“বৃষ্টি আবার গায়েব হয়েছে,” বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে নিজের খেতের দিকে যেতে যেতে বললেন ধর্মা গরেল। “জুন একটা আজব মাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২-৩ ঘন্টা বৃষ্টি হবে। কখনও ভারি কখনও হালকা। কিন্তু তারপরের কয়েক ঘন্টা আবার অসহ্য গরম। জমির সব আর্দ্রতা শুষে নেবে। মাটি আবার শুকিয়ে যায়। চারাগুলো বাড়বেই বা কেমন করে?”
থানে জেলার শাহপুর তালুকের, ১৫টি ওয়ারলি পরিবার বিশিষ্ট গরেলপাড়া আদিবাসী জনপদে এক একর জমিতে ধান চাষ করেন ৮০ বছর বয়সী গরেল ও তাঁর পরিবার। ২০১৯ সালের জুন মাসে যে ধান তাঁরা বুনেছিলেন তা সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছিল। সেই মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১ দিনে ছিল মাত্র ৩৯৩ মিলিমিটার (স্বাভাবিক গড় ৪২১.৯ মিলিমিটারের চেয়েও কম)।
যে ধান তাঁরা বুনেছিলেন তার অঙ্কুরোদ্গম অবধি হয়নি, ফলে বীজ, সার আর ট্রাক্টর ভাড়া করতে এবং চাষের অন্যান্য কাজে তাঁরা যে ১০,০০০ টাকা ব্যয় করেন তার সবটাই জলে যায়।
“নিয়মিত বৃষ্টিপাতে মাটি ঠাণ্ডা হতে শুরু করে অবশেষে অগস্ট মাসে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে দ্বিতীয়বার ধান বোনার ঝুঁকি নিলে ফসল তুলে আমাদের কিছু লাভ হতে পারে,” বললেন ধর্মার ৩৮ বছর বয়সী ছেলে রাজু।
জুন মাসের স্বল্প বৃষ্টিপাতের পর ওই তালুকে ভারি বৃষ্টি হয় — স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ৯৪৭.৩ মিমির স্থানে ১৫৮৬.৮ মিমি। অতএব গরেল পরিবার দ্বিতীয়বার চাষের উপর ভরসা করতে চাইলেন। কিন্তু অগস্ট নাগাদ মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত শুরু হল — চলল অক্টোবর পর্যন্ত। থানে জেলার সাতটি তালুকের প্রতিটিতেই ১১৬ দিনে ১,২০০ মিমি অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়।
“ফলনের পক্ষে যথেষ্ট বৃষ্টিপাত সেপ্টেম্বরের মধ্যে হয়ে গিয়েছিল। পেট ফেটে যাওয়া অবধি আমরা মানুষরাও খাই না তো অতটকু ছোটো ছোটো গাছগুলোই বা কেন খাবে?” প্রশ্ন রাজুর। অক্টোবরের বর্ষা গরেল পরিবারের ধানখেত ভাসিয়ে দিল। “আমরা সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ধান কেটে আঁটি বাঁধতে শুরু করি,” কৃষক এবং রাজুর স্ত্রী সবিতা ভেবে বললেন। “ধান কাটা তখন আরও বাকি ছিল। ৫ই অক্টোবরের পর হঠাৎ ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। আঁটি বেঁধে গোছানো ধান আমরা যথাসম্ভব বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু নিমেষের মধ্যে আমাদের খেত জলে ভেসে যায়...”
অগস্টের দ্বিতীয়বারের চাষ থেকে গরেল পরিবার উদ্ধার করতে পেরেছিল মাত্র ৩ কুইন্টাল ধান — যেখানে ৯-৮ কুইন্টাল ধান একবারের চাষ থেকে তাঁরা পেতেন আগে।
“কয়েক দশক ধরে এমনই চলছে,” বললেন ধর্মা। বৃষ্টিপাত বাড়েওনি কমেওনি, শুধু ছন্নছাড়া হয়ে গেছে — আর গরম বেড়েছে অনেক।” ২০১৮ সালেও এই পরিবার গড় সাধারণের তুলনায় কম বৃষ্টিপাতের কারণে মাত্র চার কুইন্টাল ধান তুলতে পেরেছিল। ২০১৭ সালের অক্টোবরে আর এক দফা অপ্রত্যাশিত বর্ষা তাঁদের ধানের ক্ষতি করেছিল।
ধর্মা ঠিকই বলেছেন যে গরম ক্রমাগত বেড়ে, একেবারে “অসহনীয়” হয়ে উঠেছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন বিষয়ক নিউ ইয়র্ক টাইমস- এর ইন্টারঅ্যাক্টিভ পোর্টাল দেখাচ্ছে যে ১৯৬০ সালে, যখন ধর্মার বয়স ছিল ২০, তখন থানে জেলায় ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সম্বলিত দিনের সংখ্যা ছিল ১৭৫। এখন এমন দিনের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৩৭।
শাহপুর তালুক জুড়ে আদিবাসী জনপদগুলির আরও অন্যান্য পরিবারও ধানের ফলন কমে যাওয়ার কথা বলছিল। এই জেলায় কাতকারি, মলহার কোলি, মা ঠাকুর, ওয়ারলি আদিবাসীদের বাস — তফশিলি জনজাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা থানে জেলায় ১১ লক্ষ ৫০ হাজার (জনগণনা ২০১১) অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ।
“বর্ষানির্ভর ধান চাষে নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে জল লাগে আর এজন্য চাই সুসমঞ্জস বৃষ্টিপাত। শস্যের ফলনচক্রে বৃষ্টির তারতম্য ফলন কমিয়ে দেয়,” বললেন পুণের বিএআইএফ স্থায়ী কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের (বিএআইএফ ইনস্টিটিউট ফর সাসটেনেবল লাইভলিহুডস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) ব্যবস্থাপক সোমনাথ চৌধুরি।
বহু আদিবাসী পরিবার খরিফ মরশুমে তাদের এক চিলতে জমিতে ধান চাষ করে, বছরের বাকি মাসগুলোতে ইটভাটা, আখ খেত বা অন্য কোথাও কাজ করতে চলে যায় — এইভাবেই কোনোরকমে পরিবারগুলির বছর কাটে। কিন্তু অনিয়মিত বর্ষার কারণে বারংবার ধান চাষ মার খাওয়ায় তারা আর যাই হোক বর্ষার ধান চাষের উপর আর ভরসা করতে পারে না।
জেলার ১৩৬,০০০ হেক্টর জমিতে খরিফ মরশুমে বর্ষার ধান চাষ করা হয় আর প্রধানত সেচযুক্ত (প্রধানত খোলা কুয়ো ও বোরওয়েল) ৩,০০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয় রবি মরশুমে (শুষ্কজমি চাষাবাদ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেন্ট্রাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট ফর ড্রাইল্যান্ড এগ্রিকালচারের ২০০৯-২০১০ সালের তথ্য অনুসারে)। এখানকার অন্যান্য প্রধান প্রধান শস্যগুলি হল বাজরা, ডাল ও চিনাবাদাম।
