“ছোটোবেলায় শুনতাম যে আমাদের দ্বীপটা নাকি একটা বড়ো প্রবাল স্তরের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। এর নিচে থাকা সব প্রবাল-ই একে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আর আমাদের চারদিকে আছে এক উপহ্রদ, যেটি আমাদের মহাসাগর থেকে রক্ষা করে চলেছে,” বললেন বিত্রার ৬০ বছর বয়সী মৎস্যজীবী, বি হায়দর।
বিত্রার আরেক ৬০ বছর বয়সী মৎস্যজীবী আব্দুল খদর সেইসঙ্গে আরও যোগ করলেন, “ছোটোবেলায়, ভাটার সময়ে প্রবালগুলি আমরা দেখতে পেতাম। এখন এর বিশেষ কিছু আর বাকি নেই অথচ বড়ো ঢেউয়ের আঘাত থেকে রক্ষা করতে এগুলি খুব দরকার।”
যে প্রবাল, লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জের অসংখ্য কাহিনি, কল্পনা, জীবিকা ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে তা এখানকার অন্যান্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণহীন হয়ে যাচ্ছে, কয়েক দশক ধরে এসব লক্ষ্য করছেন মৎস্যজীবীরা।
“সোজা কথা - প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে,” বুঝিয়ে বললেন মুনিয়ামিন কে কে। অগত্তি দ্বীপের ৬১ বছর বয়সী এই মানুষটি মাছ ধরা শুরু করেছিলেন যখন তাঁর বয়স ছিল ২২। “তখন সঠিক সময়ে বর্ষা নামতো (জুন মাসে) কিন্তু এখন কবে যে বর্ষা আসবে তার কোনো ঠিক থাকে না। মাছ কমে গেছে এখন। আগে আমাদের এতো দূর অবধি যেতেই হত না মাছ ধরতে। শোল মাছ তো বেশ কাছেই পাওয়া যেতো। অথচ এখন মাছের খোঁজে মানুষকে কয়েকদিন এমন কি কয়েক সপ্তাহের জন্যও চলে যেতে হয়।”
আরব সাগরে, কেরালার উপকূলের কাছে, ভারতের ক্ষুদ্রতম কেন্দ্রশাসিত রাজ্য লাক্ষাদ্বীপে, নৌকাপথে সাত আট ঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত অগত্তি ও বিত্রায় বাস করেন সব ওস্তাদ মৎস্যজীবীরা। মালায়লম এবং সংস্কৃত, উভয় ভাষাতেই, ‘লাক্ষাদ্বীপ’ মানে এক লক্ষ দ্বীপ। বস্তুত, আমরা দেখি ৩৬টি দ্বীপ যা ৩২ বর্গ কিলোমিটার স্থান জুড়ে আছে। জলজ প্রাণী ও সম্পদে সমৃদ্ধ এই দ্বীপপুঞ্জের জলরাশি যদিও ৪০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার স্থান জুড়ে বিস্তৃত।
এই এক-জেলা বিশিষ্ট কেন্দ্রশাসিত রাজ্যে প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন মৎস্যজীবী এবং মোট জনসংখ্যার ৬৪,৫০০ জনের মধ্যে মৎস্যজীবী ৯,০০০ জন (জনগণনা ২০১১)।
দ্বীপের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষজন বলেন যে আগে তাঁরা নিজেদের দিনপঞ্জি বর্ষার আগমন দিয়ে নির্ধারণ করতে পারতেন। কিন্তু “এখন যে কোনও সময়ে সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে — এমনটা আগে ছিল না,” বললেন ইউ পি কোয়া নামের এক ৭০ বছর বয়সী অভিজ্ঞ মৎস্যজীবী। “আমি সম্ভবত পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম যখন মিনিকয় দ্বীপ (৩০০ কিলোমিটার দূরে) থেকে মানুষজন এসে আমাদের বড়শি ব্যবহার করে মাছ ধরতে [pole and line fishing] শিখিয়েছিল। তখন থেকে আমরা ওইভাবেই মাছ ধরি, আমরা জাল ফেলি না কারণ জালে আটকে প্রবাল ভেঙে যায়। আমরা পাখি আর কম্পাসের সাহায্যে মাছের খোঁজ পাই।”
বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জন্য ধীবররা নিজেদের নৌকার বিশেষ পাটাতনের উপর রেলিংয়ের কাছে দাঁড়ান। একটি ছোটো পোক্ত সুতোর সঙ্গে একটি শক্ত আংটা লাগানো থাকে মূলত ফাইবারগ্লাসের তৈরি একটি দণ্ডের সঙ্গে। এটা মাছ ধরার টেকসই পদ্ধতিগুলির একটি এবং এভাবেই আমরা জলের উপরিভাগে থাকা মাছ, যেমন শোল টুনা ইত্যাদি ধরি। অগত্তি ও লাক্ষাদ্বীপের অন্যত্রও নারকেল আর মাছ, বিশেষত টুনা মাছ, মানুষের প্রধান খাদ্য।
দ্বীপপুঞ্জের, মনুষ্যবসতি আছে এমন ১২টি দ্বীপের মধ্যে ক্ষুদ্রতম দ্বীপটি হল বিত্রা যার ক্ষেত্র সীমা ০.১০৫ বর্গ কিলোমিটার বা প্রায় ১০ হেক্টর। এখানকার সমুদ্রপার নরম সাদা বালি দ্বারা গঠিত, নারকেল গাছ ভরা আর আছে চারদিকে উজ্জ্বল নীল, ফিরোজা, পান্না-সবুজ ও সমুদ্র-সবুজ — এই চার বর্ণের জলরাশি। পর্যটকদের এখানে প্রবেশ নিষেধ। একবার এখানে প্রবেশ করলে হাঁটা ছাড়া গত্যন্তর নেই কারণ এখানে মোটর গাড়ি বা বাইক চালাবার অনুমতি নেই এমন কি সাইকেলও চলে খুব কম। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে এখানে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ২৭১।
আবার এখানেই আছে কেন্দ্রশাসিত রাজ্যটির ৪৭ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী সর্ববৃহৎ উপহ্রদটি। বিত্রা সহ সমগ্র লাক্ষাদ্বীপই ভারতের একমাত্র প্রবালদ্বীপ। এখানকার বাসযোগ্য সম্পূর্ণ ক্ষেত্রটিই বস্তুত উপহ্রদকে বেষ্টনকারী এক প্রবাল প্রাচীর। এর মাটি মূলত প্রবাল থেকে প্রাপ্ত।
প্রবাল একজাতীয় প্রাণী যার দ্বারা এই প্রাচীর তৈরি হয়েছে এবং যা সমুদ্রের সকল প্রাণী, বিশেষত মাছকে বাঁচতে সাহায্য করে। প্রবাল প্রাচীর এই দ্বীপসমূহকে উত্তাল সমুদ্র থেকে রক্ষা করে ও তার সীমিত মিষ্টি জলের আওতায় নোনা জল ঢুকে পড়াকে প্রাকৃতিকভাবে ঠেকায়।
নির্বিচার মাছ ধরা, বিশেষত যন্ত্রচালিত জলযানে চেপে টানাজালে সমুদ্রের নিচ থেকে মাছ তোলার প্রক্রিয়ায় টোপ বা চার মাছের সংখ্যাহ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রবালপ্রাচীর এবং প্রাচীর-কেন্দ্রিক জীববৈচিত্রের
প্রবালপ্রাচীরে বাস ছোটো কিছু মাছের, যা ধরা হয় টুনা মাছ ধরার টোপ হিসাবে আর তাছাড়াও এখানে আছে অসংখ্য প্রাজাতির উপহ্রদীয় মাছ। ২০১২ সালের ইউএনডিপি জলবায়ু বিষয়ক লাক্ষাদ্বীপ অ্যাকশন প্ল্যান রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে যতো মাছ ধরা হয় তার ২৫ শতাংশ আসে এখানকার বৈচিত্র্যময় জল আর প্রবাল-প্রাচীর থেকেই আসে। আর টোপের মাছের ঝাঁকগুলি টুনা মাছ ধরার পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
“আগে আমরা টোপের জন্য চার মাছ ধরতাম ওদের ডিম পাড়ার সময় পার করে আর এখন তো সবাই যখন খুশি তখনই এই মাছ ধরে,” বললেন ৫৩ বছর বয়সী মৎস্যজীবী, আব্দুল রহমান, যিনি ৩০ বছর ধরে মাছ ধরছেন, বিত্রা থেকে ১২২ কিলোমিটার দূরে, জেলা কেন্দ্র, কভরত্তিতে। “মাছ ধরার নৌকার সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু কমছে ধরা মাছের পরিমাণ।” নির্বিচার মাছ ধরা, বিশেষত যন্ত্রচালিত জলযানে চেপে টানাজালে সমুদ্রের নিচ থেকে মাছ তোলার প্রক্রিয়ায় টোপ বা চার মাছের সংখ্যাহ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রবালপ্রাচীর এবং প্রাচীর-কেন্দ্রিক জীববৈচিত্রের।
আর এসবই সমস্যার একটা দিক মাত্র।
এল নিনোর মতো জলবায়ুর চরম অবস্থা সমুদ্রের উপরিতলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে প্রবালের রং ও জীবনের ক্ষয় ঘটাচ্ছে এবং তাদের দ্বীপটিকে রক্ষা করার ক্ষমতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। ১৯৯৮, ২০১০, ২০১৬ — এই তিন বছর লাক্ষাদ্বীপ প্রবাল ধোলাইয়ের [কোরাল ব্লিচিং] সাক্ষী হয়েছে। নেচার কনসারভেশন ফাউন্ডেশন নামের মাইসুরু ভিত্তিক বন্যপ্রাণী গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজে ব্রতী একটি অলাভজনক সংগঠনের ২০১৮ সালের অনুসন্ধান বলছে যে প্রবালপ্রাচীর বড়ো বিপদের মধ্যে আছে। ওই অনুসন্ধান আরও বলছে যে লাক্ষাদ্বীপের মোট প্রবাল আচ্ছাদন ১৯৯৮ সালে ৫১.৬ শতাংশ থেকে ২০১৭তে অর্থাৎ মাত্র ২০ বছরের মধ্যে নেমে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশে।
বিত্রা দ্বীপের ৩৭ বছর বয়সী মৎস্যজীবী আব্দুল কোয়া বললেন, “আমরা পলা চিনতে শুরু করেছি ৪ অথবা ৫ বছর বয়স থেকে। ঢেউয়ের ধাক্কায় পলা সমুদ্রতীরে এসে পড়ে আছে — আমরা জলে নামার আগেই দেখেছি। আমরা পলা ব্যবহার করি আমাদের বাড়ি বানাতে।”
কভরত্তিতে থাকাকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগে কর্মরত বিজ্ঞানী, ডঃ কে কে ইদ্রিস বাবু প্রবাল ক্ষয়ের বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন, “সমুদ্রের উপরিতলের উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে প্রবালপ্রাচীরের একটা সম্পর্ক আছে। ২০১৬ সালে সমুদ্রের তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি হয়ে যাচ্ছিল!” অথচ সমীক্ষা বলছে প্রাচীর অঞ্চলে তাপমাত্রা ২৮.৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকতো এমন কি ২০০৫ সালেও। ১৯৮৫ সালে এই তাপমাত্রা ছিল ২৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জলের তাপমাত্রা ও উচ্চতা বৃদ্ধি দ্বীপটির পক্ষে খুবই চিন্তার বিষয় কারণ এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১—২ মিটার।
কভরত্তির ৫৩ ফিট দীর্ঘ সবচেয়ে বড়ো নৌকার মালিক ৪৫ বছর বয়সী নিজামুদ্দিন কে, নিজেও এই পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করেছেন। তাঁর মতে প্রজন্মবহিত চিরাচরিত জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার ফলে এই সমস্যা আরও বেড়ে উঠেছে: “আমার বাবা (ওই প্রজন্মের মানুষজনদের মধ্যে) জানতেন মাছ ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে, তাঁদের কাছে সে খবর থাকতো। আর আমরা সেসব জ্ঞান হারিয়ে নির্ভর করি ফ্যাড [ফিশ অ্যাগ্রেগেটিং ডিভাইসেস] বা মাছ জোটাবার যন্ত্রের উপর। টুনা না পেলে আমরা উপহ্রদীয় মাছের সন্ধানে যাই।” ফ্যাড শুনতে যাতোই গালভরা উচ্চকারিগরিসম্পন্ন কিছু মনে হোক না কেন এর কাজ আসলে একটা ভেলা বা ভাসমান কাঠের গুঁড়িই করতে পারে —এটা মাছকে আকর্ষণ করে যাতে মাছ তার তলায় বা চার ধারে জমা হয়।
জীববিজ্ঞানী ডঃ রোহন আর্থর লাক্ষাদ্বীপে কাজ করছেন ২০ বছর ধরে, তিনি জানালেন, “এই মুহূর্তে আমি প্রবালপ্রাচীরের জীববৈচিত্র্য নিয়ে ভাবছিই না, ভাবছি এর কার্যকরী দিকটি নিয়ে। এখানকার মানুষের অস্তিত্বই এর উপর নির্ভর করে। এই প্রাচীর মানে কেবল প্রবাল নয়, এটি সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র। একে সমুদ্রের নিচের একটি জঙ্গল হিসাবে ভাবুন — জঙ্গল মানে তো কেবল গাছ না!”
এনসিএফ-এর মহাসাগর ও উপকূল পরিকল্পনার কর্ণধার ডঃ আর্থর কভরত্তিতে আমাদের বলেছিলেন, “লাক্ষাদ্বীপের প্রবালপ্রাচীর যথেষ্ট সহ্যশক্তির পরিচয় দিয়েছে কিন্তু তার সেরে ওঠার যে বর্তমান হার তা আর জলবায়ুর পরিবর্তনের ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। অতিরিক্ত মাছ ধরার মতো প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপ জনিত কারণে যে নৃতাত্ত্বিক চাপ তৈরি হচ্ছে সেই বিষয়টিকে না ধরলেও, এই কথা বলা যায়।”
প্রবালকে বিবর্ণ করে দেওয়া ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়ার আরও ফলাফল আছে। ২০১৫ সালের মেঘ ও ২০১৭ সালের ওখনির মতো সাইক্লোনও লাক্ষাদ্বীপকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। মৎস্যবিভাগের তথ্যে ধরা মাছের পরিমাণে ওঠাপড়া স্পষ্ট হচ্ছে – ২০১৬ সালে (সব প্রজাতির টুনা মিলিয়ে) ধরা গেছিলো ২৪,০০০ টন যা ২০১৭ সালে কমে হয়েছিলো ১৪.০০০ টনের সামান্য কিছু বেশি — অর্থাৎ ৪০ শতাংশের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। ২০১৮ সালে ২৪,০০০ টন থেকে ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছিল ১৯,৫০০ টন। এমন বছরও আছে যখন খুব ভালো পরিমাণ মাছ ধরা পড়েছে, কিন্তু মৎস্যজীবীরা বলেন যে পুরো বিষয়টি খামখেয়ালি এবং অনির্দিষ্ট হয়ে পড়েছে।
যে হেতু প্রবালপ্রাচীর অঞ্চলের মাছের চাহিদা বিশ্ব জুড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেহেতু মৎস্যজীবীরা গ্রুপার মাছ অথবা স্থানীয়ভাবে চম্মম নামে পরিচিত বিশাল শিকারী মাছ ধরা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
অগত্তি দ্বীপের, ৩৯ বছর বয়সী উম্মর এস, ১৫ বছর ধরে মাছ ধরছেন ও নৌকা বানাচ্ছেন। তিনি বুঝিয়ে বললেন কেন তিনি বৃহৎ গ্রুপার মাছ ধরেন। “আগে উপহ্রদ অঞ্চলেই অনেক টুনা মাছ পাওয়া যেত আর এখন টুনা ধরতে আমাদের ৪০-৪৫ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। অন্য কোনও দ্বীপে যেতে হলে তো সপ্তাহ দুয়েক লেগে যায় যাতায়াতে। সে কারণে আমি একই সঙ্গে চম্মমও ধরি। এর বাজার থাকলেও ধরা খুব সহজ না কারণ একটা মাছ ধরতে এক দু’ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে।”
বিত্রায়, এই ক্ষেত্রবিশেষের গতিপ্রকৃতি নিরীক্ষণ করছেন বিজ্ঞানী রুচা কারকরে। তিনি আমাদের বললেন, “প্রবালের স্বাস্থ্যহানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপার বা বড়ো মাছের সংখ্যা কমেছে। আর মৎস্যজীবীরা এই অনিশ্চয়তার কারণে টুনা না পেলেই আরও বেশি করে ধরছেন প্রবালপ্রাচীর অঞ্চলের মাছ, ফলে এর সংখ্যা আরও কমে যাচ্ছে। আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে মাসের যে পাঁচদিন মাছ ডিম পাড়ে সেইসময়ে যেন তাঁরা মাছ না ধরেন।”
বিত্রার মৎস্যজীবীরা ওই দিনগুলিতে নিজেদের কাজ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে দেখলেন যে আর কেউ এই নিয়ম মানতে রাজি নন।
“কিলতান দ্বীপ থেকে রাতের বেলায় ছেলেরা বিত্রায় এসে মাছ ধরতো,” নিজের মাছ শুকোতে দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে জানালেন আব্দুল কোয়া। “এতো হতে দেওয়া উচিত না...কিন্তু এমন প্রায়শই হয় আর টোপ হিসেবে ব্যবহৃত মাছ, প্রবালপ্রাচীর, টুনা সব কমে যাচ্ছে।”
“মূল ভূখণ্ড থেকে, এমন কি বিদেশ থেকেও বিরাট সব জাল নিয়ে বড়ো বড়ো নৌকা চলে আসে,” বিত্রা পঞ্চায়েতের সভাপতি, বি হায়দর জানালেন। “তাদের সঙ্গে আমরা আমাদের ছোটো নৌকা নিয়ে পাল্লা দিতে পারি না।”
ইতিমধ্যে, আবহাওয়া এবং জলবায়ু আরও অনিশ্চিত হয়ে ইঠেছে। হায়দরের কথায়, “আমার ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত মাত্র দুটি সাইক্লোনের কথাই আমি মনে করতে পারি, কিন্তু বিগত কয়েক বছরে অনেক ঘন ঘন সাইক্লোন হচ্ছে আর তার ফলে ক্ষয় হছে প্রবালপ্রাচীরের।”
কভরত্তির আব্দুল রহমানও সাইক্লোনের ফলাফলের কথা বললেন, “আগে আমরা স্কিপজ্যাক টুনা প্রবালপ্রাচীরের কাছাকাছির মধ্যেই দেখতে পেতাম কিন্তু ওচকি সাইক্লোনের পর থেকে এইসব বদলে গেছে। ১৯৯০ সালে আমরা মাত্র ৩-৪-ঘন্টা সমুদ্রে কাটাতাম। আমাদের কোনো যন্ত্রচালিত ব্যবস্থা না থাকলেও মাছ এতো বেশি ছিলো যে অল্পক্ষণেই আমরা মাছ ধরে ফেলতে পারতাম। এখন আমাদের একটা গোটা দিন অথবা তার চেয়েও বেশি সময়ের জন্য সমুদ্রে কাটাতে হয়। আমরা প্রবালপ্রাচীরের কাছে মাছ ধরতে চাই না কিন্তু টুনা না পেলে তখন সেখানে না গিয়ে উপায় থাকে না।”
রহমান আরও বললেন, “এখন নৌকার সংখ্যা বেড়েছে — এগুলি আগের তুলনায় অনেক বড়ো। কিন্তু কমে গেছে ধরা মাছের পরিমাণ আর বেড়েছে আমাদের মাছ ধরার খরচ।”
মৎস্যজীবীদের আয় আন্দাজ করা কঠিন আর সব মাসে তা এক হয় না বলে জানালেন ডঃ আর্থর। “এঁদের অনেকেই অন্য কাজও করেন ফলে মাছ ধরে ঠিক কতো হয় তা আলাদা করে বলাও কঠিন।” কিন্তু একথা ঠিক “গত দশকে রোজগারের ওঠা পড়া অনেক বেশি হয়েছে।”
“লাক্ষাদ্বীপ একইসঙ্গে দুটি বড়োমাপের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে,” তিনি জানালেন, “জলবায়ুর বিবর্তনের কারণে প্রবালপ্রাচীরের ক্ষতি হচ্ছে যা মাছের সরবরাহের উপর প্রভাব ফেলছে, আর এর ফলে মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। তবুও, লাক্ষাদ্বীপের উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হওয়ার ক্ষমতা আছে। যদি আমরা সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে প্রবালপ্রাচীরকে সেরে উঠতে সাহায্য করতে পারি তাহলে একে আমরা আরও দীর্ঘসময় বাঁচিয়ে রাখতে পারবো।”
এদিকে কভরত্তিতে নিজামুদ্দিন কে অভিযোগের সুরে বললেন, “২০ বছর আগেও এতো মাছ ছিল যে আমদের ৪-৫ ঘন্টা কাজ করলেই হয়ে যেত আর এখন নৌকা ভরতে কয়েকদিন লেগে যায়। বর্ষার সময় সরে গেছে, আমরা বুঝিই না যে কবে বৃষ্টি নামবে। মাছ ধরার মরসুমেও সমুদ্র উত্তাল থাকে। আমরা নৌকা একেবারে কিনারায় তোলার খুব কঠিন কাজটা জুন মাসে করে নিতাম কারণ জানতাম যে তখন বর্ষা নামবে। তারপর বর্ষা আসতে নিয়ে নেয় আরও একমাস! আর আমাদের নৌকা সমুদ্রতটেই আটকে যায়, বুঝতে পারি না নৌকা আবার জলে নামাবো না অপেক্ষা করবো। ফলে আমরাও একরকম আটকেই থাকি।”
পারি-র জলবায়ু বিবর্তনের উপর দেশব্যাপী রিপোর্টিং সংক্রান্ত প্রকল্পটি ইউএনডিপি সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য জলবায়ুর বিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি দেশের সাধারণ মানুষের স্বর এবং অভিজ্ঞতায় বিবৃত করা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ: চিলকা