"জীবনটা আমাদের তিনপাত্তির তাস, বুঝলেন তো? এই দুটো বছর কেমনভাবে যে টিকে আছি সেটা ঈশ্বরই জানেন," বলছিলেন ভি. থার্মা। "৪৭ বছর ধরে লোকশিল্পের সঙ্গে ঘর বেঁধেছি। খাওয়া-পরা কিস্যুটি জুটছে না, এমন অবস্থা এই দুই বছরের আগে কক্ষনো হয়নি।"

৬০ বছর বয়সী লোকশিল্পী থার্মা আম্মা একজন রূপান্তরকামী নারী, থাকেন তামিলনাড়ুর মাদুরাই নগরে। তাঁর কথায়, "আমাদের কোনও বাঁধাধরা মাইনে থোড়াই আছে, তাও বা যেটুকু রোজগারপাতি ছিল সেটাও এই করোনা [অতিমারি] এসে গিলে খেয়েছে।"

মাদুরাই জেলার রূপান্তরকামী লোকশিল্পীদের জন্য বছরের এই প্রথম ছয়টি মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামেগঞ্জে এই সময় জুড়েই পালা পার্বণ উদযাপিত হয়, মন্দিরে মন্দিরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে। কিন্তু লকডাউনের জন্য জনসমাগম নিষিদ্ধ, আর তার জেরেই এই রাজ্যের রূপান্তরকামী মহিলা লোকশিল্পীদের অবস্থা বেহাল। রাজ্যে আনুমানিক ৫০০ জন রূপান্তরকামী শিল্পী আছেন বলে জানালেন লোকজ ও নাট্যশিল্পে কর্মরত রূপান্তরকামী নারীদের রাজ্য সমিতির সম্পাদক থার্মা আম্মা (সবাই তাঁকে এই নামেই চেনে)।

এক ভাইপো ও তাঁর অল্পবয়সী দুই সন্তানের সঙ্গে মাদুরাই স্টেশনের কাছে এক-কামরার একটা ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন থার্মা আম্মা। ফুলের পাইকারি ব্যবসা আছে এই ভাইপোর। মাদুরাইয়ে বড়ো হয়ে ওঠা থার্মার মনে পড়ে ছোটোবেলায় তিনি কাছেপিঠের গ্রামগঞ্জের মন্দিরগুলোয় রূপান্তরকামী লোকশিল্পীদের নৃত্যানুষ্ঠান দেখতে যেতেন। তাঁর মা-বাবা দুজনেই ছিলেন দিনমজুর।

PHOTO • M. Palani Kumar

মাদুরাইয়ে নিজের এক-কামরার ভাড়া বাড়িতে থার্মা আম্মা: 'আমাদের কোন বাঁধাধরা মাইনে থোড়াই আছে! তাও বা যেটুকু রোজগারপাতি ছিল সেটাও এই করোনা [অতিমারি] এসে গিলে খেয়েছে'

১৪ বছর বয়েসে গানবাজনায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। "বড়োলোকেরা আমাদের বায়না করে ডেকে পাঠাত, ওই শ্রাদ্ধে টাদ্ধে গান গাওয়ার জন্য আর কি," জানালেন থার্মা আম্মা। (তাঁর মতো রূপান্তরকামী মানুষদের বোঝাতে উনি তামিল ভাষায় 'থিরুঙ্গাই' শব্দটি ব্যবহার করছিলেন)। "লোকজন আমাদের টাকাপয়সা দিত 'মারাডি পাটুর' (বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করা) সঙ্গে সঙ্গে 'ওপ্পারি' (বিলাপগীতি) গাওয়ার জন্য। এভাবেই তো লোকশিল্পের জগতে পা রাখি আমি।"

তখনকার দিনে চারজন রূপান্তরকামী লোকশিল্পীর একটি দলকে ১০১ টাকা নজরানা দেওয়া হত। ২০২০ সালের মার্চে লকডাউন শুরু হওয়ার আগে অবধি কখনও কখনও থার্মা এইসব শ্রাদ্ধানুষ্ঠগুলোয় যেতেন বটে, তবে ততদিনে এই রোজগার বেড়ে মাথাপিছু ৬০০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছিল।

৭০-এর দশকে প্রবীণ শিল্পীদের থেকে তালট্টু (ঘুমপাড়ানি গান) এবং নাটুপুরা পাটু (লোকসংগীত) গাইতে শিখেছিলেন থার্মা। এরপর ধীরে ধীরে নর্তক-নর্তকীদের দেখে দেখে তিনি রাজারানিআট্টমে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। গ্রামীণ তামিলনাড়ুর বিভিন্ন পালা পার্বণে প্রচলিত এই লোকজ নৃত্যনাট্যে থার্মা এখন রানির ভূমিকায় নৃত্যাভিনয় করেন।

"৭০-এর দশকে মাদুরাইয়ে ছেলেরাই রাজা, রানি আর ভাঁড় সেজে অভিনয় করত [অর্থাৎ এই নৃত্যনাট্যের মূল ভূমিকাগুলিতে]," স্মৃতিচারণ করছিলেন থার্মা। তিনি এটাও বললেন যে তারপর অন্য তিনজনের সঙ্গে দল বেঁধে তিনি যখন একটি গ্রামে অভিনয় করতে যান, সেটাই ছিল রাজারানিআট্টমের ইতিহাসে প্রথম রূপান্তরকামী মহিলাদের পরিবেশন।

A selfie of Tharma Amma taken 10 years ago in Chennai. Even applying for a pension is very difficult for trans persons, she says
PHOTO • M. Palani Kumar
A selfie of Tharma Amma taken 10 years ago in Chennai. Even applying for a pension is very difficult for trans persons, she says
PHOTO • M. Palani Kumar

১০ বছর আগে চেন্নাইয়ে তোলা থার্মা আম্মার প্রথম সেলফি। তিনি জানালেন যে রূপান্তরকামীদের পক্ষে ভাতার জন্য আবেদন করাটাও মোটেই সহজ কাজ নয়

কারাগাট্টাম নামক লোকশিল্পে নর্তক-নর্তকীর দল রংচঙে একটা কলসি মাথায় চাপিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে। স্থানীয় কয়েকজন শিল্পীর তত্ত্বাবধানে থার্মা এই শিল্পেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। "সরকার থেকে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তাঁরা সেগুলোতেও পরিবেশন করার সুযোগ দিয়েছিলেন আমাকে," জানালেন তিনি।

মাডু আট্টম (লোকসংগীতের তালে তালে গরু সেজে নাচ করেন শিল্পীরা), মাইয়িল আট্টম (ময়ুরের পোশাক পরে নৃত্য পরিবেশন) এবং পোই কাল কুডুরাই আট্টম (নকল ঘোড়ার সাজে লোকনৃত্য) – থাম্মার পাণ্ডিত্য ও দক্ষতার ঝুলি এভাবেই ভরে যেতে থাকে এক এক করে। তামিলনাড়ুর গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হত এই শিল্পধারাগুলি। "মুখে বেশ করে পাউডার মেখে রাত দশটা নাগাদ একবার যে নাচতে শুরু করতাম, সেটা শেষ হতে হতে ভোর আকছার ৪-৫টা বেজে যেত," বললেন থার্মা আম্মা।

জানুয়ারি থেকে জুন-জুলাই পর্যন্ত, অর্থাৎ যেটাকে লোকশিল্পের মরসুম বলা চলে, সেই সময়টায় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক পড়ত থাম্মার, ফলে হেসেখেলে মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা হাতে আসত তাঁর। তবে বাকি বছরটা কিন্তু মাসে হাজার তিনেকের বেশি জুটত না তাঁর কোনোকালেই।

যাও বা অভাব অনটন সামলে কোনওমতে চলছিল জীবন, বাধ সাধলো করোনা। "তামিলনাড়ুর এয়াল ইসাই নাটক মনরামের সদস্য হয়েও বা কী লাভ হল? কেউ তো কুটোটাও নাড়ছে না আমাদের জন্য," দুঃখ করছিলেন তিনি। তামিলনাড়ুর সংগীত, নৃত্য, নাট্য এবং সাহিত্যের উন্নতিসাধনের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই কেন্দ্রটি রাজ্য শিল্প ও সংস্কৃতি দপ্তরের অধীনে কর্মরত। "নারী বা পুরুষ হলে তারা দিব্যি ভাতার জন্য আবেদন করতে পারে হেসেখেলে, কিন্তু রূপান্তরকামীদের জন্য ব্যাপারটা এক্কেবারে উল্টো। আমি নিজে কতবার আবেদন করেছি তার ঠিকঠিকানা নেই, জানেন? আজ অবধি ওরা ভাতা চালু করেনি। খালি ঘুরেফিরে সেই এক কথা, সুপারিশ লাগবে। আরে বাবা, আমি চিনিটা কাকে যে গিয়ে সুপারিশ লিখে দিতে বলব? ভয়ানক কষ্ট করে বেঁচে আছি, একটু আধটু সাহায্য পেলে তাও বা কিছুটা সুরাহা হত। রেশনের ওই কাঁইবিচি চাল সেদ্ধ করে খাচ্ছি শুধু, সবজি টবজি কেনার দুটো পয়সাও নেই ট্যাঁকে।"

*****

মাদুরাই থেকে ভিলাঙ্গুডি শহরের দূরত্ব ১০ কিমিও নয়, সেখানে এই একই ভাবে অভাব অনটনের মধ্যে বেঁচে আছেন ম্যাগি। অতিমারি শুরু হওয়ার আগে অবধি তিনি মাদুরাই সহ অন্যান্য জেলায় ঘুরে ঘুরে কুম্মি পাটু গেয়ে রোজগার করতেন। চাষের বীজ পোঁতার পর যখন নতুন চারাগাছ জন্মায়, সেই শুভ উপলক্ষকে ঘিরেই গাওয়া হয় এই পরম্পরাবাহিত লোকগান। এই জেলায় কুম্মি পাটু পরিবেশনকারী রূপান্তরকামী নারী রয়েছেন যে কয়েকজন মাত্র, ম্যাগি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

PHOTO • M. Palani Kumar

মাদুরাইয়ে নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাগি (ক্যামেরার দিকে পিছন ফিরে)। সঙ্গে আছেন তাঁর বন্ধুবান্ধব তথা সহকর্মীর দল: শালিনী (বাঁদিকে), বাভ্যাশ্রী (শালিনীর পিছনে), আরাসি (হলুদ কুর্তা পরিহিত), কে. স্বস্তিকা (আরাসির পাশে) এবং শিফানা (আরাসির পিছনে)। পরব বা অনুষ্ঠানে শিল্প পরিবেশন করার সময় জুলাই মাসেই শেষ হয়ে যায়, এরপর আর ডাক আসবে না কোনও, ফলত বাকি বছরটা রোজগারপাতির আর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে

বছর তিরিশের ম্যাগি (এই নাম তিনি ব্যবহার করেন) বলছিলেন, "আমি রূপান্তরকামী নারী তো, তাই বাড়ি [মাদুরাই শহরে তাঁর বাড়ি। পিতামাতা কাছাকাছি গ্রামগুলোতে কৃষিশ্রমিকের কাজ করতেন।] ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। তখন আমার ২২ বছর বয়স। এক বন্ধু আমাকে মুলাইপারি পরবে নিয়ে যায়, সেখানেই কুম্মি পাটুতে হাতেখড়ি হয় আমার।"

ভিলাঙ্গুডির যে মহল্লায় ম্যাগি থাকেন, সেখানে আরও ২৫ জন রূপান্তরকামী মহিলা বসবাস করেন। তবে ম্যাগি জানালেন যে তাঁদের মধ্যে মোটে দুইজন কুম্মি পাটু গাইতে জানেন। তামিলনাড়ুতে প্রত্যেক বছর জুলাই মাসে দশদিন ধরে পালিত হয় মুলাইপারি পরব। বৃষ্টি, ফসলি মাটি এবং ভালো চাষাবাদের প্রার্থনায় এই ধরনের গান গেয়েই মানুষ আরাধনা করেন তাঁদের গ্রামদেবীর। "পরবের সময় আমরা অন্তত চার থেকে পাঁচ হাজার করে টাকা পাই," জানালেন ম্যাগি, "মাঝে সাঝে মন্দির টন্দিরে গাওয়ার বরাতও জোটে ঠিকই, তবে সেটার কোনও নিশ্চয়তা নেই।"

যুগ যুগান্তর পার করে এসে ২০২০ সালে প্রথমবারের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এই পরবটি। এবছরও জুলাই মাসে গাইতে যাওয়ার ডাক পেলেন না ম্যাগি। গতবছর মার্চ মাসে শুরু হয়েছিল কর্মনাশা এই লকডাউন, তারপর থেকে কতবার যে তিনি বাইরে কোথাও পরিবেশন করতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন সেটা এক আঙুলে গোনা যাবে। তাঁর কথায়, "এবছর আবার যখন লকডাউন শুরু হল, তার ঠিক আগে [মার্চের মাঝামাঝি নাগাদ] দিন তিনেকের জন্য ডাক এসেছিল মাদুরাইয়ের একটা মন্দির থেকে।"

জুলাই পড়ে গেছে, অবিলম্বেই শেষ হয়ে যাবে পরব আর অনুষ্ঠানের মরসুম। এরপর আর আমন্ত্রণ আসবে না একটাও। ফলত বাকি বছরটা জুড়ে ম্যাগি এবং তাঁর সহকর্মীদের রোজগারপাতির আর কোনও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

At Magie's room, V. Arasi helping cook a meal: 'I had to leave home since I was a trans woman' says Magie (right)
PHOTO • M. Palani Kumar
At Magie's room, V. Arasi helping cook a meal: 'I had to leave home since I was a trans woman' says Magie (right)
PHOTO • M. Palani Kumar

ম্যাগির ঘরে রান্নাবান্নায় সাহায্য করছেন ভি. আরাসি। 'আমি রূপান্তরকামী নারী তো, তাই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম,' জানালেন ম্যাগি (ডানদিকে)

তিনি জানালেন যে গতবছর লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে স্বেচ্ছাকর্মীদের একটি দল কয়েকবার রেশন দিয়ে গেছে তাঁকে। এছাড়াও যেহেতু রাজ্য শিল্প ও সংস্কৃতি দপ্তরের খাতায় ম্যাগির নাম লেখানো আছে, তাই সরকারের তরফ থেকে উনি ২,০০০ টাকার অনুদান পেয়েছেন মে মাসে। "তবে দুঃখের কথা কী জানেন তো? অনেকের কপালে এই সামান্য টাকাটুকুও জোটেনি," বলছিলেন ম্যাগি।

তবে অতিমারি শুরু হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু তাঁদের কর্মক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল মন্দা। পরবের মরসুমেও তাঁরা আগের মতো কাজের বরাত পাচ্ছিলেন না গত কয়েকবছর যাবৎ। "আগের মতনটি নেই আর, আজকাল ছেলে মেয়ে সবাই কুম্মি গান শিখে নিচ্ছে। আর মন্দির টন্দিরে তো ওদেরই চাহিদা বেশি, আমাদের মতো রূপান্তরকামীদের তো এখন উঠতে বসতে অপমান করা হয় নানান জায়গায়। আগে কিন্তু এমনটা ছিল না জানেন তো! সাধারণত লোকশিল্পীরাই এই গান গাইত, আর তাছাড়া রূপান্তরকামী মহিলাদেরও আলাদা জায়গা ছিল একটা। যতদিন যাচ্ছে এসব গান ততই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দিন কে দিন, তাই আমাদের মতো মানুষের কাজকম্মও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।"

*****

মাদুরাই নগর থেকে প্রায় ১০০ কিমি দূরত্বে পুদুকোট্টাই জেলায় রয়েছে ভিরালিমালাই নামে একটি ছোট্টো শহর। আজ ১৫ মাস হতে চলল অভাবে অনটনে এখানেই দিন কাটাচ্ছেন বর্ষা। সাধ আহ্লাদ তো দূরের কথা, দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতেই নাভিশ্বাস উঠেছে তাঁর। ছোটোভাই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন, বর্ষা বাধ্য হচ্ছেন তাঁর কাছেই হাত পাততে।

মাদুরাইয়ের কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকশিল্পের স্নাতকোত্তর করছেন ২৯ বছরের বর্ষা, এটা ফাইনাল ইয়ার তাঁর। সারাদিন পড়াশোনা করার পর ঠিকমতো বিশ্রামটুকুও জুটতো না তাঁর কোনকালেই। অতিমারি শুরু হওয়ার আগে অবধি কিছু রোজগারের আশায় তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তথা মন্দিরে লোকনৃত্য পরিবেশন করতেন সারারাত। পড়াশোনা ও এই খাটাখাটনির মধ্যে দম নেওয়ার জন্য পড়ে থাকতো কেবল ঘন্টা দুই-তিন।

Left: Varsha at her home in Pudukkottai district. Behind her is a portrait of her deceased father P. Karuppaiah, a daily wage farm labourer. Right: Varsha dressed as goddess Kali, with her mother K. Chitra and younger brother K. Thurairaj, near the family's house in Viralimalai
PHOTO • M. Palani Kumar
Left: Varsha at her home in Pudukkottai district. Behind her is a portrait of her deceased father P. Karuppaiah, a daily wage farm labourer. Right: Varsha dressed as goddess Kali, with her mother K. Chitra and younger brother K. Thurairaj, near the family's house in Viralimalai
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: পুদুকোট্টাই জেলায় নিজের বাড়িতে বর্ষা। পিছনের আবক্ষচিত্রটি তাঁর প্রয়াত পিতা পি. কারুপ্পিয়াহর, তিনি খেতমজুরের কাজ করতেন। ডানদিকে: ভিরালিমালাইয়ে নিজের বাড়ির কাছে কালীর বেশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বর্ষা, পাশে তাঁর মা কে. চিত্রা এবং ছোটোভাই কে. থুরাইরাজ

এক বিচিত্র লোকশিল্পের নাম কাট্টা কাল আট্টম, শিল্পীরা রনপায় চড়ে সংগীতের তালে তাল মিলিয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন। বর্ষা জানালেন যে রূপান্তরকামীদের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি এই শিল্পটির মঞ্চে পা রেখেছেন (প্রমাণ স্বরূপ উনি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ পাঠিয়েছিলেন যেখানে এই তথ্যটির উল্লেখ ছিল)। ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া, আর তারপর সেটাকে ব্যবহার করে নৃত্যরূপ ফুটিয়ে তোলা – অপার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা ছাড়া দুটোর একটাও সম্ভব নয়।

বর্ষা কাট্টা কাল আট্টম ছাড়াও থাপ্পাট্টামে পারদর্শী। এই লোকনৃত্যটিতে, মূলত দলিত শিল্পীরা থাপ্পু নামের পরম্পরা বাহিত ড্রাম জাতীয় বাদ্যযন্ত্রটি বাজান, আর তার তাল মিলিয়ে নৃত্য পরিবেশিত হয়। তবে দৈবীগা নাদনাম (দেবীনৃত্য) তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিল্পরূপ। বর্ষাকে তামিলনাড়ুর এক জনপ্রিয় শিল্পী বলা চলে, বড়ো বড়ো তামিল টিভি চ্যানেলে সম্প্রসারিত হয়েছে তাঁর নৃত্যকলা, অসংখ্য স্থানীয় সংগঠনের দ্বারা বারংবার সম্মানিত হয়েছেন তিনি। বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি – দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমন্ত্রণ এসেছে তাঁর।

মাদুরাই জেলার সাতটি ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের গ্রাম থেকে আগত যে সাতজন রূপান্তরকামী শিল্পী মিলে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অর্ধনারী কলাই কুলু নামক একটি সংগঠন, বর্ষা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কোভিডের প্রথম এবং দ্বিতীয় তরঙ্গের মধ্যিখানে, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মাঝে প্রায় ১৫টি জায়গা থেকে ডাক এসেছিল তাঁদের। "এই কয়মাস আমরা প্রত্যেকেই ১০,০০০ (প্রতি মাসে) করে রোজগার করেছি," বর্ষা জানালেন।

"শিল্প ছাড়া আমার জীবনে আর কিচ্ছুটি নেই," বলছিলেন তিনি, "নাচগান না করলে খাবারটুকুও জুটবে না। বছরের প্রথম ছয়মাস যেটুকু আসতো হাতে, সেটা দিয়েই পরের ছ’টা মাস টানতাম।" বর্ষা বা তাঁর মতো রূপান্তরকামী নারীদের সকলেরই অবস্থাই এক, যেটুকু রোজগার হয় সেটা দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতেই চলে যায়। তিনি বলছিলেন, "সঞ্চয় করার মতো টাকাপয়সা আজ অবধি আসেনি হাতে। নাচের পোশাক-আশাক, খাবারদাবার আর যাতায়াতের পিছনেই তো পুরো টাকাটা বেরিয়ে যায়, জমাব কোথা থেকে বলুন তো? ঋণের জন্য যতবার পঞ্চায়েত অফিসে গেছি, প্রতিবার ওরা মুখের উপর না বলে দিয়েছে। ঠিকঠাক নথিপত্র নেই বলে ব্যাংকের থেকেও টাকা ধার করতে পারি না আমরা। জানেন, আজ এমন অবস্থা আমাদের যে একশোটা টাকার জন্যও অনুষ্ঠান করতে রাজি আছি!"

Varsha, a popular folk artist in Tamil Nadu who has received awards (displayed in her room, right), says 'I have been sitting at home for the last two years'
PHOTO • M. Palani Kumar
Varsha, a popular folk artist in Tamil Nadu who has received awards (displayed in her room, right), says 'I have been sitting at home for the last two years'
PHOTO • M. Palani Kumar

তামিলনাড়ুর জনপ্রিয় লোকশিল্পী বর্ষা, ঘরময় তাঁর সাজানো রয়েছে সারি সারি পুরস্কার, তিনি বলছিলেন, 'দু-দুটো বছর কেটে গেল ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছি বাড়িতে'

ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন বর্ষা যখন নিজের রূপান্তরকামী সত্তার আভাস পান, তখন তাঁর বয়স মোটে ১০। স্থানীয় পালা পার্বণের সময় নর্তক-নর্তকীদের দেখে দেখেই লোকশিল্পে হাতেখড়ি হয় তাঁর। তারপর আসে প্রথমবার কোনও মঞ্চে লোকনৃত্য পরিবেশন করার পালা, তখন ১২ বছর বয়স বর্ষার। লোকশিল্প নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার আগে অবধি নৃত্যকলায় তাঁর কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছিল না।

"বাড়ির কেউই মেনে নিতে চায়নি, শেষমেশ এমন অবস্থায় এসে দাঁড়ালো যে বাধ্য হলাম বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। তখন আমার বয়স ১৭। আজ এতকিছুর পরেও কেন এরা আমায় ফিরিয়ে নিয়েছে জানেন? কারণ আমার শিরায় শিরায় বইছে লোকশিল্পের প্রতি ভালোবাসা," বলছিলেন বর্ষা। তিনি আজ ভিরালিমালাই গ্রামে তাঁর মা (এককালে কৃষিশ্রমিক ছিলেন তিনি) এবং ছোটোভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করেন।

"সবই তো হল, কিন্তু দু-দুটো বছর কেটে গেল ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বাড়িতে বসে আছি যে [মার্চ ২০২০তে প্রথম দফা লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে]। সাহায্যের হাত কেউই বাড়িয়ে দেয়নি [কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া]। এই সংস্থা, সেই সমিতি [এনজিও], কত যে লোকজনের কাছে হাত পেতেছি তার ইয়ত্তা নেই জানেন? গতবছর তাও বা কয়েকজন একটু আধটু সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু এবছর তাঁরাও পারলেন না আর," স্পষ্টত ঝরে পড়ছিল হতাশা তাঁর গলায়, "গ্রাম-গ্রামাঞ্চলে যেসব রূপান্তরকামী লোকশিল্পীরা রয়েছেন, সরকারের থেকে তাঁরা একটি নয়া পয়সাও পাননি। গতবছর ঠিক যা যা হল, এবারেও তাই-ই হচ্ছে, কাজকম্ম চুকেবুকে গেল সব, এখন কীভাবে যে পেট চালাব সেটা ভেবে ভেবেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমরা আজও সেই অদৃশ্যই থেকে গেলাম..."

এই প্রতিবেদনে উদ্ধৃত সাক্ষাৎকারগুলি ফোনের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Reporting : S. Senthalir

ایس سینتلیر، پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا میں بطور رپورٹر اور اسسٹنٹ ایڈیٹر کام کر رہی ہیں۔ وہ سال ۲۰۲۰ کی پاری فیلو بھی رہ چکی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز S. Senthalir
Photographs : M. Palani Kumar

ایم پلنی کمار پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا کے اسٹاف فوٹوگرافر ہیں۔ وہ کام کرنے والی خواتین اور محروم طبقوں کی زندگیوں کو دستاویزی شکل دینے میں دلچسپی رکھتے ہیں۔ پلنی نے ۲۰۲۱ میں ’ایمپلیفائی گرانٹ‘ اور ۲۰۲۰ میں ’سمیُکت درشٹی اور فوٹو ساؤتھ ایشیا گرانٹ‘ حاصل کیا تھا۔ سال ۲۰۲۲ میں انہیں پہلے ’دیانیتا سنگھ-پاری ڈاکیومینٹری فوٹوگرافی ایوارڈ‘ سے نوازا گیا تھا۔ پلنی تمل زبان میں فلم ساز دویہ بھارتی کی ہدایت کاری میں، تمل ناڈو کے ہاتھ سے میلا ڈھونے والوں پر بنائی گئی دستاویزی فلم ’ککوس‘ (بیت الخلاء) کے سنیماٹوگرافر بھی تھے۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز M. Palani Kumar
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر نے جادوپور یونیورسٹی، کولکاتا سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک شاعر، ناقد اور مصنف، سماجی کارکن ہیں اور پاری کے لیے بطور مترجم کام کرتے ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra