“আপনি যে এত বছর ধরে আমার ছবি তুলছেন, তা এসব নিয়ে করবেনটা কী শুনি?” কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলেন গোভিন্দাম্মা ভেলু। মার্চ মাসে ছেলে সেল্লাইয়ার মৃত্যু তাঁকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। “চোখে আর দেখতেই পাই না। আপনাকে তো দেখতেই পাচ্ছি না। বলুন তো এবার থেকে কে আমার আর আমার এই বুড়ি মায়ের দেখভাল করবে?”

অজস্র কাটাছেঁড়া দাগে ভরা তাঁর দুটি হাত তুলে দেখালেন আমাকে। “২০০ টাকার জন্য কতই না কষ্ট করতে হয়। আমার কি আর জাল ফেলে চিংড়ি ধরার মতো বয়স আছে? নাহ্, সে আমি আর পারি না। এই হাতদুটোই সম্বল,” জানালেন তিনি। সত্তরোর্ধ্ব শীর্ণকায় এই চিংড়ি সংগ্রাহকের হিসেবে অবশ্য তাঁর বয়স ৭৭ বছর। “লোকে তো তাই বলে,” বললেন গোভিন্দাম্মা, “বালি খুঁড়ে খুঁড়ে আর চিংড়ি ধরে হাতদুটো ফালা-ফালা হয়ে যায়। জলের তলায় থাকলে অবশ্য বুঝতেও তো পারি না রক্ত পড়ছে কিনা।”

বাকিংহাম খাল এলাকায় ঘুরতে গিয়ে ২০১৯ সালে প্রথমবার দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। এই খালটি এন্নোরের কোসস্তালাইয়ার নদীর সমান্তরালে বয়ে চলেছে, উত্তর চেন্নাইয়ের এন্নোর অঞ্চলের পাশেই থিরুভাল্লুর জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। খালের জলে পানকৌড়ির মতো ডুবসাঁতার দিচ্ছিলেন গোভিন্দাম্মা, তখনই নজর পড়ে তাঁর উপর। নদীবক্ষের কাঁকুরে বালিতে হাত ডুবিয়ে চিংড়ি ধরছিলেন বিদ্যুতগতিতে, তাঁর মতো ক্ষিপ্র আর কাউকেই দেখিনি। আধ-মানুষ গভীর জলে নেমে কোমরে বাঁধা একটি তালপাতার থলিতে ভরে রাখছিলেন চিংড়িগুলো, ত্বকের রং আর খালের পানি মিলেমিশে একাকার, তাদের আলাদা করে এমন সাধ্যি কার?

এন্নোরের মাঝ বরাবর চেন্নাই নগরীর অন্যতম অবলম্বন হয়ে বয়ে চলেছে দুটি নদী - কোসস্তালাইয়ার ও আরানিয়ার নদী। আর উনবিংশ শতাব্দী থেকে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে বাকিংহাম ক্যানাল। ব্রিটিশ আমলে একটি নাব্য নদীপথ রূপে এই খাল খনন করা হয়েছিল।

PHOTO • M. Palani Kumar

উত্তর চেন্নাইয়ের এন্নোরের কামারাজার বন্দরের কাছে এক আত্মীয়ের (বাঁদিকে) সঙ্গে কোসস্তালাইয়ার নদীর থেকে উঠে আসছেন গোভিন্দাম্মা ভেলু (ডানদিকে)। পর্যাপ্ত পরিমাণে চিংড়ি মেলেনি, তাই কোসস্তালাইয়ারের সমান্তরালে বয়ে চলা বাকিংহাম খালের দিকে তাঁরা দুজনে হাঁটা দিয়েছেন

PHOTO • M. Palani Kumar

ইরুলার জাতির অন্যান্যদের সঙ্গে কোসস্তালাইয়ার নদীতে চিংড়ি ধরছেন গোভিন্দাম্মা (এক্কেবারে বাঁদিকে)। এই জলজ প্রাণীর খোঁজে হররোজ ২-৪ কিলোমিটার জল ঠেলতে হয় তাঁদের

