মোটে ২২ বছর বয়স, অথচ এরই মধ্যে হাজারো শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন গত ৩-৪ বছর ধরে। ২০২১ সাল, গ্রীষ্মের এক সকালে জল আনতে বেরিয়েছিলেন মীনু সর্দার, ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তে চলেছে। দয়াপুর গ্রামে পুকুরে নামার সিঁড়িটা বড্ড এবড়োখেবড়ো, জায়গায় জায়গায় ভাঙা। নামতে গিয়ে পা পিছলে গেল মীনুর, হুড়মুড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন।

তাঁর নিজের কথায়, "বুকে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, যোনি দিয়ে রক্ত পড়ছিল। বাথরুমে যেতেই তলপেট থেকে কি যেন একটা হড়কে বেরিয়ে এসে মেঝেয় পড়ে গেল। ঠাহর করে দেখলাম, আমার শরীর থেকে মাংসপিণ্ডের মতন একটা কিছু বেরিয়ে আসছে। টেনে টেনে বার করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পুরোটা বের হল না।"

গর্ভপাত হয়েছিল তাঁর, পড়শি গ্রামে একটা বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতেই ঠাহর হল ব্যাপারটা। অন্তহীন দুশ্চিন্তা সয়ে রোগা লম্বা এই মানুষটার মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকে, সেদিনের পর থেকে ঋতুচক্রে অনিয়ম দেখা গেছে তাঁর, দোসর হয়েছে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়া যন্ত্রণা, মানসিক যাতনায় তোলপাড় হয়ে গেছে জীবন।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার গোসাবা ব্লকে তাঁর গ্রাম, মোট জনসংখ্যা ৫,০০০। সবুজ শ্যামল চিত্রপট জুড়ে ছড়িয়ে আছে ধানখেত আর সুন্দরবনের বাদা, গোসাবার পাণ্ডববর্জিত যে কটি গ্রামের সাথে অন্তত সড়ক-সংযোগটুকু রয়েছে, এটি তারই মধ্যে একটি।

আছাড় খাওয়ার পর থেকে টানা একমাস রক্ত পড়েছিল মীনুর, তবে সেটাতেই শেষ নয়। "শারীরিক সম্পর্কে (সহবাসে) এতো ব্যথা করে, মনে হয় কেউ যেন দেহটা আমার ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। পায়খানা করতে গিয়ে কোঁৎ পাড়লে, বা ভারি কিছু তুলতে গেলেই মনে হয় জরায়ুটা যেন বেরিয়ে আসছে।"

Meenu Sardar was bleeding for over a month after a miscarriage
PHOTO • Ritayan Mukherjee

মীনু সর্দারের গর্ভপাত হওয়ার পর থেকে টানা একমাসেরও বেশি রক্ত পড়েছিল

পরিস্থিতির ও লৌকিকতার দ্বৈরথে উত্তরোত্তর বেড়ে চলে তাঁর দুর্ভোগের দাস্তান। ক্লাসে টেনের পর আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি মীনুর। ফলত আছাড় খেয়ে যোনি থেকে রক্তপাত শুরু হলে গ্রামের আশাকর্মীর (অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট) দ্বারস্থ হতে মন চায়নি তাঁর। "আশাদিদি জেনে যাক এটা আমি চাইনি। উনি জানলে গাঁয়ের আর পাঁচটা মানুষও জেনে যাবে যে আমার পেটের বাচ্চাটা পড়ে গেছে। তাছাড়া এটা জানলেও তিনি আদৌ কিছু করতে পারতেন বলে মনে তো হয় না।"

মীনু এবং তাঁর স্বামী বাপ্পা সর্দার তখনই সন্তান চাননি বটে, তবে সে সময়টায় গর্ভনিরোধক কোনও ব্যবস্থার দ্বারস্থও হননি। "বিয়েথা করার সময় থোড়াই না জানতাম পরিবার পরিকল্পনা কাকে বলে? বাপকালে কেউ এসব বলেনি আমায়। এটা খায় না মাখে, সেটা জানতে পারলাম বাচ্চাটা নষ্ট হওয়ার পর।"

দয়াপুর থেকে ১২ কিমি দূরে গোসাবা গ্রামীণ হাসপাতালে একজন মহিলা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বসেন, সেটা মীনু জানেন ঠিকই, তবে কিনা সময়মতো সেই ডাক্তারকে কখনোই পাওয়া যায় না। দয়াপুরের আশা ভরসা বলতে লাইসেন্স-বিহীন দুজন হাতুড়ে (আরএমপি – রুরাল মেডিক্যাল প্রাক্টিশনার)।

তবে হাতুড়েদের দুজনেই পুরুষ।

"অচেনা একটা মরদের কাছে আমার সমস্যাটা খুলে বলতে অস্বস্তি লাগছিল। তাছাড়া ওনাদের অত বিদ্যেও নেই," অকপটে জানালেন মীনু।

সমগ্র জেলা জুড়ে একাধিক বেসরকারি ডাক্তারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এই দম্পতি, কড়া নেড়েছিলেন কলকাতার এক ডাক্তারের দরজাতেও। লাভের লাভ হয়নি কিছু, শুধু হাজার দশেক টাকা খসেছিল। ছোট্ট একখানা মুদিখানায় কাজ করে একার রোজগারে সংসার টানেন বাপ্পা, মাইনে বলতে ৫,০০০ টাকা। স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে বন্ধুবান্ধবের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়েছিলেন।

A number of women in the Sundarbans have had hysterectomy, travelling to hospitals 4-5 hours away for the surgery
PHOTO • Ritayan Mukherjee
A number of women in the Sundarbans have had hysterectomy, travelling to hospitals 4-5 hours away for the surgery
PHOTO • Ritayan Mukherjee

অস্ত্রোপচারের সাহায্যে জরায়ু কেটে বাদ দিয়েছেন সুন্দরবনের বেশ কিছু মহিলা, ৪-৫ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছতেন তাঁরা

দয়াপুরের এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে ধীরে ধীরে তাঁর ঋতুচক্র স্বাভাবিক হয়। মীনু জানালেন, উনিই একমাত্র পুরুষ ডাক্তার যাঁর সামনে গর্ভপাতের কথা খোলাখুলি বলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন তিনি। তবে ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন যে অবিরাম যোনিস্রাব এবং তলপেটে যন্ত্রণার কারণ বুঝতে গেলে আগে একবার আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করাতে হবে, কিন্তু সেটা করানোর মতো টাকাপয়সা এখনও জমিয়ে উঠতে পারেননি মীনু।

ততদিন অবধি ওজন তোলা বারণ, আর থেকে থেকে বিশ্রাম নেওয়াটা জরুরি।

এই যে ন্যূনতম চিকিৎসা পাওয়ার জন্য আঁকাবাঁকা পথে ঘুরপাক খেয়ে মরা, এটাই এ অঞ্চলের গ্রামীণ মহিলাদের হকিকত। সুন্দরবনের যে অংশটা ভারতের মধ্যে পড়ছে, সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিকল্পের অভাব ধরা পড়েছে ২০১৬ সালে একটি গবেষণায় । সরকারি পয়সায় বানানো কাঠামো "হয় নেই কিংবা থেকেও না থাকারই মতো," তাও বা যে কটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, জঙ্গলাকীর্ণ নদী-নালা পেরিয়ে সেখানে পৌঁছানোটা দুষ্কর। উক্ত দুরবস্থা সামাল দিচ্ছেন অপ্রশিক্ষিত হাতুড়ে চিকিৎসক বা আরএমপি-রা, যাঁদের ব্যাপারে গবেষণায় বলা হয়েছে: "প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক বা আর পাঁচটা দিন, সহায় বলতে একমাত্র তাঁরাই রয়েছেন।"

*****

তবে গর্ভপাতের আগে যে মীনুর কোনও শারীরিক সমস্যা ছিল না, এমন ভাবাটা ভুল। ২০১৮ সালে তাঁর দেহ জুড়ে চুলকানি যুক্ত গুঁড়ি গুঁড়ি ফুসকুড়ি দেখা দিয়েছিল। বুক, হাত-পা, মুখ, সব জায়গায় ফুটে ওঠে দগদগে ফোস্কার মতো দানা। অচিরেই ফুলে ওঠে হাত-পা। অতিরিক্ত গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলে চুলকানি। ডাক্তারবদ্যি আর ওষুধপত্রের পিছনে ২০,০০০ টাকা বেরিয়ে যায়।

মীনুর কথায়: "এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এটাই ছিল আমার জীবন – এ হাসপাতাল থেকে সে হাসপাতালে চরকিপাক খাওয়া।" সুস্থ হতে এতটাই সময় লাগে যে আজও মানসিকভাবে স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। ভয় হয়, এই বুঝি চুলকানিটা আবার ফিরে এলো।

The high salinity of water is one of the major causes of gynaecological problems in these low-lying islands in the Bay of Bengal
PHOTO • Ritayan Mukherjee

বঙ্গোপসাগরের নদী মোহনায় স্থিত এই নিচু দ্বীপগুলিতে স্ত্রীরোগের বাড়বাড়ন্ত, এর পিছনে অন্যতম কারণ জলে মাত্রাতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি

মীনুর বাড়ি থেকে মেরেকেটে ১০ কিমি দূরে রজত জুবিলি গ্রামের আলাপি মণ্ডলের গল্পটাও আশ্চর্যরকমের এক। "তিন কি চার বছর আগেকার কথা, গোটা শরীর জুড়ে চুলকুনি শুরু হল, সে যে এমন রাক্ষুসে চুলকুনি বলে বোঝাতে পারব না, মাঝেমধ্যেই পুঁজ বেরিয়ে আসত। এমন অনেক মেয়েকেই চিনি যাদের এই সমস্যাটা ছিল। একটা সময় গেছে যখন আমাদের গাঁ বা আশেপাশের গাঁয়ে কেউ না কেউ তো চুলকুনির জ্বালায় মরছেই। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, কি একটা ধরনের ভাইরাস এটা।"

পেশায় মৎস্যজীবী আলাপি আজ ভালো আছেন বটে, তবে টানা এক বছর ওষুধ খেতে হয়েছিল তাঁকে। সোনারপুর ব্লকে একটা বেসরকারি দাতব্য চিকিৎসালয়ে যেতেন। দেখাতে মোটে ২ টাকা লাগত বটে, তবে ওষুধপত্রের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। মোট ১৩,০০০ টাকা খরচা করেছিল তাঁর পরিবার। চিকিৎসালয়ে একেবার ঘুরে আসা মানে ৪-৫ ঘণ্টার ধাক্কা। আলাপিদের গ্রামে একটা ছোট্টো সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, তবে সেটার কথা তিনি জানতেনই না তখন।

"চামড়ার রোগটার বাড়াবাড়ি হওয়াতে মাছ ধরতে যাওয়া মাথায় উঠল আমার," জানালেন তিনি। এককালে বাগদা চিংড়ির মীনের খোঁজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক-গলা জলে নেমে জাল টানতেন যে মানুষটা, তিনি আজ কর্মহীন হয়ে বসে আছেন।

রজত জুবিলির একাধিক মহিলার গলায় শোনা গেল চর্মরোগের কাহিনি, সুন্দরবনের জলে থাকা অস্বাভাবিক লবণের মাত্রাকেই দোষী ঠাউরান তাঁরা।

PHOTO • Labani Jangi

গর্ভপাতের আগে যে মীনুর কোনও শারীরিক সমস্যা ছিল না, এমন ভাবাটা ভুল। ২০১৮ সালে তাঁর দেহ জুড়ে চুলকানি যুক্ত গুঁড়ি গুঁড়ি ফুসকুড়ি দেখা দিয়েছিল। বুক, হাত-পা, মুখ, সব জায়গায় ফুটে ওঠে দগদগে ফোস্কার মতো দাগ, অচিরেই ফুলে ওঠে হাত-পা

স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় জলের গুণমানের ভূমিকা নিয়ে 'ভারতীয় সুন্দরবনে পুকুর-নির্ভর বাস্তুতন্ত্র' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন সৌরভ দাস, সেখানে বলা হয়েছে যে নোনতা পুকুরের জলে রান্নাবান্না, স্নান, কাচাকাচি করার ফলে চর্মরোগে ভুগছেন মহিলারা। লবণাক্ত নদীর জলে প্রতিদিন ৪-৬ ঘণ্টা কাটান চিংড়ির মীন চাষিরা। সৌরভ লিখছেন: "লবণাক্ত জল ব্যবহার করার ফলে প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণেও ভোগেন তাঁরা।"

গবেষণায় দেখা গেছে যে সুন্দরবনের জলে নুনের মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণের পিছনে লুকিয়ে আছে দ্রুত বাড়তে থাকা সমুদ্রের স্তর, ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস – অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের করাল ছায়া। এছাড়াও রয়েছে চিংড়ির মীন চাষ ও ধ্বংস হতে থাকা বাদাবন। জলজ সম্পদে হুহু করে মিশতে থাকা লবণের ফলে রেহাই পায়নি পানীয় জলও – এশিয়ার অন্যতম ব-দ্বীপগুলির প্রায় প্রত্যেকটিতেই অনুরূপ চিত্র লক্ষ্য করা যায়।

"জলে মাত্রাতিরিক্ত নুন থাকার ফলে বিভিন্ন ধরনের স্ত্রীরোগের সংক্রমণ ঘটে সুন্দরবন অঞ্চলে, বিশেষ করে শ্রোণির প্রদাহজনক অসুখ (পেলভিক ইনফ্লেমেটরি ডিজিজ) তো বিশাল মাত্রায় বেড়ে যায়," জানালেন কলকাতার আর.জি. কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ডাঃ শ্যমল চক্রবর্তী। তিনি সুন্দরবন এলাকায় বহু মেডিক্যাল শিবির সংগঠিত করেছেন। "তবে দোষী কিন্তু একা নোনাজল নয়। আর্থসামাজিক দুরবস্থা, বাস্তুসংস্থান, প্লাস্টিকের ব্যবহার, অপরিচ্ছন্নতা, অপুষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবা বিতরণ ব্যবস্থায় গড়বড় – এই সবগুলির অবদান রয়েছে উক্ত অসুখের পিছনে।"

ইন্টারনিউজ নামের একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া সহায়ক সংগঠনের বরিষ্ঠ স্বাস্থ্য মিডিয়া উপদেষ্টা ডাঃ জয়া শ্রীধর জানালেন যে এ অঞ্চলের মহিলারা, বিশেষ করে চিংড়ির চাষ যাঁরা করেন, দিন গেলে ৪-৭ ঘণ্টা ধরে নোনাজলের সংস্পর্শে আসেন। আমাশয়, আন্ত্রিক, চর্মরোগ, হৃদরোগ, পেট ব্যথা, পাকস্থলীতে আলসার – এই জাতীয় রোগ জেঁকে ধরে খুব সহজেই। রক্তচাপ বৃদ্ধির পিছনেও রয়েছে লবণাক্ত জলের অবদান, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে, এর থেকে গর্ভাবস্থায় দেখা যায় নানান সমস্যা, একেক সময় গর্ভপাত অবধি ঘটে এই কারণে।

Saline water in sundarbans
PHOTO • Urvashi Sarkar
Sundarbans
PHOTO • Urvashi Sarkar

সুন্দরবনের জলে মাত্রাতিরিক্ত নুন থাকায় মহিলাদের শরীরে চর্মরোগের প্রবণতা বেড়ে গেছে

*****

২০১০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ছেলেদের চেয়ে রোগভোগের প্রবণতা মেয়েদের অনেকটাই বেশি।

সাদার্ন হেলথ ইম্প্রুভমেন্ট সমিতি নামের বেসরকারি সংস্থাটি দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়, এই সংস্থার পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ একটি মেডিক্যাল ইউনিটের দ্বায়িত্ব রয়েছেন আনোয়ারুল আলম। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৪০০-৪৫০ জন সুন্দরবন নিবাসী মানুষ চিকিৎসা করাতে আসেন তাঁদের ওই ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল ইউনিটে। এঁদের মধ্যে ৬০ শতাংশই মহিলা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে নানারকম চর্মরোগ, লিউকোরিয়া (যোনিস্রাব), রক্তাল্পতা ও অ্যামেনোরিয়ায় (অনিয়মিত কিংবা ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া) ভুগছেন তাঁরা।