যদিও থানে জেলায় অজস্র শাখাযুক্ত দুটি বড়ো নদী, উলহাস ও বৈতরণ আছে, আর আছে বৎস, মোদক সাগর, তানসা, এবং আপার বৈতরণ নামের চারটি বড়ো বাঁধ, তবুও আদিবাসী জনপদগুলিতে চাষাবাদ এখনও বর্ষানির্ভর।
“চারটে বাঁধের সব জল মুম্বইকেই দিয়ে দেওয়া হয়। এখানে মানুষ বর্ষা আসার আগে অবধি, অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে মে মাস জলকষ্টে ভোগে,” বললেন শাহপুরের এক সমাজকর্মী ও বৎস সেচ প্রকল্প পুনর্বাসন কমিটির সঞ্চালক, বাবন হারাণে।
তিনি আরও বললেন, “শাহপুরে বোরওয়েলের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। জল বিভাগ ছাড়াও, বেসরকারি ঠিকাদাররা বেআইনিভাবে ৭০০ মিটারেরও বেশি গভীর মাটি খোঁড়ে।” ভূগর্ভস্থ জল সমীক্ষা ও উন্নয়ন সংস্থার সম্ভাব্য জলাভাব সংক্রান্ত রিপোর্ট ২০১৮ দেখাচ্ছে যে থানে জেলার শাহপুর সহ ৩টি তালুকের ৪১টি গ্রামের ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে গেছে।
“আমরা খাওয়ার জলটুকুই পাই না তো চাষ করব কেমন করে। বড়ো চাষিরা পারে কারণ বাঁধের জল কেনার পয়সা তাদের আছে বা তাদের নিজেদের কুয়ো আর পাম্প আছে,” বললেন রাজু।
শাহপুরের আদিবাসী জনপদ থেকে অনেকেই যে নভেম্বর থেকে মে মাস অবধি অন্যত্র কাজ করতে পাড়ি দেন তার পিছনে অন্যতম কারণ জলাভাব। অক্টোবরের খারিফ ফসল তোলা হয়ে গেলেই তাঁরা মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের ইটভাটায় অথবা রাজ্যের ভেতরেই আখ খেতে কাজ করতে চলে যান। আবার ফিরে আসেন কয়েক মাস কোনোরকমে চালাবার মতো অর্থ হাতে নিয়ে, ঠিক খারিফ মরশুমের আগে।
নন্দুরবার জেলার শাহাদে তালুকের প্রকাশা গ্রামে আখ খেতে কাজ করতে চলে যান সবিতা ও রাজু গরেলও। ২০১৯ সালে ধর্মা এবং তাঁদের ১২ বছর বয়সী ছেলে অজয়কে গরেলপাড়ায় রেখে, তাঁরা একটু বিলম্বে, ডিসেম্বর মাসে, অন্যত্র কাজ করতে পাড়ি দিয়েছিলেন। এই চারজনের পরিবারের কাছে জুন অবধি চালাবার জন্য ছিল চার কুইন্টাল চাল। “(কাছের) অঘাই গ্রামের যে কৃষকরা অড়হর ডাল চাষ করে — আমরা তাদের কাছ থেকে সাধারণত খানিকটা চালের বিনিময়ে ডাল নিয়ে আসি। এবার আর তা হয়ে উঠবে না...” খারাপ ফলনের প্রসঙ্গে রাজু আমাকে একথা বলেছিলেন।
আখ খেতে সাত মাস কাজ করে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সবিতা, ৭০,০০০ টাকা আয় করেন। এছাড়াও শাহপুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভিওয়াণ্ডির একটি অনলাইন বিপণির গুদামে পণ্য বোঝাই করার কাজও রাজু করেন জুন থেকে সেপ্টেম্বর অবধি — সাধারণত ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরিতে ৫০ দিন এই কাজ করেন তিনি।
গরেলপড়া থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে, বেরশিংগিপাড়া জনপদে মালু ওয়াঘের পরিবারও ধানের পড়ন্ত উৎপাদনজনিত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাঁর খড়ের চাল দেওয়া মাটির কুঁড়েঘরের এক কোণায় বাঁশ আর গোবর দিয়ে তৈরি কানাগি নামের এক ধরনের পাত্রে পোকা তাড়াবার জন্য নিমপাতা দিয়ে ঘিরে দুই কুইন্টাল ধান জমানো আছে। “ওটাই এখন বাড়ির সবচেয়ে দামি জিনিস,” গত নভেম্বরে মালু আমাকে বলেছিলেন। “এই শস্য আমাদের খুব সাবধানে ব্যবহার করতে হবে কারণ বৃষ্টির কোনও ঠিকঠিকানা নেই। সে চলে তার নিজের খেয়ালে, আমাদের মর্জিতে না। আমাদের কথা সে তো আর শোনে না।”
সমীক্ষাগুলিতে তাঁর কথার সত্যতাই ধরা পড়ে — বর্ষা সত্যিই একেবারে দুর্বৃত্ত হয়ে উঠেছে। “আমরা মহারাষ্ট্রের ১০০ বছরের বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখেছি,” জানালেন ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের ২০১৩ সালের একটি সমীক্ষার প্রধান গবেষক, ডঃ পুলক গুহঠাকুরতা। মহারাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান জলাভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন ও মরশুমি সূচক (Detecting changes in rainfall pattern and seasonality index vis-à-vis increasing water scarcity in Maharashtra) নামের এই সমীক্ষা রাজ্যের ৩৫টি জেলার ১৯০৬—২০০৬ অবধির বৃষ্টিপাতের মাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। পুণের আবহাওয়া বিভাগ জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষণা ও পরিষেবা দপ্তরের বিজ্ঞানী, ডঃ গুহঠাকুরতা আরও বলেন, “এই সমীক্ষা থেকে, ক্ষুদ্রতর পরিধির মধ্যে আবহাওয়া পরিবর্তনের স্থানিক ও কালিক প্রভাব পরিষ্কার বোঝা যায়... কৃষিকাজের নিরিখে, বিশেষত বর্ষাকেন্দ্রিক কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল অঞ্চলগুলিতে এই পরিবর্তনের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
এই পরিবর্তনগুলির স্পষ্ট প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাস্তবে। অতএব কাতকারি সম্প্রদায়ের ৫৬ বছর বয়সী মালু ওয়াঘ ও তাঁর পরিবার এবং ওই জনপদের ২৭টি আদিবাসী পরিবারের বেশিরভাগ মানুষ যখন ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে গুজরাতের ভাপি এলাকায় ইটভাটায় কাজ করতে গেলেন, সঙ্গে ৫০ কিলো চাল নিয়ে যাওয়ায় বন্ধ কুঁড়েঘরে পড়ে রইলো আর মাত্র দুই কুইন্টাল চাল — এই দিয়ে বেরশিংগিপাড়ায় ফিরে এসে, মে-জুন থেকে অক্টোবর অবধি তাঁদের চালাতে হবে।
আজ থেকে মোটামুটি ৫-১০ বছর আগেও আমি ৮ থেকে ১০ কুইন্টাল ধান ঘরে তুলতাম — ৪ থেকে ৫ কুইন্টাল চাল আমার বাড়িতে এমনিই পড়ে থাকতো। যখন খুশি এই চালের বিনিময়ে আমরা অন্য কৃষকদের কাছ থেকে অড়হর ডাল, নাগলি (রাগি), ওয়ারাই (বাজরা) এবং হরভরা (ছোলা) নিয়ে আসতে পারতাম,” বললেন মালুর স্ত্রী, ৫০ বছর বয়সী নকুলা। পাঁচজনের পরিবারের এতে সারা বছর দিব্যি চলে যেতো। “আজ পাঁচ বছরের ওপর, আমরা ৬ থেকে ৭ কুইন্টালের বেশি ধান ঘরে তুলতেই পারি না।”
মালু আরও বললেন, “ফলন প্রতিবছর কমছে।”
গতবছর অগস্টে বৃষ্টিপাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেন। কিন্তু অক্টোবরের ভারি অকালবর্ষণ — ১১ দিনে ১০২ মিমি — পরিবারের এক একর জমি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কেটে রাখা ধান সব ভিজে যায়, বাঁচানো যায় কেবল ৩ কুইন্টাল। “এই বৃষ্টিটার ফলে আমরা যে ১০,০০০ টাকা বীজ, সার, আর বলদ ভাড়া বাবদ খরচ করেছিলাম তার সবটাই জলে যায়”, বললেন মালু।
থানে জেলার শাহপুর তালুকের ১২টি কাতকারি ও ১৫টি মলহার কোলি পরিবারের বেশিরভাগের ঘাড়েই এই লোকসানের বোঝা চেপেছে।
“সবাই জানে মরশুমি বৃষ্টি চরম অস্থির। জলবায়ুর পরিবর্তন তাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে ফলে কৃষকরা আর তাঁদের ফসল-চক্র আর নিজেদের পছন্দের চাষের ধাঁচ অনুসরণ করতে পারছেন না,” বললেন বম্বে আই আই টির জলবায়ু নিরীক্ষণ বিদ্যার আন্তর্বিভাগীয় কর্মসূচির আহ্বায়ক, ডঃ পার্থসারথী। তাঁর করা একটি সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে যে নাসিক ও মহারাষ্ট্রের কোঙ্কণ এই জেলাগুলিতে ভারি ধারাবর্ষণের (বৃষ্টির মাত্রা) সংখ্যায় বৃদ্ধি ঘটেছে আর অপরদিকে থানে জেলায় এই মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টি সম্বলিত দিনের সংখ্যা (বৃষ্টির বণ্টন) ১৯৭৬-৭৭ যা ছিল এখন তাতে তারতম্য ঘটেছে।
কৃষির উপর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব নিরীক্ষণ করতে মহারাষ্ট্রের ৩৪টি জেলার ১৯৫১ থেকে ২০১৩ — এই ৬২ বছরের বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত তথ্য তাঁরা পর্যালোচনা করেন। “জলবায়ুর পরিবর্তন বৃষ্টিপাতের ধরনকে প্রভাবিত করে। সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে যে বর্ষার শুরু আর শেষ, শুষ্ক আর আর্দ্র দিনের সংখ্যা এবং বৃষ্টিপাতের মোট পরিমাণের পরিবর্তন বীজ বোনার দিনক্ষণ, ফলনের হার এবং উৎপন্ন ফসলের মোট পরিমাণের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, যার দরুণ কখনও কখনও বড়ো আকারের অজন্মা সৃষ্টি হচ্ছে,” বললেন অধ্যাপক পার্থসারথী।
বেরশিংগিপাড়া থেকে ১২৪ কিমি দূরে নেহরোলি গ্রামে মা ঠাকুর সম্প্রদায়ের, ৬২ বছর বয়সী ইন্দু অগিওয়ালেও এই পরবর্তনগুলির কথাই বললেন। “আমরা রোহিণী নক্ষত্রে (২৫শে মে থেকে ৭ই জুন) বীজ বুনতাম। পুষ্যার (২০শে জুলাই থেকে ২রা অগস্ট) মধ্যে আমাদের বীজতলা তৈরি হয়ে যেত। চিত্রা নক্ষত্রের মধ্যে (১০ই অক্টোবর থেকে ২৩শে অক্টোবর) আমরা ফসলের কাটাই আর ঝাড়াই শুরু করে দিতাম। এখন এইসব কিছুই পিছিয়ে যায়। অনেকদিন ধরেই এখন আর নক্ষত্র মেনে বৃষ্টি হয় না। বুঝি না কেন।”
তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কথাও বললেন ইন্দু। “আমি সারাজীবনে এতো গরম দেখিনি। আমার ছোটোবেলায় ভারি বৃষ্টি শুরু হত রোহিণী নক্ষত্রে। লাগাতার ভারি বৃষ্টি গরমে তেতে থাকা জমিকে ঠাণ্ডা করে দিত। মাটির সোঁদা গন্ধ বাতাস ভরিয়ে তুলত। এখন এই গন্ধ তেমন আর পাই না...,” নিজের দুই একর চাষের জমিতে বেড়া দেওয়ার জন্য মাটিতে গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে তিনি বললেন।
ছন্দহীন এই বৃষ্টিপাত, ফলনের নিম্নগতি এবং তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতির সঙ্গেই শাহপুরের জমির উর্বরতাও কমে যাচ্ছে বলে জানালেন কৃষকরা। নেহরোলি গ্রামের, ৬৮ বছর বয়সী কিসান হিলামের মতে সংকর প্রজাতির বীজ ও রাসায়নিক সার এইজন্য দায়ি। “মসুরি, চিকনদার, পোশি, দঙ্গে... এইসব (চিরাচরিত) বীজ এখন আর কার কাছে আছে? কারো কাছে নেই। সবাই এখন চিরাচরিত বীজ ছেড়ে ওষুধ দেওয়া (সংকর প্রজাতির) বীজ ব্যবহার করতে শুরু করেছে...” তিনি বললেন।
আমাদের যখন দেখা হয়, তখন তিনি কাঁটাওয়ালা খুরপি দিয়ে সংকর প্রজাতির বীজ মাটির সঙ্গে মেশাচ্ছিলেন। “আমি এগুলি ব্যবহারের বিরোধী ছিলাম। চিরাচরিত বীজে ফলন কম হলেও তা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। এই বীজ তো ওষুধ (সার) ছাড়া হয়ও না। এতে জমির শুদ্ধতা (উর্বরতা) নষ্ট হয় - সে বৃষ্টি ভালো হোক আর না হোক।”
নিজেদের চিরাচরিত বীজ সংরক্ষণ করার বদলে কৃষকরা এখন বীজ কোম্পানিগুলির উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যত সময় গড়ায়, এই বীজগুলির সার, কীটনাশক আর জলের প্রয়োজন বাড়তে থাকে। এগুলির জোগান দিতে না পারলে এই বীজের ফলন অনিশ্চিত হয়ে যায়। অর্থাৎ, পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে সংকর প্রজাতির বীজ টেকসই নয়,” বললেন পুণের, বিএআইএফ স্থায়ী কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের (বিএআইএফ ইনস্টিটিউট ফর সাসটেনেবল লাইভলিহুডস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) প্রকল্প সমন্বয়কারী, সঞ্জয় পাতিল। “এখন, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে বৃষ্টিপাত সম্বন্ধে আগাম কিছুই বলা যায় না, কাজেই এখন এমন এক মূল ফসল দরকার যা পরিবর্তনশীল অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।”
বিএআইএফ-এর সোমনাথ চৌধুরি আরও বললেন, “চিরাচরিত ধান-বীজ, যা এই অঞ্চলের সঙ্গে অভ্যস্ত, জলবায়ুর পরিবর্তন সত্ত্বেও তা খানিক ফসল দেবেই।”
সংকর প্রজাতির সব বীজ জল টানে বেশি আর যে গ্রামে বর্ষানির্ভর চাষাবাদ হয়, সেখানে বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হলেই চাষ মার খায়।
ইতিমধ্যে, এই বছরের শুরুতে, যখন ফোনে আমাদের কথা হল তখন ভাপির ইটভাটায় নিজেদের অস্থায়ী কুঁড়েঘরে মালু, নকুলা, তাঁদের ছেলে রাজেশ, পুত্রবধূ লতা আর বছর দশেকের নাতনি সুবিধা খেতে বসেছিলেন। খানিক বেগুন আর পেঁয়াজ আর কখনও টোমেটোর রসা দিয়ে যে নিত্যদিনের ভাতের আহার তাঁদের বাঁধা ছিল, এখন তা পরিমাণে কমিয়ে দিতে হয়েছে — এখন তাঁদের ভাত জোটে একবেলা।
“ইট বানানো সহজ নয় মোটেই। কাদামাটির সঙ্গে আমাদের ঘামও গিয়ে মেশে। ফলে, কাজ চালিয়ে যেতে হলে আমাদের ঠিকমতো খাদ্যও দরকার। এইবছর ফলন কম হওয়ার কারণে আমরা একবেলা করে খাচ্ছি। জুন মাসে ধান বোনার আগে তো আমরা আমাদের জমা চালের সবটা শেষ করে দিতে পারব না,” বললেন মালু।
মে মাসে, ইট তৈরির মরশুম শেষ হলে তাঁরা সাধারণত বেরশিংগিপাড়া ফেরেন চারজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মোট মজুরি ৮০,০০০ - ৯০,০০০ টাকা নিয়ে — এই দিয়ে তাঁদের চাষাবাদ, সারাবছরের বিদ্যুৎ বিল, ওষুধ, নুন, লঙ্কাগুঁড়ো, তরিতরকারি ইত্যাদির খরচা চালাতে হয়।
আদিবাসী পাড়ার মালু ওয়াঘ, ধর্ম গরেলরা ‘জলবায়ুর পরিবর্তন’ শব্দবন্ধটি না-ই জানতে পারেন কিন্তু পরিবর্তনগুলির সঙ্গে তাঁদের সম্যক পরিচয় আছে, এর ফলাফলের সঙ্গে তাঁদের মোকাবিলা করতে হয় রোজ। তাঁরা জলবায়ুর পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক নিয়ে রীতিমতো কথা বলতে পারেন - বর্ষার খামখেয়ালিপনা আর তার অসম বণ্টন; নজরে পড়ার মতো তাপমাত্রার বৃদ্ধি; বোরওয়েল খোদাই করার তাড়া আর জলের উৎসগুলির উপর এর প্রভাবের ফল দেখা দিচ্ছে জমি আর চাষের উপর; বীজের ধরনে বদল আর আর ফলনের উপর তার প্রভাব; এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দুর্বল হতে থাকা খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে যে সতর্কবাণী শুনিয়েছিলেন - এইসবই গ্রামবাসীদের অভিজ্ঞতায় ধরা আছে।
তাঁদের জন্য এইসবকিছুই একেবারে রোজকার অভিজ্ঞতা। বস্তুত, তাঁদের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে তাঁরা তাই বুঝছেন, যা বিজ্ঞানীরাও বলছেন অন্য ভাষায় ও ভাবে। এতকিছুর সঙ্গে আবার আছে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পাঞ্জা কষা — এই জনপদগুলিতে কর্তৃপক্ষ বলতে প্রধানত বনবিভাগ।
যেমন মালু বললেন, “শুধু বর্ষা নয়, আমাদের লড়াই আরও অনেক কিছুর বিরুদ্ধে। লড়াই বনবিভাগের আধিকারিকদের সঙ্গে (জমির মালিকানা সংক্রান্ত পাট্টা নিয়ে), রেশন আধিকারিকদের সঙ্গে। তবে আর বর্ষাই বা আমাদের রেয়াত করবে কেন?”
আর, গরেলপাড়ায় নিজের চাষের জমিতে দাঁড়িয়ে ৮০ বছর বয়সী ধর্মা বললেন, “আবহাওয়া বদলে গেছে। তাপ খুব বেড়ে গেছে। বৃষ্টি আর আগের মতো হয় না। প্রজা [মানুষ] যদি আগের মতো ভালো না থাকে তবে প্রকৃতি কেমন করেই বা আর আগের মতো থাকবে? তারও পরিবর্তন হচ্ছে...”
পারি-র জলবায়ু বিবর্তনের উপর দেশব্যাপী রিপোর্টিং সংক্রান্ত প্রকল্পটি ইউএনডিপি সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য জলবায়ুর বিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি দেশের সাধারণ মানুষের স্বর এবং অভিজ্ঞতায় বিবৃত করা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিলকা