয়ালটার দিকে ফাগুয়া অঙ্গুলিনির্দেশ করেন। খুঁটি জেলার দুমারি গ্রামে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এ গ্রামের অনেকখানি জুড়ে ওরাওঁ গোষ্ঠীর মানুষজনের বাস। "ওরা তো মাপজোক করতে লেগে পড়ল, বলল কি, 'এ জমি অন্য লোকের; তোমাদের নয়।' আমরাও অমনি রুখে দাঁড়ালুম।
"এই ঘটনার দিন পনেরো পর দল বেঁধে আমরা খুঁটির সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়েছিলুম। সে আমাদের গ্রাম থেকে ঝাড়া তিরিশ কিলোমিটার রাস্তা। এক একবার যাওয়া-আসায় ২০০ টাকার বেশি খরচা পড়ে যায় আমাদের। ওখানে একজন উকিলের থেকেও মদত চাইতে হল। আমাদের থেকে ইতিমধ্যেই ২,৫০০ টাকা বাগিয়ে নিয়েছে লোকটা। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছুটি হয়নি।
"তারও আগে আমাদের ব্লকের আঞ্চলিক আপিসে যাওয়া হয়েছিল। এই নিয়ে নালিশ জানাতে থানায় পর্যন্ত গিয়েছিলুম আমরা। জমির ওপর দাবি ছাড়ার কথা বলে হুমকিও আসছিলো আমাদের কাছে। অতি-দক্ষিণপন্থী একটা দলের জেলাস্তরের একজন কেষ্টবিষ্টু আমাদের শাসিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতে শুনানিটুকুও হল না। এখন আমাদের জমিতে দিব্যি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচিলটা। অউর হাম দো সাল সে ইসি তরাহ দৌড়-ধুপ কর রহে হ্যায় [আর আমরা কিনা এইভাবে দুটো বছর ধরে কত দৌড়ঝাঁপ করে মরছি]।
"১৯৩০ সালে জমিদার বালচন্দ সাহুর থেকে জমিটা কিনেছিলেন আমার ঠাকুরদা লুসা ওরাওঁ। এই একই জমিতে আমরা আবাদ করে আসছি। এই অংশটুকুর জন্য সেই ১৯৩০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দাখিল হওয়া খাজনার রসিদগুলোও আছে আমাদের কাছে। তারপর তো [২০১৬ সালে] অনলাইন ব্যবস্থা চালু হয়ে গেল। আর ওখানে অনলাইন নথিতে আমাদের জমিটুকু দেখাল কিনা আগের জমিদারের বংশধরদের নামে। কী করে যে এমন হল খোদায় মালুম।"
ফাগুয়া ওরাওঁয়ের সাধের জমিখানা খোয়া গেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়া ল্যান্ড রেকর্ড মডার্নাইজেশন প্রোগ্রামের (ডিআইএলআরএমপি) দৌলতে। ভারত জুড়ে চলা এই অভিযানের উদ্দেশ্য হল সমস্ত ভূমিসংক্রান্ত নথি বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সংরক্ষণ করা আর দেশে সেসবের জন্য কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত তথ্যশালা (ডেটাবেস) তৈরি করা। এমন সমস্ত নথি ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি আধুনিকীকরণের জন্য নেওয়া এই উদ্যোগের অধীনে রাজ্য সরকার ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে একটা ল্যান্ড ব্যাঙ্ক পোর্টাল চালু করে, আর জেলাভিত্তিক জমির তথ্য তাতে নথিভুক্ত রাখে। এর লক্ষ্য ছিল, "জমি/সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদের সম্ভাবনা কমানো আর ভূমি নথি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা।"
কিন্তু ফাগুয়া আর তাঁর মতো আরও অনেকের ক্ষেত্রে আগাগোড়া উল্টো পথেই হেঁটেছে এই উদ্যোগ।
"অনলাইনে আমাদের জমির হাল হকিকত খুঁজে বার করতে প্রজ্ঞা কেন্দ্রে গিয়েছিলুম আমরা।" কেন্দ্রীয় সরকারের ডিজিটাল ভারত প্রকল্পের আওতায় তৈরি এবং ঝাড়খণ্ডের সাধারণ সেবা কেন্দ্রগুলোর (কমন সার্ভিস সেন্টার) বিবিধ বিপণন স্থল হিসেবে ক্রিয়াশীল এই প্রজ্ঞা কেন্দ্র গ্রাম পঞ্চায়েতে অর্থের বিনিময়ে জনসেবা প্রদান করে। "এখানকার অনলাইন নথি অনুযায়ী, জমিটার বর্তমান মালিক নাগেন্দ্র সিং। এর আগে মালিকানা ছিল সঞ্জয় সিংয়ের হাতে। তিনি নাকি জমি বেচেন বিন্দু দেবীর কাছে, যিনি আবার নাগেন্দ্র সিংকে ওই জমি বিক্রি করে দেন।
"ব্যাপার দেখে মনে হল জমিদারের বংশধরেরা ওই একই জমি দু-তিনবার ধরে বেচাকেনা করেই গেছে অথচ আমরা কিচ্ছুটি জানতে পারিনি। কিন্তু আমাদের কাছে তো ১৯৩০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত জমির ছাপা রসিদ ছিল, তবে এমনটা কী করে সম্ভব? এখনও পর্যন্ত ২০,০০০ টাকার বেশি গচ্চা গেছে আমাদের, এই ছুটোছুটি থেকে রেহাই পেলাম না এখনও। টাকা জোগাড়ের জন্য বাড়ির দানাশস্যও বেচেবুচে দিতে হয়েছে। এখন যখন জমির ওপর খাড়া পাঁচিলটা দেখি, মনে হয় আমাদের যা ছিল তা খোয়াই গেছে। এই লড়াইয়ে কে যে আমাদের পাশে দাঁড়াবে, জানা নেই।"
*****
ভূমি অধিকার বিষয়ে এক দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাসের সাক্ষী ঝাড়খণ্ড। ভারতের খনিজ ভাণ্ডারের চল্লিশ শতাংশ এই রাজ্যের আওতাধীন। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ও বহুলাংশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই অঞ্চলে নানান নীতি-নিগম আর রাজনৈতিক দলগুলো ভূমি অধিকার নিয়ে যে কী ভয়ানক ভাবে ছিনিমিনি খেলেছে সেকথা আজ আর কারও অজানা নয়।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, এ রাজ্যের ২৯.৭৬ শতাংশ ২৩,৭২১ বর্গকিলোমিটার জুড়ে অরণ্যে ঢাকা; তফসিলি জনজাতি (সিডিউলড ট্রাইব বা এসটি) হিসেবে নথিভুক্ত ৩২টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ এই রাজ্যের মোট জন্যসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরও বেশি বা মোটামুটি হিসেবে ২৬ শতাংশ; তেরোটি জেলা পুরোপুরিভাবে ও আরও তিন জেলার খানিক এলাকা সংবিধানের পঞ্চম তফসিলের আওতায় পড়ে।
স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকেই এ রাজ্যের আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিজেদের হকের লড়াই জারি রেখেছে। তাঁদের প্রথাগত সমাজ-সাংস্কৃতিক জীবনধারার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে এ সমস্ত অধিকার। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আদিবাসী মানুষদের যৌথ সংগ্রামের জেরে ১৮৩৩ সালের হুকুক-নামায় বৈধভাবে প্রথম নথিবদ্ধ করা হয় তাঁদের অধিকারগুলোর কথা। এতে স্বাধীনতারও একশো বছর আগে আদিবাসীদের গোষ্ঠীভিত্তিক কৃষি অধিকার এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
পঞ্চম তফসিলভুক্ত অঞ্চলগুলো সংবিধানে বিশেষ ভাবে মান্যতা পাওয়ার বহু আগেই, ১৯০৮ সালের ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন (ছোটোনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট বা সিএনটিএ) এবং ১৮৭৬ সালের সাঁওতাল পরগণা প্রজাস্বত্ব আইনের (সাঁওতাল পরগণা টেন্যান্সি অ্যাক্ট বা এসপিটিএ) মাধ্যমে ওই বিশেষ এলাকাগুলোতে আদিবাসী (এসটি) এবং মূলবাসী (তফাসিলি জাতি, অনগ্রসর শ্রেণি এবং অন্যান্য) জমি স্বত্বাধিকারীদের অধিকার স্বীকৃত হয়।
*****
জনৈক জমিদারের থেকে যে জমি খরিদ করেছিলেন তাঁদের পূর্বজরা, নিজেদের জীবন-জীবিকার জন্য তার ওপরেই এতকাল ভরসা করে এসেছেন ফাগুয়া ওরাওঁ ও তাঁর পরিবার। এর সঙ্গে ওরাওঁ গোষ্ঠীর বংশানুক্রমে পাওয়া দেড় একর ভুঁইহারী জমিও ছিল তাঁদের।
এককালে জঙ্গল কেটে সে জায়গায় ধানজমি তৈরি করে, বসতি স্থাপন করেছিলেন যেসব পরিবারের পূর্বজরা, তাঁদের উত্তরাধিকারীরাও যৌথভাবে এই জমিটুকুর মালিকানা পান – ওরাওঁ এলাকায় যাকে বলা হয় ভুঁইহারী আর মুন্ডা এলাকায় মুন্ডারী খুঁটকাট্টি।
"আমরা তিন ভাই," বলেন ফাগুয়া। "তিনজনেরই যার যার পরিবার আছে। বড়ো আর মেজো দুই ভাইয়েরই তিনটি করে ছেলেপুলে আর আমার নিজের দুই সন্তান। পরিবারের লোকেরা খেত আর পাহাড়ি জমিতে আবাদ করে। আমরা ধান, মিলেট আর শাকসবজি ফলাই। অর্ধেক নিজেদের খোরাকি বাবদ রাখি আর বাকিটা টাকাপয়সার দরকার পড়লে বেচে দিই। এই করেই বেঁচেবর্তে আছি," নিজেদের অবস্থাটা স্পষ্ট বর্ণনা করেন তিনি।
এই এক-ফসলি ভূমিতে বছরে একবারই চাষাবাদ হয়। বাকি সময়টা টিকে থাকার তাগিদে কররা ব্লকে তাঁদের গ্রাম ও তার আশেপাশে, এমনকি আরও দূরে মজুরি কাজের ধান্দা দেখতে হয় তাঁদের।
বৈদ্যুতায়ন আর তার সমস্যাগুলো পারিবারিক-মালিকানাধীন এসব জমিজিরেতের বাইরেও অনেকটা জুড়ে প্রভাব ফেলে।
কোসাম্বি গ্রাম থেকে মোটামুটি পাঁচ কিলোমিটার দূরে, তাঁদের যৌথ জমির কিসসা শোনান বন্ধু হোরো। "২০২২ সালের জুন মাসে," বেশ মনে পড়ে তাঁর, "কয়েকটা লোক এসে আমাদের জমি ঘিরে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। একখানা জেসিবি মেশিন (জে.সি.ব্যামফোর্ড খননযন্ত্র) নিয়ে হাজির হয়েছিল ব্যাটারা, গ্রামের সব মানুষজন বেরিয়ে এসে আটকেছিল ওদের।"
"গ্রাম থেকে ২০-২৫ জন আদিবাসী এসে গ্যাঁট হয়ে বসে পড়েছিল মাঠে," ওই একই গ্রামের বাসিন্দা বছর ছিয়াত্তরের ফ্লোরা হোরো গল্পের খেই ধরলেন এবার। "সবাই মিলে রীতিমতো জমি চষতে শুরু করে দিয়েছিল। ওই জমি খরিদ করতে উৎসাহী লোকজন তো সোজা পুলিশকে ফোন লাগাল। কিন্তু তবু সন্ধে পর্যন্ত ঠায় বসেছিল গ্রামবাসীরা। পরে, ওই মাঠে সুরগুজা [গুজি তিল বা গুইজোটিয়া অ্যাবিসিনিকা] বুনে দেওয়া হয়," বলেন তিনি।
"কোসাম্বি গ্রামে এমন ৮৩ একর জমি আছে যাকে বলে মনঝিহস," ছত্রিশ বছর বয়সি গ্রাম প্রধান বিকাশ হোরো খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেন আমাদের। "এ হল আপনাদের গিয়ে 'বিশেষ সুবিধে দেওয়া' জমি, আদিবাসীরা তাদের জমিদারের সম্মানে ওটুকু আলাদা করে রাখে। গ্রামের বাসিন্দারা সবাই মিলে ওই জমি চাষ করে ফসলের খানিকটা অংশ জমিদারের পরিবারকে সেলামি হিসেবে দিয়ে আসছে।" রাজ্যে জমিদারি ব্যবস্থায় জমির দখলদারির প্রথা রদ হলেও তাঁদের এই জোড়হস্ত দশা আর ঘোচেনি। "এখনও," ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন তিনি, "গ্রামের কত আদিবাসী মানুষ তাঁদের হকের কথা জানেন না।"
বছর পঁয়ত্রিশের কৃষক সেতেঙ হোরোর পরিবারও, তাঁর আর তিন ভাইয়ের মতো, তাঁদের দশ একর যৌথ মালিকানাধীন জমিটার ওপর ভরসা করে দিন চালান। সেতেঙের গল্পটাও বেশ মিলে যায় আর সবার সঙ্গে, "জমিনদারি ব্যবস্থা খতম হয়েছে বলে যে মনঝিহস জমিও এতকাল তাতে মিলেজুলে আবাদ করা মানুষগুলোর ভাগে পড়বে সে খবর আমাদের থোড়াই জানা ছিল? আর জানতুম না বলেই তো, খেতিকাজ করে আগের জমিদারের নাতিপুতিদের খানিকটা করে ফসল দিয়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু তারপর ব্যাটারা নিয়মকানুন শিকেয় তুলে জমিগুলো যেই বেচতে শুরু করল, আমরাও নিজেদের হকটুকু বাঁচাতে এককাট্টা হলাম," সাফ বক্তব্য তাঁর।
"১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে বিহার জমি সংশোধনী আইন বলবৎ হয়," রাঁচি নিবাসী বরিষ্ঠ আইনজীবী রশ্মি কাত্যায়ন ব্যাখ্যা করেন বিষয়টা। "জমি থেকে জমিদারের যা কিছু সুযোগসুবিধে – অনাবাদী জমি ইজারা দেওয়ার অধিকার, ভাড়া আর খাজনা নেওয়ার অধিকার, পতিত জমিতে নতুন রায়ত বসানো, গ্রামের হাটবাজার কিংবা মেলা-টেলা থেকে কর নেওয়ার অধিকার ইত্যাদি সবকিছুই তখন সরকারের হাতে বর্তালো, শুধু যেটুকু জমিতে ওই প্রাক্তন জমিদাররা নিজেরাই চাষ করতেন সেটুকুতেই তাঁদের দখল রইল।
প্রাক্তন জমিদারদের এসব জমি আর মনঝিহস বলে 'বিশেষ সুবিধে দেওয়া' জমিগুলোও লেখাপড়া-সইসাবুদ করে সরকারের কাছে ফেরত দিতে হত। কিন্তু তাঁরা ওই জমিগুলো নিজের মনে করে রেখে দিলেন, আর ফাইলপত্তর করে জমি ফেরতের ধারও ধারলেন না। শুধু তাই নয়, জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার এতকাল পরেও তাঁরা গ্রামবাসীদের থেকে ফসলের অর্ধেক ভাগ নিতে কসুর করেননি। গত পাঁচ বছরে, এইসব ডিজিটাইজেশনের চক্করে জমি নিয়ে বিবাদ-অশান্তি বেড়ে গেছে," বললেন বাহাত্তর বছরের প্রবীণ কাত্যায়ন।
খুঁটি জেলায় প্রাক্তন-জমিদারের বংশধর ও জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিবাদ বিষয়ে আলোচনা করতে করতেই বছর পঁয়তাল্লিশের আইনজীবী অনুপ মিঞ্জ জানালেন, "ওই সব জমিদারের উত্তরাধিকারীদের কাছে না আছে জমির খাজনার রসিদ, না আছে এইসব জমির ওপর কোনওরকম অধিকার। কিন্তু অনলাইনে তারা এই জমিগুলো নিজের বলে চিহ্নিত করে একে-তাকে সেসব বেচে চলেছে। ১৯০৮ সালের ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইনের দখলদারী অধিকার অংশ মোতাবেক, বারো বছরেরও বেশি সময় ধরে মনঝিহস জমিতে চাষাবাদ করে আসা ব্যক্তি আপনাআপনিই তার ওপর অধিকার দাবি করতে পারবেন। তাই এখানে যে আদিবাসীরা আবাদ করেন, তাঁরাই এই জমির সাচ্চা হকদার।"
গত এক বছর ধরে একটা সংযুক্ত পরহা সমিতি সক্রিয় থেকে, এইসব জমিতে খেতিবাড়ি করা মানুষজনকে এককাট্টা করেছে। আদিবাসী স্বায়ত্তশাসনের প্রথাগত গণতান্ত্রিক পরহা ব্যবস্থার ছত্রছায়াতেই এমনটা করা সম্ভব হয়েছে। সাধারণত ১২-২২ টা গ্রামের দল নিয়ে পরহাগুলো গড়ে ওঠে।
"খুঁটি জেলার বহু জায়গায় এই লড়াইটা চলছে," বলছেন সমিতির পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি সমাজকর্মী আলফ্রেড হোরো। “জমিদারের বংশধরেরা এই জেলার তোড়পা ব্লকের ৩০০ একর জমি, কররা ব্লকের তিয়ুগুটু (তিয়ু বলেও পরিচিত) গ্রামের ২৩ একর জমি, পরগাঁওয়ের ৪০ একর, কোসাম্বি গ্রামের ৮৩, মধুকামা গ্রামের ৪৫, মেহানের (মেহা বলেও ডাকা হয়) ২৩ আর ছাতা গ্রামের ৯০ একর জমি ফের দখলে আনার চেষ্টা করেছিল। এদ্দিনে, যৌথ পরহা সমিতি সব মিলিয়ে প্রায় ৭০০ একর আদিবাসী জমি রক্ষা করেছে," একেবারে হিসেব করে বলে দেন তিনি।
১৯৩২ সালের ভূমি সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি গোষ্ঠীভিত্তিক ও ব্যক্তিগত জমি স্বত্বাধিকারের এক নথি ওরফে খতিয়ান দেখিয়ে নিজেদের জমির অধিকার বিষয়ে আদিবাসী মানুষদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে সংযুক্ত পরহা সমিতি। কোন জমির ওপর কার অধিকার, জমির প্রকৃতি কিরকম –সব বিষয়েই অনুপুঙ্খ তথ্য দেয় এই খতিয়ান। এটা দেখেই গ্রামবাসীরা জানতে পারেন, তাঁদের পূর্বজরা যে জমি মিলেমিশে আবাদ করছিলেন তার ওপর সঠিক মালিকানা তাঁদেরই। প্রাক্তন জমিদারের মোটেই ও জমির ওপর অধিকার নেই আর জমিদারি ব্যবস্থাও কবেই চুকেবুকে গেছে।
"ডিজিটাল ভারত ব্যাপারটা হয়ে ইস্তক ওই দিয়ে জমির বিষয়ে সমস্ত তথ্যই অনলাইনে দেখতে পাওয়া যায় আর তাতেই গোলমাল বেড়ে চলেছে," বলছেন খুঁটি জেলার মের্লে গ্রামের ইপীল হোরো। "২০২৪ সালের পয়লা মে, শ্রমিক দিবসের দিন, গ্রামের কাছে মনঝিহস জমির চারপাশে সীমানা বাঁধতে জনকয়েক লোক এল। জোরগলায় দাবি করলো ওরা নাকি ও জমি কিনে নিয়েছে। গ্রাম থেকে জনা ষাটেক মেয়ে-পুরুষ জোট বেঁধে এসে ওদের ঠেকালো সেবার।
"আগের জমিদারের বংশধরেরা অনলাইনে মনঝিহস জমিগুলো দেখতে পায় কিনা! ওরা ভাবে ওসব এখনও ওদের 'বিশেষ সুবিধে দেওয়া' সম্পত্তি আর তাই কানুনের তোয়াক্কা না করে দিব্যি জমিগুলো বেচে দিচ্ছে। আমাদের এককাট্টা তাকত দিয়েই ওদের খপ্পরে জমিগুলোকে যেতে দিচ্ছি না আমরা, রুখছি সাধ্যমতো," দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ইপীল হোরো। এই মুন্ডা গ্রামে মোট ৩৬ একর জমি হল মনঝিহস জমি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এতে যৌথশ্রমে আবাদ করছেন গ্রামবাসীরা।
"গ্রামের মানুষ তো খুব একটা পড়ালেখা জানেন না," বলেন বছর তিরিশের ভরোসি হোরো। "এ দেশে যে কোন নিয়মটা বানানো হচ্ছে, কোন নিয়মটা বদলাচ্ছে কিছুরই তো খবর পাই না আমরা। লেখাপড়া করা লোকজন কত্তকিছু জানে। কিন্তু ওই জ্ঞানটুক দিয়ে তারা কম জানতে পারা লোকেদের বেবাক লুটে নেয়। একেবারে নাকানিচোবানি খাইয়ে মারে। তাই তো আদিবাসীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এবার।"
দেশজুড়ে একেবারে ধন্য ধন্য পড়ে গেল যে ডিজিটাল বিপ্লব নিয়ে, বিক্ষিপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ আর জোড়াতালি দেওয়া ইন্টারনেট পরিষেবায় বেসামাল নানান এলাকার অনেক সুবিধেভোগীর কাছে তার সুবিধেটুকু আদৌ পৌঁছয় না। ঝাড়খণ্ডের গ্রামাঞ্চলে মোটে ৩২ শতাংশ জায়গায় ইন্টারনেট এসেছে। তার ওপর শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতিগোষ্ঠীর বৈষম্যে আরও উশকে ওঠা ডিজিটাল বৈষম্য তো আছেই।
জাতীয় নমুনা সমীক্ষা বা ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভেতে (এনএসএস ৭৫তম দফা - জুলাই ২০১৭-জুন ২০১৮) খেয়াল করা হয় যে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে মোটে ১১.৩ শতাংশ মানুষ তাঁদের বাড়িতে ইন্টারনেট পরিষেবা পান এবং তাঁদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের শুধু মোটামুটি ১২ শতাংশ পুরুষ ও ২ শতাংশ মহিলা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে জানেন। গ্রামবাসীরা পরিষেবা পেতে প্রজ্ঞা কেন্দ্রগুলোর ওপরেই ভরসা করে থাকেন আবার সেসবের অপ্রতুলতার কথাও দশ-জেলা নিয়ে একটি সমীক্ষায় ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে।
খুঁটি জেলার কররা উন্নয়ন ব্লকের সার্কেল অফিসার (সিও) বন্দনা ভারতী অবশ্য খুব একটা মুখ খুলতে চান না এ ব্যাপারে, "প্রাক্তন জমিদারদের উত্তরাধিকারীদের কাছে জমির কাগজপত্র তো আছেই কিন্তু এবার দেখতে হবে জমির ওপর আদতে কাদের দখল থাকার কথা," মন্তব্য করেন তিনি। "জমিগুলো এখন গোষ্ঠীর মানুষদের অধিকারে, তাঁরাই ওখানে চাষাবাদ করে আসছেন। বেশ জটিল ব্যাপার বুঝলেন তো? এরকম কেসগুলো আমরা সরাসরি আদালতে পাঠিয়ে দিই। কখনও কখনও আগের জমিদারের উত্তরাধিকারী আর সাধারণ মানুষজন নিজেরাই ব্যাপারটা মিটিয়ে নেন।"
ঝাড়খণ্ডের স্থানীয় আবাস যোজনা বিষয়ে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলিতে ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, "... প্রত্যেক ডিজিটাল ভূমি নথি, রাজস্ব ব্যবস্থার আওতায় থাকা জমিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলছে। সিএনটিএ-র অনুমোদিত গোষ্ঠীভিত্তিক জমি স্বত্বাধিকার নথিভুক্ত রাখার প্রথাগত/খতিয়ানি বন্দোবস্তর দিকে আদৌ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না।"
খাতা বা প্লট নাম্বার কিংবা জমির পরিমাপ, পরিবর্তিত নাম, জমির মালিকদের জনজাতি/জাতিগোষ্ঠী – এসমস্ত নথিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে গলদের কথাও স্বীকার করেন গবেষকরা। তার ওপর প্রতারণা করে জমি বিক্রি তো আছেই, যার জেরে অনলাইন রেকর্ড সংশোধন আর আপডেট করার তাগিদে বৃথাই দরজায় দরজায় ঘুরে মরেছেন গ্রামবাসীরা। আর এখন জমি অন্য কারও নামে হয়ে গেছে বলে, উপযুক্ত খাজনাও আর দিতে পারছেন না তাঁরা।
"এই প্রকল্পে আদতে কারা লাভবান হচ্ছে বলুন তো?" সোজাসুজি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন একতা পরিষদের জাতীয় সমন্বয়কারী রমেশ শর্মা। ভূমি অধিকারের জন্য জনমানুষের আন্দোলন সংগঠিত করে এই পরিষদ। "ভূমি নথির বৈদ্যুতায়ন কি আদৌ একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া? নিঃসন্দেহে, রাষ্ট্র আর কয়েকজন ক্ষমতাশালীই সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে এতে, এই অভিযানের মোদ্দা ফলাফলটা তারিয়ে উপভোগ করছে, একসময় ঠিক যেমনটা করেছিল জমিদার, জমি মাফিয়া আর দালালরা।" তাঁর মতে জমির সীমানানির্দেশ করার প্রথাগত ভূমি বন্দোবস্তটি চিনতে-বুঝতে স্থানীয় প্রশাসনের এত অসুবিধে আগাগোড়াই ইচ্ছাকৃত। তারা জেনেশুনেই অগণতান্ত্রিক ও ক্ষমতাবানদের পক্ষে।
আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চারিয়ে যাওয়া যে ভয়টা বছর পঁয়ত্রিশের বসন্তী দেবীর কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার ব্যাপ্তি যে কতখানি– কল্পনা করা যায় না। "এই গ্রামটা চারদিক দিয়ে মনঝিহস জমিতে ঘেরা," জানান বসন্তী। "৪৫ ঘর লোকের বাস এখানে। লোকে দিব্যি সুখেশান্তিতে থাকে। গ্রামটা এমন করেই চলে কারণ আমরা এভাবে একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে মিলেমিশে দিন কাটাই। এখন চারদিকের জমি যদি এরকম বেআইনি ভাবে বিক্রি হয়ে যায়, ঘনঘন পাঁচিল ওঠে, আমাদের গরু, বলদ, ছাগলগুলো চরবে কোথায়? এক্কেবারে ঘেরাও হয়ে পড়বে তো গ্রামটা। আমাদের সবাইকে ঠিক এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। ভাবলেই বুক কাঁপে।"
বরিষ্ঠ আইনজীবী রশ্মি কাত্যায়নের কাছে লেখক আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। তাঁর সহায়তা ও সুচিন্তিত মতামত এই লেখাকে সমৃদ্ধ করেছে।
অনুবাদ: রম্যাণি ব্যানার্জী