মাদুরাইয়ে আমাদের বাড়ির সামনেই একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে, মনে দাগ রেখে যায় এমন না জানি কত গল্প করেছি তার সঙ্গে। বড়োই গহীন সে আলোর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা। ইস্কুলে পড়াকালীন আমাদের বাড়িতে কারেন্ট ছিল না, ২০০৬ সালে বিজলি বাতি এসেছিল বটে, তবে ৮ ফুট বাই ৮ ফুটের ছোট্ট একটা দালানে থাকতাম তখন। একটাই কামরা, জনা পাঁচেক মানুষের ভিড় তার ভিতর। সেই কারণেই বোধহয় দিনকে দিন আরোই জড়িয়ে গিয়েছিলাম ল্যাম্পপোস্টের আলোআঁধারিতে।
ছোটবেলাটা ছিলো বাড়ি-বদলের হলফনামা। কুঁড়েঘর থেকে মাটির কোঠা, সেখান থেকে ভাড়াবাড়ি, শেষে এখন যেখানে থাকি সেই কুড়ি বাই কুড়ির দালানটা। ১২টা বছর ধরে আমার মা-বাবা তিলে তিলে এটা গড়ে তুলেছেন। হ্যাঁ, রাজমিস্ত্রি বহাল করা হয়েছিল বটে, তবে নিজেরাও কম ঘাম ঝরাননি তাঁরা। বাড়িটা পুরোপুরি বানানোর আগেই গৃহপ্রবেশ করেছিলাম আমরা। তবে লাট্টুর মতো এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি গেলেও ল্যাম্পপোস্টটা কিন্তু বরাবর চৌহদ্দির মধ্যেই ছিল। চে গেভারা, নেপোলিয়ান, সুজাতা, না জানি কত বই-ই না পড়েছি তার আলোয় বসে।
এই যে এখন গল্পটা লিখছি, এর সাক্ষীও কিন্তু সেই একই ল্যাম্পপোস্ট।
*****
করোনার দয়ায় বহুদিন পর মায়ের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতে পারলাম। ২০১৩ সালে প্রথম ক্যামেরা কেনার পর থেকে বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরেই থেকেছি। ইস্কুল-জীবনে ঠিক যা যা ভাবতাম, ক্যামেরাটা হাতে আসার পর থেকে পাল্টে গিয়েছিল সবই। তবে কোভিড আসার পর শুরু হল লকডাউন, মাসের পর মাস জুড়ে বাড়িতেই ছিলাম মায়ের কাছে। তাঁর সঙ্গে একটানা এতটা সময় এর আগে কক্ষনো কাটাইনি।
এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে কক্ষনো দেখিনি মাকে। এটাসেটা সারাক্ষণই কিছু না কিছু করতে থাকেন। তবে বছর কয়েক আগে হঠাৎই জেঁকে ধরে বাত, এক লহমায় কেমন যেন জবুথবু হয়ে গেলেন মানুষটা। মনের ভিতরটা উথালপাথাল হয় এটা ভাবলেই যে মাকে এভাবে যে কোনওদিনও দেখিনি।
দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না মায়েরও। "বুড়ো বয়েসে এ কি অবস্থা হল রে আমার? কে দেখবে আমার ছেলেমেয়েদের এবার?" মা যখনই বলেন: "কুমার রে, আমার পা-দুটো আবার আগের মতো ঠিক করে দে না," কেমন যেন অপরাধীর মতো মনে হয় নিজেকে, সত্যিই তো আমি মায়ের দেখভাল করিনি ঠিকমতন।
মায়ের গল্প করতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এই যে আমি ফটোগ্রাফার হতে পেরেছি, এত যে লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা করছি, আমার খেতাব, আমার কীর্তি – এসবই মা-বাবার হাড়ভাঙা খাটুনির ফসল। বিশেষ করে মায়ের। আমার জীবনে মায়ের অবদান বাকি সব্বার চেয়ে বেশি।
ভোর ৩টে বাজতে না বাজতেই আম্মা ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়তেন বাইরে, মাছ বেচতে হবে যে। রেহাই পেতাম না আমিও, ওমন বিদঘুটে একটা সময়ে জোর করে তুলে আমায় পড়তে বসাতেন মা। ব্যাপারটা তাঁর পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না। আম্মা বেরোনো অবধি সেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পড়তে বসতাম বটে, কিন্তু মা নজরের বাইরে বেরোতে না বেরোতেই সটান গিয়ে ঘুম দিতাম, শিকেয় উঠতো পড়াশোনা। এমন হাজারো ঘটনার সাক্ষী হয়ে থেকেছে ল্যাম্পপোস্ট বাবাজি।
জানেন, তিন-তিনবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে আমার মা? তিনবারই যে কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।
একটা ঘটনার কথা না বলে পারছি না। আমি তখন ছোট্টটি, গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিলেন মা। ঠিক তখনই জোরসে কঁকিয়ে উঠেছিলাম আমি। আমার কান্না শুনে পড়শিরা দৌড়ে এসে দেখে যে আম্মা ছাদ থেকে ঝুলছে। তড়িঘড়ি মা-কে নামিয়ে আনে তারা। কেউ কেউ বলে যে মানুষটার নাকি জিভ বেরিয়ে গিয়েছিল নামিয়ে আনার সময়। মা আজও মাঝেসাঝে বলেন: "তুই কেঁদে না উঠলে কেউ ছুটে আসতো না রে আমাকে বাঁচাতে।"
আমার মায়ের মতো এমন অনেক মা-ই আছে যারা বারেবারে শেষ করে দিতে চেয়েছে নিজেদের। শেষ মুহূর্তে না জানি কোন জাদুবলে সন্তানের মুখ চেয়ে ফিরে এসেছে তারা। ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে গেলেই চোখদুটো ছলছল করে ওঠে মার।
একবার পাশের এক গাঁয়ে গিয়েছিলেন মা, বীজধান বুনতে। আমায় একটা থুলিতে (বাচ্চাদের জন্য কাপড়ের দোলনা) ভরে কাছেই একটা গাছে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। হঠাৎই সেখানে এসে উপস্থিত হন বাবা, মা-কে আচ্ছাসে পিটুনি দিয়ে থুলি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেন আমাকে। বেশ খানিকটা দূরে, শ্যামলা সবুজ খেতের কাদামাখা আলে ছিটকে পড়ি আমি। দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমার দম আটকে গিয়েছে।
জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন মা। তখন চিথি, অর্থাৎ মা-র ছোট বোন, আমায় হেঁটমুণ্ডু করে ঝুলিয়ে পিঠ থাবড়াতে থাকেন জোরে জোরে। সবাই বলে যে ঠিক তক্ষুনি নাকি আমি কেঁদে উঠেছিলাম। সেদিনকার কথা মনে করলেই শিরদাঁড়া দিয়ে যেন বরফ বয়ে যায় মায়ের। মা বলেন, সাক্ষাৎ যমের মুখ থেকে ফিরে এসেছিলাম আমি।
*****
আমার তখন দু'বছর বয়েস, অন্যের খেতে মজুরি ছেড়ে মাছ বিক্রি করা শুরু করেন মা। সেই থেকে আজ অবধি তাঁর রুজিরুটির সহায় এটাই। আমি তো রোজগার করা শুরু করেছি এই বছরটাক হ'ল মোটে, তার আগে পর্যন্ত আম্মার রোজগারেরই ভরসাতেই আমাদের পরিবারটা টিকেছিল। বাতে ধরার পরও মুখে ওষুধ গুঁজে মাছ নিয়ে বেরোতেন মা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলাটাই যে তাঁর বারোমাস্যা।
আমার মায়ের নাম থিরুমায়ি, গাঁয়ের লোক অবশ্য কুপ্পি বলেই ডাকে। ফলত আমি হয়ে গিয়েছি 'কুপ্পির পোলা'। আগাছা উপড়ানো, ধান কাটা, খাল কাটা: এই করেই বছরের পর বছর কেটে গেছে মায়ের। দাদমশায় একফালি একটা জমি ইজারায় নিলে সেটায় সার-টার ছড়িয়ে চাষযোগ্য করার দ্বায়িত্বটাও আম্মার একার ঘাড়ে এসে পড়েছিল। কোমরভাঙা যে খাটুনিটা মা বরাবর খেটে এসেছেন, ওমনটা আর কাউকে খাটতে দেখিনি আজ অবধি। আম্মাই (দিদা) বলতেন যে হাড়ভাঙা খাটুনি আর আমার মা, এই দুটো নাকি একই জিনিস। একটা মানুষ যে কীভাবে দিনান্ত এমন পরিশ্রম পারে, কিছুতেই ভেবে পেতাম না।
তবে একটা জিনিস বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছি – দিনমজুর, বিশেষ করে যাঁরা মহিলা, তাঁরা অতিরিক্ত মেহনত করতে বাধ্য হন। মাকে নিয়ে সাত-সাতটা সন্তানের মা ছিলেন আমার দিদিমা – ৫টি মেয়ে ও ২টি ছেলে। মা-ই সবার বড়ো। দাদু ছিলেন বেহেড মাতাল, ঘরদুয়ার বেচে সব টাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন মদে। ফলত সবরকমের দায়-দায়িত্ব দিদিমা একাই সামলেছিলেন: রুজিরুটির বন্দোবস্ত, ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদি, এমনকি নাতিনাতনিদের দেখভাল অবধি।
কাজের প্রতি এই একই ধরনের আত্মত্যাগ দেখেছি আমার মায়ের মধ্যে। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে যখন ঘর বাঁধতে চেয়েছিল চিথি, একবুক সাহস নিয়ে বিয়ের সমস্ত ইন্তেজাম করেছিলেন আমার মা। একবার আমাদের বাড়িতে আগুন লেগে গিয়েছিল জানেন? তখন একটা কুঁড়েঘরে থাকতাম। আমার ছোট ছোট ভাইবোন আর আমার হাত ধরে একছুটে বাইরে বেরিয়ে আসে আম্মা, নয়তো কেউই বাঁচতাম না। মানুষটা বরাবরই এমন দুঃসাহসী। নিজের জীবনের বাজি রেখেও সন্তানের কথা আগে ভাবা, এমনটা একজন মা ছাড়া আর কেউ পারে এই দুনিয়ায়।
বাড়ির ঠিক বাইরেই কাঠের উনুন জ্বেলে পানিয়ারম (মিঠে কিংবা মশলাদার একধরনের পিঠে) বানাতেন মা। লোকজন যাওয়া-আসা করত; খাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকত ছানাপোনারা। মা কিন্তু একটাই কথা বলতেন: "আগে সব্বার সঙ্গে ভাগ করে নাও।" এইটা শুনে মুঠোভরা পানিয়ারম তুলে দিতাম পড়শি বাচ্চাদের হাতে।
অন্যের প্রতি এই যে তাঁর অপার অনুকম্পা, হাজারো জিনিসের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠত সেটা। যখনই মোটরবাইকটা স্টার্ট করি, আম্মা বলে ওঠেন: "নিজে আছাড় খেতে হলে খেয়ো, কিন্তু খেয়াল রেখো অন্য কারও যেন হাতপা না ভাঙে..."
মানুষটা দুটি খেয়েছে কিনা বাবা এটা কক্ষনো জিজ্ঞাসা করে দেখেননি। দুজনে একসঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছে, বা মন্দিরে গেছে পুজো দিতে – আজ পর্যন্ত এমনটা দেখিনি। জীবনভর মা শুধু খেটেই মরেছেন। মাঝেমাঝেই তাই বলে ওঠেন: "তুই না থাকলে সেই কবেই মরে যেতাম রে।"
ক্যামেরা কেনার পর থেকে গল্পের খোঁজে যতজন নারীর কাছে গিয়েছি, প্রত্যেকের মুখে সেই একই কথা শুনেছি প্রতিবার: "সন্তানদের জন্যই তো বেঁচে আছি।" কথাটা যে কতখানি সত্যি, সেটা আজকে এই ৩০ বছর বয়সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমি।
*****
মাছ বেচতে গিয়ে মা দেখতেন যে সবকটা বাড়িতেই বাচ্চারা যা যা কাপ বা মেডেল জিতেছে সেসব কেমন সাজিয়ে রাখা আছে। একদিন নিজের ছেলেমেয়েরাও ট্রফি জিতে আনবে, এ স্বপ্ন তাড়া করে ফিরত তাঁকে। কিন্তু ইংরেজি খাতায় "রসগোল্লা" ছাড়া আমি আর কিছুই যে দিতে পারতাম না মাকে। সেদিন প্রচণ্ড খেপে গিয়ে বলেছিলেন, "আ মরণদশা, কষ্ট করে বেসরকারি ইস্কুলের বেতন গুনে মরছি, আর এদিকে ইনি দিব্যি ইংরেজিতে ফেল করে ফিরছেন।"
মায়ের এই নিকষ রাগটা আমার জেদের বাগানে সাফল্যের বীজ হয়ে দাঁড়ায়। শুরু হয় ফুটবল দিয়ে। ইস্কুলের ফুটবল টিমে স্থান পেতে দু-দুটো বছর মুখ চেয়ে বসেছিলাম, আসলে বড্ড ভালোবাসতাম যে এই খেলাটাকে। দলের সঙ্গে প্রথম খেলাতেই টুর্নামেন্টের কাপ জিতে যাই আমরা। মাথা উঁচু করে বাড়ি ফিরে সে ট্রফি তুলে দিয়েছিলাম মায়ের হাতে।
ফুটবল থেকে পড়াশোনারও উন্নতি হয়েছিল। খেলাধুলার কোটা ছিল বলেই না হসুরের একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিগ্রি-হাতে বেরোতে পেরেছিলাম। একথা আলাদা যে অচিরেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে জলাঞ্জলি দিয়ে ক্যামেরা তুলে নিয়েছিলাম হাতে, তবে হ্যাঁ, সোজা সাপ্টা ভাষায় বলতে গেলে আজ আমি যা আছি, যেখানে আছি, পুরোটাই আম্মার কৃতিত্ব।
মা পারুথিপাল পানিয়ারম (তুলোবীজের দুধ আর গুড় দিয়ে বানানো মিষ্টি একজাতীয় পিঠে) কিনে দিত বলে ছোটবেলায় তাঁর সঙ্গে বাজারে যেতাম লোভে লোভে।
কখন টাটকা মাছ আসবে বাজারে তার অপেক্ষায় রাতের পর রাত রাস্তার ধারের চাতালে মশার সঙ্গে যুদ্ধ করা, যাতে সক্কাল সক্কাল কেনা যায়, এসব কথা ভাবতে গেলে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় মাথাটা। তবে এসব খুবই মামুলি জিনিস ছিল তখনকার দিনে। সমস্ত মাছ বেচেও মুনাফা হতো যৎসামান্য।
মাদুরাই কারিমেদুর মাছপট্টি থেকে কিলো পাঁচেক মাছ কিনতেন আম্মা। এই ওজনটা কিন্তু বরফ সমেত। ফলত সেই মাছ ঝুড়িতে ভরে মাথায় তুলে মা যতক্ষণে মাদুরাইয়ের অলিগলিতে ফেরি করা শুরু করতেন, বরফ গলে ওজনটা এসে ঠেকতো ৪ কিলোয়।
২৫ বছর আগে এই ব্যবসায় নেমেছিলেন আম্মা, তখন সারাটাদিন খেটেও ৫০ টাকার বেশি মুনাফা হত না। পরে সেটা বেড়ে ২০০-৩০০ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। ততদিনে অবশ্য রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করার বদলে নিজের একটা গুমটি বসিয়েছিলেন মা। এখন মাস গেলে ১২,০০০ টাকা রোজগার হয়, তবে একদিনও ছুটি পান না, মাসের ৩০ দিনই খাটতে হয় তাঁকে।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বুঝেছিলাম যে সপ্তাহের দিনগুলোয় ১,০০০ টাকার করে মাছ কেনেন মা, পরিমাণ হয় একেক দিন একেক রকমের। তবে সপ্তাহান্তের দুটো দিন বিক্রিবাটা হয় সবচাইতে বেশি, তাই ২,০০০ টাকার অবধি মাছ কেনা যায় আরামসে। আজ সেটা বেড়ে ১,৫০০ হয়েছে সপ্তাহের ৫টা দিন, আর সপ্তাহান্তের হিসেব বাড়তে বাড়তে ৫-৬ হাজার টাকার মাছে এসে ঠেকেছে। তবে মানুষটা বড্ডো দরাজ-দিল, তাই মুনাফাটাও যে সমান তালে বেড়েছে তা নয়। ওজনে চুরি করাটা আম্মার ধাতে নেই, উল্টো খদ্দেরদের বেশি বেশি করে মাছ দিয়েই সুখী হন তিনি।
কারিমেডুতে মাছ কেনার টাকাটা এক মহাজনের থেকে ধার করেন মা, ফেরত দেন তার পরেরদিন। সপ্তাহের দিনগুলোয় ১,৫০০ টাকা নিয়ে তার পরেরদিন ফেরত দিতে হয় ১,৬০০ টাকা – অর্থাৎ দৈনিক ১০০ টাকার সুদ, ধারের পরিমাণ সে যা-ই হোক না কেন। আপাত দৃষ্টিতে জলের দর মনে হতেই পারে, তবে সাপ্তাহিক কর্জ যেহেতু সেই হপ্তাতেই চুকিয়ে ফেলতে হয়, ফলত সারা বছরের হিসেবনিকেশ করলে দেখা যাবে যে পেটকাটা এ সুদের আসল হার আদতে ২,৪০০ শতাংশেরও বেশি।
ওদিকে সপ্তাহান্তের মাছ-কেনার ৫,০০০ টাকা সুদে-আসলে ৫,২০০ টাকা হয়ে যায় সোমবারে। দিনটা সপ্তাহের মধ্যে পড়ুক বা শেষে, শোধ করতে যত দেরি হবে ততই ১০০ টাকা করে দৈনিক বাড়তে থাকবে সুদের পরিমাণ। সুতরাং বাৎসরিক হিসেব অনুযায়ী সপ্তাহান্তের সুদ ৭৩০ শতাংশ।
মাছপট্টিতে যাতায়াত করতে করতে রংবেরঙের গল্প শোনার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। কয়েকটা তো রীতিমতো তাজ্জব বনে যাওয়ার মতো। এছাড়াও ফুটবল প্রতিযোগিতা চলাকালীন বা বাবার সঙ্গে সেচখালে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় শোনা গল্প, সবকিছু মিলে আমার ভিতর তৈরি হয় সিনেমা তথা দৃশ্যকল্পের প্রতি এক অদ্ভুত টান। প্রতি সপ্তাহে খানিকটা করে খোরাকির টাকা পেতাম আম্মার থেকে, সেটা দিয়ে কেনা চে গেভারা, নেপোলিয়ান আর সুজাথার বই পড়তে পড়তে না জানি কখন সম্পর্কটা আরোই নিবিড় হয়ে গেল সেই ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে।
*****
একটা সময় ধীরে ধীরে বাবার মধ্যেও পরিবর্তন আসে, সে মানুষটাও রোজগেরে হয়ে ওঠে একদিন। দিনমজুরির এটাসেটার পাশাপাশি ছাগল পোষা শুরু করেন বাবা। হপ্তা গেলে ৫০০ টাকা আসতো তাঁর পকেটে। তারপর শুরু হয় হোটেল আর রেস্টুরেন্টের কাজ করা। এখন তাঁর রোজগার দৈনিক ২৫০ টাকা। এখন যে বাড়িটায় আমরা সবাই থাকি, ২০০৮এ মা-বাবা সেটা মুখ্যমন্ত্রীর আবাসিক বিমা প্রকল্পের আওতায় খানিক টাকা ধার করে বানাতে শুরু করেছিলেন। বাড়িটা জওহরলাল পুরমে, একদা যেটা তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ের একপ্রান্তে একটি স্বতন্ত্র গ্রাম ছিল। শহরটা বাড়তে বাড়তে গিলে খেয়েছে তার পড়শিদের, আজ তাই এটা কেবলই একটা শহরতলি হয়ে বেঁচে আছে।
হাজারো বাধাবিপত্তি টপকে ১২ বছর ধরে এই বাড়িটা বানিয়েছেন আমার মা-বাবা। পাই পাই করে টাকা জমিয়েছেন বাবা; কাপড়জামা রং করার কারখানা, হোটেল, গরুছাগল চরানো, না জানি আরও কত কি কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। আমায় আর আমার দুই ভাইবোনকে ইস্কুলে রেখে পড়ানো, একটা একটা করে ইঁট গেঁথে বাড়িটা দাঁড় করানো, এসবই হয়েছে তিলে তিলে জমানো সেই পুঁজি থেকেই। তাঁদের আত্মত্যাগের জীবন্ত দলিল আমাদের এই গেরস্থালি, দাঁতে দাঁত চিপে টিকে থাকার এ এক আজব দস্তাবেজ।
জরায়ুর কিছু সমস্যা দেখা গেলে সরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করিয়েছিলেন আম্মা, খরচা হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। তখন কলেজে পড়তাম আমি, ফলত নিজে থেকে একটা পয়সাও জোগাড় করতে পারিনি। যে নার্সের তত্ত্বাবধানে মা ছিলেন, তিনি মোটেও সেবাআত্তি করতেন না ঠিকমতো। আম্মাকে আরও ভালো কোনও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম বটে, কিন্তু ট্যাঁকের সে জোর ছিল না আমার। এ হেন সময় আমার জীবনে দেখা দেয় পারি (PARI), দ্রুতগতিতে বদলাতে থাকে অবস্থাটা।
আমার ভাইয়ের অস্ত্রোপচারের সময়েও খরচাপাতির দ্বায়িত্ব নিয়েছিল পারি। মাসে মাসে যে বেতনটা পেতাম, পুরোটাই তুলে দিতাম মায়ের হাতে। বিকতান পুরস্কারের মতো অজস্র খেতাব জুটতে থাকে, ছেলে যে শেষমেশ উন্নতি করছে জীবনে, ধীরে ধীরে সে আস্থা জন্মায় আম্মার। তবে বাবা কিন্তু আজও ঠাট্টা করা ছাড়েননি আমার সঙ্গে, মাঝেসাঝেই চোখ টিপে বলে ওঠেন: "খেতাব টেতাব পাচ্ছিস বটে, কিন্তু বাড়িতে ঠিকমতো পয়সাকড়ি দিতে পারছিস কি?"
হক কথাই বলেছিলেন। ছবি তোলা যদিও সেই ২০০৮ সালেই শুরু করেছিলাম, কাকা আর বন্ধুবান্ধবের থেকে মোবাইল ধার করে, কিন্তু ২০১৪ সালের আগে বাড়ি থেকে খরচা-পানির টাকা নেওয়া বন্ধ করতে পারিনি। ততদিন অবধি এটাসেটা হরেক রকমের কাজ করতে থেকেছি – কখনও হোটেলে বাসন ধোয়া, কখনও বিয়েবাড়ি বা অন্য কোনও জায়গায় খাবার পরিবেশন।
এই যে আমি আজ মায়ের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা তুলে দিতে পারছি, এ জায়গায় পৌঁছতে দশ-দশটা বছর সময় লেগেছে আমার। বিগত এক দশক ধরে হাজার একটা ঝক্কি সামলেছে গোটা পরিবার। পালা করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে মা আর বোন। হাসপাতালটা যেন দ্বিতীয় বাড়ি আমাদের। এছাড়াও মায়ের গর্ভাশয়ের সমস্যাগুলো তো রয়েইছে। তবে আজ আমাদের অবস্থা অনেকটাই ভালো। মা-বাবার জন্য কিছু না কিছু যে করতে পারবো, সে ভরসা আজ আছে আমার নিজের উপর। এই যে আমি একজন ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি – নিজস্ব অভিজ্ঞতায় তাঁদের সে যন্ত্রণার শরিক না হলে এমনটা কখনওই পারতাম না। ওঁদের টিকে থাকার যুদ্ধেই যে আমার যাপনের হাতেখড়ি। সেই ল্যাম্পপোস্টের আলো যে আজও পথ দেখায় আমাকে।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)