আলম জানাচ্ছেন যে মহিলা রোগীদের প্রত্যেকেই অপুষ্টির শিকার। তাঁর কথায়: "ফল বলুন বা সবজি, বেশিরভাগই নৌকায় করে দ্বীপগুলিতে আনাতে হয়, এসব এখানে চাষ হয় না। অতসত কিনে খাওয়ার টাকা তো আর সবার নেই। এছাড়াও দিনকে দিন তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে গ্রীষ্মকালে, পানীয় জলের বড্ডো অভাব, এই জন্যই তো এত অসুখবিসুখ হচ্ছে।"

অধিকাংশ দিনই ভাত, ডাল, আলু আর মাছ খেয়ে পেট ভরান মীনু ও আলাপি। ওই অঞ্চলে তেমন ফল-টল, শাক-সবজি গজায় না, তাই সেসব খাওয়া হয়ে ওঠে না বিশেষ। মীনুর মতোই হাজার একটা রোগজ্বালার সঙ্গে ঘর করছেন আলাপি।

PHOTO • Labani Jangi

গবেষণায় দেখা গেছে যে সুন্দরবনের জলে নুনের মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণের পিছনে লুকিয়ে আছে দ্রুত বাড়তে থাকা সমুদ্রের স্তর, ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস – অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের করাল ছায়া

বছর পাঁচেক আগে আলাপিরও অতিরিক্ত রক্তপাত হয়েছিল। "সোনোগ্রাফি করে টিউমার পাওয়া যায়, তাই খান তিনেক অপারেশন করে জরায়ুটা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। অঢেল টাকা খরচা করেছিল আমার পরিবার, পঞ্চাশ হাজারেও কুলোয়নি," বলছিলেন তিনি। প্রথম অস্ত্রোপচারটি ছিল অ্যাপেন্ডিক্স কেটে বাদ দেওয়ার জন্য, শেষের দুটি জরায়ু বাদ দেওয়ার হিস্টেরেকটমি অপারেশন।

সুদূর পথ ঠেঙিয়ে পাশের বাসন্তী ব্লকের সোনাখালিতে গিয়ে ওঠেন আলাপি, সেখানকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে হিস্টেরেকটমি করা হয়। রজত জুবিলি থেকে প্রথমে নৌকায় চেপে পৌঁছন গোসাবার ফেরিঘাটে, সেখান থেকে আরেকটা নৌকায় চেপে গদখালি গ্রাম, এবার পালা বাস কিংবা শেয়ারের ভ্যান ভাড়া নিয়ে সোনাখালি – যাত্রাপথেই ২-৩ ঘণ্টা কেটে যায়।

সন্তান বলতে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। আলাপির কাছ থেকে জানতে পারলাম যে রজত জুবিলি গ্রামে এমন আরও চার-পাঁচজন রয়েছেন যাঁদের জরায়ু পুরোপুরি কেটে বাদ দিতে হয়েছে।

তাঁদের একজন হলেন বাসন্তী মণ্ডল। পেশায় মৎস্যজীবী এই মহিলার বয়স ৪০। "ডাক্তারবাবুরা কয়েছিলেন যে আমার জরায়ুতে নাকি একটা টিউমার হয়েছে। আগে আগে মাছ ধরতে গিয়ে দম ফুরোত না, বিশাল খাটাখাটনি করতাম," জানালেন তিন সন্তানের এই মা, "কিন্তু জরায়ুটা কেটে বাদ দেওয়ার পর থেকে আগের মতো শক্তি পাই না আর।" বেসরকারি একটি হাসপাতাল থেকে অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে ৪০,০০০ টাকা গচ্চা গিয়েছিল তাঁর।

চতুর্থ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৫-১৬) জানাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় ১৫-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে অপারেশন করে জরায়ু বাদ গেছে ২.১ শতাংশের – শহুরে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যানটি ১.৯ শতাংশ, অর্থাৎ কিছুটা হলেও কম। (সর্বভারতীয় স্তরে এই পরিসংখ্যানটি ৩.২ শতাংশ।)

For women in the Sundarbans, their multiple health problems are compounded by the difficulties in accessing healthcare
PHOTO • Urvashi Sarkar

একদিকে যৌনরোগ ও প্রজনন সংক্রান্ত অসুখবিসুখের বাড়বাড়ন্ত, অন্যদিকে স্বাস্থ্য পরিষেবা নাগালের বাইরে, এ হেন জাঁতাকলে পিষে জেরবার হয়ে যাচ্ছেন সুন্দরবনের মহিলারা

গতবছর সেপ্টেম্বরে সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্যের কলমে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল আনন্দবাজার পত্রিকা, সেখানে বলা হয়েছে যে যোনিতে সংক্রমণ, অত্যধিক কিংবা অনিয়মিত ঋতুস্রাব, যন্ত্রণাদায়ক যৌনমিলন অথবা শ্রোণির প্রদাহজনক অসুখের ফলে জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়েছে সুন্দরবনবাসী অসংখ্য মহিলার, বহুক্ষেত্রেই তাঁদের বয়স ছিল মোটে ২৬ বা ৩৬।

বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত অপ্রশিক্ষিত চিকিৎসকের দল জরায়ুর টিউমারের কথা বলে ভয় পাইয়ে দেয় সেই মহিলাদের, এককথায় বলতে গেলে তারা ঘাড় ধরে বাধ্য করে হিস্টেরেকটমি করাতে। স্বাস্থ্য সাথী বিমা যোজনা নামে রাজ্য সরকারের যে প্রকল্পটি আছে, সেটির আওতায় পরিবার-পিছু বছরে ৫ লাখ টাকা অবধি দেওয়া হয়, স্বাতীর মতে এই যোজনাটির সুবিধা ভোগ করছে মুনাফাখোর ওই বেসরকারি হাসপাতালগুলি।

একদিকে যৌনরোগ ও প্রজনন সংক্রান্ত অসুখবিসুখের বাড়বাড়ন্ত, অন্যদিকে স্বাস্থ্য পরিষেবা নাগালের বাইরে, এ হেন জাঁতাকলে পিষে জেরবার হয়ে যাচ্ছেন মীনু, আলাপি ও বাসন্তীর মতো সুন্দরবনের লাখ লাখ মহিলা।

জরায়ু কেটে বাদ দিতে গোসাবা ব্লকে তাঁর বাড়ি থেকে ৫ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন বাসন্তী। "বেশি বেশি করে হাসপাতাল আর নার্সিংহোম বানানোর মুরোদ নেই সরকারের? আমাদের জন্য বেশি সংখ্যায় গাইনির ডাক্তার কি রাখা যায় না?" কড়াভাষায় বলে উঠলেন তিনি, "গরিব হতে পারি গো, তাই বলে কে-ই বা আর সাধ করে মরতে চায়!"

মীনু ও বাপ্পা সর্দারের পরিচয় গোপন রাখতে তাঁদের নাম ও ঠিকানা পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।

নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected]– এই আইডিতে

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Urvashi Sarkar

اُروَشی سرکار ایک آزاد صحافی اور ۲۰۱۶ کی پاری فیلو ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز اُروَشی سرکار
Illustrations : Labani Jangi

لابنی جنگی مغربی بنگال کے ندیا ضلع سے ہیں اور سال ۲۰۲۰ سے پاری کی فیلو ہیں۔ وہ ایک ماہر پینٹر بھی ہیں، اور انہوں نے اس کی کوئی باقاعدہ تربیت نہیں حاصل کی ہے۔ وہ ’سنٹر فار اسٹڈیز اِن سوشل سائنسز‘، کولکاتا سے مزدوروں کی ہجرت کے ایشو پر پی ایچ ڈی لکھ رہی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Labani Jangi
Photographs : Ritayan Mukherjee

رِتائن مکھرجی کولکاتا میں مقیم ایک فوٹوگرافر اور پاری کے سینئر فیلو ہیں۔ وہ ایک لمبے پروجیکٹ پر کام کر رہے ہیں جو ہندوستان کے گلہ بانوں اور خانہ بدوش برادریوں کی زندگی کا احاطہ کرنے پر مبنی ہے۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Ritayan Mukherjee
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر نے جادوپور یونیورسٹی، کولکاتا سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک شاعر، ناقد اور مصنف، سماجی کارکن ہیں اور پاری کے لیے بطور مترجم کام کرتے ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra