মাঠঘাঠ পেরিয়ে, টিলার সারি ছাড়িয়ে, হাঁটতে হাঁটতেই চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছিলাম হাতির পদচিহ্নের খোঁজে।

পায়ের কয়েকটা ছাপ তো ভাতের থালার চেয়েও বড়ো, রীতিমতো গর্ত হয়ে গেছে নরম মাটিতে। পুরোনো ছাপগুলি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে বসেছে। এই ছাপগুলির মালিক যে ঠিক কী কী করেছিল সেটা বাকিদের থেকে জানতে পারলাম: খানিক দুলকি চালে হাঁটা, পেটপুরে খাওয়া, যত্রতত্র মলত্যাগ। ও হ্যাঁ, এসব ছাড়াও আরেকটি জিনিস আছে, খেলাচ্ছলে সে হাতি যা যা উপড়ে ফেলেছে তার ধ্বংসাবশেষ: গ্র্যানাইটের খুঁটি, তারের বেড়া, গাছপালা, ফটক...

হাতির সঙ্গে যদি দূর-দূরান্তের সম্বন্ধ থেকে থাকে, এই ভেবে আমি তেমন কিছু দেখলেই থমকে গিয়ে ছবি তুলছিলাম। পদচিহ্নের একখান ছবি আমার সম্পাদককে পাঠাতেই তিনি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "খোদ হাতির দেখা পেয়েছিলেন বুঝি ওটার সঙ্গে?" আমার একটাই আর্তি, এ হেন আশা যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

কারণ, যা শুনলাম, কৃষ্ণগিরি জেলার গঙ্গানাহল্লি জনপদে হাতির দর্শন পেলেও সেই মূর্তিমান যে আপনার মাথায় শুঁড় ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করে কলা চাইবে, এমন আশা করাটাও বোকামি। হয়তো বা মন্দিরের পালিত হাতিরা এসব করে, কিন্তু এরা তো তাদের জংলি তুতো-ভাইবোন। বেশিরভাগ সময়ই খিদের জ্বালায় ইতিউতি ঘুরে বেড়ায়।

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে তামিলনাড়ুর কৃষ্ণগিরি জেলার মাড়োয়া (রাগি) চাষিদের সঙ্গে মোলাকাত করতে গিয়ে বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই পা রেখেছিলাম হাতির রাস্তায়। ভেবেছিলাম যে আলোচনাগুলো বুঝি কেবলই চাষের অর্থনীতি ঘিরে হবে। খানিকটা তা ছিল ঠিকই, তবে খামারের পর খামার ঘুরে মূলত যে কথাটা কানে এসেছিল বারংবার, তা ছিল: হাতির অত্যাচারের ফলে চাষিরা কেবল বাড়ির লোকের পেট ভরানোর মতো রাগি (ফিংগার মিলেট) চাষ করছেন। তলানিতে ঠেকা দাম (কিলো-পিছু ৩৫-৩৭ টাকা পেলে অন্তত চাষের খরচটা উঠত, কিন্তু প্রতি কিলো ২৫-২৭ টাকার বেশি মেলে না), জলবায়ুর পরিবর্তন, এবং ভয়াবহ অতিবৃষ্টি, সবমিলিয়ে নাকানি-চোবানি খাচ্ছেন কৃষকের দল। এর সঙ্গে রয়েছে হাতির শুঁড় ও গজদন্ত, উপমার কাঁঠালটি তারা চাষির মাথায় ভেঙে খাচ্ছে বটে, তবে ভাঙছে কেবল অসহায় সে চাষির পিঠ।

"হাতিদের তো আর কেরামতির কোনও খামতি নেই, তারগুলো কেমনভাবে চেপে ধরে বেড়া টপকাতে হয়, এটা বেশ ভালভাবেই রপ্ত করেছে ওরা। গাছ ফেলে কেমন করে বিদ্যুতের বেড়া শর্ট-সার্কিট করতে হয়, ব্যাটারা সেটাও জানে," বুঝিয়ে বললেন আনন্দরামু রেড্ডি, "আর দলে বাকি যে হাতিগুলো রয়েছে, সারাটাক্ষণ চোখে চোখে রাখে ওদের।" দেঙ্কানিকোট্টাই তালুকের ভদ্র পালায়ম গ্রামের মানুষ তিনি, পেশায় কৃষক , ডাকনাম আনন্দ। মেলাগিরি সংরক্ষিত অরণ্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিলেন আমাদের। এটি কাবেরী উত্তর অভয়ারণ্যের একটি অংশবিশেষ।

The large footprint of an elephant.
PHOTO • M. Palani Kumar
Damage left behind by elephants raiding the fields for food in Krishnagiri district
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: বিশাল বড়ো একটি হাতির পায়ের ছাপ। ডানদিকে: কৃষ্ণগিরি জেলায় খাবার খুঁজতে খেত-খামারে হানা দেয় হাতিরা, তাদেরই রেখে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ

আজ বহু বছর হতে চলল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে খেত-খামারে ঢুকে পড়ছে হাতির দল। গ্রামের উপর অহরহ হামলা নেমে আসে প্যাকিডার্মের, সিংহভাগ রাগিশস্য খেয়ে বাকিটা পায়ের তলায় পিষে ছারখার করে দেয় তারা। ফলত চাষিরা টমেটো, গাঁদা, গোলাপ ইত্যাদি চাষের কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন - অর্থাৎ বাজারে যার চাহিদা আছে, আবার হাতিরা যেগুলো খাওয়ার কথা ভাববেও না। "২০১৮-১৯ সাল নাগাদ বিদ্যুতের বেড়া লাগানো হয় এখানে, তারপর থেকে দলবেঁধে ওরা আর আসে না বটে," আমায় আশ্বস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন আনন্দ, "তবে মরদ হাতিগুলো যে কিছুতেই হার মানে না, মোট্টাই ভাল, মাখনা, গিরি...খিদের জ্বালায় আর থাকতে না পেরে আমাদের খামারে ঢুকে পড়ে।"

তামিলনাড়ুর কৃষ্ণগিরি ও ধর্মপুরী জেলার অনারারি ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন এস.আর. সঞ্জীব কুমার বুঝিয়ে বললেন: "মানুষ ও হাতির ভিতর চলতে থাকা সংঘর্ষের একটি প্রধান কারণ হল ক্রমশ নষ্ট হতে থাকা বনাঞ্চল।" তাঁর আন্দাজ, শুধুমাত্র কৃষ্ণগিরিতেই এ সমস্যায় জেরবার হয়ে উঠেছে ৩৩০টি গ্রাম।

তিনি কেনেথ অ্যান্ডারসন নেচার সোসাইটি নামে একটি বেসরকারি বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য তথা প্রাক্তন সভাপতিও বটেন। ওই অঞ্চলে ঘুরে আসার দিনকতক পরেই তিনি জুম কলের মাধ্যমে একটি প্রেজেন্টেশন পাঠিয়েছিলেন আমায়। ছবিটি মারাত্মক, হাতির আকারের কালো কালো বিন্দুতে ছেয়ে গেছে পর্দা। "বিন্দুগুলি আদতে এক একটি গ্রাম, যেখানে মানুষ ও হাতি মুখোমুখি সংঘর্ষে নেমেছে। চাষিদের থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের খবর পেয়ে এই তথ্য আমরা সাজিয়েছি," জানিয়েছিলেন তিনি।

উত্তর-পূর্ব বর্ষার ঠিক পরপরই শুরু হয় হাতির উৎপাত, অর্থাৎ খেতের ফসল যখন কাটার জন্য তৈরি। "কিছু মানুষের মৃত্যুও ঘটে, বছরে ১২-১৩টা করে [কৃষ্ণগিরি জেলায়], মূলত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস জুড়ে। অর্থাৎ মাড়োয়া কাটার সময়ে।" হাতিরাও মারা যায়। "ঘাত-সংঘাত তো লেগেই আছে। এছাড়াও রেললাইন বা সড়ক দুর্ঘটনা, কিংবা খোলামুখ কুয়োতে পড়ে গিয়ে। বুনো শুয়োর আটকানোর জন্য বিদ্যুৎবাহী তার পাতা হয়, সেখানেও তড়িদাহত হয়ে প্রাণ হারায় হাতিরা।"

হাতির খাদ্যতালিকায় রয়েছে একশোরও অধিক প্রজাতির গাছপালা, বলেছিলেন সঞ্জীব। "গাছের বিভিন্ন অংশ খায় ওরা। পাকড়াও করা হাতির উপর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে আমরা দেখেছি, ওরা ২০০ কিলো ঘাস আর ২০০ লিটার জল দিব্যি খেয়ে ফেলে। কিন্তু, অরণ্যজাত খাদ্যের পরিমাণ সব মরসুমে সমান নয় – তাই ওদের শারীরিক অবস্থাও এক থাকে না," বুঝিয়ে বললেন তিনি।

In this photo from 2019, Mottai Vaal is seen crossing the elephant fence while the younger Makhna watches from behind
PHOTO • S.R. Sanjeev Kumar

২০১৯ সালে তোলা এই ছবিটিতে হাতি-আটকানোর বেড়া ডিঙোতে দেখা যাচ্ছে মোট্টাই ভালকে, পিছন থেকে তাকিয়ে আছে জোয়ান মাখনা

এছাড়াও "হোসুরের অরণ্য অঞ্চলের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই" আজ পুটুস বা লান্টানা কামারা নামে একটি বিদেশী বিজাতীয় ফুলগাছের কবলে। এ গাছের যেন কই মাছের প্রাণ, গরুছাগল ছুঁয়েও দেখে না, হুহু করে বাড়তে থাকে। "বান্দিপুর ও নগরহোলেরও একই হাল। সাফারির রাস্তা থেকে লান্টানা ছেঁটে ফেলা হয় যাতে ঘাস খেতে হাতিরা বেরিয়ে এসে পর্যটকের নজরে পড়ে যায়।"

সঞ্জীবের বিশ্বাস, মূলত পুটুসগাছের কারণেই হাতিরা নিজের বিচরণভূমি ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। উপরন্তু রসালো রাগির সোয়াদ যেন চুম্বকের মতো টানে হাতিদের। "আমি যদি হাতি হতাম, তাহলে মাড়োয়া খেতে আমিও ছুটে আসতাম।" বিশেষ করে পুরুষ হাতিরা ফসলি মাঠে না হামলা করে থাকতে পারে না। কারণ ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়েসের মধ্যে ওদের শারীরিক বৃদ্ধির হার অত্যন্ত দ্রুত হয়, আর এই বয়সী হাতিরা ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না।

তবে মোট্টাই ভাল কিন্তু এইসব হিসেব-নিকেশের ঊর্ধ্বে। বয়সও হয়েছে, আবার নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণাটাও বেশ স্বচ্ছ। সঞ্জীবের আন্দাজ, তার বয়স ৪৫ তো পেরিয়েইছে, এমনকি ৫০ও হতে পারে। তাঁর মতে মোট্টাই ভাল নাকি 'সবচাইতে মিষ্টি' হাতি। "ওর মস্ত চলছিল, এরকম একটা ভিডিও দেখেছি। (পুরুষ হাতির জীবনে মস্ত একটি জৈবিক ও হরমোন-সংক্রান্ত বৃদ্ধির সময়, এটি একাধারে বেশ স্বাভাবিক ও সুস্থতার লক্ষণ। তবে যে ২-৩ মাস এটি চলে, সে সময়টাতে হাতিগুলি অত্যন্ত একরোখা হয়।) "সাধারণত ওরা উন্মত্ত হয়ে যায়, তবে মোট্টাই ভাল কিন্তু বেশ ঠান্ডা মাথাতেই ছিল। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী হাতিদের দলে থাকা সত্ত্বেও একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল। আসলে দুনিয়াদারি তো আর কম দেখেনি ও।"

সঞ্জীবের হিসেব মতো মোট্টাই ভালের উচ্চতা ৯.৫ ফুট, ওজন প্রায় ৫ টন। "ও একটি চ্যালা আছে, নাম তার মাখনা, অবশ্য অন্যান্য জোয়ান পুরুষ হাতির সঙ্গেও দল বাঁধে ওরা দুজন।" তার কি কোনও ছানাপোনা আছে, এটা না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারলাম না। জবাবে হেসে ফেললেন সঞ্জীব, "গন্ডাখানেক তো নিশ্চয় আছে।"

কিন্তু দ্রুত হারে বেড়ে ওঠার সময়টা পার করার পরেও খেত-খামারে হামলা করে কেন ওভাবে? সঞ্জীবের মতে, মোট্টাই ভাল নাকি নিজের শারীরিক অবস্থা ধরে থাকতে বেশ উৎসুক। "জঙ্গলের বাইরে তো দিব্যি ভুরিভোজ মেলে – মাড়োয়া, কাঁঠাল, আম – সব খেয়েদেয়ে আবার ফিরে যায় বনে।" এছাড়াও কিছু মদ্দা হাতি আছে যারা বাঁধাকপি, বিনকলাই ও ফুলকপি খায়। তবে হাতির কাছে নাকি এগুলো সবই বিজাতীয় খাদ্য, বললেন সঞ্জীব।

"বছর তিনেক আগে বেহাল অবস্থা ছিল। টমেটো ও বিনকলাইয়ের পিছনে প্রচুর টাকা ঢেলে ফতুর হয়ে গিয়েছিলেন অসংখ্য চাষি। হাতিরা একভাগ খায় বটে, তবে পাঁচভাগ নষ্ট করে।" হাতির লোভ এড়াতে অন্যান্য ফসলের দিকে ঝুঁকছেন, দিনকে দিন বেড়ে চলেছে এমন কৃষকের সংখ্যা। সুতরাং মোট্টাই ভাল যে দলবল নিয়ে এ অঞ্চলের কৃষি-মানচিত্র বদলে ফেলছে, একথাটা মোটেও অত্যুক্তি নয়।

A rare photo of Mottai Vaal, in the Melagiri hills
PHOTO • Nishant Srinivasaiah

মোট্টাই ভালের একটি দুষ্প্রাপ্য ছবি, মেলাগিরি পাহাড়ে

বহু বছর হতে চলল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে খেত-খামারে ঢুকে পড়ছে হাতির দল। গ্রামের উপর অহরহ হামলা নেমে আসে প্যাকিডার্মের, সিংহভাগ রাগিশস্য খেয়ে শেষ করে দেয় তারা

*****

'আগে তাও কিছুটা করে ক্ষতিপূরণ পেতাম। এখন তো ওনারা [সরকারি বাবু] শুধু ছবি তুলে নিয়ে যান, একটা পয়সাও পাই না হাতে।'
বিনোদাম্মা, গুমলাপুরম গ্রামের গঙ্গানাহল্লি জনপদ-নিবাসী কৃষক

মোট্টাই ভালকে একদম কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হাতে গোনা কয়েকজনের হয়েছে মোটে, তাঁদের মধ্যে গোপি শঙ্করসুব্রাহ্মণি একজন। গোল্লাপল্লিতে যাঁর অতিথি ছিলাম, সেই গোপকুমার মেননের বাড়ি থেকে গাড়ি করে নবদর্শনম অলাভজনক সংস্থার বাংলোতে যেতে আধা ঘণ্টা লাগে। একদিন সাত সকালে দরজা খুলতে না খুলতেই পিলে চমকে গিয়েছিল শঙ্করসুব্রাহ্মণির।

এক বন্ধুর আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন গোপি, কিন্তু কপাট খুলেই দেখলেন সামনে লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়প্রমাণ এক হাতি। লাজুক বলছি কারণ চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল মোট্টাই ভাল। পাহাড়তলির সেই সুরম্য বাড়িটির বারান্দায় বসে একের পর এক কাহিনি শোনালেন গোপি। কয়েকটা গল্প মাড়োয়া ঘিরে, বাকিগুলির কেন্দ্রে বিরাজমান হাতির দল।

এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করা সত্ত্বেও পেশা পাল্টে চাষের জগতে পা রেখেছেন শঙ্করসুব্রাহ্মণি। গুমলাপুরম গ্রামের গঙ্গানাহল্লি জনপদে যে ১০০ একর জমিটি নবদর্শনম ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে রয়েছে, আজ বহু বছর ধরে সেখানে রয়েছেন তিনি, দায়-দায়িত্ব সবই তাঁর কাঁধে। বাসিন্দা, পর্যটক এবং কর্মশালা থেকে প্রাপ্ত অনুদানের সাহায্যেই কাজ করে এই ট্রাস্টটি। "বড়ো বড়ো পরিকল্পনা আমরা করি না, পয়সাকড়ি তো আর অফুরন্ত নয়, তাই সাধাসিধা ছোট্টখাটো কাজকম্মেই আমরা সন্তুষ্ট।" কাছেপিঠের গ্রামে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সঙ্গে যৌথভাবে একটি খাদ্য সমবায় চালান এঁরা, এটি তাঁদের কর্মকাণ্ডের প্রধান অঙ্গ। ছিটেফোঁটা শালিজমি, তার উপর বছরের মোটে কয়েকটা মাসেই চাষ করা সম্ভব, সুতরাং জঙ্গলের ভরসাতেই জীবনধারণ করেন তাঁরা।

"৩০টি পরিবারের খাদ্যসংস্থানের দ্বায়িত্ব নিয়েছি আমরা, বেশিরভাগই গঙ্গানাহল্লি গাঁয়ের মানুষ। টান পড়লেই জঙ্গলে যাওয়াটা এখানকার রীতি ছিল, তবে প্রয়োজনীয় পরিসর এবং মূল্য-সংযোজিত খাদ্যদ্রব্য বানানোর কায়দা, এ দুটোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে সে রীতিতে লাগাম টেনে ধরতে সফল হয়েছি," জানালেন গোপি। মূলত পরিবারের পেট চালাতেই তাঁরা মাড়োয়া চাষ করেন, উদ্বৃত্ত ফসলটুকুই বিক্রি হয় কেবল।

আজ ১২ বছর ধরে নবদর্শনমে রয়েছেন গোপি, তবে একটিই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছেন তিনি। এখন দেশি প্রজাতির রাগির বদলে দ্রুত-ফসলি প্রজাতির চাষ হয় – আগে যে শামাধান (বা শাঁওয়াধান) ফলতে ৪-৫ মাস লেখে যেত, সেটা এখন ৩ মাসে এসে ঠেকেছে। তবে শুকনো জমির ফসল যতদিন মাটির সংস্পর্শে থাকে তত ভাল, বলে উঠলেন তিনি, "বেশি বেশি করে পুষ্টি জমা হয় শস্যদানায়।" দ্রুত-ফসলি প্রজাতির ক্ষেত্রে যে এর ঠিক উল্টোটাই হয়, সেটা বলাই বাহুল্য। ফলত আগে যেখানে একটা মুদ্দেই [রাগির নাড়ু] যথেষ্ট ছিল, আজ সেখানে দুটো মুদ্দে খেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। "তফাতখানা সত্যিই চোখে পড়ার মতো।"

Gopi Sankarasubramani at Navadarshanam's community farm in Ganganahalli hamlet of Gumlapuram village.
PHOTO • M. Palani Kumar
A damaged part of the farm
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: গুমলাপুরম গ্রামের গঙ্গানাহল্লি জনপদ, নবদর্শনম সমবায় খামারে দাঁড়িয়ে রয়েছেন গোপি শঙ্করসুব্রাহ্মণি। ডানদিকে: হাতির হামলায় তছনছ হয়ে যাওয়া খামারের একাংশ

তা সত্ত্বেও এ হেন পরিবর্তন করতে চাষিরা যে বাধ্য হয়েছেন তার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে একটি অমোঘ সত্য – দ্রুত-ফসলি শস্য পাহারা দিতে হয় না বেশি। উপরন্তু বাজারদর সবেরই সমান। গোপির জবানে: "এছাড়াও চাষের সময়টা একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয় চাষিদের। অনেকজন মিলে যদি পাহারা দেয় – ধরুন এ প্রান্ত থেকে একজন হাঁক পাড়ল তো ও প্রান্ত থেকে আরেকজন – তাহলে হাতিদের থেকে রক্ষা পেলেও পেতে পারেন। কিন্তু ধরুন আপনি বাদে আর সবাই দ্রুত-ফসলি শস্য চাষ করেছে, তাহলে হাতিদের কোপটা একা আপনার ঘাড়েই এসে পড়বে..."

আমার আলোচনার মাঝে যতিচিহ্নের মতো ভেসে আসছিল পাখিদের কলতান। কেউ বা শিষ দিচ্ছে, কারও বা অবিকল হাসির মতো স্বর, কেউ বা ব্যস্ত মৃদুমন্দ গানে, মনে হয় ওরা বুঝি অরণ্য থেকে খবরাখবর পাঠাচ্ছে আমাদের।

পালংশাকের ঝোল সহযোগে মাড়োয়ার মুদ্দে দিয়ে মধ্যাহ্নভোজটা সারতে না সারতেই হাতে এলো কুড়মুড়ে চিনেবাদামের ক্যান্ডি ও সুগন্ধি রাগির লাড্ডু। যে মহিলারা এগুলো বানিয়েছেন, সেই বিনোদাম্মা ও বি. মঞ্জুলা দেখলাম কন্নড়ে কথা বলেন (বন্ধুদের সঙ্গে মিলে আমাদের জন্য দোভাষীর কাজ করছিলেন শঙ্করসুব্রাহ্মণি)। ওঁদের কাছে জানা গেল, অতিবৃষ্টি ও হাতির চক্করে রাগির সিংহভাগটাই নষ্ট হয়ে যায়।

