টকটকে লাল পটভূমিকায় লেখা: কেএফসি

এখানকার মুখরোচক খাবারদাবারের সঙ্গে প্রয়াত কর্নেল স্যান্ডার্সের না আছে কোনও যোগ, আর না এখানকার কেএফসি-র ‘কে’ অক্ষরটি ‘কেনটাকি’র ধার ধারে! কুলামোড়ার বছর ৩২-এর বিমান দাস, এই একতলা রেস্তোরাঁটির সর্বেসর্বা।

আসামের মাজুলি নদীদ্বীপে অবস্থিত এই গ্রামটির সরকারি নাম নতুন কুলামোড়া চাপোরি। জনসংখ্যা ৪৮০, অধিকাংশই চাষি কিংবা খেতমজুর। তবে এই কেএফসির খদ্দের শুধু তাঁরা নন, দ্বীপে ঘুরতে আসা পর্যটকরাও ভিড় জমান এখানে। ভ্রমণের প্রত্যেকটা গাইড বইয়ে এই রেস্তোরাঁর জয়জয়কার।

২০২২ সালের মে মাসের এক কাঠফাটা দুপুর, খাবার খেতে অবিলম্বেই হাজির হবেন মানুষজন, দোকানের ঝাঁপ তুলতে তুলতে বিমান জানালেন: “২০১৭ সালে পথচলা শুরু কেএফসির, তখন ঠ্যালাগাড়িতে দোকান দিতাম।” উজ্জ্বল লালরঙে ছোপানো দোকানের ভেতর আর বাইরের দেওয়াল। বাইরে খটখটে রোদে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ছাগল, রাজহাঁস আর গরুর পাল।

Biman Das (left) and Debajani (right), his wife and business partner at KFC, their restaurant in Natun Kulamora Chapori
PHOTO • Riya Behl

নতুন কুলামোড়া চাপোরিতে তাঁদের কেএফসি রেস্তোরাঁয় বিমান দাস (বাঁদিকে) ও তাঁর স্ত্রী ও ব্যবসার অংশীদার দেবযানী (ডানদিকে)

ঠ্যালাগাড়ি থেকে চাউমিন ইত্যাদি টুকিটাকি কিছু খাবারদাবার বেচা দিয়েই শুরু হয়েছিল বিমানের যাত্রা। দুবছর বাদে ২০১৯ সালে, ১০ জন বসে খেতে পারেন এমন একটি রেস্তোরাঁ খোলেন। ভাজাভুজি, বার্গার, পিৎজা, পাস্তা, মিল্কশেক ইত্যাদি নানান খাবার বেচেন তিনি।

কুলামোড়ার স্থানীয় মানুষ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাঁরা এই নদীদ্বীপটি দেখতে আসেন, প্রত্যেকেই কেএফসির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গুগল রিভিউতে ৪.৩ স্টার রেটিং তো আর মিছেমিছি হয়নি, সেখানে লেখা আছে কেএফসির খানাপিনা যেমন সুস্বাদু, তেমনই টাটকা।

কিন্তু নামটা কৃষ্ণ ফ্রায়েড চিকেন কেন? উত্তরে ফোন বার করে তাঁর, স্ত্রী দেবযানী দাস ও ৭-৮ বছরের একটি বাচ্চাছেলের ছবি দেখালেন বিমান। “ছেলে কৃষ্ণর নামে নাম রেখেছি,” সগর্ব হাসি এই পিতার চোখেমুখে। প্রতিদিন ইস্কুল শেষ হলেই কৃষ্ণ সটান এসে হাজির হয় এখানে, এককোনায় বসে হোমওয়ার্ক সারে, ওদিকে মা-বাবা তখন খদ্দেরের ক্ষুধা নিবারণে ব্যস্ত।

মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়ে গেছে, কুচমুচে মুরগি ভাজার সঙ্গে আলুভাজার কথা পাড়লেন বিমান। রান্নার পদ্ধতিটাও দেখিয়েছিলেন আমাদের। অপরিসর রান্নাঘরে পাশাপাশি তিনটি কাউন্টার, একটি ফ্রিজ, খানকতক চুলা ও একটি ডিপ ফ্রায়ার, তারই মাঝে কাজ করতে করতে তিনি বললেন: “এমন সাফ-সুতরো হেঁশেল মাজুলিতে খুব কমই আছে, এ ব্যাপারে আমাদের বেশ নামডাক।” যত্ন করে সাজানো আছে কেটে রাখা সবজি, তাকে তাকে অপেক্ষারত কেচআপ সহ হরেক কিসিমের সসের বোতল।

Biman dredging marinated chicken in flour (left) and slicing onions (right) to prepare a burger
PHOTO • Vishaka George
Biman dredging marinated chicken in flour (left) and slicing onions (right) to prepare a burger
PHOTO • Vishaka George

বার্গার বানাবেন বলে জারিয়ে রাখা মুরগির মাংসে ময়দার প্রলেপ লাগাচ্ছেন (বাঁদিকে) বিমান, পাশপাশি চলছে পেঁয়াজ কুচানোর পালা (ডানদিকে)

This KFC's fried chicken (left) and burgers (right) are popular dishes among Kulamora’s locals and tourists
PHOTO • Vishaka George
This KFC's fried chicken (left) and burgers (right) are popular dishes among Kulamora’s locals and tourists
PHOTO • Vishaka George

কুলামোড়ার স্থানীয় মানুষজন তথা পর্যটকদের মধ্যে কেএফসির মুরগি ভাজা (বাঁদিকে) ও বার্গার (ডানদিকে) বেশ জনপ্রিয়

ফ্রিজ খুলে একবাক্স জারিয়ে রাখা মুরগির মাংস বার করে ময়দার প্রলেপ লাগিয়ে দিলেন বিমান, তারপর কুড়মুড়ে করে ছাঁকা তেলে ভাজার পালা। বুদবুদ ওঠা তেলে ছ্যাঁকছোঁক চড়মড় শুরু হতেই পাঁউরুটি সেঁকতে লাগলেন। রান্না করতে করতে বলছিলেন: “সকাল হতেই মা কাজে বেরিয়ে যেত, তাই নিজের খাবার নিজেই বানাতাম।” এই জন্যই মোটে ১০ বছর বয়সে রান্নায় হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। মা এলা দাস খেতমজুরের কাজ করতেন মাজুলি দ্বীপে, বাবা দীঘল দাস পেট চালাতেন মাছ বেচে।

বিমানের কথায়, “মা-কে দেখে দেখে ডাল, মুরগির মাংস আর মাছ রাঁধতে শিখেছি। পাড়া-পড়শি, বন্ধুবান্ধব, সবাই খেতে আসত আমার বাড়িতে, আমার হাতের রান্না খেতে সব্বাই ভালোবাসত। এটার থেকেই আরও বেশি বেশি করে রান্নার উৎসাহ পেয়েছিলাম।”

১৮ বছরে পা দিয়েই রুজিরুটির সন্ধানে ঘর ছাড়েন বিমান। এক ইয়ারের সঙ্গে পাড়ি দেন মুম্বইয়ে, এদিকে পকেটে মোটে ১,৫০০ টাকা। সেখানে এক আত্মীয়ের সাহায্যে একটি আবাসনে পাহারাদারির কাজ পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারেননি: “কাজ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম। খুব খারাপ লেগেছিল এমনটা করার পর, তাই চাকরিটা যে আত্মীয় জুটিয়ে দিয়েছিল, তেনাকে চিঠি লিখে বলেছিলাম, ‘দয়া করে আমাকে খারাপ ভাববেন না। চাকরিটা আমার সইছে না, তাই ছাড়তে বাধ্য হচ্ছি। এখানে কাজ করে একফোঁটাও সন্তুষ্টি মিলছে না’।”

এরপর শুরু মুম্বই জুড়ে একে একে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় কামকাজের পালা। পঞ্জাবি, গুজরাতি, ইন্দোচিনি, ইউরোপিয়ান খানাপিনা — শিখে ফেলেন সবই। শুরুতে পাশ থেকে অন্যদের দেখতেন: “গোড়ার দিকে বাসন মাজতাম আর টেবিল সাজাতাম।” তারপর ২০১০ সালে হায়দরাবাদের এটিকো নামে একটি ফুডকোর্টে কাজ করার সুযোগ আসে, অচিরেই পদোন্নতি করতে করতে ম্যানেজার বনে যান বিমান।

'I'm known to have one of the cleanest kitchens in Majuli,' says Biman. Right: His young cousin often comes to help out at the eatery
PHOTO • Riya Behl
'I'm known to have one of the cleanest kitchens in Majuli,' says Biman. Right: His young cousin often comes to help out at the eatery
PHOTO • Riya Behl

বিমানের কথায়, ‘এমন সাফ-সুতরো হেঁশেল মাজুলিতে খুব কমই আছে, এ ব্যাপারে আমাদের বেশ নামডাক।’ ডানদিকে: মাঝেসাঝেই এই ছোটো তুতো-বোনটি রেস্তোরাঁর কাজে সাহায্য করতে আসে

ততদিনে তিনি প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছেন দেবযানীকে, এই কেএফসিতে যিনি বিমানের অংশীদার। বিমানের এক তুতো-বোন শিবানী রেস্তোরাঁ চালাতে সাহায্য করেন, সঙ্গে তাঁর এক বোনও আছে, যাঁর নামটিও দেবযানী।

তারপর একদিন হায়দরাবাদ ছেড়ে মাজুলিতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন বিমান, শুরুতে আসামের শিবসাগর জেলার ডেমৌ ব্লকের একটি রেস্তোরাঁয় কাজে ঢোকেন। দিনকতক পর মনে স্বপ্ন জাগে নিজস্ব খাবারের দোকান খোলার। সে খোয়াব আজ সাকার হয়েছে তাঁর — ইট-সুরকিতে গাঁথা এই কেএফসি তার প্রমাণ। “রান্নাঘরটা নিজেই বানিয়েছি, তবে খদ্দেরদের বসার জায়গাটা ভাড়ায় নেওয়া, মাসে মাসে ২,৫০০ টাকা গুনতে হয়,” জানালেন তিনি।

বিমানের গল্প শুনতে শুনতে বার্গার আর ভাজাভুজি গোগ্রাসে গিলছিলাম। অসম্ভব স্বাদু, অথচ মূল্য মোটে ১২০ টাকা। এছাড়া ২৭০ টাকায় পিৎজাও বানান তিনি, তার জনপ্রিয়তাও আকাশছোঁয়া। গুগল রিভিউ বলছে টাটকা লেবুজল, মিল্কশেক আর ভেজেটেবল রোলও নাকি জব্বর ভালো এখানে।

সপরিবারে সেনসোয়া গ্রামে থাকেন বিমান, কুলামোড়া থেকে দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। প্রতিদিন সুইফট্ ডিজায়ার গাড়ি চালিয়ে রেস্তোরাঁয় আসেন। তাঁর কথায়: “রোজ সকাল ৯টায় রান্নার তোড়জোড় শুরু করি, সবজি আর মাংস কেটেকুটে তৈরি করে রাখি।”

Biman's cousin serving Nikita Chatterjee her burger
PHOTO • Vishaka George
KFC is a favourite spot in Kulamora on Majuli island
PHOTO • Riya Behl

বাঁদিকে: নিকিতা চ্যাটার্জিকে বার্গার পরিবেশন করছেন বিমানের তুতো-বোন। ডানদিকে: মাজুলি নদীদ্বীপের কুলামোড়া, এখানে কেএফসি বলতে জনতা এটিকেই চেনে

দিন ভালো গেলে ১০,০০০ টাকা অবধি রোজগার করেন বিমান। তবে, সেটা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর অবধি চলতে থাকা পর্যটনের মরসুমেই হয়। অন্যান্য দিন হাজার পাঁচেকের বেশি হয় না বলেই জানালেন তিনি।

ঠিক তক্ষুনি নিকিতা চ্যাটার্জি নামের এক চেনা খদ্দের ঢুকলেন রেস্তোরাঁয়। পেশায় সমাজকর্মী নিকিতা আজ এক বছরও হয়নি মুম্বই ছেড়ে মাজুলি এসেছেন। “কেএফসি আমার জান বাঁচিয়েছে। প্রথমে যখন কৃষ্ণ ফ্রায়েড চিকেনের কথা শুনি, লোকে বলেছিল যে মাজুলির অনুপাতে খুব ভালো। কিন্তু খাবার চেখে দেখলাম, শুধু মাজুলি কেন, দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তের অনুপাতে এটি খুবই ভালো।”

বিমানের দিকে তাকিয়ে নিকিতা বললেন: “আমার অবশ্য একখান নালিশ আছে। দুদিন বন্ধ রেখেছিলেন কেন শুনি?” বিহুর (আসামের অন্যতম পরব বিশেষ) জন্য দ্বীপ জুড়ে ছুটি ছিল দুদিন, নিকিতা সেকথাই বলছিলেন।

“গত দুদিন পেটে কোনও দানাপানি পড়েছে তো?” রসিকতায় যোগ দিলেন বিমানও।

নতুন কুলামোড়া চাপোরি যদি কখনও যান, কৃষ্ণ ফ্রায়েড চিকেনে ঢুঁ মারতে ভুলবেন না যেন! সত্যি সত্যিই এখানে মিলবে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়, যাকে বলে ‘ফিঙ্গার লিকিং গুড’ খানাপিনার সম্ভার।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Photos and Text : Vishaka George

وشاکھا جارج، پاری کی سینئر ایڈیٹر ہیں۔ وہ معاش اور ماحولیات سے متعلق امور پر رپورٹنگ کرتی ہیں۔ وشاکھا، پاری کے سوشل میڈیا سے جڑے کاموں کی سربراہ ہیں اور پاری ایجوکیشن ٹیم کی بھی رکن ہیں، جو دیہی علاقوں کے مسائل کو کلاس روم اور نصاب کا حصہ بنانے کے لیے اسکولوں اور کالجوں کے ساتھ مل کر کام کرتی ہے۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز وشاکا جارج
Photographs : Riya Behl

ریا بہل، پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کی سینئر اسسٹنٹ ایڈیٹر ہیں۔ ملٹی میڈیا جرنلسٹ کا رول نبھاتے ہوئے، وہ صنف اور تعلیم کے موضوع پر لکھتی ہیں۔ ساتھ ہی، وہ پاری کی اسٹوریز کو اسکولی نصاب کا حصہ بنانے کے لیے، پاری کے لیے لکھنے والے طلباء اور اساتذہ کے ساتھ کام کرتی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Riya Behl
Editor : Priti David

پریتی ڈیوڈ، پاری کی ایگزیکٹو ایڈیٹر ہیں۔ وہ جنگلات، آدیواسیوں اور معاش جیسے موضوعات پر لکھتی ہیں۔ پریتی، پاری کے ’ایجوکیشن‘ والے حصہ کی سربراہ بھی ہیں اور دیہی علاقوں کے مسائل کو کلاس روم اور نصاب تک پہنچانے کے لیے اسکولوں اور کالجوں کے ساتھ مل کر کام کرتی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Priti David
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کے ہندوستانی زبانوں کے پروگرام، پاری بھاشا کے کانٹینٹ مینیجر ہیں۔ انہوں نے کولکاتا کی جادوپور یونیورسٹی سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک کثیر لسانی شاعر، ترجمہ نگار، فن کے ناقد اور سماجی کارکن ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra