পারি'র এই প্রতিবেদনটি পরিবেশ সংক্রান্ত সাংবাদিকতা বিভাগে ২০১৯ সালের রামনাথ গোয়েঙ্কা পুরস্কার প্রাপ্ত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি সিরিজের অংশ।
“বিকেল ৪টের মধ্যেই ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে আমাদের আগুন জ্বালতে হত,” কেরালার পাহাড়ি ওয়েনাড জেলায় তাঁর ধুঁকতে থাকা খামারে (দাঁড়িয়ে) বললেন অগাস্টিন ভাডকিল। “কিন্তু সে তো ৩০ বছর আগের কথা। ওয়েনাড এখন আর আগের মতো ঠান্ডা কুয়াশাচ্ছন্ন জায়গা নেই।” এককালে মার্চের শুরুতে সর্বোচ্চ ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে তাপমাত্রা এখন সহজেই ৩০ ডিগ্রি পার হয়ে যায় বছরের ওই একই সময়ে।
ভাডকিলের জীবদ্দশাতেই উষ্ণতর দিনের সংখ্যা আগের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। ইন্টারএক্টিভ টুলের সূত্রে প্রাপ্ত ও এইবছর জুলাই মাসে নিউইয়র্ক টাইমসে অনলাইন প্রকাশিত আবহাওয়া ও বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্বন্ধীয় তথ্য বলছে, ভাডকিলের জন্মের বছর ১৯৬০ সালে, “ওয়েনাডে প্রতি বছর মোটামুটি ২৯ দিন অন্তত ৩২ ডিগ্রিতে (সেলসিয়াস) তাপমাত্রা থাকত। এখন ওয়েনাড অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে অন্তত ৫৯ দিন ৩২ ডিগ্রিতে বা তার উপরে থাকে তাপমাত্রা।
দাক্ষিণাত্য মালভূমির পশ্চিমঘাটের দক্ষিণতম প্রান্তের এই জেলায় এক সময় যে প্রচুর পরিমাণ তীব্র উষ্ণতা এবং রুক্ষ্মতা সংবেদী অক্ষম কমলালেবু ও গোলমরিচ গাছ হত, ভাডকিলের মতে আবহাওয়ার পরিবর্তন তার ক্ষতিসাধন করছে।
চেরুকুট্টুর গ্রামের মানাওয়াওয়াডি তালুকে ভাডকিল ও তাঁর স্ত্রী ভালসার চার একরের খামার আছে। প্রায় ৮০ বছর আগে তাঁর পরিবার কোট্টায়াম থেকে সমৃদ্ধ অর্থকরি ফসলের দেশ ওয়েনাডে আসে ভাগ্যান্বেষণে। মধ্য কেরালা থেকে কয়েক হাজার ছোটো ও প্রান্তিক কৃষক ওই সময়ে রাজ্যের উত্তরপূর্বের এই জেলায় আভিবাসী হয়ে আসেন।
কালক্রমে ওই সমৃদ্ধিতে মনে হয়ে ফাটল ধরেছে। “গত বছরের মতো এ বছরেও যদি বর্ষা খামখেয়ালি হয় তাহলে কফি (জৈব রোবাস্টা) চাষের সর্বনাশ হবে,” বললেন ভাডকিল। “কফি (চাষ) খুবই লাভজনক। কিন্তু এর সমস্যা আবহাওয়া। অতি উষ্ণতা ও খামখেয়ালি বৃষ্টিপাত এর বড়ো ধরনের ক্ষতি করে। এই ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষদের মতে, ২৩-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (রোবাস্টা) কফি চাষের পক্ষে আদর্শ তাপমান।
ওয়েনাডের রোবাস্টা প্রজাতির (ক্রান্তীয় চিরহরিত গুল্ম গোত্রীয়) কফির চাষ হয় ডিসেম্বর থেকে মার্চের শেষ অবধি। কফি গাছগুলির ফেব্রুয়ারি শেষ বা মার্চের শুরুতে প্রথম বর্ষণ দরকার হয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যে গাছগুলিতে মুকুল ধরতে শুরু করে। প্রথম বর্ষণের পর এক সপ্তাহ আর বৃষ্টি না হওয়া খুব জরুরি কারণ বৃষ্টি হলে মুকুলের ক্ষতি হয়। কফি ফল বা ‘চেরি’গুলির বৃদ্ধির জন্য দ্বিতীয় বর্ষণ দরকার হয় প্রথম বর্ষণের এক সপ্তাহ পর। মুকুলগুলি সব প্রস্ফুটিত হয়ে ঝরে যাওয়ার পর কফির দানা সম্বলিত চেরিগুলি পাকতে আরম্ভ করে।
“সময় মতো বৃষ্টিপাত ৮৫% ফলন নিশ্চিত করে,” বললেন ভাডকিল। মার্চের গোড়ায় আমাদের যখন দেখা হয় তখন তিনি এমন বর্ষণ হবে কি হবে না এই দোলাচলে ছিলেন। বৃষ্টি শেষ পর্যন্ত কিন্তু হল না।
মার্চের গোড়ায় কেরালার প্রবল গ্রীষ্মের শুরুতেই তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রিতে পৌঁছায়। “এ বছর দ্বিতীয় বর্ষণ ( রান্দামাথা মাঝহা ) খুব তাড়াতাড়ি এসে সব নষ্ট করে দিল”, ভাডকিল আমাদের জানালেন মার্চের শেষে।
দুই একর জমি এই ফসল চাষে লাগানোর ফলে ভাডকিলের ক্ষতির পরিমাণ এই বছরে ৭০,০০০ টাকা। ওয়েনাড সমাজ সেবা সঙ্ঘ (ডাবলুএসএসএস, ওয়েনাড স্যোশাল সার্ভিস সোসাইটি) স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকে প্রক্রিয়াজাত নয় এমন জৈব কফি কেজি প্রতি ৮৮ টাকায় কেনে। অন্যদিকে অজৈব কফিতে কেজি প্রতি ৬৫ টাকা পাওয়া যায়।
ডাবলুএসএসএস-এর একজন পরিচালক, ফাদার জন চুরাপুজাহ্ইল ফোনে জানালেন যে এ বছর ওয়েনাডে ২০১৭-১৮ সালের ৫৫,৫২৫ টনের তুলনায় ৪০% কম কফি উৎপন্ন হয়েছে। এখনও যদিও সরকারি তথ্য প্রকাশিত হয়নি। “উৎপাদনে ঘাটতির কারণ মূলত জলবায়ুর পরিবর্তন, যা ওয়েনাডজাত কফির সামনে সবচেয়ে বড়ো বিপদ বলে প্রতিপন্ন হয়েছে”, জানালেন ফাদার জন। গোটা জেলা জুড়ে যত কৃষকের সঙ্গে কথা হল তাঁরা সবাই জানালেন যে বিভিন্ন বছরে উৎপাদনের ভয়ানক তারতম্যের জন্য অতি বৃষ্টি বা অনাবৃষ্টিই দায়ী।
বর্ষার খামখেয়ালিপনার জন্য খেতে জলাভাব দেখা দেয়। ফাদার জন-এর হিসাব অনুসারে, “ওয়েনাডের মাত্র ১০ শতাংশ কৃষকই অনাবৃষ্টি বা খামখেয়ালি বর্ষার তোয়াক্কা না করে বোরওয়েল ও পাম্পের মতো সেচ ব্যবস্থার সাহায্যে কাজ করতে পারেন।”
ভাডকিল অবশ্য সেই ভাগ্যবানদের দলে পড়েন না। ওয়েনাড সহ কেরালার অন্যান্য অঞ্চলকে তছনছ করে যাওয়া ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসের বন্যা তাঁর পাম্পের ক্ষতি করে। এই কষ্টের সময়ে ১৫,০০০ টাকা ব্যয় করে পাম্প সারানো তাঁর পক্ষে খুব কঠিন।
বাকি দুই একর জমিতে ভাডকিল ও ভালসা রবার, গোলমরিচ, কলা, ধান আর সুপুরি চাষ করেন। ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা এই ফসলগুলির উপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। “পনেরো বছর আগে আমাদের জীবনধারণের জন্য শুধু গোলমরিচ চাষ করলেই চলত। কিন্তু তার পর থেকে ধ্রুথাভাত্তম (গাছের দ্রুত শুকিয়ে ওঠার রোগ) এর মতো রোগ গোটা জেলায় একরের পর একর জমির ফসল ধ্বংস করেছে।” কৃষকদের এতে নিদারুণ ক্ষতি হয়েছে কারণ গোলমরিচ বছরব্যাপী ফসল।
“ক্রমেই মনে হচ্ছে একমাত্র শখ করেই চাষ করা চলে। আমার এত জমি অথচ দেখুন আমার অবস্থা,” বললেন ভাডকিল। “এ সময় খানিক বাড়তি লঙ্কা গুঁড়িয়ে রাখাই একমাত্র কাজ হতে পারে কারণ ভাতের সঙ্গে খাওয়ার মতো শুধু এটাই তো যা আছে,” হেসে বললেন তিনি।
“পনেরো বছর আগে এইসব শুরু হয়,” তিনি বললেন। “ কালাবস্থা কেন এমনভাবে বদলাচ্ছে?” উল্লেখযোগ্য যে, মালায়ালম ভাষায় কালাবস্থা বলতে জলবায়ুর স্থায়ী অবস্থাকে বোঝায়, তাপমাত্রা বা সাময়িক আবহাওয়াকে না। ওয়েনাড জুড়ে বহু কৃষক আমাদের এই প্রশ্ন করেছেন।
দুঃখের কথা এই যে এর জন্য আংশিকভাবে দায়ী কয়েক দশক কৃষকদের হাত ধরে চলে আসা কৃষিকাজের রকমসকম।
“আমরা বলি, এক ফসলি চাষের যে চলন অধুনা হয়েছে তার বদলে খেতের এক এক টুকরো জমিতে এক এক রকম ফসল ফলানো স্বাস্থ্যকর,” জানালেন ওয়েনাডের এম এস স্বামীনাথন গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানী, সুমা টি আর। জমি ব্যবহারের ধরনে পরিবর্তন বিষয়ে ইনি ১০ বছর ধরে গবেষণা করছেন। এক ফসলি চাষ রোগ এবং পোকা ছড়াতে সাহায্য করে, যার হাত থেকে বাঁচতে রাসায়নিক, কীটনাশক ও সার ব্যবহার করা হয়। এগুলি ভূগর্ভস্থ জলে বা বাতাসে মিশে দূষণ ঘটিয়ে পরিবেশের নিদারুণ ক্ষতিসাধন করে।
সুমার মতে, ইংরেজরা যে অরণ্য ধ্বংস আরম্ভ করেছিল তার থেকেই এই বিপত্তির শুরু। “ওরা কাঠের জন্য জঙ্গল কেটে অনেক উঁচু পর্বতকে (চাষের জন্য) বাগিচায় রূপান্তরিত করেছিল।” তিনি আরও বললেন যে এ ছাড়াও স্থায়ী জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত, “বিশাল মাত্রায় অভিবাসন (এই জেলায় যা শুরু হয়েছিল ১৯৪০ থেকে) হেতু আমাদের ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন। এর আগে ওয়েনাডের কৃষকরা প্রধানত ঝুম চাষ করতেন।”
ওই দশকগুলিতে এখানকার প্রধান ফসল কফি বা গোল মরিচ ছিল না। ছিল ধান — এমন কি ওয়েনাড নামটিও এসেছে ‘ভায়াল নাদু’ বা ধানী-জমির দেশ থেকে। এই অঞ্চল এবং কেরালার পরিবেশ ও প্রাকৃতিক অবস্থার পক্ষে ওই খেতগুলি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ১৯৬০ সালে যেখানে ৪০,০০০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হত সেখানে এখন মাত্র ৮,০০০ হেক্টরে ধান চাষ হয়। ২০১৭-১৮ সালের সরকারি তথ্য অনুসারে যা জেলার মোট আবাদি জমির মাত্র ৫ শতাংশ। ওয়েনাডের ৬৮,০০০ হেক্টর জমিতে এখন কফি বাগিচা। এই হল গোটা কেরালার কফি জমির ৭৯ শতাংশ — এবং ভাডকিলের জন্ম বছর ১৯৬০ সালে যত জমিতে রোবাস্টা চাষ হত তার চেয়ে এই পরিমাণ ৩৬ শতাংশ বেশি।
“অর্থকরি ফসলের জন্য জমি সাফ না করে ছোটো পাহাড়ের উপর চাষিরা রাগির মতো ফসল চাষ করতেন,” বললেন সুমা। আবাদি জমি প্রাকৃতিক পরিবেশ-ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে পারত। ক্রমবর্ধামান অভিবাসনের ফলে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে অর্থকরি ফসলের চাষ প্রাধান্য পেল। ১৯৯০ সালে বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে আরও অধিক সংখ্যক মানুষ গোলমরিচের মতো অর্থকরি ফসলের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন।
‘উৎপাদনে ঘাটতির কারণ মূলত আবহাওয়ার পরিবর্তন, যা ওয়েনাড-জাত কফির সামনে সবচেয়ে বড়ো বিপদ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে’ — গোটা জেলা জুড়ে যত কৃষকদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁরা সবাই তাপমাত্রায় বল্গাহীন তারতম্যের কথা বলেছেন
“আজ কৃষকরা এক কেজি ধানের জন্য পান ১২ টাকা আর কফির জন্য ৬৭ টাকা। গোলমরিচের জন্য তাঁরা কিলো প্রতি পান ৩৬০ থেকে ৩৬৫ টাকা,” বললেন মানান্থাওয়াডি শহরের ই জে হোসে, তিনি জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন ও এককালে ডাবলুএসএসএস-এর প্রকল্প আধিকারিক ছিলেন। দামের এই বিশাল তফাত কৃষকদের আরও বেশি করে ধানের বদলে কফি ও গোলমরিচের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। “এখন তো সবাই যা প্রয়োজন তার বদলে যা সবচেয়ে লাভজনক তাই চাষ করেন। বর্ষায় জল শুষে নিয়ে জলস্তরকে ধরে রাখে – ধান এমনই এক ফসল (যা আমরা হারাচ্ছি)।”
যে সব কৃষক ধান চাষে পারদর্শী ছিলেন তাঁদের শ্রমদিবসের লোকসান হচ্ছে কারণ রাজ্যের অনেক ধানী জমিকে নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ভূসম্পত্তিতেও পরিণত করা হয়েছে।
“এই সব পরিবর্তনগুলি ওয়েনাডের ভূপ্রকৃতির উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলছে,” বললেন সুমা। “এক ফসলি চাষ জমিকে শুষে নিচ্ছে। তার উপর আছে বর্দ্ধিত জনসংখ্যা (১৯৩১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ১০০,০০০-এর কম থেকে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮১৭, ৪২০) আর একই সঙ্গে আছে জমির ক্রমাগত বিভাজন — কাজেই ওয়েনাডের উষ্ণতা যে বাড়ছে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।”
হোসে মনে করেন যে চাষাবাদের পরিবর্তিত ধরনের সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধির ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। “চাষাবাদের ধাঁচের পরিবর্তন বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করেছে,” তিনি বললেন।
নিকটবর্তী থাভিনহাল পঞ্চায়েতে তাঁর ১২ একরের খামার ঘুরিয়ে দেখাবার সময়ে এম যে জর্জ বললেন, “এই জমিগুলিতে একসময়ে এমন ঘন হয়ে গোলমরিচ ফলত যে গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলোর প্রবেশ করা কঠিন হত। বিগত বছরগুলিতে আমাদের কয়েক টন গোলমরিচ নষ্ট হয়েছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন হেতু ধ্রুথাভাত্তম-এর (গাছপালায় দ্রুত শুষ্কতা বা কুইক উইল্ট) মতো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে।”
ফাইটোপথোরা নামক ছত্রাকজাত ধ্রুথাভাত্তম (দ্রুত শুষ্কতা বা কুইক উইল্ট) জেলা জুড়ে কয়েক হাজার মানুষের জীবন-জীবিকাকে ধ্বংস করেছে। “বিগত ১০ বছরে ওয়েনাডে আর্দ্রতা লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়েছে” যা এই রোগ বৃদ্ধিতে সাহায়ক। “বৃষ্টিপাত এখন অনিয়মিত। রাসায়নিক সারের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের ফলে ভালো জীবানু ট্রাইকোডার্মা, যা ওই ছত্রাকের বিরুদ্ধে লড়ত, তা ক্রমাগত ধ্বংস হয়ে এই রোগের বংশবৃদ্ধি ঘটতে সাহায্য করছে।”
“আগে ওয়েনাডে আমাদের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া ছিল। এখন কিন্তু আর তা নেই”, বললেন জর্জ। “বছর জুড়ে সব মরসুমেই সমান গড় বৃষ্টিপাত গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। আগে আমরা বৃষ্টিপাতের জন্য বিখ্যাত ছিলাম…”
তিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত ভারতীয় আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে যে ১লা জুন থেকে ২৮শে জুলাই ২০১৯ ওয়েনাডে বৃষ্টিপাত ওই সময়ের স্বাভাবিক গড় পরিমাণের তুলনায় ৫৪ শতাংশ কম ছিল।
স্বাভাবিকভাবে ওয়েনাডের মতো উচ্চ বৃষ্টিপাত সম্বলিত অঞ্চলগুলিতে কোনও কোনও বছরে ৪,০০০ মিলিমিটারের অধিক বর্ষণ হয়। কিন্তু কিছুকাল যাবৎ জেলার (বৃষ্টিপাতের) গড় বল্গাহীনভাবে ওঠা-নামা করছে। ২০১৪ সালে ছিল ৩,২৬০ মিমি, পরবর্তী দুই বছর তা ভীষণভাবে কমে দাঁড়িয়েছে ২,২৮৩ মিমি ও ১,৩২৮ মিমিতে; ২০১৭ সালে তা দাঁড়ায় ২,১২৫ মিলিমিটারে এবং আবার ২০১৮ সালে, অর্থাৎ কেরালার বন্যার বছরে তা বেড়ে হয় ৩,৮৩২ মিমি।
“সাম্প্রতিক কয়েক দশকে, বিশেষত আশি এবং নব্বইয়ের দশকে আরও বেশি করে প্রতি দশকে বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে তারতম্যে বদল লক্ষ্য করা গেছে”, বললেন থ্রিসুরে অবস্থিত কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়ার পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা অ্যাকাডেমির বিজ্ঞানী, ডঃ গোপকুমার চোলাইল। “তাছাড়া, বর্ষাকাল ও তৎপরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত বর্ষণের ঘটনাও সারা কেরালাতেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওয়েনাডের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু না।”
এই কথাগুলো, বস্তুত ভাডকিল, জর্জ ও অন্যান্য কৃষকদের মতামতকেই জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করে। দীর্ঘকালীন গড় বর্ষণের নিম্নমুখী গতি বিষয়ে তাঁরা যখন হাহুতাশ করছেন, তখনও তাঁরা এটাই বলতে চান - যে সময়ে অথবা মরশুমে তাঁদের সবচেয়ে বেশি দরকার বা তাঁরা যখন সবচেয়ে বেশি বর্ষা আশা করেন সে সময়ে বৃষ্টিপাত হয় কম। এমন ঘটনা ঘটতে পারে যে বছর বৃষ্টি কম হয়েছে বা বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে – সেই সকল বছরগুলোতেই। বারিপাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলেও কমে গেছে বৃষ্টিপাতের সময়সীমা, মোট বর্ষণ-দিবস। অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে ওয়েনাডে ভারি বর্ষণ হতেই পারে যদিও বর্ষার প্রধান মাস এখানে জুলাই। (২৯ জুলাই ভারতীয় আবহাওয়া দফতর এখানে এবং আরও কয়েকটি জেলায় ভারি থেকে খুব ভারি বৃষ্টির সাবধান বাণী হিসাবে ‘কমলা সতর্কতা’ জারি করে থাকে।)
“প্রকৃতি-কাঠামোর উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে চাষাবাদের ধাঁচে আসা পরিবর্তন, অরণ্যভূমির ক্ষয় এবং জমি ব্যবহারের ধরনে পরিবর্তন”, বললেন ডঃ চোলাইল।
“গত বছরের বন্যায় আমি আমার কফি ফসল খুইয়েছি। গোটা ওয়েনাডে এ বছর সবচেয়ে কম কফি উৎপন্ন হয়েছে”, বললেন সুভদ্রা - তাঁকে মানান্থাওয়াডির সবাই ভালোবেসে ‘দিদিমণি’ বলেন। এডাভাকা পঞ্চায়েত এলাকায় ২৪ একর পারিবারিক জমির চাষাবাদ দেখাশুনা করেন ও অন্যান্য ফসলের সঙ্গে কফি, ধান এবং নারকেল চাষ করেন ৭৫ বছর বয়সী এই কৃষক (সুভদ্রা বালকৃষ্ণণ)। “ওয়েনাডের কফি চাষিদের মধ্যে (জীবিকার জন্য) পশুপালনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য রকমে বৃদ্ধি পেয়েছে।”
যেসব কৃষকদের সঙ্গে দেখা করেছি তাঁরা ‘জলবায়ুর বিবর্তন’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার না করলেও এর প্রভাব নিয়ে খুব চিন্তিত।
সুলথান বাথেরি তালুকের পুথাদি পঞ্চায়েতের ৮০ একরের বাগিচা আডেন উপত্যকা ছিল আমাদের যাত্রার শেষ গন্তব্য। ৪০ বছর ধরে কৃষিশ্রমিক হিসাবে কর্মরত গিরিজান গোপীর সঙ্গে দেখা হয় সেখানে, তিনি তখন দিনের অর্ধেক কাজ সবে সেরেছেন। দ্বিপ্রাহরিক আহারে যাওয়ার আগে তিনি বললেন “কে জানে এখানে কী হচ্ছে,” তারপর নিজের মনেই বলে চললেন, “সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। নইলে এসবের অর্থ বোঝা আমাদের কম্মো?”
কভার চিত্র : বিশাখা জর্জ
এই লেখা তৈরিতে সহৃদয় সহায়তা ও সময় দেওয়ার জন্য লেখক গবেষক নোয়েল বেন্নোকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছেন।
পারি-র জলবায়ু বিবর্তনের উপর দেশব্যাপী রিপোর্টিং সংক্রান্ত প্রকল্পটি ইউএনডিপি সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য জলবায়ুর বিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি দেশের সাধারণ মানুষের স্বর এবং অভিজ্ঞতায় বিবৃত করা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিল্কা