দুই পাড়ে ম্যানগ্রোভের বাদাবন নিয়ে এন্নোরের পেট চিরে এঁকেবেঁকে পাড়াভেরকডু হ্রদে (স্থানীয় নাম পুলিকট) গিয়ে মিশে যায় কোসস্তালাইয়ার নদী। ২৭ কিলোমিটার লম্বা এই জলাশয়ের আশেপাশে থাকেন যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে জল-জমিনের নাড়ির টান। নারী-পুরুষ উভয়েই মৎস্যজীবী, জলজ প্রাণীই তাঁদের রুজিরুটির প্রধান সহায়। বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি মেলে এখানে, মূল্য তাদের অপরিসীম।

২০১৯ সালে যখন প্রথম মোলাকাত হয়, গোভিন্দাম্মা বলেছিলেন, “আমার দুই সন্তান। স্বামী যখন মারা যায়, তখন ছেলের বয়স ১০, আর মেয়ের ৮। সে আজ ২৪ বছর আগের কথা। ছেলের বিয়েথা হয়ে গেছে, চার-চারটি মেয়েও হয়েছে; ওদিকে আমার মেয়েটাও দুই বাচ্চার মা, সবকটিই মেয়ে। এর চেয়ে বেশি আর কীই বা চাইতে পারি? চলুন, আমার বাড়িতে, কথা বলা যাবে।” আমন্ত্রণ জানিয়েই আথিপাট্টু পুডুনগরের (আথিপাট্টু নিউ টাউন) পানে হাঁটা লাগালেন জোর কদমে, সাত কিলোমিটারের পথ, ওখানে গিয়ে রাস্তার ধারে চিংড়িগুলো বেচবেন তিনি। এরপর, দেশ জুড়ে কোভিড-১৯ লকডাউনের ফলে পরবর্তী দুই বছর আমাদের আর দেখাই হয়নি।

তামিলনাড়ুতে তফসিলি জাতি রূপে স্বীকৃত ইরুলার সম্প্রদায়ের গোভিন্দাম্মা এককালে চেন্নাইয়ের কামরাজার বন্দরের কাছে থাকতেন, তার সন্নিকটেই ছিল কোসস্তালাইয়ার নদী যেখানে তিনি চিংড়ি ধরেন। কিন্তু ২০০৪ সালের সুনামিতে ভেসে যায় তাঁর কুঁড়েঘর। পরের বছর তল্পিতল্পা গুটিয়ে উঠে যান ১০ কিলোমিটার দূরে থিরুভাল্লুর জেলার আথিপাট্টু শহরে। ইরুলার জাতির যেসব মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন সুনামিতে, পুনর্বাসনের পর তাঁদের অধিকাংশেরই ঠাঁই হয় এখানকার যে তিনটি মহল্লায়, সেগুলি হল অরুণোদ্যয়ম নগর, নেসা নগর ও মারিয়াম্মা নগর।

গোভিন্দাম্মা থাকেন অরুণোদ্যয়ম নগরে, সুনামি পরবর্তী সময়ে সারি দিয়ে যে অসংখ্য ঘর গড়ে উঠেছিল, আজ সেগুলি আজ শ্রীহীন অবস্থায়। বছর দুয়েক আগে তাঁর এক নাতনির বিয়ের সময় নবদম্পতির জন্য নিজের কুঁড়েঘরটি ছেড়ে দিয়ে কাছেই একটি নিমগাছের তলায় এসে ডেরা বাঁধেন তিনি।

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: অরুণোদ্যয়ম নগরে নিজেদের বাড়ির বাইরে (সবুজ শাড়ি পরিহিতা) গোভিন্দাম্মা ও (ডানদিকে) তাঁর মা। ডানদিকে: আত্মীয়স্বজন ও নাতনিদের সঙ্গে গোভিন্দাম্মা ও তাঁর ছেলে সেল্লাইয়া (মাঝখানে, চেককাটা লুঙ্গি পরনে)। এই বছর মার্চে একটি পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন সেল্লাইয়া

রোজ ভোর ৫টা বাজতেই উঠে আথিপাট্টু রেলস্টেশনের দিকে হাঁটা লাগান, পাক্কা দুই কিলোমিটারের পথ। তারপর রেলগাড়ি চেপে দুটি স্টেশন টপকে আথিপাট্টু পুডুনগরে এসে পৌঁছান, সেখানে থেকে পায়ে হেঁটে সাত কিলোমিটার পেরিয়ে কামরাজার বন্দরের কাছে মাথা (সন্ত মেরি) গির্জা। মাঝেসাঝে অবশ্য অটোরিকশাতেও চেপে আসেন। বন্দর এলাকায় ইরুলাদের বাস, দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে ছোট্ট ছোট্ট ঝুপড়ি। চিংড়ির ভরসায় বেঁচে আছেন অগুনতি মানুষ। এখানে এসে গোভিন্দাম্মা নিজের বেরাদরির সঙ্গে কাজে যোগ দেন। চটজলদি জলে নেমে শুরু হয় রুজিরুটির খোঁজ।

ক্রমশ কমে আসছে চোখের জ্যোতি, রোজ রোজ এতটা পথ পেরিয়ে কাজে যাওয়া আর সয় না। গোভিন্দাম্মার কথায়, “কেউ একটু সাহায্য না করলে ট্রেনে বা অটোয় চড়তে পারি না। আগের মতো আর জোর নেই চোখ দুটোয়,” দিন গেলে শুধু যাতায়াতের পিছনেই ৫০ টাকা বেরিয়ে যায়, “এতটা খরচা করার পর যদি চিংড়ি বেচে শুধু ২০০ টাকা জোটে, তাহলে পেটটা কেমনে চালাই বলুন দেখি?” কখনও ৫০০ টাকাও রোজগার করেন বটে, তবে অধিকাংশ দিনই ১০০টা টাকা পেতেই নাভিশ্বাস উঠে যায়, একেকদিন তো সেটাও আসে না হাতে।

যেদিন সকালবেলা জোয়ারের পানি বড্ড বেশি উঠে যায়, সেদিন রাতবিরেতে জলের স্তর নামার পর চিংড়ি ধরতে যান গোভিন্দাম্মা। চোখে ঠিকমতো দেখতে পান না তো কী হয়েছে? আঁধার হাতড়ে চিংড়ি ধরায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তবে জলজ সাপ, এবং বিশেষ করে ইরুঙ কেড়াতির (গাঙ মাগুর বা গ্রে ঈল ক্যাটফিশ) ভয় তাড়া করে ফেরে। “দেখতে তো পাই না ঠিক করে...পায়ে কী না কী ঠেকছে তা বুঝতে নারি...সাপ না মাছ-ধরার জাল,” বললেন তিনি।

তাঁর কথায়: “চেষ্টা করি যাতে এদের কাঁটা না খেয়ে বাড়ি ফিরতে পারি। এই কালচে মাছগুলো [গাঙ মাগুর বা কাইন মাগুর] যদি হাতে এসে ঝাপটা মারে, টানা সাত-আটদিন আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকবে না। ইরুঙ কেড়াতির (প্লোটোনাস ক্যানিয়াস) পিঠের পাখনাগুলো বেশ বিষাক্ত, একবার কাঁটা মারলে যন্ত্রণার শেষ থাকে না। “সে এমনই জ্বালা যে ওষুধ গিলেও লাভ নেই। হাতদুটো জোয়ান হলে এ কষ্ট সয়ে নেওয়া যায়। এ কি আর আমার সাধ্যি, বলুন তো?”

PHOTO • M. Palani Kumar

বাকিংহাম খালে চিংড়ি ধরে দাঁতের ফাঁকে পাকড়ে রাখা একটি ঝুলিতে ভরছেন গোভিন্দাম্মা

PHOTO • M. Palani Kumar

গোভিন্দাম্মার কেটেছড়ে যাওয়া হাত। ‘বালির ভিতর খোঁড়াখুঁড়ি করা আর মুঠির ভিতর চিংড়ি ধরে রাখা, দুটোতেই কেটে ফালাফালা হয়ে যায় হাত’

বাকিংহাম খালে যত্রতত্র এসে পড়ে এন্নোরের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেগুলির বর্জ্য, স্থানে স্থানে ঢিপি হয়ে আছে উড়কি ছাই (ফ্লাই অ্যাশ), যেন সহস্র ক্ষতচিহ্ন জলধারার দেহে। গোভিন্দাম্মার জীবনে সমস্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। “আন্দ সগথি পাড়ু [দেখুন তো কেমন থিকথিকে পাঁক জমে আছে],” জলে নেমে ছবি তুলতে যেতেই আঙুল তুলে দেখালেন তিনি, “কালা এড়ুথু ভাচু পোগা নামাক্কু সাত্তু পোয়িড়ুদু [পাদুটো টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতেই দম ফুরিয়ে যায়]।”

বাকিংহাম খাল ঘিরে গজিয়ে ওঠা এন্নোর-মানালি শিল্পাঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছে ৩৪টি দৈত্যাকার শিল্প, প্রত্যেকটিই বিপজ্জনক। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক তাপবিদ্যুৎ, পেট্রো-কেমিক্যাল ও সারের কারখানা। এছাড়াও তিনটে বিশাল বন্দর আছে এখানে। শিল্পজাত বর্জ্য পদার্থের ঠাঁই হয় জলে, ফলত নিঃশেষ হতে বসেছে জলজ সম্পদ। স্থানীয় জেলেদের থেকে জানা গেল যে, দুই দশক আগেও যেখানে ৬-৭ প্রজাতির চিংড়ি মিলত, আজ সেখানে ২-৩ প্রজাতির বেশি পাওয়া যায় না।

গোভিন্দাম্মার ঘুম কেড়ে নিয়েছে ধীরে ধীরে কমে আসা চিংড়ি। তিনি বলছিলেন, “এককালে মুষলধারে বৃষ্টি নামলে গাদা গাদা চিংড়ি মিলত। সেসব ধরে সকাল ১০টার মধ্যেই বেচতে যেতাম। এখন তার সিকিভাগও মেলে না। বর্ষা কাটলে আধ কিলো চিংড়ি ধরতে ধরতে বেলা গড়িয়ে যায় [দুপুর ২টো]।” ফলত তাঁরা দিনের শেষে চিংড়ি বেচতে বাধ্য হন।

বেশিরভাগ দিনই চিংড়ি বিকোতে বিকোতে রাত ৯-১০টা বেজে যায়, গোভিন্দাম্মা বললেন: “লোকজন কিনতে এসে দরদাম করে। কী করা যায় বলুন তো? চাট্টি চিংড়ি বেচব বলে গনগনে রোদ মাথায় নিয়ে বসে থাকি। একথা যে কেউই বোঝে না। দেখতেই তো পাচ্ছেন – দুমুঠো চিংড়ি বেচতে কেমন নরকযন্ত্রণা পোহাতে হয়।” একেক মুঠিতে ২০-২৫টি চিংড়ি থাকে, দাম ১০০-১৫০ টাকা। “অন্য কিছুই যে পারি না, এটাই আমার রুজিরুটি,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন প্রৌঢ়া।

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: মাছ-ধরার সরঞ্জাম, এগুলোই তাঁর সহায়। ডানদিকে: কাজের শেষে, বাকিংহাম খালের পাড়ে দুই দণ্ড বসে একটু জল খেয়ে নিচ্ছেন গোভিন্দাম্মা

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: কামরাজার বন্দরের নিকটে, সন্ত মেরি গির্জার সামনে অটোর জন্য অপেক্ষা। ডানদিকে: আথিপাট্টু পুডুনগরের থিরুভোট্টিয়ুর সড়কের পাশে চিংড়ি বেচেন গোভিন্দাম্মা। একেক মুঠো চিংড়ি, অর্থাৎ ২০-২৫টি করে বিকোয় ১০০-১৫০ টাকায়

