“ও ইনি এসেছেন আমাদের গেস্টহাউসের বিষয়ে শুধুই জানতে,” রানী নিজের ঘরের ‘সহবাসী’ লাবণ্যকে বললেন। আমাদের যাওয়ার কারণ জেনে তাঁরা নিশ্চিন্ত হলেন।
জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে গিয়ে গেস্টহাউসের বিষয়ে প্রথম জানতে চাওয়ায় মাদুরাই জেলার টি কালুপট্টি ব্লকের কুভালাপুরম গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। পুরুষরা ফিসফিসিয়ে কথা বলে আমাদের দুজন মহিলার দিকে ইঙ্গিত করলেন — অল্পবয়সী দুই মা দূরে বাড়ির দাওয়ায় বসেছিলেন।
“ওটা ওই দিকে, চলুন আমরা যাই ওখানে”, বলে মহিলারা আমাদের আধ কিলোমিটার দূরে গ্রামের এক কোণে নিয়ে গেলেন। পৃথক দুটি ঘর, সেই তথাকথিত ‘গেস্টহাউসে’ পৌঁছে আপাতভাবে মনে হল একেবারে পরিত্যক্ত। দুটি ঘরের মাঝখানে একটি নীম গাছের ডাল থেকে অনেকগুলি ঝুলন্ত বস্তা দেখে অবাক লাগল।
গেস্টহাউসের গেস্টরা (অতিথিরা) সবাই রজস্বলা মেয়ে। তাঁরা এখানে স্বেচ্ছায় বা কারও আমন্ত্রণে আসেননি যদিও। মাদুরাই থেকে ৫০ কিমি দূরে ৩,০০০ জনের এই গ্রামীণ সমাজের কঠোর নিয়মের চাপে তাঁরা আছেন এখানে। গেস্টহাউসে যে দুই মহিলার সঙ্গে দেখা হল - রানী ও লাবণ্য (নাম পরিবর্তিত) তাঁদের এখানে থাকতে হবে পাঁচ দিন। কিন্তু সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা মেয়েদের আর সন্তান সহ নতুন মায়েদের এখানে একমাস আটক করে রাখা হয়।
“আমাদের বস্তা নিজেদের সঙ্গে আমরা এই ঘরে রাখি,” বললেন রানী। মেয়েদের এইসময়ে যে আলাদা বাসন ব্যবহার করতে হয়, তাই থাকে সেই বস্তায়। এখানে কোনও রান্নাবান্নার পাট নেই। বাড়ি থেকে, বেশিরভাগ সময়ে পাড়াপড়শিদের রান্না করা খাবার এঁদের জন্য এই বাসনগুলিতে করে পাঠানো হয়। এঁদের ছোঁয়াচ বাঁচাতে বস্তাগুলি নীম গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এক পরিবারের সদস্য হলেও প্রত্যেকের জন্যই আলাদা বাসন থাকে। কিন্তু তাঁদের একসঙ্গে থাকতে হয় দুটি ঘরে।
কুভালামে রানী বা লাবণ্যর মতো মায়েদের ঋতুস্রাবের সময়ে এই ঘরগুলিতে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। এর প্রথমটি, দুই দশক আগে, গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে বানিয়েছিলেন। এই দুই মহিলারই বয়স ২৩ এবং তাঁরা বিবাহিত। লাবণ্যর দুই সন্তান আর রানীর সন্তান সংখ্যা এক; দুজনের স্বামীই কৃষিশ্রমিক।
“এই মুহূর্তে কেবল আমরা দুজনেই আছি কিন্তু কখনও একসঙ্গে আট, নয়জন হয়ে গেলে জায়গাটা ঘিঞ্জি হয়ে যায়,” বললেন লাবণ্য। যেহেতু এমনটা প্রায়ই হয়, অতএব গ্রামের বড়োরা আর একটি ঘর বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ও একটি যুব কল্যাণ সংস্থা, ২০১৯ সালের অক্টোবরে এর জন্য অর্থ সংগ্রহ করে ঘরটি তৈরি করে দেয়।
যদিও এখন কেবল এঁরা দুজনই আছেন তাও রানী আর লাবণ্য নতুন তৈরি ঘরটি ব্যবহার করছেন কারণ এটি বড়ো আর এতে আলো হাওয়াও খেলে বেশি। এমন পিছিয়ে পড়া দস্তুর রক্ষার্থে যে ঘর বানানো হয়েছে, আজব ব্যাপার যে সেখানেই আবার রয়েছে স্কুলে থাকতে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে লাবণ্যর পাওয়া একটি ল্যাপটপ। “এখানে বসে আর কেমন করেই বা আমরা সময় কাটাব? গান শুনি অথবা আমার ল্যাপটপে সিনেমা দেখি। বাড়ি যাওয়ার সময়ে আমি এটা ফেরত নিয়ে যাব,” তিনি বললেন।
মুট্টুথুরাই অর্থাৎ ‘অশুচি’ মেয়েদের জন্য পৃথক স্থানটিকে একটু আড়াল রেখে বোঝাতে ‘গেস্টহাউস’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। রানীর কথায়, “আমরা বাচ্চাদের সামনে গেস্টহাউস বলি যাতে ওরা বুঝতে না পারে এটা কী, মুট্টুথুরাই য়ে থাকা লজ্জার ব্যাপার। বিশেষ করে যখন কোনও উৎসব বা মন্দিরে অনুষ্ঠান চলে আর এই প্রথার সঙ্গে অপরিচিত আত্মীয়স্বজন বাইরে থেকে আসেন।” মাদুরাই জেলার যে পাঁচটি গ্রামে এই প্রথা অনুসরণ করা হয় কুভালাপুরম তার মধ্যে অন্যতম। অন্য গ্রামগুলি হল পুদুপট্টি, গোবিন্দনাল্লুর, সপ্তুর অলগপুরি এবং চিন্নাইয়াপুরম।
এই পৃথক থাকা থেকে জন্ম নেয় আরও নানা সংস্কার। কমবয়সী অবিবাহিত মেয়েরা নির্দিষ্ট সময়ে মুট্টুথুরাই য়ে না গেলেই গ্রামের লোক নানা কথা বলতে শুরু করে। “তারা তো আর জানে না আমার ঋতুচক্র কীভাবে কাজ করে, কিন্তু ৩০ দিন অন্তর আমি মুট্টুথুরাই য়ে না গেলেই সবাই বলবে আমাকে স্কুলে পাঠানো চলবে না,” বলল নবম শ্রেণির ছাত্রী, ১৪ বছরের ভানু (এটা তার আসল নাম নয়)।
“আমি অবাক হচ্ছি না”, বললেন পুদুচ্চেরির নারীবাদী লেখক সালাই সেলভাম - তিনি মাসিক ঋতুস্রাবকে ঘিরে চালু থাকা
বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব। “সারা পৃথিবী জুড়েই মেয়েদের দমিয়ে রেখে দ্বিতীয়
শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার প্রয়াস চলে। এই সংস্কারগুলি ঐতিহ্যের নামে মেয়েদের
মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার আর এক উপায়। গ্লোরিয়া স্টেইনেম
যেমন প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর বিখ্যাত রচনায় (‘
ইফ মেন
কুড মেন্স
ট্রুয়েট
’) যদি পুরুষের ঋতুস্রাব হত তাহলে চিত্রটি ভিন্ন হত, তাই না?”
কুভালাপুরম ও সপ্তুর অলগে আমি যত মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি তাঁরা অনেকেই সেলভামের মতোই মনে করেন সংস্কৃতির নাম করে বঞ্চনাকে আড়াল করা হয়। রানী এবং লাবণ্য - দুজনকেই দ্বাদশ শ্রেণির পরই পড়া ছাড়িয়ে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। “আমার সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা দেখা দেয় বলে সিসেরিয়ান হয়। তারপর থেকেই আমার ঋতুচক্র অনিয়মিত হয়ে গেছে, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে মুট্টুথুরাই না গেলেই গ্রামের লোক জিজ্ঞেস করতে শুরু করে আমি আবার গর্ভবতী হয়েছি কি না! ওরা আমার সমস্যাটাই বোঝে না,” বললেন রানী।
রানী, লাবণ্য বা কুভালাপুরমের অন্য মেয়েরা জানেনই না কবে এই প্রথা শুরু হয়েছিল। লাবণ্য বললেন, “আমাদের মা, ঠাকুমা, তাঁদের মায়েদেরও এইভাবেই আলাদা করে দেওয়া হত, সুতরাং আমরাও একইভাবে চলেছি।”
চেন্নাই নিবাসী চিকিৎসক এবং দ্রাবিড় সংস্কৃতি বিষয়ে পণ্ডিত ডাঃ ইজিলান নাগানাথন শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এই প্রথাটির ব্যাপারে কিন্তু যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন: “আমরা যখন শিকারী-সংগ্রাহক ছিলাম তখনই এর সূচনা হয়েছিল,” তাঁর বিশ্বাস।
“তামিল শব্দ, ভিটু ক্কু থুরাম (বাড়ি থেকে দূরে মাসিক ঋতুস্রাব চলাকালীন মেয়েদের পৃথক করে রাখার প্রথাটির ছদ্মনাম) এর বদলে আগে ব্যবহার করা হত কাটুকু থুরাম (জঙ্গল থেকে দূরে)। এই সময়ে মেয়েরা নিরাপদ কোনও স্থানে আশ্রয় নিত কারণ মনে করা হত যে রক্তের গন্ধ পেলে (ঋতুস্রাব, কৈশোর প্রাপ্তির কারণে অথবা সন্তান প্রসব করার পর) মেয়েদের খুঁজে বের করে বন্যপশুরা শিকার করতে পারে। পরে এই প্রথাই মেয়েদের দমন করার কাজে ব্যবহার হতে থাকে।”
কুভালাপুরমের লোককাহিনীতে যুক্তি বড়ই কম। স্থানীয় মানুষরা বলেন সিদ্ধ র -এর (সন্ত গোছের পুরুষ) কাছে এমন এক পণ করা আছে যা রক্ষা করতে বাধ্য এই গ্রাম এবং কাছাকাছি আরও চারটি গ্রাম। “সিদ্ধর আমাদের মধ্যে চলে ফিরে বেড়াতেন, তিনি ছিলেন শক্তিমান ঈশ্বর,” কুভালাপুরমের থঙ্গামুমুদি সামির নামে পরিচিত সিদ্ধর মন্দিরের প্রধান কর্মকর্তা ৬০ বছর বয়সী এম মুথু। “আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের গ্রাম এবং পুদুপট্টি, গোবিন্দনাল্লুর, সপ্তুর অলগপুরি এবং চিন্নাইয়াপুরম ছিল সিদ্ধরের স্ত্রী। এই প্রতিজ্ঞা ভাঙার কোনও চেষ্টা হলে গ্রামগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে।”
কিন্তু ৭০ বছর বয়সী সি রাসু, যিনি জীবনের বেশিরভাগটাই কাটিয়েছেন কুভালাপুরমে, এই প্রথাকে মোটেই বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন না। “সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে শ্রদ্ধা জানাতে এই প্রথা মেনে চলা হয়। মেয়েদের সব আরামের ব্যবস্থাই তো করে দেওয়া হয়েছে — মাথার উপর ঢালাই করা ছাদ আছে, আছে আলো পাখা এবং যথেষ্ট ঠিকঠাক একটা থাকার জায়গা।”
এই সব এমন জিনিস যা তাঁর ৯০ বছর বয়সী দিদি মুথুরোলি নিজের যৌবনকালে ‘উপভোগ’ করতে পারেননি। “আমাদের তো মাথার উপর ছিল কেবল খড়ের ছাউনি। বিদ্যুতের ব্যবস্থাও ছিল না। এখন তো মেয়েরা অনেক ভালো অবস্থায় থাকে কিন্তু তবু তাদের অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু আমাদের এই নিয়ম মেনে চলতেই হবে,” তিনি বেশ জোরের সঙ্গে বললেন। “নইলে আমরা রসাতলে যাব।”
গ্রামের বেশিরভাগ মহিলাই এই লোকশ্রুতিটিকে আত্মস্থ করেছেন। জনৈক মহিলা যিনি একবার নিজের মাসিক ঋতুস্রাব গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি বারবার সাপের স্বপ্ন দেখছিলেন, এর থেকে তাঁর মনে হয়েছিল এই নিয়ম অমান্য করে মুট্টুথুয়াইয়ে না যাওয়ায় দেবতাদের কোপ পড়েছে তাঁর উপর।
গেস্টহাউসের বিভিন্ন ‘আরামের’ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় কেউ অবশ্য শৌচাগারের প্রসঙ্গ তোলেননি। “মলমূত্র ত্যাগ করতে অথবা ঋতুস্রাবকালীন শৌচকর্মের জন্য আমরা দূরের কোনও মাঠে চলে যাই,” বললেন ভানু। যে মেয়েরা ইস্কুল যায় তারা এখন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে শুরু করেছে (এগুলি আমরা ব্যবহারের পর মাটি চাপা দিয়ে দিই, বা পুড়িয়ে ফেলি অথবা গ্রামের ত্রিসীমানার বাইরে কোথাও ফেলে আসি), কিন্তু বয়স্ক মহিলারা এখনও বার বার ধুয়ে ধুয়ে একই কাপড় ব্যবহার করেন।
মুট্টুথুরাইয়ে বসবাসকারী মেয়েদের জন্য খোলা জায়গায় একটি জলের কল আছে যা গ্রামের আর কেউ ছোঁয় না। “যে জামা-কাপড় কম্বল আমরা এখানে নিয়ে আসি তা না কেচে আমরা গ্রামে পা দিতে পারি না,” রানী বিস্তারে জানান।
সেডাপ্পটি ব্লকের সপ্তুর অলগপুরি গ্রামে ৬০০ মানুষের বাস — এখানে মেয়েরা বিশ্বাস করেন যে তাঁরা যদি এই নিয়ম লঙ্ঘন করেন তাহলে তাঁদের আর ঋতুস্রাব হবে না। চেন্নাইয়ের ৩২-বছর বয়সী করপাগম (নাম পরিবর্তিত) এই প্রথা দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন। “কিন্তু আমি বুঝি এটা এঁদের সংস্কৃতি, আমি একে অমান্য করতে পারব না। এখন আমি আর আমার স্বামী দুজনেই তিরুপ্পুরে কাজ করি আর ছুটিতে এখানে আসি।” তিনি সিঁড়ির নীচে একটা ছোট জায়গা দেখিয়ে জানালেন যে মাসিক চলাকালীন এইটাই হয় তাঁর ‘জায়গা’।
সপ্তুর অলগপুরির ছোট্ট নড়বড়ে মুট্টুথুরাই একটি বিচ্ছিন্ন স্থানে অবস্থিত বলে মেয়েরা মাসিকের সময়ে রাস্তার উপর নিজেদের বাড়ির বাইরে তাঁবু খাটিয়ে থাকতেই পছন্দ করেন। “যদি না বৃষ্টি হয়,” বললেন ৪১ বছর বয়সী লতা (নাম পরিবর্তিত)। বৃষ্টি হলে ওঁরা মুট্টুথুরাই য়ে চলে যান।
পরিহাসের বিষয় এটাই যে কুভালাপুরম এবং সপ্তুর অলগপুরি - উভয় স্থানেই প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে সাত বছর ধরেই রাজ্য সরকারি প্রকল্পের অধীনে তৈরি শৌচাগার আছে। বাড়ির ছোটোরা এগুলি ব্যবহার করে যদিও মহিলারা এবং বাড়ির বড়োরা এখনও মাঠে-ঘাটে যেতেই পছন্দ করেন। কিন্তু দুটো গ্রামের কোনওটার মুট্টুথুরাই য়ে কোনও শৌচাগার নেই।
“মাসিক শুরু হওয়ার পর যখন ওইখানে হেঁটে যাই তখনও গ্রামের মূল রাস্তা ধরে আমরা যেতে পারি না, মুট্টুথুরাই যেতে আমাদের একটা আলাদা ঘুর পথ নিতে হয়,” মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তীর্ণ ২০ বছর বয়সী শালিনী (নাম পরিবর্তিত) বললেন। । মাদুরাইয়ের কলেজে শালিনী কখনও ঋতুস্রাব বিষয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করেন না পাছে ‘গোপন কথা প্রকাশ পেয়ে যায়’। “এতো খুব গর্ব করার মতো কথা নয়,” তিনি বললেন।
জৈব প্রক্রিয়ায় চাষ করেন ৪৩ বছর বয়সী টি সেলভাকনি, তিনি এই বিধিনিষেধ নিয়ে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন। “আমরা সেলফোন ল্যাপটপ ব্যবহার করতে শুরু করেছি অথচ আমাদের ঋতুমতী মেয়েদের বিচ্ছিন্ন করে রাখি ২০২০ সালে এসেও?” তিনি প্রশ্ন তুললেন। যুক্তিযুক্ত আলোচনায় অবশ্য খুব বেশি কাজ হয়নি। লতা বললেন, “একজন জেলা কালেক্টরকেও এই নিয়ম মানতে হয়। এখানে হাসপাতাল অথবা ডাক্তারখানায় কর্মরত নার্স (এবং অন্যান্য শিক্ষিত ও কর্মরত মেয়েরাও) ঋতুচক্র চলাকালীন গ্রামের বাইরে গিয়ে থাকেন।” সেলভাকনিকে তিনি বললেন, “আপনার স্ত্রীরও তাই করা উচিত কারণ এটা বিশ্বাসের ব্যপার।”
মেয়েদের পাঁচদিন অবধি গেস্টহাউসে থাকতে হয়। সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা অথবা সন্তান প্রসবের পর সন্তানসহ মেয়েদের এখানে এক মাস আটকে রাখা হয়
সালই সেলভাম জানাচ্ছেন, “এমন আরও অনেক ‘গেস্টহাউস’ দেখতে পাবেন মাদুরাই ও থেনি জেলার চারিদিকে। সবখানেই আলাদা আলাদা মন্দির অথবা নিয়ম থাকে, আমরা মানুষের সঙ্গে কথা বলার সব চেষ্টা করেছি কিন্তু বিশ্বাসের ব্যাপার বলে তাঁরা কোনও কথাই শুনতে চান না। রাজনৈতিক প্রয়াসের মাধ্যমেই কেবল এই প্রথার পরিবর্তন ঘটতে পারে। কিন্তু তার বদলে ভোট চাইতে এসে সবাই গেস্টহাউসকে আরও আধুনিক করার অথবা আরও সুবিধাযুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেয়।”
সেলভম মনে করেন যে তার চেয়ে ভালো হয় যদি যারা ক্ষমতায় আছেন তাঁরা এই গেস্টহাউসগুলি উচ্ছেদ করে দিতে পারেন। “ওরা বলে যে মানুষের বিশ্বাসের ব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব না। কিন্তু আর কতদিন আমরা এই অস্পৃশ্যতার প্রথা টিকিয়ে রাখব? সরকার এর অবসান ঘটাবার চেষ্টা করলে অবশ্যই একটা বড়ো ধাক্কা আসবে — কিন্তু (এর শেষ) তো করতেই হবে আর বিশ্বাস করুন মানুষ অচিরেই সব ভুলেও যাবে।”
মাসিক ঋতুস্রাবকে কেন্দ্র করে তামিলনাডুতে নানা বিধিনিষেধ আর লজ্জার ঘেরাটোপ খুবই সাধারণ বিষয়। পট্টুক্কোট্টাই ব্লকের আনাইক্কডু গ্রামের ১৪ বছর বয়সী এস বিজয়ার তো এই নিয়ম মানতে গিয়ে প্রাণই চলে গেল ২০১৮ সালের নভেম্বরে যখন গজ সাইক্লোন এল। প্রথমবার ঋতুস্রাব হওয়া মেয়েটিকে একা বাড়ির কাছে একটা খড়ের চালা ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল (পরিবারের আর সবাই মূল বাড়ির ভিতরে ছিলেন বলে বেঁচে যান)।
তামিলনাডুর সর্বত্রই কম বেশি এই বিধিনিষেধ চালু আছে,” বললেন তথ্যচিত্র নির্মাতা, গীতা ইলনগোভন, যিনি নিজের বানানো তথ্যচিত্র, মাধভিদাই (ঋতুচক্র) -এর মাধ্যমে এর সঙ্গে যুক্ত সমস্ত বিধিনিষেধকে তুলে ধরেছেন। শহর অঞ্চলে হয়তো বিচ্ছিন্ন করে রাখার কায়দায় রাখ-ঢাক থাকে, কিন্তু থাকে তো বটে। “আমি একজন সরকারি আধিকারিকের স্ত্রীকে বলতে শুনেছি যে তিনি এই তিন দিন তাঁর মেয়েকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেন না, কারণ এটা তার ‘বিশ্রাম’-এর সময়। যে ভাষাতেই বল না কেন আসলে তো বিধিনিষেধ।”
ইলনগোভন বললেন যে ঋতুস্রাবকে ঘিরে বিধিনিষেধ ইত্যাদি সব জায়গায়, সব ধর্মেই নানা রূপে আছে। “আমার তথ্যচিত্রের জন্য আমি এমন একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলেছিলাম যিনি এখন আমেরিকার একটি শহরে বসবাস করেন এবং এখনও ঋতুস্রাবের সময়ে পৃথক থাকেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ বলে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন। যেটা তাঁর মতো উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির মহিলার কাছে ব্যক্তিগত ইচ্ছা তা এই কঠোর পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক মহিলাদের কাছে হয়ে যায় বাধ্যতামূলক নিয়ম।”
“মনে রাখতে হবে যে এই পবিত্রতা রক্ষার সংস্কৃতি কেবলই ‘উচ্চ’ বর্ণের সংস্কৃতি,” বললেন ইলনগোভন। তবুও এই সংস্কৃতির প্রভাবে গোটা সমাজটাই আচ্ছন্ন — কুভালাপুরম কিন্তু মূলত দলিত অধ্যুষিত। এই চিত্র নির্মাতা আরও জানালেন, “এই তথ্যচিত্রের লক্ষ্য পুরুষ সমাজ; আমরা চাই তাঁরা এই বিষয়টা বুঝুন। নীতি প্রণয়নকারীদের বেশিরভাগই তো পুরুষ। এ বিষয়ে কথা বলা বা পরিবারের ভিতরে আলোচনা শুরু করা ছাড়া আমি তো আর কোনও উপায় দেখি না।”
তাছাড়া, “ঠিক মতো জলের ব্যবস্থা না করে মহিলাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে,” বললেন চেন্নাইয়ের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, ডঃ শারদা শক্তিরাজন। “ভেজা স্যানিটারি প্যাড বেশিক্ষণ পরে থাকলে অথবা পরিষ্কার জল না থাকলে মূত্রনালি বা প্রজনন নালিতে সংক্রমণ হতে পারে। সংক্রমণের ফলে মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং সারাজীবনের মতো তলপেটে ব্যথা জাতীয় আরও নানা জটিল সমস্যা হতে পারে। স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থার অভাব (পুরোনো কাপড় বারবার ব্যবহার করা) সারভিকাল ক্যান্সারের অন্যতম কারণ,” তিনি বললেন।
২০১৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল জ র্নল অফ কমিউনিটি মেডিসিন অ্যান্ড পাব্লিক হেলথ -এ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, বিশেষত গ্রামীণ তামিলনাডুতে যেসব ধরনের কর্কট রোগে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন তার মধ্যে সারভিকাল ক্যান্সারের স্থান দ্বিতীয়।
কুভালাপুরমে ভানু অবশ্য একটি ভিন্ন বিষয়ের উপর জোর দিলেন। “যত চেষ্টাই করুন এই ব্যবস্থা বদলাতে পারবেন না,” আমাকে ভানু বিচক্ষণতার সঙ্গে বলেন। “যদি আমাদের জন্য কিছু করতে চান তাহলে মুট্টুথুরাই য়ে আমাদের জন্য শৌচাগারের ব্যবস্থা করে দিন। তাতে আমাদের জীবন অনেকটা সহজ হবে।”
প্রচ্ছদ চিত্র: নিউ-মিডিয়া শিল্পী প্রিয়াঙ্কা বোরার নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ভাব এবং অভিব্যক্তিকে নতুন রূপে আবিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত আছেন। তিনি শেখা তথা খেলার জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করছেন ; ইন্টারেক্টিভ মিডিয়ায় তাঁর সমান বিচরণ এবং সেই সঙ্গে কলম এবং কাগজের চিরাচরিত মাধ্যমেও তিনি একই রকম দক্ষ।
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিলকা