পারি'র এই প্রতিবেদনটি পরিবেশ সংক্রান্ত সাংবাদিকতা বিভাগে ২০১৯ সালের রামনাথ গোয়েঙ্কা পুরস্কার প্রাপ্ত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি সিরিজের অংশ।
এক দুপুরে ইঁটের বাড়ির মাটির মেঝেতে বসে ৫৩ বছর বয়সী ধ্যানু খারাত বললেন, “এসব কথা বললে লোকে আমাকে পাগল বলবে। কিন্তু ৩০-৪০ বছর আগে এখানে বর্ষার সময়ে [কাছের খাল-বিল ছাপিয়ে] মাছে আমাদের খেত ভরে যেত। আমি নিজের হাতে তা ধরেছি।”
জুন মাসের মাঝামাঝি আমরা তাঁর বাড়িতে পৌঁছানোর খানিক আগে খারাত বস্তি নামের ছোট্টো জনপদটিতে ঘড়ঘড়িয়ে একটি ৫,০০০ লিটার ক্ষমতা সম্পন্ন জলের ট্যাঙ্কার ঢুকল। খারাত, তাঁর স্ত্রী, ফুলাবাঈ ও যৌথ পরিবারের অন্যান্য ১২ জন সদস্য সবাই হাতের কাছের যাবতীয় ঘটি-বাটি ড্রাম অন্য নানা পাত্রে জল ভরতে ব্যস্ত। ট্যাঙ্কার ঢুকেছে এক সপ্তাহ পর। ফলে জল সঙ্কট একেবারে তুঙ্গে তখন।
সাঙ্গোলে তালুকের খারাত বস্তি থেকে পাঁচ কিমি দূরে ৩,২০০০ জন মানুষ সম্বলিত গৌড়বাড়ি গ্রামে নিম গাছের ছায়ায় বসে ৭৫ বছরবয়সী গাঙ্গুবাঈ গুলিগ বললেন, “বিশ্বাস করবেন না ৫০-৬০ বছর আগে এখানে এমন বৃষ্টি হত যে মানুষের পক্ষে চোখ খোলা রাখা দায় হত। আসার পথে বাবুল গাছগুলি দেখলেন তো? ওই পুরো জমিতে খুব ভালো মটকি [মোঠ নামের ডাল] হত। মুরুম [ব্যাসল্ট পাথর] বর্ষার জল ধরে রাখত। আমাদের খেত থেকে ফোয়ারা উঠত। এক একরে মাত্র চার সারি বাজরা বুনলে ৪-৫ বস্তা (২-৩ কুইন্টাল) ফসল দিত। মাটি এতটাই ভালো ছিল।”
গৌড়বাড়ির অদূরে আরেক জনপদ আলদার বস্তির বাসিন্দা, অশীতিপর হৌসাবাঈ আলদারের মনে আছে তাঁর পারিবারিক চাষ জমিতে অবস্থিত জোড়া কুয়োর কথা। “দুটোই বর্ষা কালে জলে পরিপূর্ণ থাকত (৬০ বছর আগে)। প্রত্যেকটির সঙ্গে দুটি করে বলদে টানা কপিকল ছিল —চারটিই একসঙ্গে চলত। দিনের যে কোনও সময়ে – তা সে রাত হোক বা দিন - আমার শ্বশুরমশাই, যার দরকার পড়ত তাকেই জল তুলে দিতেন। এখন কেউ একপাত্র জলও আর মুখ ফুটে চাইতে পারে না। সব কিছু এখন ওলোট-পালোট হয়ে গেছে।”
মহারাষ্ট্রের বৃষ্টিচ্ছায় (বর্ষাবাহী বাতাসকে আড়াল করে রাখে পাহাড়) অঞ্চল মানদেশে অবস্থিত হয়েও সাঙ্গোলে তালুকে এমন গল্পের ছড়াছড়ি। এই অঞ্চলের মধ্যে পড়ে সোলাপুর জেলার সাঙ্গোলে (যা স্থানীয়ভাবে সাঙ্গোলা নামেও পরিচিত) ও মালশিরাস তালুক; সাঙ্গলী জেলার জাট, আটপাড়ি, কাভাথেমহাঙ্কাল তালুকগুলি এবং সাতারা জেলার মাণ ও খাটাভ তালুক দুটি।
ভালো বর্ষণ ও খরার নিয়মিত চক্রই এখানকার স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল আর মানুষের স্মৃতিতে [বৃষ্টির] প্রাচুর্য ও অভাব - দুইয়ের কথাই গেঁথে আছে। অথচ এখন গ্রামে ‘সব ওলোট-পালোট হয়ে যাওয়ার’ গল্প, প্রাচুর্য কেমন অতীত বলে মনে হয় আর আগের [বর্ষা ও খরার] নিয়মিত চক্রাবর্ত কেমন ছিন্ন হয়ে গেছে - সেইসব গল্পের এমন ছড়াছড়ি যে গৌড়বাড়ির নিবৃত্তি শেন্ডগে বললেন, “এমনকি এখন বৃষ্টি আমাদের আর স্বপ্নেও দেখা দেয় না।”
“এই জমি - যেখানে এখন এই পশু শিবির, তা বাজরা চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। আমি নিজেও আগে তা চাষ করেছি...” মে মাসের এক প্রখর গ্রীষ্মের দুপুরে নিজের জন্য পান সাজতে সাজতে গৌড়বাড়ির একটি পশু ছাউনিতে বসে বললেন ৮৩ বছর বয়সী বিঠোভা সোমা গুলিগ, সবাই তাঁকে আদর করে তাত্যিয়া ডাকে। “এখন সব বদলে গেছে”, চিন্তিত হয়ে বললেন তিনি। “বৃষ্টি আমাদের গ্রাম থেকে স্রেফ উবে গেছে।”
দলিত, হোলার সম্প্রদায়ের তাত্যিয়া আজীবন কাটিয়েছেন গৌড়বাড়িতে — ৫-৬ প্রজন্ম ধরেই তাঁর পরিবারের বাস ওইখানে। অতি কষ্টে চলে তাঁর। ৬০ বছর আগে তিনি ও তাঁর স্ত্রী গাঙ্গুবাঈ, সাঙ্গলী ও কোলাপুরে অভিবাসী শ্রমিক হয়ে গিয়ে আখ কেটেছেন, পরের জমিতে মজুরি করেছেন, গ্রামের আশপাশের রাষ্ট্র পরিচালিত নানা ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। “মাত্র ১০-১২ বছর আগে আমরা ৪ একর জমি কিনেছি। তখন সবই ছিল কঠোর পরিশ্রমের ব্যাপার।”
যদিও বর্তমানে তাত্যিয়া মানদেশের লাগাতার খরা কথা ভেবে চিন্তিত। ১৯৭২ সালের পর খরার পর ভালো বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক চক্রাকার চলন আর ফেরেনি বলে তিনি জানালেন। আমরা হয় [যথেষ্ট] ওয়াল্যি (প্রাক বর্ষা বৃষ্টি) পাই অথবা পাই ফিরতি মৌসুমী বায়ুর বৃষ্টি। তাছাড়া তাপমাত্রা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। গতবছর আমরা অন্তত ভালো ওয়াল্যি পেয়েছিলাম, এই বছর... এখন অবধি দেখা নেই। জমি ঠান্ডা হবে কী করে?”
গৌড়বাড়ির অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ মনে করেন তাঁদের গ্রামের খরা আর বর্ষার চক্রাকার ছন্দের মোড় ঘুরে যায় ১৯৭২ সালের খরার পরেই। ওই বছর কোলাপুরে মাত্র ৩২১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল (ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য ব্যবহার করে ইন্ডিয়াওয়াটারপোর্টাল indiawaterportal দেখাচ্ছে) - যা ১৯০১ সালের পর থেকে এ যাবৎ সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত।
গাঙ্গুবাঈয়ের স্মৃতিতে ১৯৭২ সালটি স্বাভাবিক পরিস্থিতির তুলনায় কঠোরতর পরিশ্রম আর ক্ষুধার বছর। “আমরা (খরার সময়ে মজুরির জন্য) রাস্তা বানিয়েছি, কুয়ো খুঁড়েছি, পাথর ভেঙেছি। শরীরে শক্তি ছিল আর পেটে ছিল খিদে। আমি ১২ আনার (৭৫ পয়সা) জন্য ১০০ কুইন্টাল গম ভাঙার কাজ করেছি। তার পরের বছর থেকে অবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটেছে,” বললেন তিনি।
“খরা এমন মারাত্মক হয়েছিল যে আমি ১২টি গবাদি পশু নিয়ে একা একা ১০ কিমি পথ হেঁটে কোলাপুর পৌঁছেছিলাম, পশু শিবিরের ভিতর চায়ের গুমটিতে বসে ৮৫ বছর বয়সী দাদা গডদে বললেন। “মিরাজ রোডের সব নিম গাছগুলি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। সব পাতা আর ডাল গবাদি পশু আর ভেড়াকে খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেগুলি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন। তারপর আর কোনোকিছুই নিজের ছন্দে ফেরেনি।”
দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে সোলাপুর, সাতারা ও সাঙ্গলী - এই তিন জেলার খরা-প্রবণ অঞ্চলগুলি নিয়ে মানদেশ নামে একটি পৃথক জেলা গড়ার দাবি ওঠে ২০০৫ সালে। (ক্রমে আন্দোলনের কিছু নেতার মনোযোগ ওই অঞ্চলে সেচ প্রকল্প গড়ে তোলার মতো বিষয়গুলির দিকে ঘুরে যাওয়ায় এই আন্দোলনের দম ফুরিয়ে যায়)।
গৌড়বাড়ির অনেকেই ১৯৭২ সালের খরাকেই মাইলফলক বলে মনে করলেও, সোলাপুরের সরকারি ওয়েবসাইট অনুসারে এর চেয়েও কম বৃষ্টিপাত এই জেলায় হয়েছিল ২০০৩ সালে (২৮৭.৭ মিমি) এবং ২০১৫ সালে (২৫১.১৮ মিমি)।
মহারাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরের ‘বৃষ্টিপাতের হিসাব সংরক্ষণ ও নিরীক্ষণ’ পোর্টাল বলছে ২০১৮ সালে সাঙ্গোলেতে ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছিল - ২৪১.৬ মিমি আর বর্ষার মেয়াদ ছিল মাত্র ২৪ দিন। দপ্তর জানাচ্ছে যে ওই ব্লকের জন্য প্রয়োজনীয় ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাত হল ৫৩৭ মিমি।
অতএব, জল-প্রাচুর্য্যের সময়কাল আপাতদৃষ্টিতে কমে গেছে বা একেবারে শেষই হয়ে গেছে, অপরদিকে খরা, উচ্চ তাপমাত্রা আর জল-সঙ্কট বাড়ছে।
এই বছর মে মাসে গৌড়বাড়ি পশু শিবিরে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৪৬ ডিগ্রিতে। নিদারুণ তাপমাত্রার কারণে বাতাস আর জমির শুষ্কতা বাড়ছে। নিউইয়র্ক টাইমস -এর আবহাওয়া ও বিশ্ব উষ্ণায়ন বিষয়ক ইন্টারঅ্যাক্টিভ পোর্টাল দেখাচ্ছে যে ১৯৬০ সালে, অর্থাৎ তাত্যিয়ার বয়স যখন ২৪, তখন সাঙ্গোলেতে ৩২ ডিগ্রি তাপমাত্রাবিশিষ্ট দিনের সংখ্যা হত বছরে ১৪৪টি। এখন এমন দিনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭৭-এ আর তিনি যদি ১০০ বছরে পৌঁছাতে পারেন, অর্থাৎ ২০৩৬ সালে এমন দিনের সংখ্যা হবে ১৯৩।
পশু শিবিরে বসে স্মৃতি হাতড়ে তাত্যিয়া জানালেন, “আগে সব সময় মতো হত। মিরিগ (মৃগ বা কালপুরুষ নক্ষত্র যোগ) বৃষ্টি ঠিক ৭ই জুন আসত আর এত ভালো বৃষ্টি হত তখন যে ভিভঘাটে (নালা) পৌষ (জানুয়ারি) অবধি জল থাকত। “ রোহিনীতে (মে মাসের শেষে ঘটা নক্ষত্রযোগ) বীজ বুনলে মিরিগ বর্ষা হয় আর আকাশ রক্ষা করে ফসলকে। শস্যদানা পুষ্টিতে ভরপুর থাকে বলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু এসব ঋতু আর এখন তেমন নেই।”
পশু শিবিরে অন্যান্য যে সকল কৃষকরা তাঁর সঙ্গে বসেছিলেন সকলেই তাঁর সঙ্গে সহমত হলেন। অনিশ্চিত বৃষ্টির কথা ভেবে সবাই চিন্তিত। “গতবছর পঞ্চাঙ্গ ’ (চান্দ্রমাসভিত্তিক হিন্দু পঞ্জিকা) বলেছিল, ‘ ঘাভীল তো পাভীল’ — ‘যে সময় মতো বীজ বুনবে সে ভালো ফসল তুলবে।’ কিন্তু বর্ষা এখন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, সমস্ত জমির উপর ঝরেও না,” বুঝিয়ে বললেন তাত্যিয়া।
পথের অপর প্রান্তের ছাউনিতে বসে আছেন খারাত বস্তির ৫০ বছর বয়সী ফুলাবাঈ খারাত, তিনি ধাঙ্গর (যাযবর গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত) সম্প্রদায়ের মানুষ - সঙ্গে এনেছেন দুটি মোষ। তাঁর স্মৃতিতেও আছে “সব নক্ষত্রযোগে সময় মতো বৃষ্টির” কথা। তিনি বললেন, “একমাত্র ধোন্দ্যাচা মাসে (হিন্দু চান্দ্র দিনপঞ্জি অনুসারে তিন বছর অন্তর যে একটি বাড়তি মাস আসে), বৃষ্টি থমকে যেত। পরের দুবছর আবার আমরা ভালো বর্ষা পেতাম। কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবৎ এমনিতেও বৃষ্টি থমকে আছে।”
এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেক কৃষক নিজেদের চাষের সময় বদলে ফেলেছেন। সাঙ্গোলের আদর্শ চাষ ব্যবস্থায় খরিফ মরশুমে মটকি (মোঠ ডাল), হুলাগে (ছোলা), বাজরা ও তুর (অড়হর) চাষ হওয়ার কথা আর রবি মরশুমে গম, কাবলি ছোলা আর জোয়ার। গ্রীষ্মে মূলত পশু খাদ্য হিসাবে ভুট্টা এবং জোয়ার চাষ হয়।
“বিগত ২০ বছর ধরে আমি এমন কাউকে দেখিনি যে (দেশি) মটকি চাষ করে। একই অবস্থা দেশি বাজরা আর অড়হরের। খাল্পি জাতের গমও আর চাষ হয় না, চাষ হয় না হুলাগ আর তিল,” বললেন আলদার বস্তি জনপদের হাউসাবাঈ।
বর্ষা আসে দেরিতে — জুনের শেষ বা এমনকি জুলাই মাসের শুরুতে — চলেও যায় তাড়াতাড়ি -ফলে সেপ্টেম্বরে তেমন বৃষ্টি হয় না, অগত্যা কৃষকরা দ্রুত ফলনশীল সংকর প্রজাতির ফসলের দিকে চলে যাচ্ছেন। এগুলি বোনার পর থেকে পাকতে সময় লাগে ২.৫ মাস। “বাজরা, মটকি , জোয়ার, অড়হরের মতো দেশি শস্য যেগুলির পাঁচ মাস (দীর্ঘতর সময়) লাগত তা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে কারণ মাটি তার আর্দ্রতা হারাচ্ছে”, বললেন নবনাথ মালি। আরও ২০ জন সহ তিনি কোলাপুরের অ্যামিকাস অ্যাগ্রো নামক গোষ্ঠীর সদস্য - এই গোষ্ঠী মোবাইল বার্তার মাধ্যমে বিনামূল্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানায়।
অন্য ফসল ফলাবার প্রয়াসে এখানকার কিছু কৃষক আন্দাজ ২০ বছর আগে ডালিম চাষ করার চেষ্টা করেছিলেন। রাজ্য সরকারের ভর্তুকি সাহায্য করেছিল তাঁদের। ক্রমে চাষিরা দেশি থেকে সংকর প্রজাতির ফসলের দিকে সরে যান। “একর প্রতি আমরা প্রায় ২-৩ লাখ টাকা আয় করতাম [আন্দাজ ১২ বছর আগে] শুরুতে। কিন্তু বিগত ৮-১০ বছর ধরে ফল বাগানগুলিতে তেলিয়া [জীবাণু বাহিত রোগ] ছড়িয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণেই এমন হচ্ছে। গতবছর আমাদের [এই] ফল বিক্রি করতে হয়েছে কিলো প্রতি ২৫-৩০ টাকায়। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে আমরা কী-ই বা করতে পারি?” মালির প্রশ্ন।
বর্ষা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বৃষ্টির ধাঁচ বদলাবার কারণেও চাষের ধারায় বড়ো রকমের বদল এসেছে। সাঙ্গোলেতে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বর্ষা-পরবর্তী বৃষ্টি লক্ষ্যণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্য প্রমাণ করে যে ওই ব্লকের বিগত দুই দশকের — ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ — বর্ষার মরশুম পরবর্তী বৃষ্টির গড় যেখানে ৯৩.১১ মিমি সেখানে ২০১৮ তে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৩৭.৫ মিলিমিটারে।
“গোটা মানদেশ অঞ্চলে বর্ষা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে,” গ্রামীণ মহিলাদের সঙ্গে চাষ, ঋণ ও উদ্যোগ নিয়ে কর্মরত মান দেশি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, চেতনা সিনহা জানালেন। (এই বছর জানুয়ারি মাসে সাতারা জেলার মাণ ব্লকে মাহস্ওয়াড়-এ প্রথম পশু শিবির শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান ৮,০০০-এর বেশি পশুকে আশ্রয় দিয়েছে)। “ফিরতি মৌসুমী বায়ুবাহী বর্ষা আমাদের জীবন - কারণ মানুষ ও পশু - উভয়ের খাদ্যের জন্যই আমরা রবি ফসলের উপর নির্ভর করি। বিগত ১০ বছর ধরে এই বর্ষণের অভাব মানদেশের পশুপালকসহ অন্যান্য গোষ্ঠীর উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছে।”
কিন্তু আখ চাষ শুরু হওয়াই বোধহয় এখানকার কৃষি ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তন। মহারাষ্ট্র সরকারের অর্থ ও পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুসারে ২০১৬-১৭ সালে সোলাপুরে ১০০,৫০৫ হেক্টর জমিতে ৬৩৩,০০০ টন আখের চাষ হয়। কিছু সংবাদ সূত্রের খবর অনুসারে, জেলার নথিভুক্ত (চিনি বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত বিভাগ সুগার কমিশনারেট) ৩৩টি চিনিকলে ১০ মিলিয়ন টন আখ মাড়াই করে অক্টোবরে শুরু হওয়া মাড়াই মরশুমে এ বছর জানুয়ারির মধ্যে সোলাপুর সবার উপরে স্থান করে নেয়।
সোলাপুরের সাংবাদিক ও জল সংরক্ষণ আন্দোলন কর্মী রজনীশ জোশী বললেন এক টন আখ মাড়াই করতে প্রায় ১,৫০০ লিটার জল লাগে। তার মানে গত আখ মাড়াই মরশুমে অক্টোবর ২০১৮ থেকে জানুয়ারি ২০১৯ অবধি - ১৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার জল আখের পেছনে খরচ হয়েছে কেবল সোলাপুর জেলাতেই।
অপর্যাপ্ত বর্ষা ও অমিল সেচ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য হওয়া এক জেলায় যদি মাত্র একটি অর্থকরি ফসলের জন্য এতখানি জল খরচ হয় তাহলে অন্যান্য ফসলের ভাগে জল আরও কমে যায় বলাই বাহুল্য। নবনাথ মালির হিসাব অনুসারে, ১৩,৬১ হেক্টর (২০১১ আদমশুমারি অনুসারে) জমিতে অবস্থিত গৌড়বাড়ি গ্রামে প্রায় সব জমিই আবাদি - সেখানে মাত্র ৩০০ হেক্টর জমি সেচসিঞ্চিত; বাকি জমি বর্ষা-নির্ভর। সোলাপুর জেলার সরকারি তথ্য দেখায় যে ওই জেলার সেচ-যোগ্য ৭৭৪,৩১৫ হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ৩৯.৪৯% জমি সেচের সুবিধা পেয়েছে ২০১৫ সালে।
কৃষকদের মতে, (ক্রমহ্রাসমান বর্ষার সঙ্গে পাল্লা দিতে দ্রুত ফলনশীল ফসল চাষের কারণে) আবাদি জমি খালি পড়ে থাকা এবং তাপমাত্রা বাড়ার কারণে জমি আরও আর্দ্রতা হারাচ্ছে। জমির আর্দ্রতা “এখন আর [জমির] ছয় ইঞ্চি গভীর অবধিও নেই” বললেন হাউসাবাঈ।
ভূগর্ভস্থ জলস্তরও নেমে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের জল-স্তর সমীক্ষা ও উন্নয়ন এজেন্সির সম্ভাব্য জল-সংকট বিষয়ক রিপোর্ট দেখাচ্ছে যে ২০১৮ সালে সাঙ্গোলের ১০২টি গ্রামের জল-স্তর প্রায় এক মিটার নেমে গেছে। “আমি একটি বোরওয়েল খোঁড়ার চেষ্টা করে দেখেছি যে ৭৫০ ফিট গভীরেও জল নেই। জমি একেবারে শুকনো”, বললেন গৌড়বাড়িতে চার একর জমি ও একটি চুল ছাঁটার ছোটো দোকানের মালিক জ্যোতিরাম খান্ডাগালে। তাঁর সংযোজন, “বিগত কয়েক বছর ধরে রবি ও খরিফ কোনও ফসলেরই ভালো ফলন হওয়া আর নিশ্চিত নয়।” মালি হিসাব করে বললেন যে গৌড়বাড়িতে ১৫০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন বোরওয়েলের মধ্যে অন্তত ১৩০টিই শুকিয়ে গেছে এবং মানুষ জলের খোঁজে এমনকি ১,০০০ ফিট অবধি খুঁড়ছেন।
আখ উৎপাদনের দিকে ব্যাপক ঝোঁক খাদ্যশস্যের চাষ থেকে কৃষককে ক্রমশ সরিয়ে আনতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। কৃষি বিভাগ জানাচ্ছে যে ২০১৮-১৯ সালে সোলাপুরে রবি শস্যের মরশুমে মাত্র ৪১% শতাংশ জোয়ার ও ৪৬% ভুট্টা চাষ হয়েছে। গোটা মহারাষ্ট্র জুড়ে জোয়ার চাষের জমি ৫৭% আর ভুট্টা চাষের জমি ৬৫% কমে গেছে বলে জানাচ্ছে রাজ্যের ২০১৮-১৯ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা। তাছাড়া উভয় ফসলের ফলনই প্রায় ৭০% কমে গেছে।
এই দুই ফসলই মানুষ তথা পশুর খাদ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস। পশু
খাদ্যের এই চরম অভাব সাঙ্গোলেতে সরকারকে (ও অন্যান্যদের) শুখা মরশুমে পশু শিবির
খুলতে বাধ্য করেছে। পোপট গডদের হিসাব মতো ২০১৯ সালে এখনো অবধি ১০৫টি শিবিরে ৫০,০০০
পশু আশ্রয় পেয়েছে। ইনি
দুগ্ধ সমবায়ের পরিচালক এবং গৌড়বাড়ির পশু শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা। ছাউনিতে পশুরা কী
খায়? সেই আখ যা (হিসাব মতো) হেক্টর পিছু ২৯.৭ মিলিয়ন লিটার জল গিলে থাকে।
একটির সঙ্গে আর একটি বিষয় সম্পৃক্ত হয়ে সাঙ্গোলেতে কত পরিবর্তন ঘটে চলেছে — এর কিছু নিশ্চয় ‘প্রাকৃতিক’ আর বেশ কিছু মনুষ্যসৃষ্ট। এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে আছে কম বৃষ্টিপাত স্বল্পস্থায়ী বর্ষাকাল, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, উচ্চ তাপমাত্রা সম্বলিত অধিকতর দিন, প্রায় লুপ্ত হতে বসা মৌসুমী বর্ষা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বৃষ্টিপাত এবং জমির আর্দ্রতা ক্ষয়। এর সঙ্গে আছে চাষের ধরনে পরিবর্তন — দ্রুত ফলনশীল ফসল চাষ ও তার ফলে আবাদি জমির পরিমাণগত লোকসান, কমসংখ্যক দেশি প্রজাতির ফসল চাষ, জোয়ারের মতো খাদ্যশস্য চাষে ঘাটতি, আর আখের মতো অর্থকরি ফসলের চাষে ক্রমাগত বৃদ্ধি — সঙ্গে আছে সেচ ব্যবস্থার অভাব ও নিম্নমুখী ভূগর্ভস্থ জলস্তর এবং আরও নানান বিষয়।
এই সব পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে পশু শিবিরে বসে মৃদু হেসে তাত্যিয়া বললেন, “আমরা যদি একটু মেঘরাজার মনের কথা জানতে পারতাম! মানুষ এমন লোভী হয়ে গেছে বৃষ্টি আর হবে কী করে? মানুষ যখন নিজের ধরনধারণ বদলে ফেলেছে, তখন প্রকৃতিই বা নিজের স্বভাব বজায় রাখবে কী করে?”
লেখক শাহজি গাদাহিরে ও দত্তা গুলিগকে সময় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করার জন্য লেখক ধন্যবাদ জানাচ্ছেন ।
কভার চিত্র : সংকেত জৈন/পারি
পারি-র জলবায়ু বিবর্তনের উপর দেশব্যাপী রিপোর্টিং সংক্রান্ত প্রকল্পটি ইউএনডিপি সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য জলবায়ুর বিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি দেশের সাধারণ মানুষের স্বর এবং অভিজ্ঞতায় বিবৃত করা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিল্কা