“এই রায়ের [শীর্ষ আদালতের] ফলে আমাদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার বাড়বে!”
সরোজা স্বামীর কথা মন দিয়ে শুনুন। বিগত ২রা এপ্রিল, মুম্বই শহরে বিক্ষোভে সামিল হওয়া তথা দেশব্যাপী লক্ষ লক্ষ দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের রাগ তাঁর কথায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
৫৮ বছর বয়সী রাজনৈতিক কর্মী সরোজ সেন্ট্রাল মুম্বইয়ের দাদরের কোতোয়াল উদ্যান থেকে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে শিবাজী পার্কের নিকটস্থ চৈত্য ভূমির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলেন, “এমন একটা সময়ে আমরা বেঁচে আছি যখন একজন দলিত তরুণকে ঘোড়ায় চড়ার ‘অপরাধ’ করার জন্য হত্যা করা হয়।”
১৯৮৯ সালের তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি (নিপীড়ন বিরোধী) আইনের বেশ কিছু ধারাকে শিথিল করার শীর্ষ আদালতের ২০শে মার্চের রায়ের পর থেকেই প্রতিবাদীরা অত্যন্ত ত্রস্ত এবং বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের অর্থ দাঁড়ালো, এরপর থেকে যে সকল সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে দলিত বা আদিবাসীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ আছে, একমাত্র তাঁদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পূর্ব অনুমোদনের ভিত্তিতেই তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা বা মামলা-মোকদ্দমা করা সম্ভব হবে।
শুধু তাই নয়, পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্টকে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখে সেগুলি সত্য নাকি ভুয়ো তা নির্ধারণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার এই রায়ের বিরোধিতা করে পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করে রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছে। বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে শুনানি করতে আদালত সম্মতি প্রদান করেছে।
এনসিআরবি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে অত্যাচারের ঘটনা শতকরা ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শাস্তির হার ছিল অত্যন্ত কম – শতকরা ২-৩ শতাংশ
স্বামীর জিজ্ঞাসা, “এমন একটা সময়ে, এই রায় ঘোষণার ঘটনার আদৌ কোনও ন্যায্যতা বিচার করা যায় সম্ভব? মহিলাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে কারণ তারা দলিত, আমাদের জাতিগত পরিচয়ের কারণে আমরা চাকরিতে প্রত্যাখ্যাত হই। এছাড়া গ্রামে গ্রামে বারোয়ারি কুয়ো ব্যবহার করতে না পারার মতো দৈনন্দিন বৈষম্য তো আছেই।”
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ উঠে আসছে দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধের/ অত্যাচারের ঘটনা ২০১৫ সালে ৩৮,৬৭০ থেকে ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪০,৮০১ (৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি)। একইরকমভাবে তফসিলি উপজাতিভুক্ত মানুষের বিরুদ্ধেও নিপীড়নের ঘটনায় ৪.৭ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে।
নির্যাতনের ক্ষেত্রে শাস্তিদানের হার অতি সামান্য ২-৩ শতাংশ, এর থেকেই স্পষ্ট কেন তাঁদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে দলিত ও আদিবাসীদের মধ্যে এত তীব্র অসন্তোষ দানা বাঁধছে।
২০১৬ সালের অক্টোবরে দেশের প্রধানমন্ত্রী এই মন্তব্য করতে বাধ্য হন যে, “এমনকি আজকের দিনেও আমাদের দলিত ভাইদের প্রতি আক্রমণের ঘটনাগুলি” দেখে “লজ্জায় আমার মাথা নত হয়ে যায়।” অথচ তাও, তাঁর শাসনকালেই এই অত্যাচারের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
দাদর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে মুম্বইয়ের উপকণ্ঠে ভান্ডুপ অঞ্চলে বসবাসকারী সরোজার বক্তব্য, মোদী সরকারের শাসনকালে দলিতদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, “রোহিত ভেমুলা কোন দোষটা করেছিল? কেনই বা উনায় এত বিক্ষোভ হল? দলিতরাও তো মানুষ।”
২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিত ভেমুলার ঘটনাটি জনসমক্ষে আসে। হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, দলিত সম্প্রদায় থেকে আগত ঝকঝকে তরুণ গবেষক রোহিতের পিএইচডি-এর বৃত্তি বন্ধ করে দিলে রোহিত আত্মহননের পথ বেছে নেন। তাঁর মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদরত দলিত ও বামপন্থী ছাত্র-কর্মীদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
সারোজের মতোই, ভান্ডুপের ষোল বছরের তরুণী, বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী মনীষা ওয়াংখেড়েও ক্রুদ্ধ। তিনি মনে করেন বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর দেশকে যে সংবিধান প্রদান করেছেন তা আজ আক্রান্ত হতে বসেছে। মনীষার কথায়, “সংবিধান মান্য করে চললে শম্ভাজী ভিডে [ভীমা কোরেগাঁও হিংসার মামলায় অভিযুক্ত কুখ্যাত ব্যক্তি] এতদিনে হাজতে থাকত। মোদি সরকার এইসব দুষ্কৃতীদের মদত দিয়ে চলেছে। আম্বেদকরের প্রতি লোক দেখানো শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন, অথচ তাঁরই লেখা সংবিধানকে অশ্রদ্ধা করেন। এটা মোটেই সংবিধানের সীমাবদ্ধতা নয়, সংবিধানকে যথাযথভাবে বলবৎ করতে না পারার দায় সম্পূর্ণরূপে সরকারেরই।”
তাঁর কথায় যুক্তি আছে। বিগত তিন বছরে দলিতদের উপর আক্রমণের ঘটনায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে, গুজরাটের গীর সোমনাথ জেলার উনা শহরে চারজন দলিত যুবকের উপর অকথ্য অত্যাচারের প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘অপরাধ’ হল: মৃত গবাদি পশুর চর্ম সংগ্রহ।
সবে তিনমাস হল ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনার। মহারাষ্ট্রের পুণে জেলার কোরেগাঁও ভীমা থেকে দলিতদের যাতায়াতের পথে তাঁদের উপর উচ্চবর্ণের প্রভাবশালী জাতি গোষ্ঠীগুলি যথেচ্ছ হিংসা চালায়। ১৮১৮ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মাহার সৈন্যদের হাতে পেশোয়ার নেতৃত্বাধীন উচ্চবর্ণ মারাঠা সেনাদের পরাজয়ের ঘটনার স্মরণে প্রতি বছর দলিতরা বিপুল সংখ্যায় ভীমা কোরেগাঁওয়ে একত্রিত হন।
এইসমস্ত হিংসাত্মক ঘটনার স্মৃতি মুম্বইয়ে সমবেত প্রতিবাদকারীদের মনে দগদগ করছিল। চৈত্য ভূমিতে পৌঁছানোর পরে নেতৃস্থানীয়রা গান ধরলেন, স্লোগান এবং বক্তৃতা দিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুপরিচিত রাজনৈতিক কর্মী উল্কা মহাজন, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর জেনারেল সুধাকর সুরাদকর এবং অন্যান্যরা।
সুরাদকার বলছিলেন, সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষদেরই এই নিপীড়ন বিরোধী আইনটিকে বোঝা দরকার। “পুলিশেরও জানা দরকার। অজ্ঞতার কারণেই এই আইনের সন্তোষজনক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। মনে রাখা দরকার সমাজে প্রত্যেক মানুষের নিজের নিজের দায়িত্ব রয়েছে।”
মুম্বইয়ের পদযাত্রা কর্মসূচি ঘিরে রাস্তায় উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়নি। তবে, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে তীব্রতর বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। যেদিন দেশ জোড়া প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছিল, সেদিন সংঘর্ষে সাতজন প্রাণ হারান: মধ্যপ্রদেশে পাঁচজন, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানে একজন করে মারা যান। গুজরাট ও পঞ্জাব থেকেও সহিংস আক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। প্রায় ১,৭০০ দাঙ্গা দমনকারী পুলিশ কর্মীকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিযুক্ত করা হয়। দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অত্যাচারে শীর্ষে ছিল যেসব রাজ্য সেখানেই সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ হয়েছে।
জমি সংক্রান্ত বিরোধ বিষয়ক একজন সক্রিয় কর্মী চন্দা তিওয়ারি একদল বন্ধুর সঙ্গে ১৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুদূর রায়গড়ের রোহা থেকে দাদরে এসেছেন। চন্দা জানালেন, “আমরা নিজের টাকা খরচ করে, নিজেদের খাবারদাবার প্রস্তুত করে নিয়ে এসেছি এবং আমরা নিজেদের জলও সঙ্গে এনেছি।” চতুর্দিক তখন “ জো হিটলার কি চাল চলেগা , ওহ হিটলার কি মৌত মরেগা ” স্লোগানে মুখরিত। “আজ রাতের ট্রেন ধরেই আমরা আবার নিজের নিজের ঘরে ফিরে যাব। যদিও খুব একটা ভিড় হয়নি, কিন্তু আমাদের এই ধরনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে সরকারকে বার্তা দেওয়া দরকার। আমরা আমাদের দলিত ভাইবোনদের সঙ্গে আছি।”
২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “যেসকল আইনে আমরা উপকৃত হই সেগুলো বাস্তবায়িত করা হয় না।” এই আইনের ফলে কয়েক দশক ধরে আদিবাসীরা যে জমি চাষ করে চলেছেন তার মালিকানা সংক্রান্ত পাট্টা তাঁদের পাওয়ার কথা। “আমাদের জন্য উপকারী আইনগুলি যদিবা বলবৎ করা হয়, তাহলে অবশ্যই সেগুলিতে নানান রদবদল করে শিথিল করে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে!”
জমায়েতে অংশগ্রহণকারী ২০০ জনের প্রায় প্রত্যেকেই কোনও দল বা সঙ্গীর সঙ্গে রয়েছেন। ব্যতিক্রম সুনীল যাদব। ৪৭ বছর বয়সী সুনীল দাদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে নভি মুম্বইয়ের বাসিন্দা। সংবাদপত্রে এই প্রতিবাদ মিছিলের খবর পড়ার পর বিক্ষোভে সামিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর কথায়, “আমি সিয়নে একজন পাহারাদার হিসেবে কাজ করি। আমার দায়িত্ব রাত্রিকালীন পাহারা। এই বিক্ষোভ মিছিল থেকে আমি সরাসরি কাজে যোগ দেব।” সুপ্রিম কোর্টের রায়ের নানান সূক্ষ্ম বিষয় বা কেমন করে এই রায় থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি জন্ম নিল – এত শত হয়তো সুনীল খুব স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারছেন না। কিন্তু যে বিষয়টা তিনি বিলক্ষণ জানেন, ম্লান হেসে সে বিষয়ে বললেন, “দলিতদের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। আমি ভাবলাম, এরা সবাইতো আমার আপনজন, আমার যাওয়া উচিত।”
বাংলা অনুবাদ: স্মিতা খাটোর