চিংড়িগুলো তাজা রাখতে বরফের বদলে বালি ব্যবহার করেন গোভিন্দাম্মা, টাটকাও থাকে, আবার জলটাও শুকোয় না। “লোকে [খদ্দের] বাড়ি নিয়ে গিয়ে রান্না করা অবধি তাজা থাকে। রাঁধলে কেমন সুস্বাদু হয় তা জানেন নিশ্চয়?” সওয়াল করলেন তিনি, “যেদিন ধরি, সেদিনই বেচে দিই। বিক্রিবাটা হয়ে গেলে খানিক কাঞ্জি [জাউ] খেয়ে নাতনিগুলোর জন্য টুকিটাকি কিছু একটা কিনে নিয়ে যাই। না বিকোলে পেটে কিল মেরে পড়ে থাকি।”

খুবই অল্প বয়সে চিংড়ি ধরার কাজে হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। “মা-বাবা আমায় লিখতে পড়তে পাঠাননি ইস্কুলে, তার বদলে নদীতে নিয়ে যান চিংড়ি ধরা শেখাতে,” স্মৃতিচারণ করছিলেন গোভিন্দাম্মা, “আজীবন জলে-জলেই কেটেছে আমার। নদীই আমার সব। এটা ছাড়া আমার আর কিসুই নেই। স্বামী মারা যাওয়ার পর বাচ্চাদের মুখে দু’দানা ভাত তুলে দিতে সে যে কি অসহ্য খাটনি করতে হয়েছে, তা কেবল ভগবানই জানেন। নদীতে নেমে চিংড়ি না ধরলে সেই কবেই মরে-হেজে যেতাম।”

বহু কষ্টে গোভিন্দাম্মা ও তাঁর চার ভাইবোনকে বড়ো করেছিলেন ওঁদের মা। নদী থেকে চিংড়ি ধরা ছাড়াও হরেক কিসিমের ছোটখাট মাছ কেনাবেচা করতেন তিনি। ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন গোভিন্দাম্মা। “মা আর বিয়েথা করেননি। আজীবন আমাদের দেখভাল করেই কাটিয়ে দিলেন। এখন ১০০ বছরেরও বেশি বয়স তাঁর। সুনামি কলোনির লোকে বলে, মায়ের চেয়ে বয়স্ক আর কেউই বেঁচে নেই।”

গোভিন্দাম্মার নিজের ছেলেমেয়েরাও টিকে আছে এই স্রোতস্বিনীর ভরসায়। “জামাইটা আমার বেহেড মাতাল। জুতের কোনও কামকাজ করেনা। শাশুড়ি চিংড়ি ধরে না বেচলে একটা গেরাস খাবারও জুটত না ওদের,” বলে উঠলেন তিনি।

PHOTO • M. Palani Kumar

কোসস্তালাইয়ার নদীরে চিংড়ি ধরার তোড়জোড় করছেন সেল্লাইয়া। ছবিটি ২০২১ সালে তোলা

PHOTO • M. Palani Kumar

মাছ-ভর্তি জাল হাতে সেল্লাইয়া (বাঁদিকে), ওদিকে কোসস্তালাইয়ারের ধারে একটি অস্থায়ী তাঁবুর পাশে পরিবারের জন্য রাঁধছেন সেল্লাইয়ার স্ত্রী

৪৫ বছর বয়েসে মারা যাওয়ার আগে তাঁর ছেলে সেল্লাইয়াও চিংড়ি ধরে সংসার চালাতেন। ২০২১ সালে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ায় মনে করে বলেছিলেন, “যখন ছোটো ছিলাম, ভোর ৫টা বাজলেই নদীর পথে হাঁটা লাগাতেন মা-বাবা। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৯-১০টা তো বাজতই। আমি আর আমার বোন একপেট খিদে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়তাম। ওদিকে বাবা-মা চাল কিনে এনে, রেঁধেবেড়ে, আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে খাওয়াতেন।”

১০ বছর বয়সে একটি আখের কারখানায় কাজ নিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশে চলে যান সেল্লাইয়া। তাঁর কথায়, “আমি তখন ওখানে, এদিকে চিংড়ি বেচে ঘরে ফেরার সময় একটা দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় আমার বাবার। শেষবারের মতো বাপের মুখটাও দেখতে পাইনি। বাবা চলে যাওয়ার পর মা-ই সবকিছু সামলেছেন। বেশিরভাগ সময়েই নদীর জলে পড়ে থাকতেন মা।”

কারখানায় সময়মতো মজুরি দিত না, তাই বাড়ি ফিরে মায়ের কাজে হাত লাগান তিনি। তবে গোভিন্দাম্মার মতো খালি-হাতে নয়, সেল্লাইয়া ও তাঁর স্ত্রী কিন্তু জাল দিয়ে চিংড়ি ধরেন। চার মেয়ে এই দম্পতির। “বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। পরেরজন গ্রাজুয়েশন [ইংরেজিতে বিএ] করছে আর বাকি দুটো মেয়ে ইস্কুলে। চিংড়ি বেচে যেটুকু পাই, তা ওদের পড়াশোনার পিছনেই চলে যায়,” বলেছিলেন তিনি, “গ্রাজুয়েশনের পর আইন নিয়ে পড়তে চায় আমার মেয়েটা। ওর সঙ্গে আমাকে দাঁড়াতেই হবে।”

কিন্তু হায়, মেয়েটির খোয়াব যে শুধু খোয়াব হয়েই থেকে গেল। মার্চ ২০২২, পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করেন সেল্লাইয়া। ভগ্নহৃদয় গোভিন্দাম্মা বললেন, “জোয়ান বয়সে স্বামীকে হারিয়েছি। আজ ছেলেটাও চলে গেল। মরার পর মুখাগ্নি করার মতোও কেউ রইল না আর। ছেলেটা আমার যেমন যত্ন-আত্তি করত, অমন করে কি আর কেউ করবে?”

PHOTO • M. Palani Kumar

অরুণোদ্যয়ম নগরে প্রয়াত সেল্লাইয়ার বাড়ি, ছেলের ছবির দিকে তাকাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন গোভিন্দাম্মা

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: ছেলে মারা যাওয়ায় তছনছ হয়ে গেছে গোভিন্দাম্মার জীবন। ‘জোয়ান বয়সে স্বামীকে হারিয়েছি। আজ ছেলেটাও চলে গেল।’ ডানদিকে: অরুণোদ্যয়ম নগরে নিজের বাড়ির সামনে চিংড়ির থলি হাতে গোভিন্দাম্মা। সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব কাঁধে তুলে আজও খেটে চলেছেন তিনি

তামিল ভাষায় লেখা মূল প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে তর্জমা করেছেন সেন্থলির এস.। মূল প্রবন্ধটির সম্পাদনায় সাহায্য করেছেন পারির তামিল ভাষার অনুবাদ-সম্পাদক রাজাসংগীথন, তাঁকে প্রতিবেদক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

M. Palani Kumar

ایم پلنی کمار پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا کے اسٹاف فوٹوگرافر ہیں۔ وہ کام کرنے والی خواتین اور محروم طبقوں کی زندگیوں کو دستاویزی شکل دینے میں دلچسپی رکھتے ہیں۔ پلنی نے ۲۰۲۱ میں ’ایمپلیفائی گرانٹ‘ اور ۲۰۲۰ میں ’سمیُکت درشٹی اور فوٹو ساؤتھ ایشیا گرانٹ‘ حاصل کیا تھا۔ سال ۲۰۲۲ میں انہیں پہلے ’دیانیتا سنگھ-پاری ڈاکیومینٹری فوٹوگرافی ایوارڈ‘ سے نوازا گیا تھا۔ پلنی تمل زبان میں فلم ساز دویہ بھارتی کی ہدایت کاری میں، تمل ناڈو کے ہاتھ سے میلا ڈھونے والوں پر بنائی گئی دستاویزی فلم ’ککوس‘ (بیت الخلاء) کے سنیماٹوگرافر بھی تھے۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز M. Palani Kumar
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کے ہندوستانی زبانوں کے پروگرام، پاری بھاشا کے کانٹینٹ مینیجر ہیں۔ انہوں نے کولکاتا کی جادوپور یونیورسٹی سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک کثیر لسانی شاعر، ترجمہ نگار، فن کے ناقد اور سماجی کارکن ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra