"ম্যায় তেজ দৌড় কে আউঙ্গা, ঔর কুনো মে বস্ জাউঙ্গা [একছুটে দৌড়ে এসে কুনোয় ডেরা বাঁধব]।"
এই হল চিন্টু দ্য চিতার বক্তব্য – দু'দণ্ড দাঁড়িয়ে একটু পড়েই দেখুন না পোস্টারটা।
উর্ধ্বতন আধিকারিকদের হুকুম বলে কথা, এই পোস্টারখানা না সেঁটে যাবেন কোথায় মধ্যপ্রদেশের বনকর্মীরা? সে আজ মাস ছয়েক আগেকার ঘটনা, কুনো জাতীয় উদ্যানের আশেপাশের প্রত্যেকটা গ্রাম টাঙানো হয়েছিল এই পোস্টারটি। হ্যাঁ, চিন্টু বাবাজি এই কুনোতেই ঘর বানাবার কথা বলছেন বটে। চিতা হলে কী হবে? চিন্টু যে আদ্যপান্ত মিশুকে।
আফ্রিকা থেকে আগত ৫০টি জ্বলজ্যান্ত চিতার সঙ্গে সংসার পাতবে চিন্টু, অথচ সে 'ঘর' থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়ানো হবে বাগচা গ্রামের বাসিন্দাদের। পুনর্বাসিত হবেন মোট ৫৫৬ জন। মূলত সাহারিয়া আদিবাসী জনজাতির মানুষ তাঁরা, তাঁদের দৈনন্দিন জীবন জঙ্গলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এভাবে উৎখাত করা হলে সে নাড়িই বলুন বা রুজিরুটির শিকড়, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সবকিছু।
খুব স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় উদ্যানে শুরু হবে সাফারি রাইড, বিলিতি চিতা দেখতে ধেয়ে আসবে পর্যটকের দল। ট্যাঁকের জোর না থাকলে এটা অসম্ভব, ফলত আপনা থেকেই বাদ পড়ে যাবেন দারিদ্রসীমার নিচে থাকা স্থানীয় মানুষেরা।
ইতিমধ্যে, 'মিশুকে' সে ছোপ-ছোপ বাঘমামার পোস্টার আর কার্টুন দেখে হতবাক হয়ে গেছে পাইরা যাতভ জনপদের বছর আষ্টেকের সত্যন যাতভ। "এটা কি ছাগল?" তার বাবাকে না জিজ্ঞেস করে আর থাকতে পারেনি অভয়ারণ্য থেকে ২০ কিমি দূরে থাকা এই বাচ্চাটি। সত্যনের ছোটভাই অনুরোধের বয়স মেরেকেটে চার, তার অবশ্য দৃঢ় ধারণা যে এটি এক প্রকারের কুকুর।
চিন্টু বাবাজি ঘোষিত হওয়ার পরপরই পোস্টার রূপে টাঙানো হয় পঙ্খানূপুঙ্খ বিবরণী সমেত দুটি কমিকস্। সেখানে চিতার সম্বন্ধে তথ্য তুলে ধরেছে মিন্টু ও মীনু নামক দুটি শিশুচরিত্র। তাদের দাবি, চিতা নাকি চিতাবাঘের (লেপার্ড) চেয়ে অনেক শান্ত, তেনারা নাকি মরে গেলেও মানুষের উপর হামলা করেন না। এমনকি মিন্টু তো ঠিক করেই রেখেছে যে চিতার দৌড় করাবে সে।
আশা করি যাতভ জাতির এই ছেলে দুটি চিতার মুখোমুখি হলেও বেড়াল ভেবে তেনাদের আদর-টাদর করতে যাবে না।
তবে হ্যাঁ, আসল গল্পটা কিন্তু একবর্ণও 'তুতুপুতু' করার মতো নয়।
অ্যাসিনোনিক্স জুবাটুস, অর্থাৎ আফ্রিকান চিতা সম্ভাব্য রূপে যতটা বিপজ্জনক ঠিক ততটাই প্রকান্ড একপ্রকারের স্তন্যপায়ী জীব। ডাঙার প্রাণীদের মধ্যে এর চাইতে দ্রুতগামী আর কেউই নেই। বিপন্ন এই পশুটি ভারতের দেশজ নয়, এবং এর ফলে শয়ে শয়ে স্থানীয় পরিবার মুহাজির হতে বাধ্য হবেন।
*****
"এবছর ৬ই মার্চ একটা সভা ডাকা হয় বনচৌকিতে, ওই যে ওখানে," তাঁর গ্রামের একপ্রান্তে স্থিত কুনো অরণ্যের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন বাগচা-নিবাসী বাল্লু আদিবাসী (৪০)। "আমাদের বলা হল, এই জায়গাটা জাতীয় উদ্যান হয়ে গেছে, তাই ঘরদোর সব ছেড়েছুড়ে পালাতে হবে আমাদের।"
মধ্যপ্রদেশের শেওপুর জেলার পশ্চিম সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাগচা গ্রামটি, এখানকার বাসিন্দারা সবাই সাহারিয়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। যে রাজ্যে স্বাক্ষরতার হার ৪২ শতাংশ, সেখানে এঁরা বিশেষরূপে অসুরক্ষিত ট্রাইবাল গোষ্ঠী (পিভিটিজি) রূপে চিহ্নিত। মোট ৫৫৬ জন বাস করেন বিজয়পুর ব্লকের এই গ্রামটিতে। বাড়ি বলতে মূলত মাটি আর ইটের দেওয়াল, ছাদের বদলে সারি সারি পাথরের চাঙড়। দিকচক্রবাল ঘিরে রেখেছে জাতীয় উদ্যান (স্থানীয় নাম যার কুনো পালপুর), বনানীর অন্তঃপুরে বয়ে চলেছে কুনো নদী।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শালি জমিতে বৃষ্টির ভরসায় চাষবাস করেন সাহারিয়ারা, তার পাশাপাশি কুনোর জঙ্গল থেকে কাঠ বাদ দিয়ে অন্যান্য বনজ বস্তুও (এনটিএফপি) সংগ্রহ করে আনেন বিক্রি করার জন্য
বিবাহিত জীবনের পুরোটাই এই বাগচা গাঁয়ে কাটিয়েছেন কাল্লো আদিবাসী, ষাটের কোঠায় বয়স আজ তাঁর। "এটা আমাদেরই জমিন। এটাই আমাদেরই জঙ্গল। এটাই আমাদের ভিটেমাটি, এখানে যা কিছু আছে, সবই আমাদের। অথচ আজ আমাদের দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে।" চাষবাসের পাশাপাশি বনজ সামগ্রী সংগ্রহ করে আনেন এই মানুষটি। সাত সন্তানের মা তিনি, অগুনতি নাতিনাতনি, সবাই মিলে একসাথে বসত করেন এখানে। "ওই চিতাগুলো দিয়ে কার কী লাভ হবে শুনি?" সোজাসাপ্টা ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন কাল্লো।
বাগচাই আসতে হলে শেওপুর থেকে সিরোনি যাওয়ার পাকা রাস্তাটা ছেড়ে নেমে পড়তে হবে চাকোয়া (কারধাই বা অ্যানোগেইসাস পেন্ডুলা), খয়ের (আকেশিয়া ক্যাটেচু) ও লুবান (সল্লকি বা বসওয়েলিয়া সেরাটা) ঘেরা পর্ণমোচী অরণ্য মাঝে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া কাঁচা রাস্তায়। ১২ কিমি পর একটা চড়াইয়ের উপর দেখা মিলবে সে গ্রামের, আশেপাশে ছন্নছাড়া গরুছাগলের দল। নিকটতম স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ২০ কিমি দূর। চাইলে ১০৮ নম্বরে ফোনও করতে পারেন, তবে কিনা নেটওয়ার্ক না থাকার সম্ভাবনাটাই বেশি। বাগচায় একটা প্রাথমিক ইস্কুল রয়েছে বটে, তবে ক্লাস ফাইভের পর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাইলে ২০ কিমি দূর ওছা গ্রামের মধ্যবর্তী বিদ্যালয়ে যেতে হবে, এবং সপ্তাহান্ত ছাড়া বাড়ি ফেরার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শালি জমিতে বৃষ্টির ভরসায় চাষবাস করেন সাহারিয়ারা, তার পাশাপাশি কুনোর জঙ্গল থেকে কাঠ বাআদ দিয়ে অন্যান্য বনজ বস্তুও (এনটিএফপি) সংগ্রহ করে আনেন বিক্রি করার জন্য। তবে আসন্ন উদ্বাস্তু জীবনে এই দ্বিতীয় সামগ্রীটি আর থাকবে না। এনটিএফপির মধ্যে চিরহরিৎ পাইন গাছের আঠা (গোন্ড) এঁদের রুজিরুটির একটা বড়ো সম্বল। এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য গাছের রজন, কেন্দু পাতা, ফলমূল, জড়িবুটি ইত্যাদি। সাহারিয়াদের আন্দাজ, ঋতুচক্র সহায় হলে এসব থেকে পরিবার-পিছু (গড় হিসেবে জনা দশেক সদস্য) প্রতি বছর ২-৩ লাখ টাকা অবধি রোজগার করেন তাঁরা। হাতে বিপিএল (দারিদ্রসীমার নিচে) কার্ড থাকায় খানিকটা করে রেশনও পান, সব মিলিয়ে খাদ্য সুরক্ষা না জুটলেও সেই অর্থে খাদ্যাভাব নেই।
তবে অরণ্য হতে বিতাড়িত হলে এ সুখ আর সইবে না তাঁদের। "আরামসে আছি জঙ্গলে, হাতছাড়া হয়ে যাবে সব। চির বা অন্যান্য গাছের গোন্ড আর পাব না, সে তেল বলুন বা নুন, ওগুলো বেচেই তো সব কিনি আমরা। সব শেষ হয়ে যাবে গো। পশুর মতন গতর খাটানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না," বাগচা গ্রামের সাহারিয়া গোষ্ঠীভুক্ত হরেথ আদিবাসী জানালেন।
অধ্যাপক অস্মিতা কাব্রার মতে বাস্তুচ্যুতির মানবিক ও অর্থনৈতিক ধাক্কাটা অপরিসীম। সংরক্ষণ ও উৎখাত বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ২০০৪ সালে বাগচার উপর গবেষণা করেছিলেন তিনি। সেখানে দেখা যায়, এ গাঁয়ের রুজিরুটির সিংহভাগ দখল করে রেখেছে বিপণনযোগ্য বনজ সামগ্রী। "জ্বালানি, কাঠকুট, গাছ-গাছড়া, ফল, মহুয়া, সে নানানতর জিনিস সরবরাহ করে এ অরণ্যভূমি," বলছিলেন তিনি। সরকারি ওয়েবসাইট অনুযায়ী কুনো জাতীয় উদ্যানের পরিধি ৭৪৮ বর্গ কিলোমিটার, অধিকন্তু এটি বৃহত্তর কুনো বন্যপ্রাণ বিভাগের অন্তর্গত, যেটির আয়তন ১,২৩৫ বর্গ কিলোমিটার।
জঙ্গল থেকে পাওয়া সাতরাজার ধন তো আছেই, এছাড়াও যে জমিটুকু তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চাষ করে আসছেন, সেটা হারানোর ক্ষত সারবে না কোনওদিন। হরেথ আদিবাসীর কথায়: "বৃষ্টি পড়লে বাজরা, জোয়ার, মক্কা (ভুট্টা), উরদ (বিউলি), মুঙ (মুগ) আর রমাস (লোবিয়া বা রমাকলাই, অর্থাৎ বরবটির দানা) চাষ করি আমরা, এছাড়াও ভিন্ডি (ঢ্যাঁড়শ), কদ্দু (কুমড়ো), তরি (ঝিঙে), এসবও ফলাই।"
কথাটির পূর্ণ সমর্থন করলেন কাল্লো, ১৫ বিঘার জমির উপর চাষ করে তাঁর পরিবার: "আমাদের মাটিটা খুবই উর্বর। থোড়াই না ছেড়ে যেতে চাই? কিন্তু কী করব? বাবুরা তো চাইলেই আমাদের তাড়িয়ে দিতে পারেন।"
প্রফেসর কাব্রার মতে সাহারিয়াদের তাড়িয়ে এই জঙ্গলটিকে চিতার বাসস্থান করার ভাবনাটি ভিত্তিহীন, পরিবেশগত কোনও গবেষণাই নাকি করা হয়নি। "হ্যাঁ, ট্রাইবাল মানুষদের উৎখাত করাটা আলবাৎ খুব সোজা, কারণ বনদপ্তর আর আদিবাসীদের সম্পর্কটা মূলত আধিপত্যের, ইতিহাস সাক্ষী আছে তার। ওঁদের জীবনের একাধিক আঙ্গিক যে বনদপ্তরের হাতের মুঠোয় বন্দি," জানালেন তিনি।
এ কথাটা বোধহয় রাম চরণ আদিবাসীর চেয়ে ভাল করে বোঝা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়, এই তো ক'দিন আগেই জেলের ঘানি ঘোরাতে হয়েছিল তাঁকে। ৫০ বছর বয়েস, জন্মলগ্ন থেকেই কুনোর জঙ্গলে অবাধ যাতায়াত তাঁর। প্রথমবার গিয়েছিলেন মায়ের পিঠে চেপে, জ্বালানির খোঁজে। তবে আজ বছর ৫-৬ হতে চলল, বনজ সামগ্রীর উপর রাম চরণ ও তাঁর বেরাদরির সহজাত অধিকার ধাপে ধাপে খর্ব করেছে বনদপ্তর। এককোপে রোজগারপাতি আধা হয়ে গেছে তাঁদের। "মিছি মিছি আমাদের উপর চোরাশিকারের মামলা চাপিয়ে দেন রেঞ্জার বাবুরা [গত ৫ বছর ধরে], এমনকি শেওপুরের জেলে অবধি ঢুকিয়ে দিয়েছিল [উনি এবং ওঁর ছেলে মহেশকে]। জামিন আর জরিমানা মেটাতে কুড়িয়ে বাড়িয়ে ১০-১৫ হাজার টাকা জোগাড় করেছিলাম," জানালেন তিনি।
ঘাড়ের উপর ঝুলতে থাকা ভিটেমাটি হারানোর খাঁড়া, প্রায় প্রতিনিয়ত চলতে থাকা বনদপ্তরের জুলুম, এতকিছুর পরেও সাহসের বলে বুক বেঁধেছেন বাগচার মানুষজন। "এখনও অবধি তাড়াতে পারেনি। গ্রামসভার মিটিংয়ে আমাদের দাবিগুলো বেশ স্পষ্টভাবে জানিয়েছি," একদল গ্রামবাসীর মাঝ থেকে মেঘমন্দ্র স্বরে বলে উঠলেন হারেথ। সদ্য সদ্য গড়ে ওঠা এই গ্রামসভাটির একজন সদস্য তিনি। উৎখাতের কাজ সুষ্ঠুভাবে চালনা করতে ৬ই মার্চ ২০২২শে এটি তৈরি করতে আদেশ দ্যায় বনদপ্তর। বন অধিকার আইন, ২০০৬এর [ভাগ ৪(২)(ই)] নিয়মানুযায়ী গ্রামসভা সম্মত না হলে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করা অসম্ভব।
গ্রামবাসীর চোখে বাল্লু আদিবাসীই এ গাঁয়ের মোড়ল, তাঁর কথায়: "সরকারি বাবুদের বললাম, আপনাদের খাতায় ১৭৮টা নাম লেখা আছে বটে, তবে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এমন লোকের সংখ্যা এ গাঁয়ে ২৬৫। ওনারা মানা করে দিলেন, আমরাও জেদ ধরে বললাম যে সব্বাইকে ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত একচুলও নড়ব না এখান থেকে। তখন তাঁরা বললেন যে হ্যাঁ হ্যাঁ, ৩০ দিনের মধ্যে সেটার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।"
এর মাসখানেক পর, ৭ই এপ্রিল ২০২২শে আয়োজিত হয় সভাটি। গ্রামবাসীরা যেন প্রত্যেকেই সেদিন সকালে হাজির থাকেন, একথাটা তার আগেরদিন সন্ধ্যাবেলায় চাউর করে দেওয়া হয়। সকাল ১১টায় শুরু হয় সভা। আধিকারিকের দল ওঁদের হাতে একটি কাগজ তুলে দিয়ে সইসাবুদ করতে বলেন, সেখানে লেখা ছিল যে তাঁরা স্বেচ্ছায় জমিজমা ছেড়ে দিচ্ছেন, কেউই তাঁদের জোর-জবরদস্তি করছে না। তবে মোটে ১৭৮ জনের নাম ছিল সেখানে, এঁরা বাদে আর কেউই পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিপূরণ পাবেন না। গ্রামসভা থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, দস্তখত তাঁরা করবেন না।
তবে সাহারিয়াদের এই জেদটা কিন্তু মোটেও অমূলক নয়, পুনর্বাসনের নামে কুনো অরণ্যে তাঁদের পড়শিদের সঙ্গে যে কী ধরনের জুলুম করা হয়েছিল, সেকথা মরে গেলেও ভুলতে পারবেন না তাঁরা। গুজরাত থেকে সিংহ আনা হবে, তাই ২৮টি গ্রাম জুড়ে ১,৬৫০টি পরিবারের ভিটেমাটি সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ১৯৯৯ সালে। "সরকার বাহাদুর হাজার একটা কথা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকল, অথচ ওই মানুষগুলোর কপালে একটা কড়িও জুটল না। হকের দাবি নিয়ে ওনারা আজ অবধি চক্কর কেটে যাচ্ছেন সরকারের দুয়ারে। এমনতর গেরোয় ফাঁসতে চাই না আমরা," সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন বাল্লু।
ও হ্যাঁ, গ্রামবাসীরা উৎখাত হলেন বটে, তবে আজ অবধি সিংহমামাদের টিকিটিরও দেখা মেলেনি। একে একে ২২টি বছর কেটে গেছে তারপর থেকে।
*****
নিরন্তর মৃগয়ার ফলে ভারত থেকে বিলুপ্ত হয়েছে এশীয় চিতা (অ্যাসিনোনিক্স জুবাটাস ভেনাটিকাস)। পিঙ্গলবর্ণ, সারা গায়ে ছোপ ছোপ, ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক আর শিকারের কিংবদন্তি ছাড়া আর কোত্থাও দেখা মেলে না তার। ভারতের শেষ তিনটি এশীয় চিতাকে ১৯৪৭ সালে গুলি করে মেরেছিলেন কোরিয়া (অধুনা ছত্তিশগড়ে স্থিত) নামক অখ্যাত একটি প্রিন্সলি স্টেটের মহারাজ রামানুজ প্রতাপ সিং দেও।
একদা সারা দুনিয়ায় একটিমাত্র দেশ ছিল যেখানে একত্রে দেখা মিলত বাঘ, সিংহ, চিতা, চিতাবাঘ, তুষার চিতাবাঘ ও গেছো বাঘের (ফুলেশ্বরী বাঘ বা মেঘলা চিতা নামেও পরিচিত)। তবে দেও বাবাজির এ কুকর্মের ফলে সেটা আর রইল না। এ দেশের বহু সরকারি ছবিতে জ্বলজ্বল করে জগতের ক্ষিপ্রতম সব শ্বাপদের ছবি, লেখা থাকে 'জঙ্গলের রাজা'। ভারতের জাতীয় শিলমোহর তথা মুদ্রার গায়ে ছাপা অশোকচক্রেও স্থান পেয়েছে এশীয় সিংহ। সুতরাং এশীয় চিতার বিলুপ্তি ঘটায় যে জাতীয় আত্মগরিমায় আঘাত লাগবে, এতে আর আশ্চর্যের কী? বারবার সরকার পাল্টালেও সংরক্ষণের আওতা থেকে চিতা যেন বাদ না পড়ে, সে খেয়াল ছিল সক্কলের।
এবছর জানুয়ারি মাসে 'ভারতে চিতার প্রবর্তনের কর্ম-পরিকল্পনা' শিরোনামে একটি নথি প্রকাশ করে আমাদের পরিবেশ, অরণ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক (এমওইএফসিসি)। সেখানে বলা আছে 'চিতা' নামটার উৎস নাকি সংস্কৃত এবং তার অর্থ 'ছোপ ছোপ দাগ আছে যার'। এছাড়াও মধ্যভারতে যে নব্যপ্রস্তর যুগের কিছু গুহাচিত্র রয়েছে, সেখানেও দ্যাখা মেলে চিতার। ১৯৭০-এর দশকে ইরানের শাহের সঙ্গে আলোচনায় বসে এ দেশের সরকার। ভারতের মাটিতে চিতাদের ফিরিয়ে আনতে হবে, তাই পারস্য থেকে খানকতক এশীয় চিতা পাঠাতে অনুরোধ করা হয়।
২০০৯ সালে এই বিষয়টিতে আবারও ইন্ধন জোগায় এমওইএফসিসি, এ দেশে নতুন করে চিতাকে ফেরানোর ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে বলা হয় ভারতের বন্যপ্রাণ প্রতিষ্ঠান ও ভারতের বন্যপ্রাণ ট্রাস্টকে। এশীয় চিতার একমাত্র বাসস্থান আজ ইরান, কিন্তু তারা সংখ্যায় এতো কম যে আমদানি করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ফলত বাবুদের নজর গিয়ে পড়ে আফ্রিকান চিতার উপর, কারণ তারা নাকি একই রকমের দেখতে। অথচ বিবর্তনের ইতিহাসে যে তাদের মাঝে প্রায় ৭০,০০০ বছরের একটা ফাঁক রয়ে গেছে, সেকথাটা বুঝেও বোঝে না সরকারি বাহাদুর!
জরিপ শুরু হয় মধ্য ভারতের দশটি অভয়ারণ্যে, চিহ্নিত হয় ৩৪৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত কুনো অভয়ারণ্য। এশীয় সিংহ ছাড়া হবে বলে অচিরেই তার পরিধি বাড়িয়ে ৭৪৮ বর্গ কিলোমিটার করা হয়, নতুন নাম যার কুনো-পালপুর জাতীয় উদ্যান। তবে ঝামেলা একটাই, উদ্যানের ঠিক মধ্যিখানে অবস্থিত বাগচা গ্রামটি তুলে অনত্র কোথাও একটা সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তবে এমওইএফসিসি থেকে জানুয়ারি ২০২২শে যে বিবৃতিটি পাঠানো হয় সংবাদমাধ্যমকে, সেখানে বলা হয়েছিল: কুনোর ভিতর নাকি "কোত্থাও কোনও জনবসতি নেই..."
সেই কর্ম-পরিকল্পনায় লেখা আছে যে চিতার প্রত্যাবর্তনের ফলে "আবার সেই অতীতের মতো এক আসমানের নিচে ঘর করবে বাঘ, চিতাবাঘ, সিংহ ও চিতা।" তবে বিশাল দুইখান গলদ আছে বিবৃতিটায়। এক, এটা আফ্রিকান চিতা, এ দেশের মাটিতে একদা যাদের দেখতে পাওয়া যেত, সেই এশীয় উপপ্রজাতিটি নয়। দুই, কুনোতে সিংহ থাকে না, ২০১৩ সালে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত হুকুম দিয়েছিল ঠিকই, তবে গুজরাত সরকার বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দেয়নি।
"২২ বছর হতে চলল, সিংহের দেখা আজও মেলেনি, আর কোনদিন মিলবে বলেও মনে হয় না," জানালেন রঘুনাথ আদিবাসী। বাগচা গ্রামের বহু পুরানো এই বাসিন্দাটিকে তাড়া করে ফেরে ভিটেমাটি হারানোর জ্বালা। তার কারণ কুনোর আশপাশের গ্রামগুলির ঝুলিতে যে আজ অবধি অবহেলা, উপেক্ষা আর ফাঁকি ছাড়া আর কিস্যুটি জোটেনি, এ কথা হাড়ে হাড়ে জানেন তিনি।
অবশিষ্ট এশীয় সিংহেরা (প্যান্থেরা লিও লিও) গুঁতোগুঁতি করে বাস করছে গুজরাতের সৌরাষ্ট্র উপদ্বীপে, ফলত দুশ্চিন্তার শেষ নেই বন্যপ্রাণ সংরক্ষণবাদীদের। এই কারণেই ঠিক করা হয়, জঙ্গলের নৃপতিকে পুনর্বাসন না করলেই যে নয়। খানকতক সিংহ-সিংহীকে অন্য কোথাও সরিয়ে না নিয়ে গেলে ক্যানাইন ডিস্টেম্পার জীবাণুর প্রাদুর্ভাব, দাবানল, বা অন্য কিছু বিপদ-আপদের ফলে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে গোটা উপপ্রজাতিটাই।
একা শুধু আদিবাসীরা নন, বন্য জানোয়ারদের সাথে তাঁরা যে সাচ্ছন্দে সহাবস্থান করতে পারেন, একথা অরণ্যবাসী দলিত ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতিরাও জানান সরকারকে। পাইরা-নিবাসী ৭০ বছর বয়সী রঘুলাল যাতভের কথায়: "আমরা ভেবে দেখলাম, সিংহ আসে আসুক না, আমরা হটে যাব কোন দুঃখে? জন্তু-জানোয়ারদের খুব কাছ থেকে চিনি আমরা। আরে বাবা, বড়ো তো জঙ্গলেই হয়েছি, নাকি? হম্ ভি শের হ্যাঁয়!" একদা এই গ্রামটি জাতীয় উদ্যানের ভিতরেই ছিল। ৫০ বছর সেখানেই বসত করেছেন তিনি, কক্ষনো উল্টা-সিধা কিছু হয়নি, একথা হলফ করে বললেন রঘুলাল।
ভারতের বন্যপ্রাণ প্রতিষ্ঠানের (ডাব্লিউআইআই) প্রধান সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী ডঃ যাদবেন্দ্র ঝালা জানালেন, চিতার হামলায় কোনও মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এমনতর ঘটনার না আছে ঐতিহাসিক কোনও ভিত্তি, না আছে সাম্প্রতিক কোনও খবর। "মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষ নিয়ে মাথাব্যথা নেই তেমন। যেসব জায়গায় সরকার চিতাকে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে, সেখানকার বাসিন্দারা বড়োসড়ো মাংসাশী প্রাণীর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে পটু, তাঁদের জীবনযাপন বা পশুপালনের কায়দা, সবই এমনভাবে সাজানো যে সংঘর্ষের কোনও বালাই নেই।" তা সত্ত্বেও যদি গবাদি পশু-টশু কিছু মারা যায়, সেটা সামলানোর জন্য খানিকটা করে টাকাপয়সা তাঁরা এমনিতেও তুলে রাখেন আলাদা করে।
৭ই এপ্রিল ২০২২ সালে আয়োজিত হয় সভাটি। গ্রামবাসীরা যেন প্রত্যেকেই সেদিন হাজির থাকেন, একথাটা তার আগেরদিন সন্ধ্যাবেলায় চাউর করে দেওয়া হয়। সকাল ১১টায় শুরু হয় সভা। আধিকারিকের দল ওঁদের হাতে একটি কাগজ তুলে দিয়ে সইসাবুদ করতে বলেন, সেখানে লেখা ছিল যে তাঁরা স্বেচ্ছায় জমিজমা ছেড়ে দিচ্ছেন, কেউই তাঁদের জোর-জবরদস্তি করছে না
না মূলনিবাসী মানুষ না বিজ্ঞানী, কারোর কথায় পাত্তা না দিয়ে জানুয়ারি ২০২২শে সংবাদমাধ্যমের প্রতি এই বিবৃতিটি প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার: "ভারত থেকে বিলুপ্ত হওয়া একমাত্র বৃহৎ স্তন্যপায়ী জীব হ'ল চিতা, তাকে আবার ফিরিয়ে আনাটাই প্রজেক্ট চিতার লক্ষ্য।" উপরন্তু, এমনটা করলে নাকি, "ইকো-পর্যটন শিল্প ও সংযুক্ত বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।"
এবছর ১৫ই আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসে ভারতের মাটিতে পা, থুড়ি থাবা রাখতে চলেছে আফ্রিকান চিতা।
আর তার প্রথম শিকার হতে চলেছে হতভাগ্য বাগচা গ্রামটি।
উচ্ছেদ ও পুনর্বাসনের দ্বায়িত্বে রয়েছেন জেলা বন আধিকারিক প্রকাশ ভার্মা, তাঁর বক্তব্য: চিতা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য নিয়োজিত ৩৮.৭ কোটি টাকার থেকে ২৬.৫ কোটি টাকা তুলে রাখা হয়েছে বাস্তুচ্যুতির জন্য, "চিতার ঘেরাটোপ বানানো, জলের ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট পরিস্কার করা এবং বনকর্মীরা যাতে প্রাণীগুলোর দেখভাল করতে পারেন, সেজন্য তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া – এসবরে পিছনে প্রায় ৬ কোটি টাকা বেরিয়ে যাবে।"
প্রথম কিস্তিতে ২০টি চিতা আসতে চলেছে আফ্রিকা থেকে। তাদের বাসস্থান রূপে বৃহত্তর ঘেরাটোপটির পরিধি ৩৫ বর্গ কিলোমিটার, এছাড়াও ৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট ছোট একাধিক ঘেরাটোপ এবং ২ কিমি ছাড়া ছাড়া একটা করে ওয়াচটাওয়ার বানানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। চিতা বাবাজীবন যাতে সুখে-শান্তিতে বংশবিস্তার করতে পারেন, সেজন্য কোনও প্রচেষ্টাই বাদ রাখছে না সরকার বাহাদুর। ঠিকই তো, আফ্রিকার বন্যপ্রাণ বিষয়ে আইইউএনসির রিপোর্ট যে ইতিমধ্যেই বিপন্ন হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছে আফ্রিকান চিতাকে। দ্রুতগতিতে কমে আসছে তাদের সংখ্যা, একাধিক রিপোর্টে বলা হয়েছে সেটা।
বিজাতীয় একটি বিপন্ন পশুকে জোর করে টেনে আনা হচ্ছে বিদেশ বিভুঁইয়ে, এবং তার খেসারত রূপে ভিটেমাটি হারাতে বসেছেন আদিবাসী, বিশেষ করে অসুরক্ষিত তফসিলি জনজাতির মানুষজন – মোটের উপর হিসেবটা তাই-ই। অর্থাৎ 'মানুষ-পশু সংঘাত' এই শব্দবন্ধটির নতুন মানে তৈরি হতে চলেছে।
"মানুষ আর বন্যপ্রাণী নাকি একত্রে সহাবস্থান করতে সক্ষম নয় – সংরক্ষণের প্রতি এরূপ সংকীর্ণতা কেবলই অনুমান-ভিত্তিক, এর কোনও প্রমাণ নেই," বলে উঠলেন অধ্যাপক কাব্রা। সংরক্ষণের নামে এই যে জমিজমা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, এবছর জানুয়ারি মাসে অপর একজন গবেষকের সঙ্গে এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র লিখেছেন তিনি। খাতায়-কলমে কার্যকরী হয়েছে অরণ্য অধিকার আইন, ২০০৬, হাজারো সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে অরণ্যজীবীদের তরে, তা সত্ত্বেও কেন ভারত জুড়ে একাধিক ব্যঘ্র প্রকল্প এলাকায় জোর-জবরদস্তি স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন ১৪,৫০০টি পরিবার? কড়া ভাষায় এ প্রশ্নটা তুলে ধরেছেন অধ্যাপক কাব্রা। ওঁর মতে, পাশাখেলার ঘুঁটিগুলো বরাবরই আটকে থাকে প্রশাসনের মুঠোয়, হরেক কিসিমের আইনি ও পদ্ধতিগত কলকাঠি নেড়ে তেনারা জল-জমিন-জঙ্গল ছেড়ে 'স্বেচ্ছায়' চলে যেতে বাধ্য করেন গ্রামবাসীদের।
যুগ যুগান্তরের বাসভূমি ছেড়ে দিলে ক্ষতিপূরণ মিলবে ১৫ লাখ টাকা, বাগচার বাসিন্দারা জানালেন। এককালীন হয় পুরো টাকাটাই হাতে পাবেন, কিংবা ভাগাভাগি করে দেওয়া হবে নগদ টাকা আর জমির মধ্যে, যাতে নতুন করে বাসা বাঁধতে পারেন। "বাড়ি বানাতে ৩.৭ লাখ টাকা দেবে বলেছে, বাকি টাকাটার বদলে খানিকটা জমি মিলবে যাতে চাষবাস করতে পারি। কিন্তু সে ব্যাটারা বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পাকা রাস্তা, হাতকল, নলকূপ, হ্যানা-ত্যানা এসবের জন্য একগাদা টাকা কেটে নিচ্ছে," রাগত স্বরে জানালেন রঘুনাথ।
বাগচা থেকে মেরেকেটে ৪৬ কিলোমিটার দূরে কালাহল তেহসিলের গোরাস, সেখানেই বামুরা নামক একটি গ্রামে পুনর্বাসিত হওয়ার কথা তাঁদের। "নতুন যে জমিটা আমাদের দেখাল, ওটা ফালতু, তার চেয়ে এখানকার মাটি ঢের ভাল। খানিকটা তো আবার এবড়ো খেবড়ো পাথুরে, ফসল-টসল কিসুই ফলবে না তেমন। এ জমি চাষযোগ্য করতে বহুদিন লাগবে, আর প্রথম তিনটে বছর তো কারোর থেকে সাহায্য-টাহায্য কিছুর আশা করাটাও পাপ," বলে উঠলেন কাল্লো।
*****
' বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে হবে ' – আফ্রিকা থেকে চিতা নিয়ে এসে ভারতের জঙ্গলে ছাড়ার পিছনে যে ক'টি কারণ আছে চিতা প্রকল্পের (চিতা প্রজেক্ট) দস্তাবেজে, তার মধ্যে এটিই অন্যতম। ডঃ রবি চেল্লমের মতো বহু বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই পংক্তিটি। "তৃণভূমি সংরক্ষণের দোহাই দিয়ে চিতা আনা হচ্ছে ভারতে। কোনও মাথামুণ্ডু নেই, কারণ এদেশের তৃণভূমি জুড়ে কারাকাল বা স্যহগোশের মতন বনবেড়াল, কৃষ্ণসার মৃগ আর হুক্না পাখির (গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড) মতন অসংখ্য জীবজন্তু এমনিতেই বিপন্ন হয়ে পড়ে আছে। সুদূর আফ্রিকা থেকে কোন দুঃখে চিতা আমদানি করতে হচ্ছে শুনি?" স্পষ্ট ভাষায় সওয়াল করলেন মেটাস্ট্রিং ফাউন্ডেশনের সিইও এই প্রখ্যাত বন্যপ্রাণ জীববিজ্ঞানী।
উপরন্তু ওঁর মতে সরকারের লক্ষ্যটা (১৫ বছরে চিতার সংখ্যাটা ছত্রিশে নিয়ে যাওয়া) না টেকসই, না স্বাবলম্বী, এমনকি জেনেটিকসের দিক থেকেও এটি আদতে অর্থহীন। "ঢাকঢোল পিটিয়ে, এককাঁড়ি টাকা খসিয়ে একখান সাফারি উদ্যান বানানো হবে শুধু, লাভের লাভ কিসুই হবে না," জানালেন চেল্লম। ইনি বায়োডাইভার্সিটি কোলাবোরেটিভের একজন সদস্যও বটেন, ভারতের জীববৈচিত্র্য তথা সংরক্ষণের উপর গবেষণা তথা প্রচারের কাজ করে এই সংগঠনটি।
সাহারিয়াদের এই জেদটা কিন্তু মোটেও অমূলক নয়, পুনর্বাসনের নামে কুনো অরণ্যে তাঁদের পড়শিদের সঙ্গে যে কেমন ধরনের জুলুম করা হয়েছিল, সেকথা মরে গেলেও ভুলতে পারবেন না তাঁরা। গুজরাত থেকে সিংহ আনা হবে, তাই ১৯৯৯ সালে ২৮টি গ্রাম জুড়ে ভিটেমাটি হারিয়েছিল ১,৬৫০টি পরিবার
আসব আসব করেও এলেন না সিংহমামা, অথচ আজ ২২ বছর হয়ে গেল কুনো থেকে বিতাড়িত হয়ে বসে আছেন মঙ্গু আদিবাসী। ক্ষতিপূরণ স্বরূপ যে জমিটুকু পেয়েছিলেন, সেটা এতই ঊষর যে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। চেল্লমের বক্তব্যের সাথে সহমত তিনি: "চিতা আসছে বটে, তবে স্রেফ দেখনদারী এসব। 'এই দেখো, কুনোতে কী মারাত্মক কাজটাই না করেছি,' দেশে-বিদেশে এসব বুকনি দিয়ে গলা ফাটাবে সরকার। [জঙ্গলে] ছাড়ুক না চিতাগুলো, আর্ধেক তো এখানকার জন্তু-জানোয়ারের পেটেই চলে যাবে। আর ওই যে তার দিয়ে ঘেরাটোপ বানিয়েছে না? ওটায় শক্ খেয়ে [তড়িদাহত হয়ে] মরবে বাকিগুলো। আমরাও দেখব কেমন টেকে।"
এছাড়াও বিলিতি পশুরা অজানা সমস্ত রোগ বহন করে আনবে তাদের দেহে, ঝুঁকিটা মোটেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মতো কিছু নয়। ডঃ কার্তিকেয়ন ভাসুদেবনের কথায়: "বেচারা চিতাগুলো ভারতে অচেনা সব অসুখবিসুখের পাল্লায় পড়বে, এখানকার জীবানুগুলো তো ওদের জন্য আনকোরা নতুন, সরকার মোটেও মাথা ঘামায়নি এসব নিয়ে।"
সংরক্ষণ বিষয়ক একজন জীববিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি ইনি হায়দরাবাদের সেন্টার ফর সেল্যুলার অ্যান্ড মলিক্যুলার বায়োলজিতে অবস্থিত বিপন্ন প্রজাতি সংরক্ষণ গবেষণাগারের প্রধান। "বিভুঁই থেকে আসা প্রিয়ন (প্রোটিন দ্বারা গঠিত সংক্রামক সত্ত্বা) ও অন্যান্য অসুখের কবলে দেশজ বন্যপ্রাণের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এছাড়াও অদূর ভবিষ্যতে চিতাগুলোর বংশবিস্তার হওয়াটা অসম্ভবের সামিল, উপরন্তু এখানকার জলবায়ুতে দেশি রোগজীবাণু তো রয়েইছে [যার থেকে আক্রান্ত হতে পারে নবাগত চিতারা]," এমনতর নানান বিষয়ে সাবধান করে দিলেন ডঃ কার্তিকেয়ন।
তাছাড়া বেশ কিছু গুজবও রটেছে। চিতাদের আসার কথা ছিল গতবছর, অনেকে ধরেই নিয়েছেন যে দফতরি কিছু গ্যাঁড়াকলের ফলে বাঘমামারা আসতে পারছেন না। হাতির দাঁতের কারবার, এমনকি আমদানি করাটাও নিষিদ্ধ – ভারতের বন্যপ্রাণ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৭২ রের ৪৯বি সংখ্যক বিভাগে এটি স্পষ্ট ভাবে বলা আছে। আন্তর্জাতিক স্তরে বিপন্ন বন্যপশু ও উদ্ভিদের কারবার ঘিরে লিখিত রীতি (সিআইটিইএস) অনুযায়ী এমন কিছু বনজ সামগ্রী রয়েছে যা নিয়ে আন্তর্দেশীয় ব্যবসা করা অপরাধ, গুজব ছড়াচ্ছে যে ভারত যতক্ষণ না এই তালিকা থেকে হাতির দাঁত বাদ দেওয়ার জন্য লড়ছে, ততদিন একটিও চিতা পাঠাবে না নামিবিয়া। সরকারি বাবুরা অবশ্য একথাটা মানতে বা খারিজ করতে নারাজ।
ততদিন ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকবে বাগচা। আগেভাগে জমিয়ে রাখা গাছের রজন সংগ্রহ করতে অরণ্য-পানে রওনা দিয়েছিলেন হারেথ আদিবাসী, একদণ্ড থমকে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন: "সরকারের কাছে আমরা তো মাছি-মশা। ওনারা যা হুকুম দেবেন, তা মাথা পেতে নিতে হবে। নিজে থেকে থোড়াই না যেতে চাই? কিন্তু ওনারা চাইলেই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়াতে পারেন আমাদের।"
এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় গবেষণা ও তর্জমার কাজে সাহায্য করেছেন সৌরভ চৌধুরি, তাঁর প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন লেখক।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)