নিজেরা তো রোজ মাড়োয়া খানই, এমনকি বাচ্চাদেরও খাওয়ান – না ঝোল, না শক্ত, মাখামাখা জাউ রাঁধা হয় শিশুদের জন্য, যতদিন না তারা বড়ো হয়ে ভাত খেতে শিখছে। সারাবছরের উৎপাদিত শামাধান তাঁরা বস্তায় ভরে মজুত করে রাখেন, দরকার মতো বার করে গুঁড়িয়ে নেন। তবে এবছর ফসলের যা হাল, তাতে কুলানো মুশকিল।

নবদর্শনমের কাছেই থাকেন দুজনে, গঙ্গানাহল্লি জনপদে। সবেমাত্র দুপুরের খাওয়া সেরে ফিরেছেন। নিজের নিজের জমিতে (বিনোদাম্মা ৪ একর ও মঞ্জুলা ১.৫ একর জমির মালিক) এই মহিলারা মাড়োয়া, ধান, কলাই ও সর্ষে চাষ করেন। "বেমরসুমি বৃষ্টি হলে গাছে থাকা অবস্থাতেই রাগির দানা থেকে শিস বেরিয়ে যায়," জানালেন মঞ্জুলা। অর্থাৎ ফসল আক্ষরিক অর্থেই মাঠে মারা যায়।

এটার থেকে বাঁচতে বিনোদাম্মার বাড়ির লোক ঠিক করেছে যে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় যন্ত্র দিয়ে ফসল কেটে শস্যমঞ্জরী থেকে মাড়োয়ার দানা ঝাড়াই করে নেবেন তাঁরা। কথা বলতে বলতে হাতের ইশারায় বাতাসের গায়ে লাইনের পর লাইন কেটে দিলেন মানুষটি। আমাদের ভাষা আলাদা তো কী হয়েছে? হাতের মুদ্রা দিয়েই তো সেতু বেঁধে ফেললেন বিনোদাম্মা।

তবে অনুবাদের দরকার বোধহয় ততটাও নেই, মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘর্ষ ঘিরে তাঁদের দুশ্চিন্তা কতটা গভীর তা দিব্যি টের পাচ্ছিলাম। "আগে তাও কিছুটা করে ক্ষতিপূরণ পেতাম। এখন তো ওনারা [সরকারি বাবু] শুধু ছবি তুলে নিয়ে যান, একটা পয়সাও পাই না হাতে।"

Manjula (left) and Vinodhamma from Ganganahalli say they lose much of their ragi to unseasonal rain and elephants
PHOTO • M. Palani Kumar
A rain-damaged ragi earhead
PHOTO • Aparna Karthikeyan

বাঁদিকে: গঙ্গানাহল্লির মঞ্জুলা (বাঁয়ে) ও বিনোদাম্মা জানালেন, যতটুকু মাড়োয়া ফলে তার বেশিরভাটগাই খোয়া যায় বেমরসুমি বৃষ্টি ও হাতির উৎপাতে। ডানদিকে: বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া রাগির শস্যমঞ্জরী

একটা হাতির খোরাকি কতটা? মাপের কোনও হিসেব নেই, জানালেন গোপি। তাঁর মনে আছে, একবার দুটো হাতি মিলে দুরাত্তিরেই ১০টা বস্তাভর্তি ২০,০০০ টাকার মাড়োয়া চেঁছেপুঁছে সাফ করে দিয়েছিল। "এক মক্কেল তো এক দর্শনে ২১খানা কাঁঠাল সাবড়ে দিয়েছিল একাই। বাঁধাকপিও ছাড়েনি..."

ঘাম ঝরানো ফসল কী করে বাঁচাবেন সে চিন্তায় ঘুম উড়ে গেছে চাষিদের। রাগির মরসুমে দু-দুটো বছর কীভাবে রাতের পর রাত মাচানে বসে খেত পাহারা দিয়েছিলেন, একথা আজও ভোলেননি গোপি। বড্ডো কষ্টের জিন্দেগি, স্বীকার করলেন তিনি, ভোরের আলো ফোটার আগেই শরীরটা ছিবড়ে হয়ে যায়। নবদর্শনম ঘিরে পাকদণ্ডি ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়েছিল অসংখ্য মাচান। কয়েকটা কাঁচা, বাকিগুলো বেশ শক্তপোক্ত, চড়ে বসলেই হয়। অধিকাংশের গায়েই দেখলাম একটা করে ঘণ্টা (টিনের ক্যানেস্তারার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা কাঠি) লাগানো আছে, হাতি দেখতে পেলে এইটা বাজিয়েই বাকিদের সাবধান করা হয়।

আসল দুঃখটা কোথায় জানেন? এতো বন্দোবস্ত করা সত্ত্বেও হাতিরা মনের সুখে এসে হানা দেয়। "শেষে একখান হাতি এসে দেখা দিল, হাজার চেষ্টা করেও তাকে আটকাতে পারিনি," স্মৃতিচারণ করছিলেন গোপি, "বাজি ফোটালাম, কতকিছুই না করলাম, কিন্তু সে ব্যাটা মনের সুখে যা ইচ্ছা তাই করে গেল।"

আপাতত একখান বিচিত্র বিপদ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে গঙ্গানাহল্লির ঘাড়ে: বনদপ্তর থেকে হাতি আটকাতে যে বৈদ্যুতিক বেড়াটা লাগিয়েছে, সেটা নবদর্শনমের দোরগোড়ায় এসে শেষ হয়, অর্থাৎ এমন একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে যে না চাইতেও সমস্ত হাতি এসে জড়ো হচ্ছে তাঁদের জমিতে। ফলত আগে যেখানে বছর গেলে ২০বার হামলা হত, সেখানে আজ পাকা ফসল কাটার মরসুম এলে একটা রাতও স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না এখানকার মানুষজন।

"বেড়ার দুইদিকেই হামলায় অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে লোকে। একবার যখন [বেড়া দিয়ে হাতি আটকানো] শুরু করেছেন, তখন থামা তো আর সম্ভব নয়," মাথা ঝাঁকিয়ে আঙুল নেড়ে বলে উঠলেন শঙ্করসুব্রাহ্মণি।

A makeshift machan built atop a tree at Navadarshanam, to keep a lookout for elephants at night.
PHOTO • M. Palani Kumar
A bell-like contraption in the farm that can be rung from the machan; it serves as an early warning system when elephants raid at night
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: নবদর্শনমে একটি গাছের উপর তড়িঘড়ি মাচান বাঁধা হয়েছে, যাতে রাত্রিবেলা হাতিরা এলে নজর রাখা যায়। ডানদিকে: চাইলে এই ঘণ্টাসম যন্তরটি মাচান থেকেই বাজানো যায়; রাতে যদি হাতি হামলা করে, তাহলে আগেভাগে সতর্ক করার কাজে ব্যবহৃত হয় এটি

*****

'আমার স্ত্রী চায় আমি যাতে আরও ঘনঘন দেখা করি।'
জাতীয় গ্রীন ট্রাইব্যুনালের এক বিচারপতিকে বলেছিলেন ৬০ বছর বয়সী এক কৃষক, যিনি হাতির আক্রমণ থেকে ফসল পাহারা দিতে গিয়ে আটকে পড়েছেন

মানুষ ও হাতির মাঝে চলতে থাকা এই সংঘাত মেটাতে গেলে সংবেদনশীল হওয়াটা জরুরি, ঠিক তেমনই জরুরি সমাধানটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, সমস্যার পরিধিটা হাতির মতোই দৈত্যাকার। ফ্রন্টিয়ারস্ ইন ইকোলজি অ্যান্ড ইভোল্যুশন পত্রিকায় চলতি ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজির পর্যালোচনা নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে বলা আছে যে বিশ্বজুড়ে "যে ১২০ কোটি মানুষের দৈনিক জীবনধারণের সহায় ১.২৫ ডলারেরও কম, তাঁদের অধিকাংশই এশিয়া ও আফ্রিকার হাতি-বহুল অঞ্চলে বসবাস করেন।" আর এই প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলি বাধ্য হয় "স্থান ও সম্পদের তাগিদে দিনকে দিন বেশি বেশি করে হাতির মতো বন্যপশুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে।"

অনারারি ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন সঞ্জীব কুমার জানালেন যে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, কেরালা, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিশগড় ও আসাম সহ ভারতের ২২টি রাজ্যের মানুষ হাতির সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামতে বাধ্য হয়েছেন।

পরিবেশ, অরণ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক থেকে যে সরকারি তথ্য জমা দেওয়া হয়েছে রাজ্যসভায়, সেখানে দেখা গেছে যে এপ্রিল ২০১৮ ও ডিসেম্বর ২০২০, অর্থাৎ তিন বছরেরও কম সময়ে উপরোক্ত সংঘর্ষের ফলে প্রাণ গেছে ১,৪০১ মানুষের ও ৩০১টি হাতির।

চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হলে খাতায় কলমে তার ক্ষতিপূরণের সব দায়-দায়িত্ব নিতে রাজি আছে সরকার। পরিবেশ, অরণ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের হাতি প্রকল্প বিভাগের তরফ থেকে একটি সরকারি নথি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে, সেখানে সুপারিশ জানানো হয়েছে যে শস্যহানি ঘটলে মোট ক্ষতির ৬০ শতাংশ যেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হয় চাষিদের। সঙ্গে এটাও বলা আছে যে, "ক্ষতিপূরণের পরিমাণ যদি শস্যমূল্যের ১০০ শতাংশের সমান হয়ে যায় তাহলে নিজের ফসল রক্ষা করার কোনও গরজ থাকবে না কৃষকের।"

ভারতীয় বনসেবা (আইএফএস) আধিকারিক তথা হোসুরের বন্যপ্রাণ ওয়ার্ডেন দফতরের সহকারী কনসার্ভেটর অফ ফরেস্টস্ কে. কার্তিকেয়নী জানালেন: হোসুর বনবিভাগে বাৎসরিক ২০০ হেক্টর ফসল নষ্ট হয়, "শস্যহানির ফলে ৮০০-১০০০ চাষি ক্ষতিপূরণের আবেদন জানান বন দফতরের কাছে। এবং বছর গেলে এই খাতে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা খরচা করি আমরা।" হাতির কবলে পড়ে এ অঞ্চলে প্রতিবছর ১৩ জন করে মারা যায়, আর মৃত্যু-পিছু দেওয়া হয় ৫ লাখ টাকা, তবেও সেটাও ওই ক্ষতিপূরণের হিসেবের মধ্যেই পড়ছে।

Tusker footprints on wet earth.
PHOTO • Aparna Karthikeyan
Elephant damaged bamboo plants in Navadarshanam
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: ভেজা মাটিতে হাতির পদচিহ্ন। ডানদিকে: নবদর্শনমে হাতির হামলায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বাঁশগাছ

"একর-পিছু ২৫,০০০ টাকার বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম নেই," বুঝিয়ে বললেন কার্তিকেয়নী। "দুর্ভাগ্য এটাই যে উদ্যানপালনের ক্ষেত্রে এ টাকাটা কিছুই না, কারণ একর-পিছু ৭০,০০০ টাকারও অধিক ক্ষতি হয় একেকজন কৃষকের।"

এখানেই শেষ নয়। ক্ষতিপূরণ পেতে হলে গুচ্ছের কাগজপত্র জমা দিতে হয় চাষিদের, তারপর কৃষি আধিকারিক কিংবা উদ্যানপালন আধিকারিক (যেখানে যেটা প্রযোজ্য) এসে যাচাই করে যায়, এবার পালা গ্রাম প্রশাসন আধিকারিকের (ভিএও), তিনি এসে কৃষকের জমি-সংক্রান্ত নথি খতিয়ে দেখেন। শেষে ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার এসে সবকিছুর ছবি তোলেন। এতকিছুর পর যদি বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে, তবেই ক্ষতিপূরণের অনুমোদন আসে জেলা বন আধিকারিকের (ডিএফও) তরফ থেকে, নয়ত কাঁচকলা।

ততদিন তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকেন চাষিরা – হাজার ৩-৫ টাকার ক্ষতিপূরণের আশায় কখনও কখনও গোটা একটা ফসলি মরসুম কেটে যায়। "চালু কোনও তহবিল থেকে যদি ভরপাইয়ের দাবিগুলো মেটানো যেত, খুব ভাল হতো তাহলে," স্বীকার করলেন কার্তিকেয়নী।

মানুষ-হাতির এ নিরন্তর যুদ্ধের রফা করা গেলে শুধুই যে চাষির জীবন ও রুজিরুটি রক্ষা পেত বা তাঁর জীবনধারণের গুণমান বাড়ত তা নয়, কিছুটা হলেও সুনাম জুটত রাজ্য বনবিভাগের ভাঁড়ারে, জানালেন সঞ্জীব কুমার। তিনি একথাও বললেন: "এই মুহূর্তে হস্তী সংরক্ষণের পুরো দ্বায়িত্বটাই একা বহন করছে কৃষিবিশারদরা।"

রাতের পর রাত, মাসের পর মাস ধরে উন্মত্ত হাতির থেকে শস্য বাঁচানোর কাজটা মোটেও ছেলেখেলা নয়, এক কথায় সেটা মেনে নিলেন সঞ্জীব। দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ফালতু সময় নষ্ট হয় কৃষকের। তাঁর মনে আছে, জাতীয় গ্রীন ট্রাইব্যুনালের একটি বিচারসভা চলাকালীন এক কৃষক বিচারপতিকে বলেছিলেন: "আমার স্ত্রী চায় আমি যাতে আরও ঘনঘন দেখা করি।" চাষিটির বয়স ষাট পেরিয়েছে, তাঁর স্ত্রীর সন্দেহ ছিল স্বামী বুঝি পরকীয়ায় মত্ত, জানালেন সঞ্জীব।

কৃষক যে ভার তাঁর শীর্ণ দুটি হাতে বহন করেন, সেটি অচিরেই সমস্যা হয়ে দেখা দেয় বন দফতরের কপালে। "ওঁরা তো পুরো রাগটাই আমাদের উপর উগরে দেন। আমাদের অফিস-কাছারি ভাঙচুর হয়েছে। রোড রোকো (পথ অবরোধ) থেকে আমাদের কর্মীদের মারধোর, সবই করেছেন তাঁরা। এই কারণে বন দফতর বাধ্য হচ্ছে পিছু হটতে, সুরক্ষামূলক যে দ্বায়িত্বগুলো রয়েছে, সেগুলোও পালন করতে পারছি না আমরা," অসহায় হয়ে বলে উঠলেন সঞ্জীব।

Anandaramu Reddy explaining the elephants’ path from the forest to his farm in Vadra Palayam hamlet
PHOTO • M. Palani Kumar

হাতিরা ঠিক কোন পথে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে ভদ্র পালায়মের খেতখামারে ঢুকে পড়ে একথা বুঝিয়ে বলছেন আনন্দরামু রেড্ডি

মানুষ ও হাতির ঘাত-সংঘাতের দায় বহুবিধ - অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, মানসিক। ব্যাপারটা এমন: আপনার কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও যে কোনও দিন ভেঙেচুরে ছারখার হয়ে যেতে পারে আপনার দোকানপাট, আর এটা জেনেও আপনি ব্যবসাটা চালিয়ে যাচ্ছেন

এসব তো রয়েইছে, উপরন্তু হাতিদের জীবনহানি হওয়ার আশঙ্কাটাও মিটছে না। ২০১৭ সালের একটি গণনায় দেখা গেছে যে তামিলনাড়ুতে মোটে ২,৭৬১টি হাতি পড়ে আছে, অর্থাৎ ভারতে যে মোট ২৯,৯৬৪ সংখ্যক হাতি রয়েছে তার ১০ শতাংশ মাত্র। সুতরাং আশঙ্কাটি যে আদতে কতটা ভয়াবহ ও আশু তা বেশ ভালভাবেই বোঝা যাচ্ছে।

এদেশে প্যাকিডার্মের জিন পুল এমনিতেই সংকীর্ণ, তার উপর ঘাত-সংঘাত, প্রতিশোধ, তড়িদাহত হওয়া, রেললাইন তথা পথদুর্ঘটনার ফলে সেটা দিনকে দিন শূন্যের দিকে এগোচ্ছে। হুট করে দেখলে মনে হবে যেন এ সমস্যার হয়তো বা কোনও সমাধান নেই। তবে হ্যাঁ, সঞ্জীব সহ অন্যান্যরা কিন্তু মূর্তির দৌলতে অন্তত একখানা উপায় খুঁজে পেয়েছেন...

*****

'সত্যি কথা বলতে, আমরা কিন্তু কোনোভাবেই বিদ্যুতের উপর নির্ভর করে থাকতে চাই না। সৌরবিদ্যুৎ তো আরোই ভরসাহীন। তাছাড়া বিদ্যুতের কারসাজিটা তো ধরেই ফেলেছে হাতিরা।'
এস. আর. সঞ্জীব কুমার, কৃষ্ণগিরি ও ধর্মপুরী জেলার অনারারি ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন

সঞ্জীবের কাছ থেকে জানা গেল, কৃষ্ণগিরি জেলার এই মেলাগিরি হাতি রোধক বেড়ার ভাবনাটি দক্ষিণ আফ্রিকার আড্ডো এলিফ্যান্ট নাশ্যনাল পার্ক থেকে পেয়েছে প্রশাসন। "আমি এটা রমন সুকুমার, অর্থাৎ 'ভারতের হাতি-মানব'-এর কাছে শুনেছি। ওখানে ওরা বাতিল রেললাইন এবং লিফ্টের তার জুড়ে জুড়ে বানিয়েছিল। আর বেড়াটা খাড়া করতে না করতেই মানুষ ও হাতির মধ্যে চলতে থাকা সংঘাতের ইতি ঘটে।" আড্ডো পার্কের ভাবনাটা আরও খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন সঞ্জীব।

এর আগে কীভাবে হাতিদের খেত-খামার থেকে দূরে জঙ্গলের ভিতর রাখা যায়, এ ব্যাপারে বহু চেষ্টা করেছিল হোসুর বনবিভাগ, কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি। হাতি-রোধক পরিখাও খোঁড়া হয়েছিল বনের সীমানা বরাবর। এছাড়াও রয়েছে সৌরবিদ্যুৎ-চালিত বেড়া, কাঁটাতার, এমনকি সুদুর আফ্রিকা থেকে আমদানি করা কাঁটাদার গাছ, কিন্তু এতকিছু করা সত্ত্বেও চিঁড়ে ভেজেনি।

তবে হোসুর বিভাগের ডেপুটি কনসার্ভেটর অফ ফরেস্টস্ রূপে আইএফএস আধিকারিক দীপক বিলগি নিয়োজিত না হওয়া অবধি সমস্যাটার কোনও হিল্লে হয়নি। বেড়ার ভাবনাটা তাঁর নজর কাড়ার পর তহবিলের বন্দোবস্ত করে কালেক্টরের সঙ্গে কথা বলেন তিনি, তারপর "আমরা ঠিক করলাম যে আপাতত পরীক্ষামূলক একটা বেড়া লাগাব," জানালেন সঞ্জীব।

A section of the Melagiri Elephant Fence, which is made of pre-cast, steel-reinforced concrete posts, and steel wire rope strands
PHOTO • M. Palani Kumar

ইস্পাত দিয়ে ঢালাই করা পূর্বনির্মিত কংক্রিটের খুঁটি, ইস্পাতের তার ও দড়ি দিয়ে বানানো মেলাগিরি হাতি রোধক বেড়ার একটি অংশবিশেষ

তবে মজার বিষয় হল একটি হাতির যে ঠিক কতখানি শক্তি, সে ব্যাপারে কোথাও কোনও তথ্য নেই বললেই চলে। একটি হাতি বা হাতির দল যে ঠিক কতখানি ওজন ঠেলতে পারে, এ ব্যাপারেও ধোঁয়াশা কাটেনি। তাই মুধুমালাইয়ে একটি পরীক্ষামূলক কাঠামো বানিয়ে কুনকি হাতিদের দিয়ে গবেষণা চালানো হয়। এদের মধ্যে মূর্তি নামের একটি পাঁচ টন ওজনের গজদন্তহীন হাতিও ছিল যে কিনা বন দফতরের পোষ্য হওয়ার আগে অবধি সিদ্ধহস্ত ছিল মানুষ মারায়। অথচ মানুষ বনাম হাতির সংঘাতে রাশ টানতে বিটা বা প্রাথমিক টেস্টার রূপে বেড়ার তারগুলো পরীক্ষা করার দ্বায়িত্বটা কিন্তু তার উপরেই এসে পড়ে।

সঞ্জীবের কথায়: "সে ব্যাটা এমনই প্রশিক্ষিত যে দেখে বুঝতেই পারবেন না ওর অতীতটা ঠিক কেমন ছিল। শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট হয়ে গিয়েছিল।" মূর্তি এখন অবসরপ্রাপ্ত। হাতিরা ৫৫ বছর বয়সে পা রাখলে তবেই অবসর পায়, জানতে পারলাম সেকথা, তারপর আসে সুখের জীবন, থাকা-খাওয়ার অভাব হয় না আর, উপরন্তু শিবিরে থাকা মাদি হাতিদের সঙ্গে কালেভদ্রে 'স্টাড' বা রতিমিলনের সুযোগও মেলে। জঙ্গলে থাকলে কিন্তু শেষের ওই সুখটি মিলত না মোটেই, কারণ অপেক্ষাকৃত জোয়ান হাতিদের টপকে এসব সুযোগ পাওয়া অসম্ভবের সামিল।

তা সেই মুর্তির থেকে জানা যায় যে বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে একেকটি হাতি ১,৮০০ কিলোগ্রাম অবধি বলপ্রয়োগ করতে সক্ষম। এসবের থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি হয় বিশেষ খুঁটি, শুরু হয় বেড়ার কাজ। আর বেড়াটির প্রথম দুই কিলোমিটার থেকে আনন্দের বাড়িখান ঢিলছোঁড়া দূরত্বে।

"প্রথম প্রচেষ্টা থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম। মাখনা, অর্থাৎ মোট্টাই ভালের ল্যাংবোট হয়ে ঘুরে বেড়ায় যে হাতিটি, তিনি তো প্রথম সপ্তাহেই খুঁটি-শুদ্ধ বেড়া উপড়ে দিলেন। নতুন কৌশলে খুঁটি বানাতে বাধ্য হলাম, এগুলো আগের চাইতেও ৩.৫ গুণ শক্তিশালী। তারগুলো নিয়ে সমস্যা নেই, ১২ টনের চাপ সইতে পারে। অর্থাৎ দু-দুটো হাতির ওজন সহজেই বওয়া যাবে।"

অন্যান্য মডেলের তুলনায় তাঁদের এই বেড়াটি প্রায় অবিনশ্বর। ইস্পাত দিয়ে ঢালাই করা পূর্বনির্মিত কংক্রিটের খুঁটি, ইস্পাতের তার ও দড়ি দিয়ে বানানো এটি। হাতিরা চাইলে এ বেড়া ডিঙিয়ে বা ফাঁক গলে যেতে পারে, তবে এ খুঁটি ভাঙা বা তার ছেঁড়া তাদের সাধ্যের অতীত। "কোথাও কোনও গড়বড় দেখলে অন্তত একটা সুযোগ তো মেলে সেটার সমাধান খুঁজে বার করার। দলের লোকজন খানকতক ক্যামেরাও বসিয়েছে, হাতিরা ফসল খেতে এলে বা খেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে যায় সে ক্যামেরায়।" তারপর ভিডিও দেখে নির্দিষ্ট সমস্যা অনুযায়ী উত্তরোত্তর আরও জোরদার করে তোলেন বেড়ার নকশাটা। একমুখ হাসি নিয়ে সঞ্জীব বলে উঠলেন: "নকশাটার কোথায় কেমন উন্নতি দরকার, সেটা তো হাতিরা নিজেরাই এসে দেখিয়ে দিয়ে যায়।"

এই ধরনের ইলেকট্রিক বেড়া বসাতে কিলোমিটার পিছু ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকা খরচা হয়। বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সাহায্য ও রাজ্য সরকারের তামিলনাড়ু ইনোভেটিভ ইনিশিয়েটিভ যোজনার অধীনে বেড়াটির প্রথম দুই কিলোমিটার এবং পরে আরও ১০ কিলোমিটার বসানোর খরচ বহন করেছিলেন জেলা কালেক্টর।

Anandaramu walking along the elephant fence and describing how it works
PHOTO • M. Palani Kumar

হাতি-রোধক বেড়াটির ধার বরাবর হাঁটতে হাঁটতে এটা কেমন করে কাজ করে সেটা বোঝাচ্ছেন আনন্দরামু

২৫ কিলোমিটার বেড়া বসানো হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। এর মধ্যে ১৫ কিমি বিদ্যুৎবিহীন ও বাকিটা বিদ্যুৎচালিত (সৌরবিদ্যুৎ)। ভোল্টেজের মাত্রা অনেক – ১০,০০০ ভোল্ট। তবে কারেন্টের মাত্রা খুব বেশি নয়, একমুখী তড়িৎ প্রবাহের (ডিসি কারেন্ট) দ্বারা সঞ্চারিত এই বিদ্যুতের একেকটি তরঙ্গ এক সেকেন্ড লম্বা। "সাধারণত এটা ছুঁয়ে ফেললেও হাতিদের প্রাণহানী হয় না," বুঝিয়ে বললেন সঞ্জীব, "আমাদের বাড়ি বা খেত-খামারে যে ২৩০ ভোল্টের বিবর্তিত তড়িৎ প্রবাহটি (এসি কারেন্ট) ব্যবহার করা হয়, তড়িদাহত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাগুলো ওটার থেকেই ঘটে। এখানে সেটা সম্ভব নয়, কারণ তড়িৎ প্রবাহের মাত্রাটা বাড়ির চাইতে হাজার হাজার গুণ কম। অন্যথা একটা হাতিও বাঁচবে না।"

তবে বেড়ার উপর গাছপালা জাতীয় কিছু ভেঙে পড়লে ডিসি ভোল্টেজ কমে ৬,০০০ ভোল্টে এসে ঠেকে, তখন মনের সুখে তার মাড়িয়ে চলে যায় হাতির দল। উপরন্তু কয়েকটি পুরুষ হাতি তো খিদের জ্বালায় এমনই পাগল যে বিদ্যুৎ-টিদ্যুৎ সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেড়া ভেঙে বেরিয়ে যায়। "ওদের মগজে যে ঠিক কী চলছে, সেটা বোঝা খুব কঠিন," স্বীকারোক্তি সঞ্জীব কুমারের।

তাঁর জবানে: "সত্যি কথা বলতে, আমরা কিন্তু কোনোভাবেই বিদ্যুতের উপর নির্ভর করে থাকতে চাই না। সৌরবিদ্যুৎ তো নৈব নৈব চ।" তাছাড়া বিদ্যুতের কারসাজিটা তো ধরেই ফেলেছে হাতিরা। সে ইনসুলেশন বলুন বা কন্ডাক্টিভিটি, এসব তো হাতিদের নখদর্পণে। দিব্যি তারা ডালপালা বা গোটা গাছ ভেঙে শর্ট-সার্কিট ঘটিয়ে দেয়। গজদন্ত যে তড়িৎ পরিবহণ করে না, একথাও জেনে গেছে মদ্দা হাতিরা, তাই দাঁত দিয়ে তার ছিঁড়ে দেয়। "আমার কাছে প্রমাণস্বরূপ একখান ফটো আছে, তার দিয়ে বিদ্যুৎ আদৌ বইছে কিনা সেটা ছোট্টমতন একটা ডাল ভেঙে পরীক্ষা করে দেখছিল হাতিটা," হাসতে হাসতে বলে উঠলেন সঞ্জীব।

*****

'মেলাগিরির ওই বেড়াটির জন্য হাতিরা দক্ষিণ দিকে সরে গেছে। এটা খুবই ভা লো , কারণ ওই দিশায় ঘন জঙ্গল রয়েছে, একটানা...সুদূর সেই নীলগিরি অ বধি '
কে. কার্তিকেয়নী, ভারতীয় বনসেবা আধিকারিক (আইএফএস)

মানুষ ও হাতির ঘাত-সংঘাতের প্রভাব বহুবিধ - অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, মানসিক। ব্যাপারটা এমন: আপনার কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও যে কোনও দিন ভেঙেচুরে ছারখার হয়ে যেতে পারে আপনার দোকানপাট, আর এটা জেনেও আপনি ব্যবসাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যাঁরা কৃষ্ণগিরি জেলায় চাষ করে আসছেন, এটাই তাঁদের জীবনের নির্মম সত্য।

আরও একটি জিনিস বুঝিয়ে বললেন সঞ্জীব কুমার, স্থানীয় ফসল লুটেপুটে সাফ করা ছাড়াও দূর-দূরান্তে কেমন করে পাড়ি জমাতে হয়, এটাও নাকি শিখে গেছে হামলাদার হাতিরা – বিশেষ করে বিগত দেড় দশকে। "শুরুতে অভয়ারণ্যে থেকে মেরেকেটে ১-২ কিলোমিটার দূরে হানা দিত, আর এখন ওরা প্রায় ৭০-৮০ কিলোমিটার দূর অন্ধ্রপ্রদেশ আর কর্ণাটকে গিয়ে ওঠে, তারপর মাস দুয়েক সময় কাটিয়ে ফিরে আসে আবার।" হোসুর অঞ্চল, অর্থাৎ হাতির হামলায় ফসল টিকিয়ে রাখা দায় যেখানে, এখানকার হাতিগুলো বেশ নাদুস-নুদুস। শরীরগুলো তো বাগিয়েইছে, আবার ছানাপোনার সংখ্যাও অগুনতি।

জোয়ান হাতিরাই সবচাইতে বেশি ঝুঁকি নেয়। "অভয়ারণ্যের বাইরে কোথায় কত হাতি মারা যাচ্ছে, সে তথ্য জোগাড় করে গ্রাফ সাজিয়েছিলাম। মারা যাওয়া হাতির ৬০-৭০ শতাংশই অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী ও পুরুষ।"

Mango plantation damaged by elephants in Anandaramu’s field
PHOTO • Anandaramu Reddy
Ananda with more photographs showing crops ruined by elephant raids
PHOTO • Aparna Karthikeyan

বাঁদিকে: আনন্দরামুর জমিতে হাতির দৌলতে তছনছ হয়ে যাওয়া আম বাগান। ডানদিকে: হাতির হামলায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসলের অসংখ্য ছবি দেখাচ্ছেন আনন্দ

আনন্দ জানালেন, আজকাল নাকি হাতির পালগুলো আর দেখাই যায় না তেমন। শুধু মদ্দা হাতিরাই দর্শন দিয়ে যায়: মোট্টাই ভাল, মাখনা ও গিরি। হাতিরা হানা দিলে তিনি আজও আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে ছবি পাঠান মাঝেমধ্যে। ভেঙে পড়া আমগাছের ডাল, পিষে যাওয়া ফলমূল কিংবা কলাগাছ এবং ঢিপির পর ঢিপি ঢাঁই হয়ে থাকা হাতির বিষ্ঠা। এতকিছুর পরেও মানুষটা শান্তভাবে কথা বলেন সবসময়, কেমন যেন একটা হাল-ছেড়ে দেওয়া ভাব, কখনও মেজাজ হারাতে দেখিনি।

সঞ্জীবের কথায়: "এমনটা কেন জানেন? রাগটা ওঁরা সরকার বা বন দফতরের জন্য পুষে রাখেন। চাষিরা হাড়ে হাড়ে বোঝেন, ক্ষতিপূরণের টাকা হয় আসবেই না, কিংবা এলেও বড্ড দেরি করে, তাই কেউ আর আবেদনটুকুও আর করেন না। মুশকিলটা এখানেই, কারণ সংঘাতের মাত্রা যে ঠিক কতখানি, এক্ষেত্রে সেটা আর তথ্যে ধরা পড়ে না।"

এ সংঘাত কমানোর একটাই উপায়, অরণ্যের মধ্যেই আটকে রাখতে হবে হাতিদের। ওদের প্রাকৃতিক পরিবেশটা আগের মতো সবুজ-শ্যামল করে তুললেই ওরা আর বাইরে আসার কথা ভাববে না। "সমাধানের ৮০ শতাংশ এটাই। তবে পুটুসফুলের গাছগুলোও দূর করতে হবে, ওটাও বেশ জরুরি বটে।"

আপাতত ২৫ কিলোমিটার লম্বা বেড়া বসানো হয়েছে – অর্থাৎ যে সীমানা বরাবর মানুষ ও হাতির অস্তিত্ব মিশে যায় একে অপরের দেহে, তার ২৫ শতাংশ। এর ফলে চলতি সংঘাতের ৯৫ শতাংশ মিটে গেছে আজ। কার্তিকেয়নীর কথায়: "মেলাগিরির ওই বেড়াটির জন্য হাতির দল দক্ষিণ দিকে সরে গেছে। এটা অত্যন্ত খুশির খবর, কারণ ওই দিশায় ঘন জঙ্গল রয়েছে, সত্যমঙ্গলম থেকে একটানা সুদূর সেই নীলগিরি অবধি। ওদের জন্য এটাই ভালো"

অবশ্য মেলাগিরির এই বেড়াটি কেবলই যে কায়িক বাধা, তা নয়। "সৌরশক্তি দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত হলে বাধাটা মানসিকও হয়ে দাঁড়ায় – অল্প একটু ঝটকা লাগে, তাই ওরা ভয় পেয়ে যায়। তবে হাতিরা কিন্তু বেজায় সেয়ানা। মৌচাক লাগানো বেড়া, বাঘের ডাক, কিংবা অ্যালার্ম, কিছুতেই কাজ হয়নি।" মোটের উপর সঞ্জীব কুমার বলতে চাইছেন যে হাতিরা এক-দুইবার বোকা বনলেও সবসময় তা হয় না।

অনন্ত এ পাশাখেলায় হাতির দল যেন সর্বক্ষণ একটা করে চাল এগিয়ে থাকে। মনে হয় আমাদের প্যাঁচগুলো ওরা ধরে ফেলেছে, উল্টো এখন আমাদেরকেই শেখাচ্ছে কেমনভাবে গৃহবন্দি করে রাখতে হয়। এখন তো আবার ক্যামেরাগুলোও সব ভেঙে দিচ্ছে। একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন সঞ্জীব, এদিকে আমার চোখ আটকে আছে ফোনের পর্দায়: বেড়ার ঠিক সামনেই জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে দুটি হাতি, তার ডিঙিয়ে কেমনভাবে মাড়োয়ার খেত অবধি পৌঁছবে, বোধহয় সেটারই ফন্দি আঁটছে...

এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় সাহায্য, আতিথেয়তা ও মূল্যবান তথ্য প্রদান করেছেন গোপকুমার মেনন। তাঁর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন লেখক।

২০২০ সালের রিসার্চ ফান্ডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গবেষণামূলক এই প্রতিবেদনটি রূপায়িত করতে আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রচ্ছদচিত্র (মোট্টাই ভাল): নিশান্ত শ্রীনিভাসাইয়াহ।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Aparna Karthikeyan

اپرنا کارتی کیئن ایک آزاد صحافی، مصنفہ اور پاری کی سینئر فیلو ہیں۔ ان کی غیر فکشن تصنیف ’Nine Rupees and Hour‘ میں تمل ناڈو کے ختم ہوتے ذریعہ معاش کو دستاویزی شکل دی گئی ہے۔ انہوں نے بچوں کے لیے پانچ کتابیں لکھیں ہیں۔ اپرنا اپنی فیملی اور کتوں کے ساتھ چنئی میں رہتی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز اپرنا کارتکیئن
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کے ہندوستانی زبانوں کے پروگرام، پاری بھاشا کے کانٹینٹ مینیجر ہیں۔ انہوں نے کولکاتا کی جادوپور یونیورسٹی سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک کثیر لسانی شاعر، ترجمہ نگار، فن کے ناقد اور سماجی کارکن ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra