নিজের নামটি বাদে আর কিছুই লিখতে বা পড়তে পারেন না তিনি। দেবনাগরী হরফে সগর্বে গোটা গোটা করে লিখলেন: গো-প-লি। লিখেই হেসে ফেললেন, খিলখিলিয়ে ওঠা সংক্রমক হাসি।
চার সন্তানের মা গোপলি গামেতির (৩৮) কথায়, মেয়েরা জেদ ধরলে করতে পারবে না হেন জিনিস নেই এই দুনিয়ায়।
উদয়পুর জেলার গোগুন্ডা ব্লকের কারদা গ্রামের ঠিক বাইরেই খান তিরিশেক ঘর নিয়ে এক বসতি, বেরাদরির জনাকয় মহিলার সাহায্যে নিজের বাড়িতেই চার-চারটি সন্তান প্রসব করেছেন গোপলি। জীবনে প্রথমবার হাসপাতালে গিয়েছিলেন তৃতীয় কন্যা অর্থাৎ কনিষ্ঠতম সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর, টিউবাল লাইগেশন করাতে।
“পরিবার তো পুরো হয়ে গেছে, কাজেই না করে উপায় ছিল না আর,” বললেন তিনি। এই “অপারেশনটা” করালে পেটে আর বাচ্চা আসবে না, গোগুন্ডা কম্যুনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের (সিএইচসি) থেকে একজন স্বাস্থ্যকর্মী এসে বলেছিলেন কথাটা। একটা পয়সাও লাগবে না, সিএইচসি পর্যন্ত গিয়ে উঠতে পারলেই কেল্লা ফতে। ৩০ কিলোমিটার দূরের এই সরকারি গ্রামীণ হাসপাতালটির আওতায় যেকটা গ্রাম আছে তাদের ভরসা বলতে কেবল চারখানা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র (পিএইচসি)।
বেশ কয়েকবার বাড়িতে এই কথাটা পাড়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বামী গা করেননি। মাসের পর মাস ছোটমেয়েকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন গোপলি। একাহাতে সিদ্ধান্ত নিলেও সেটার শেষ দেখে ছাড়তে পারবেন কিনা, এই নিয়ে দ্বিধা মনে ছিল।
“শেষে একদিন দাওয়াখানার [সিএইচসি] দিকে হাঁটা লাগালাম, বলে গেলাম যে নালিদুটো বাঁধতে যাচ্ছি,” ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর ভিলি মিশিয়ে বললেন গোপলি, “বর আর শাশুড়ি দৌড় লাগাল আমার পিছু পিছু।” রাস্তায় খানিক কথা-কাটাকাটি হয়েছিল বটে, তবে তাঁর জেদের কাছে হার মেনেছিলেন মা-ছেলে। শেষে তিনজন মিলেই বাস ধরে গোগুন্ডা সিএইচসিতে পৌঁছলেন, টিউবাল লাইগেশন হল গোপলির।
সেদিন ওই সিএইচসিতে লাইগেশন করাবেন বলে আরও অনেকেই এসেছিলেন, জানালেন তিনি, তবে মোট কতজন মহিলা ছিলেন কিংবা সেদিন বিশেষ কোনও বন্ধ্যাত্বকরণ শিবির পাতা হয়েছিল কিনা সেসব কথা তাঁর মনে নেই। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যায় কর্মীর বড্ড অভাব, তাই বন্ধ্যাত্বকরণ শিবির পাতা হয় ছোটো শহরে, যাতে অস্ত্রোপচার করাতে ইচ্ছুক মহিলারা কাছেপিঠের গ্রাম থেকে আসতে পারেন। তবে পরিচ্ছন্নতার নিদারুণ অভাব এবং পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্য ধরে স্টেরিলাইজেশন করানো হয় বলে আজ দশকের পর দশক ধরে সমালোচনার ঝড় উঠেছে এই জাতীয় শিবির ঘিরে।
টিউবাল লাইগেশন বা ‘টিউবাল স্টেরিলাইজেশন’ কিংবা ‘মহিলা স্টেরিলাইজেশন’ নামে পরিচিত এই গর্ভনিরোধক প্রক্রিয়াটি চিরস্থায়ী। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ফ্যালোপিয়ান নালি-দুটি আটকে দিতে ৩০ মিনিট লাগে। জাতিসংঘ প্রকাশিত ২০১৫ সালের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে: দুনিয়া জুড়ে প্রচলিত গর্ভনিরোধক পন্থাগুলির মধ্যে এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়, বিবাহিত অথবা সহবাসী মহিলাদের ১৯ শতাংশই এটি বেছে নেন।
এদিকে ভারতের পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২১) অনুযায়ী ১৫-৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত মহিলাদের ৩৭.৯ শতাংশের পছন্দ এই টিউবাল লাইগেশন পদ্ধতি।
উজ্জ্বল কমলা ঘোমটায় চোখদুটিও ঢাকার জোগাড় গোপলির কাছে অবশ্য এই ঘটনাটি বিদ্রোহের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। অসুস্থ হয়ে পড়েননি ঠিকই, তবে চতুর্থবার প্রসব করার পর বড্ড ধকল বয়ে গিয়েছিল শরীরের উপর দিয়ে। উপরন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তটির পেছনে আর্থিক কারণও ছিল।
গোপলির অভিবাসী শ্রমিক স্বামী সোহনরাম বছরের সিংহভাগটাই কাটান সুদূর সুরাটে, কেবল হোলি আর দীপাবলির সময় মাসখানেকের জন্য বাড়ি আসতে পারেন। চতুর্থ সন্তানের জন্মের মাসকয়েক বাদে ঘরে ফেরেন সোহনরাম, তখন গোপলি মনস্থির করেন যে মরে গেলেও আর কখনও গর্ভধারণ করবেন না।
“বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করার কাজে মরদদের টিকিটিও দেখা যায় না,” বললেন গোপলি। তাঁর খড়ে ছাওয়া ইটের ঘরের হিমশীতল মেঝেয় বসেছিলেন, সামনে কয়েক মুঠি মকাইয়ের দানা। সোহনরামের অনুপস্থিততিতে চার-চারটি গর্ভাবস্থা সামলেছেন তিনি। পূর্ণ গর্ভাবস্থা নিয়েই নিজেদের আধ-বিঘা জমিতে চাষবাস, অন্যের জমিতে খেতমজুরি, ঘরকন্না ইত্যাদি একাহাতে টেনেছেন সবই। “এই সন্তানদের খিদে মেটাতেই চোখে সর্ষেফুল দেখছি, এর চেয়ে বেশি বাচ্চা আনার কোনও মানে আছে?”
আর কোনও গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিনা এটা জিজ্ঞেস করাতে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল মুখে। নিজের স্বামীকে নিয়ে কথা বলতে নারাজ ঠিকই, তবে তাঁদের সমাজের মহিলারা হাজার পিড়াপিড়ি করা সত্ত্বেও যে পুরুষেরা কোনও রকম গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা নিতেই চান না, এটুকু অন্তত জানা গেল তাঁর কাছ থেকে।
*****
কারদা গ্রামটি আরাবল্লি পর্বতের পাদদেশে ছড়িয়ে থাকা রোইদা পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে। পাশেই রাজসমন্দ জেলা, ৩৫ কিলোমিটার গেলেই বিখ্যাত কুম্ভলগড় কেল্লা, হাজারো পর্যটকের আনাগোনা লেগেই থাকে এখানে। কারদা গাঁয়ের একপ্রান্তে ১৫-২০ ঘর গামেতির বাস, প্রত্যেকেই ভিল গামেতি (তফসিলি) জনজাতির একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষ, পরিবার-পিছু এক বিঘা জমিও নেই কারও। এখানকার প্রায় কোনও মহিলাই ইস্কুলের চৌকাঠ ডিঙোননি, আর পুরুষদের অবস্থা তুলনায় সামান্য ভালো।
জুনের শেষের দিকটায় বর্ষা নামে, শুরু হয় গমচাষের জন্য লাঙল টানা, চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই সময়টা বাদে পুরুষদের দেখা মেলে না বাড়িতে, এলেও একমাসের বেশি থাকা হয় না তাঁদের। বিশেষ করে কোভিড-১৯ লকডাউনের ওই দুর্বিষহ মাসগুলোর পর অধিকাংশ পুরুষই সুরাটের শাড়ি-কাটাই কলে কাজ করতে যান। লম্ব লম্বা কাপড়ের থান থেকে হাতে করে ৬ মিটার দৈর্ঘের টুকরো কাটতে হয়, তারপর আসে পাড়ে পুঁতি কিংবা ঝালর বসানোর পালা। এই কাজটি পুরোপুরি অদক্ষ শ্রমভুক্ত হওয়ায় দৈনিক ৩৫০-৪০০ টাকার বেশি মজুরি জোটে না।
সোহনরাম তথা অন্যান্য গামেতি পুরুষের মতো আরও লাখে লাখে মজুর রয়েছেন যাঁরা কাজের খোঁজে দক্ষিণ রাজস্থান থেকে দশকের পর দশক ধরে পাড়ি জমিয়েছেন সুরাট, আহমেদাবাদ, মুম্বই, জয়পুর ও দিল্লিতে। ফেলে আসা গ্রামগুলিতে মূলত মেয়েরাই পড়ে থাকেন।
তাঁদের অবর্তমানে গত কয়েক বছর ধরে নিজেদের জটিল স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে শিখেছেন নিরক্ষর ও আধা-সাক্ষর মহিলারা।
সবে তিরিশ পেরিয়েছেন, এর মধ্যেই পুষ্পা গামেতি, তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। অতিমারির ঠিক আগেই এই তিন সন্তানের মধ্যে তাঁর কিশোর ছেলেটিকে সুরাট থেকে ফিরিয়ে আনেন শিশুশ্রম-বিরোধী কর্মীরা। এই গ্রামের মহিলারা যে নিতান্ত ঠেকায় পড়েই নিজেদের বদলাতে বাধ্য হয়েছেন, সেকথা জানালেন তিনি।
এককালে চিকিৎসাজনিত কিছু বিপদ হলেই মহিলারা ঘাবড়ে যেতেন। অতীতের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন পুষ্পা - হপ্তার পর হপ্তা কেটে যাচ্ছে অথচ বাচ্চার জ্বর কমছে না, অথবা ধরুন খেতিবাড়ির কাজে আঘাত লেগেছে আর রক্ত পড়ছে তো পড়ছেই – এই অবস্থায় ভয়ে সিঁটিয়ে যেতেন মহিলারা। তাঁর কথায়, “গাঁয়ে একটাও ব্যাটাছেলে নেই, চিকিৎসা-টিকিৎসা করানোর মতো চাট্টি পয়সাও থাকত না হাতে, এমনকি সরকারি বাস-টাসে চেপে যে ডাক্তারখানা যাব, সেটাও জানতাম না। তবে হ্যাঁ, ধীরে ধীরে সবকিছুই শিখে গেছি আমরা।”
তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কিষন আজ আবারও কাজে ঢুকেছে, আপাতত পাশের গ্রামে মাটি খোদাইয়ের যন্ত্রচালকের সহকারী হিসেবে বহাল হয়েছে সে। যথাক্রমে ৫ ও ৬ বছর বয়সী কনিষ্ঠ দুই সন্তান মঞ্জু ও মনোহরের জন্য ৫ কিলোমিটার দূরে রোইদা গ্রামের অঙ্গনওয়াড়িতে যাতায়াত করছেন পুষ্পা।
“বড়ো বাচ্চাগুলোর জন্য অঙ্গনওয়াড়ি থেকে কিছুই পাইনি,” বলে উঠলেন তিনি। তবে সাম্প্রতিক কালে কারদার যুবতী মায়েরা সাবধানে পা ফেলে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে রোইদায় যেতে শুরু করেছেন, ওখানকার অঙ্গনওয়াড়িতে গরম খাবার দেওয়া হয় শিশু ও তাদের মায়েদের। পাঁজাকোলা করে ছোট্ট মঞ্জুকে নিয়ে যান পুষ্পা। তবে পথচলতি গাড়িঘোড়ার চালকেরা মাঝেমধ্যে তাঁদের পৌঁছেও দেন।
“এসব করোনার [কোভিড-১৯] আগের গল্প,” জানালেন তিনি। লকডাউনের পর ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি কবে থেকে খুলবে, সেই ব্যাপারে তাঁদের খবরই দেওয়া হয়নি।
৫ম শ্রেণির পর হঠাৎই একদিন পড়াশোনার পালা চুকিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে সুরাটে কাজ করতে চলে যায় কিষন। আকাশ ভেঙে পড়ে পুষ্পার মাথায়। তাঁর মনে হতে থাকে যে কিশোর সন্তানটিকে কেমন করে বাগে আনা যায় সে ব্যাপারে পারিবারিক সিদ্ধান্ত-টিদ্ধান্ত যা-ই নেওয়া হোক না কেন, কিছুই আর হাতে নেই তাঁর। “তবে ছোটোদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমি হাতছাড়া করতে চাইছি না।”
কর্মঠ পুরুষদের মধ্যে একা পুষ্পার স্বামী নাটুরামই পড়ে আছেন গ্রামে। ২০২০ সালের সেই অস্থির গ্রীষ্মকালটার কথা ভেবে আতঙ্কিত নাটুরাম, সেই যখন লকডাউন চলাকালীন পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে হাতাহাতি বেধে গিয়েছিল পুলিশের। তাই কারদার আশেপাশেই কাজ খুঁজে ফিরছেন, যদিও সেরকম কিছু এখনও জোটেনি।
গোপলির থেকে টিউবাল লাইগেশনের ভালোমন্দ জেনেছেন পুষ্পা। অস্ত্রোপচারের পর ঠিকঠাক চিকিৎসা না পেলেও তেমন কিছু অসুবিধার (যেমন ক্ষতস্থানে সেপসিস বা সংক্রমণ, রেচনতন্ত্রে বাধা, এবং অন্ত্র কিংবা মুত্রথলির ক্ষতি) কথা শোনেননি তাঁরা, তাছাড়া এই পদ্ধতির পর গর্ভনিরোধ বিফল হয়েছে এমনটাও তাঁরা শোনেননি। আর এই জাতীয় বন্ধ্যাত্বকরণ পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে মূলত জনসংখ্যার বৃদ্ধি আটকানোর এক কৌশল, সে ব্যাপারেও গোপলি অবগত নন। বরং, “ঝাড়া হাত-পা হওয়া গেল,” বলেই খুশি আছেন তিনি।
পুষ্পাও তাঁর সবকটি সন্তান বাড়িতেই প্রসব করেছেন। হয় ননদ-বৌদি কিংবা বেরাদরির কোন প্রবীণ মহিলা এসে নাড়ি কেটে ‘লাছা ধাগা’ বেঁধে দিয়ে গেছেন। এই জাতীয় সুতলি সাধারণত হিন্দুরা তাঁদের কব্জিতে বাঁধেন।
এই ১৮ বছরের হবু মা আপাতত তার মা-বাবার বাড়িতে আছে, আরাবল্লির উঁচু এলাকায় থাকা সেই গ্রামটি থেকে যদিও বিপদ-আপদের ক্ষেত্রে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। “প্রসবের সময় হলে এখানে নিয়ে আসব, তারপর দু-তিনজন মহিলা মিলে ওকে টেম্পোতে করে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাব।” টেম্পো বলতে অটোরিক্সা-জাতীয় একধরনের বড়ো তিন-চাকার বাহনের কথা বলতে চাইছিলেন গোপলি, এ অঞ্চলের গণপরিবহনে এটির খুব চল।
“এমনিতেও ধরুন আজকালকার মেয়েরা ব্যথা-ট্যথা খুব একটা সইতে পারে না,” আবারও হাসতে লাগলেন গোপলি। আবারও সেই সংক্রামক হাসি, ঘাড় নেড়ে খিলখিলিয়ে উঠলেন চারপাশে জড়ো হওয়া মহিলারাও (প্রত্যেকেই তাঁর পড়শি এবং আত্মীয়)।
গাঁয়ের ধারে খান তিরিশেক বাড়ির এই পাড়াটিতে টিউবাল লাইগেশন করিয়েছেন এমন মহিলা আরও জনা দুই-তিন রয়েছেন বটে, তবে লজ্জার আগল টপকে মুখ ফুটে সেকথা বললেন না কেউই। অন্য কোনও ধরনের আধুনিক গর্ভনিরোধক পন্থার চল নেই তেমন, তবে গোপলির মতে: ‘অল্পবয়সী মেয়েরা মনে হয় অনেক বেশি চালাকচতুর’
নিকটতম পিএইচসি বলতে সেই ১০ কিলোমিটার দূর নন্দেশমা গ্রামে। পেটে বাচ্চা এসেছে জানতে পারলে কারদার যুবতী মহিলারা ওখানেই গিয়ে নাম লিখিয়ে আসেন। নিয়মিত পরীক্ষা করাতে সেখানে যেতে হয় বটে, তবে সাপ্লিমেন্টারি ক্যালসিয়াম ও আয়রন বড়িগুলি কিন্তু গ্রামে আসা স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকেই পেয়ে যান।
এই গ্রামে বসবাসকারী রাজপুত জাতির বামরিবাই কালুসিং জানালেন, “কারদার মেয়েরা দল বেঁধে যায়, কখনও কখনও তো সুদূর গোগুন্ডার সিএইচসিতে গিয়ে হাজির হয়।” একথাও বললেন – আগে আগে সঙ্গে কোনও মরদ না থাকলে গাঁয়ের বাইরে যাঁরা পা-ই রাখতেন না, আজ নিজের শরীর-স্বাস্থ্য ঘিরে সকল সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নিতে পেরে পাল্টে গেছে সেই মানুষগুলির জীবন।
অজীবিকা ব্যুরোর উদয়পুর ইউনিটে কর্মরত কমিউনিটি ম্যানেজার কল্পনা যোশীর কথায়, যে যে গ্রাম থেকে সিংহভাগ পুরুষ দূরদূরান্তে পাড়ি দেন রুজিরুটির সন্ধানে, সেখানকার ‘পড়ে-থাকা’ মহিলাদের মধ্যে ধীরে ধীরে মাথা তুলছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতা। গামেতি পুরুষ সহ অন্যান্য পরিযায়ী মজুরদের নিয়ে কাজ করছে এই সংস্থাটি। “দরকার পড়লে নিজেরাই অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে আনছেন। নিজে নিজে হাসপাতালে যাওয়া থেকে স্বাস্থ্যকর্মী ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনও রাখঢাক ছাড়াই কথা বলা, এসব তো অনেকেই করছেন,” বলছিলেন কল্পনা, “তবে, বছর দশেক আগেও পরিস্থিতি এক্কেবারে আলাদা ছিল।” তখনকার দিনে বাড়ির পুরুষেরা সুরাট থেকে না ফেরা পর্যন্ত সমস্ত রকমের চিকিৎসাজনিত সমস্যা মুখ বুজে সহ্য করতেন মহিলারা।
গাঁয়ের ধারে খান তিরিশেক বাড়ির এই পাড়াটিতে টিউবাল লাইগেশন করিয়েছেন এমন মহিলা আরও জনা দুই-তিন রয়েছেন ঠিকই, তবে লজ্জার আগল টপকে মুখ ফুটে সেকথা বললেন না কেউই। অন্য কোনও ধরনের আধুনিক গর্ভনিরোধক পন্থার চল নেই তেমন, তবে গোপলির মতে, “অল্পবয়সী মেয়েরা মনে হয় অনেকটাই বেশি চালাকচতুর।” তাঁর নিজের পুত্রবধূ বিয়ের একবছর পরে সন্তানধারণ করেছেন।
*****
কারদা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে থাকেন পার্বতী মেঘওয়াল (নাম পরিবর্তিত), তিনি জানালেন যে বর পরিযায়ী শ্রমিক হলে দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ে না কখনই। সুদূর গুজরাতের মেহসানায় একটি প্যাকেজিং কারখানায় কাজ করতেন তাঁর স্বামী। অল্প সময়ের জন্য মেহসানায় গিয়ে সংসার পাতার চেষ্টাও করেছিলেন পার্বতী, সেখানে একটি চায়ের দোকানও চালাতেন, তবে তিন সন্তানের পড়াশোনার তাগিদে অচিরেই উদয়পুরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।
২০১৮ সালে স্বামী তখন গুজরাতে, হঠাৎই একদিন পথদুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হন পার্বতী। পড়ে যাওয়ার সময় একটি পেরেক এসে বিঁধে যায় তাঁর কপালে। ক্ষতটা সারার পর হাসপাতাল থেকে ছুটি পান বটে, তবে অজানা এক মানসিক রোগে জেরবার হয়ে যায় দু-দুটি বছর।
“স্বামী, বাচ্চাকাচ্চা, টাকাপয়সা, সারাটাক্ষণ ভেবে ভেবে মরতাম সবকিছু নিয়ে, আর ঠিক তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটল,” জানালেন পার্বতী। থেকে থেকে অসাড় হয়ে পড়তেন, ঘুরেফিরে তলিয়ে যেতেন দুঃখে। “এমন চেঁচাতাম যে সব্বাই ভয়ে ভয়ে থাকত; গাঁয়ের একটা লোকও আমার কাছে আসতে চাইত না। চিকিৎসার কাগজপত্তর, টাকা, নিজের কাপড়জামা, ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিতাম সব...” যা যা করেছেন সব মনে পড়ে আজ, মানসিক অসুস্থতা ঘিরে মনে জমা হয়ে রয়েছে লজ্জা।
“ঠিক তার পরেই আরম্ভ হল লকডাউন, দুচোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। আরেকটু হলেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তাম সেই আগের মতো,” মনে করছিলেন তিনি। তাঁর স্বামী ২৭৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে মেহসানা থেকে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় আবারও মানসিক বিকারের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন পার্বতী। ছোটো ছেলেটাও যে বাড়িতে নেই তখন, উদয়পুরের একটি খাবারের দোকানে রুটি বানানোর কাজ করছিল।
মেঘওয়াল জাতিটি দলিত সমাজের অন্তর্গত। পার্বতীর জানান, তফসিলি জাতির মজুরেরা বউ-বাচ্চা ফেলে রেখে পেটের টানে বাইরে গেলে, রুজিরুটির তাগিদে গ্রামে বসে অমানুষিক মেহনত করতে বাধ্য হন তাঁদের স্ত্রীয়েরা। “যে দলিত নারী মানসিকভাবে অসুস্থ, কিংবা যার ধরুন আগে কখনও মানসিক অসুখ-বিসুখ হয়েছে, ভাবতে পারেন তাকে কতখানি কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয়?”
অসুস্থ হওয়ার আগে একটি সরকারি দফতরে সহায়কের কাজ করতেন তিনি, একই সঙ্গে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীও ছিলেন। তবে দুর্ঘটনার পর চাকরি করাটা আর সম্ভবপর ছিল না।
২০২০ সালে দীপাবলির দুয়েকদিন আগে বা পরে লকডাউন উঠে যেতেই স্বামীকে বলেন, তিনি যেন আর কক্ষনো কাজের সন্ধানে বাইরে না যান। আত্মীয়স্বজন তথা একটি সমবায় থেকে খানিক ধার করে গ্রামেই একটি ছোট্ট মুদিখানা খোলেন পার্বতী। স্বামী আপাতত কাছেপিঠেই দিনমজুরির কাজ খুঁজে ফেরেন। “প্রবাসী মজদুর কি বিবি নহিঁ রেহনা হ্যায় [পরিযায়ী শ্রমিকের বৌ হয়ে আর বেঁচে থাকতে চাই না],” জোরগলায় বলে উঠলেন তিনি, “মনের উপর বড্ড চাপ পড়ে।”
ওদিকে কারদা গ্রামের মহিলারা সমবেত কণ্ঠে জানালেন যে পুরুষরা ঘরে না থাকলে নিজে রুজিরোজগারের বন্দোবস্ত করাটা অসম্ভব ব্যাপার। গামেতি নারীদের জন্য মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (মনরেগা) ছাড়া আর কোনও কর্মসংস্থান নেই, এবং বর্ষা আসতে না আসতেই কারদা সীমান্তের এই ছোট্ট পাড়াটির মহিলারা তাঁদের জন্য ২০২১ সালে বরাদ্দ ১০০ দিনের কাজ শেষ করে ফেলেছেন।
গোপলির বলছেন, “বছর গেলে অন্তত ২০০ দিনের কামকাজ তো লাগেই।” আপাতত এখানকার মহিলারা সবজি চাষে মন দিয়েছেন, যাতে কলাটা-মূলোটা যা-ই ফলুক না কেন তা নিকটতম বাজারে গিয়ে বেচে আসা যায়, এবং এই সিদ্ধান্তটিও তাঁরা স্বাধীনভাবে নিয়েছেন পুরুষদের মতামত না নিয়ে। “যাই হোক, চাট্টি পুষ্টিকর না খেলে আমাদের চলবে কেমন করে, বলুন?”
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)