“দেশকে ভালোবাসি, তাই তো এমন তিরঙ্গা দিয়ে আমাদের ট্রাক্টরগুলো সাজাচ্ছি,” জানালেন শামশের সিং। ভারতীয় পতাকার তিনটি রঙে ছোপানো ফিতে, বেলুন, ফুল, না জানি আরও কত কিছু দিয়ে সেজে উঠেছিল তাঁর সাধের বাহনটি। তাঁর কথায়, “জন্মভূমি যতটা প্রিয়, কৃষিকাজও ততটাই। মাসের পর মাস চাষ করি, মায়েরা যেমন করে আমাদের যত্ন নেন, ঠিক তেমনভাবেই ফসলের যত্ন নিই আমরা। এইটা মাথায় রেখেই মা বসুধার মতো সাজিয়েছি ট্রাক্টরগুলো।”
আসন্ন প্রজাতন্ত্র দিবস ঘিরে নানান আনুষঙ্গিক ভাবনা মাথায় রেখে দিল্লি ও তার উপকণ্ঠে অবস্থিত আন্দোলনস্থলগুলিতে নিজেদের ট্রাক্টরগুলি সাজাচ্ছেন চাষিরা। এই কুচকাওয়াজ যাতে একই সঙ্গে রংদার ও অর্থবহ হয়ে ওঠে, সেটা ভেবেই রাজধানীর বুকে একের পর এক প্রদেশ ও বিষয়ের ট্যাবলো বার করতে চলেছেন তাঁরা। ফুল, পতাকা ও ট্যাবলোয় ঢাকা ট্রাক্টরগুলি চট করে চেনা মুশকিল। ৬ই জানুয়ারির মধ্যে যাতে সবকিছু তৈরি হয়ে যায়, সে ব্যাপারে উঠেপড়ে লেগেছেন চাষিরা, সঙ্গত করছে কৃষক সংগঠনের নিয়োজিত দলগুলি।
“গৌরে নাঙ্গালে আমার বাড়ি থেকে গাড়ি [ট্রাক্টর] চালিয়ে এখানে আসতে পাক্কা দুই দিন লেগেছে,” জানালেন ৫৩ বছর বয়সী শামশের। দেশ জুড়ে চাষিরা আজ নয়া কৃষি-আইন প্রত্যাহারের দাবিতে মুখর, সেটাকে আরও জোরদার করে তুলতে পঞ্জাবের অমৃতসর জেলা থেকে হরিয়ানা-দিল্লি সীমান্তে অবস্থিত টিকরিতে এসে উঠেছেন শামশের, সঙ্গে রয়েছেন তাঁর গ্রামেরই আরও ২০ জন চাষি।
কৃষকরা যে আইনগুলির প্রতিবাদ করছেন: কৃষিপণ্য ব্যবসা – বাণিজ্য (উৎসাহ ও সুযোগসুবিধা দান) আইন, ২০২০ ; মূল্য নিশ্চয়তা ও কৃষি পরিষেবা বিষয়ে কৃষক (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তি আইন, ২০২০ ; অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০ । কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি আইন প্রথমে অধ্যাদেশ হিসেবে পাশ হয় ৫ জুন, ২০২০, তারপর কৃষিবিল হিসেবে লোকসভায় পেশ করা হয় ১৪ই সেপ্টেম্বর এবং সেই মাসের ২০ তারিখ দ্রুততার সঙ্গে সেটিকে আইনে পরিণত করে বর্তমান সরকার।
কৃষকরা মনে করেন এই আইনগুলি তাঁদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে দেবে, কারণ এই আইনের দ্বারা কৃষক ও কৃষির ওপর বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থার শক্তি আরও বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য , কৃষি উৎপাদন বিপণন কমিটি, সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা সহ চাষিদের সহায়তাকারী মূল নীতিগুলিকে লঙ্ঘন করবে এই আইন। এরই পাশাপাশি, ভারতীয় সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদকে উপেক্ষা করে ভারতীয় নাগরিকের আইনি লড়াইয়ের পথে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্যও সমালোচনার মুখে পড়েছে এই আইন তিনটি।
বলজিৎ সিংয়ের বাহনটিও ঢাকা পড়েছে লম্বা লম্বা ফেস্টুন ও ভারতীয় তিরঙ্গায়। ১৪ বছর বয়সী নাতি নিশান্তের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেবেন বলে সুদূর রোহতক জেলার খেড়ি সাধ গ্রাম থেকে ট্রাক্টর চালিয়ে এসেছেন তিনি। সম্মানের প্রতীক হিসেবে তথা নিজ রাজ্যের চাষিদের প্রতিনিধিত্ব করতে হরিয়ানার প্রথাগত বেশভূষায় সাজতে চলেছে ছোট্ট নিশান্ত, জানালেন বলজিৎ।
৫৭ বছরের এই চাষিটির কথায়, “কুচকাওয়াজে অংশ নেব বলে দিন কতক আগেই মাহিন্দ্রা কোম্পানির একটা ট্রাক্টর কিনলাম, নিজের গাঁটের কড়ি দিয়ে। অন্য কেউ যে আমাদের পুঁজির জোগান দিচ্ছে না, এই কথাটাই বোঝাতে চাই সরকারকে। নিজেদের খাই-খরচা নিজেরাই রোজগার করি আমরা।”
কুচকাওয়াজে অংশ নেবে মোটরগাড়িও। ‘কিষান প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে’ যোগ দিতে পঞ্জাবের মোগা জেলার মোগা শহর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার পথ ইনোভা চালিয়ে টিকরিতে এসে পৌঁছেছেন বলজিন্দর সিং (২৭)। চাষবাসের প্রতীক রূপে নিজের গাড়িখানা সবুজ রঙে রাঙিয়ে তুলেছেন এই পেশাদার শিল্পীটি। ‘পঞ্জাব মালা দিল দিল্লির গলায়’ – এই স্লোগানটি লেখা আছে তাঁর পিছনের ডিকিতে। “এটার মানে, দিল্লিবাসীর দিল্ না জেতা অবধি আমরা পঞ্জাবের মানুষেরা বাড়ি ফিরব না,” বুঝিয়ে বললেন তিনি। প্রবাদপ্রতিম স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং যে তাঁর অনুপ্রেরণা, এটাও জানালেন বলজিন্দর।
কুচকাওয়াজের প্রস্তুতি নিতে অসংখ্য পোস্টার, ব্যানার ও হোর্ডিং বানিয়েছেন অন্যান্য শিল্পীরা। সেই সকল আঁকিয়েদের একটি তালিকা বানিয়েছে ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন (উগ্রাহান)। এই প্রসঙ্গে বিকেইউয়ের একজন মুখপাত্র (পরিচয় হিসেবে শুধু ‘বিকাশ’ নামটি দিয়েছিলেন তিনি) জানালেন: “কৃষি-আন্দোলনের এই মঞ্চ থেকে দলিতের উপর অত্যাচার এবং পরিযায়ী মজদুরদের সমস্যার মতো হাজারো সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়ে চাই আমরা। গুরুরা আমাদের যা যা শিখিয়ে গেছেন, সেগুলো হোর্ডিং-আকারে লিখছি। দিনরাত খাটছি, কাজটা যাতে সময়মতো শেষ করা যায়।”
শেষমেশ তাই ২৬শে জানুয়ারির সকালে ট্রাক্টর, মোটরগাড়ি ও দিগন্ত বিস্তৃত জনজোয়ারে সজ্জিত হয়ে রওনা দিল এক অভূতপূর্ব কুচকাওয়াজ – আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য একটাই: নয়া কৃষি-আইন প্রত্যাহার।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)