“আজাদি! আজাদি!” কোটি কোটি আধপেটা জন্তু ওঁত পেতে ছিল রাজপ্রাসাদের একটু দূরেই। তাদের গর্জনে আকাশ বুঝেছিল সিঁদুরে মেঘ কাকে বলে। এই জানোয়ারগুলোর জন্য রাজার বুকে দলা দলা ঘৃণা ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না। “আজাদি! আজাদি!” কী দুঃসাহস কীটস্য কীটগুলোর, বলে কিনা মাথা উঁচু করে বাঁচবে? “আজাদি! আজাদি!” পোকামাকড়গুলো কালাজাদুতে ওস্তাদ, ঐক্য নামে কি যেন একটা মারাত্মক মন্ত্র জানে তারা। “আজাদি! আজাদি!” তাদের এতো স্পর্ধা যে ঘামের সঙ্গে ধুলোবালি মিশিয়ে শ্যামলঘন শস্য ঝরাবে অনায়াসে? একি অনাসৃষ্টি? অসহ্য, অসহ্য! “আজাদি! আজাদি!” হাড়ভাঙা খাটুনির বিনিময়ে যোগ্য পারিশ্রমিক চাইছে এই পিঁপড়ের দল...এত সাহস হয় কী করে ব্যাটাদের?
নাহ্, দামাল এই শ্বাপদগুলোকে এবার পাকড়াও করে খাঁচায় পুরতেই হবে। তবে একটা ভালো খবর আছে। মেঘমিনারের ওই যে হাসমুখ সম্রাট, তাঁর আশীর্বাদে নাম-না-জানা এক মড়ক দেখা দিয়েছে এ রাজ্যে। পোকামাকড়গুলো হুড়হুড় করে সাফ হয়ে যাচ্ছে! একই সঙ্গে ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে রাজকোষ। আহা কী আনন্দ! “আজাদি! আজাদি!” এই মারণরোগের একটাই টোটকা পাওয়া গেছে, আর সেটা আছে রাজার হাতের মুঠোয়, কী মজা! ওদিকে আপদগুলো বলছে যে এই টোটকা নাকি তাদের বিনামূল্যে দিতে হবে। ছোঃ! মামাবাড়ির আবদার পেয়েছে?
টলতে টলতে নামে রাত। তারাহীন আকাশে ঝলমল করছে ওই যে সুদূরে নতুন রঙমহলের চূড়া। চোখভরা খিদে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রাজা। “আজাদি! আজাদি!” অসহ্য, অসহ্য ওই কুকুরগুলোর চিৎকার! জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাক মাটির গর্ভদান করে যারা! পলির কাঁখে পান্নার জন্ম দেবে, এত্ত সাহস ওই হাড়গিলে আঙুলগুলোর? চুপ চুপ! কিসের একটা যেন আওয়াজ হল না ঝরোখার ওইদিকটায়? গুটিগুটি পায়ে আঁধার ঠেলে উঠে আসছে একটা লতানে গাছ, ঠোঁটে তার অবেলার আলতাসি কথা। পাতার বদলে ধরে আছে তীক্ষ্ণ সারি সারি পেরেক, ফুলের বদলে ফুটে আছে যমুনার চরে সলতে হয়ে যাওয়া লাশ।
ঝরোখার বাইরে চুপকথা হয়ে দুলতে থাকে দুটি চাঁদ। তার একটি আমাদের ছিঁড়ে খাওয়া রমজানের কাস্তে, অন্যটি বারবেলা কোন ট্রাক্টরের একখানি চাকা।
ছিঁড়ে খাওয়া আমাদের রমজানী কাস্তে
হিং টিং
ছট।
নাচে ছায়ানট।
ভেঙেছি নজরকাঠি
মিথ্যে নহন্যে —
রাজা তোর
জন্যে।
রাজা তোর
জন্যে।
আজাদির মৌমাছি
রূপকথা ফাহেশায়,
কার কাঁখে
রোজা রাখে?
কার গাঙে
ঝলকায়?
গোলাপের
নামতা শুনে,
হাওয়াকল
দেখল গুনে,
রাজা তোর
ইস্কাবনে
অথই তাথই
বানভাসি ওই দিনমজুরের লাশ!
খিদার টানে
আঙার জানে
হিংসুটি
কার উড়কিধানে
বাঁদনা মেলায়
জঠর ছড়ায় চাঁদকুড়ানির দল।
ধানশালিকের
ঘুঙরু সাকিন বনকালিমের গানে,
লোহরি মা
তোর চুমকুড়ি ভয়
জাতকের অভিমানে?
চিনেমাটি
তোর। জিপসি নাগর।
আকণ্ঠ আলাদিনে
একি অনাসৃষ্টি?
হাতুড়ি
আমার। তসবি খেলার।
খিদের নামাজ
পড়ে আইবুড়ি বৃষ্টি।
গাঁইতি কুড়াল,
আঁঝলা সকাল,
কুনকি রাজার
গাঁ।
নার্গিসে
তাই সিঁদুর জড়ায়
ল্যাংটা
অযোধ্যা।
আজাদির বেনোফুল
পুতুলের লজ্জায়,
ইস্পাতে
রুবায়তে
কার নথে
ছলকায়?
লজ্জা লজ্জা
সে তো রমজানী চাঁদ।
গল্প ছোঁয়াচে
তার মিঠে অবসাদ।
পেটকাটি
কোকিলের
হুডখোলা
বিকেলের
হেঁশেল নেভানো
ঠোঁটে গোলাপি জেহাদ।
রাতকানা
জানালায়
চুপকথা খুঁটে
খায়
ফসজিনে ফলিডলে
বৈশাখী যাত্রা।
মেয়েবেলা
আমাদের
তেলচিটে
জোনাকের
রাংতা জড়ানো
রোদে লাঙলেরই আত্মা।
**********
শব্দার্থ
ঝরোখা:
জাফরি-কাটা বাহারি জানলা
ফাহেশা:
মন্দ, অশ্লীল (আরবি)
বাঁদনা:
মূলত পূর্ব ভারতের অস্ট্রোএশিয়
এবং দ্রাবিড়ীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত সর্বপ্রাণবাদী ও মহাপ্রাণবাদী এক
কৃষিভিত্তিক উৎসব
বনকালিম:
সিঁদুরে ছোপওয়ালা নীলচে-কালো রঙের এক প্রজাতির প্রজাপতি যারা রোদ পোহাতে ভালোবাসে
তসবি:
জপমালা
(আরবি)
লোহরি:
দক্ষিণায়ণ বা মকরক্রান্তিকে
ঘিরে পঞ্জাবে প্রচলিত একটি কৃষিভিত্তিক উৎসব
আঁঝলা:
আধোয়া
নার্গিস:
পোয়েটস্ ড্যাফোডিল বা
নারসিসাস্ পোয়েটিকাস নামক ফুল
রুবায়ত:
পারস্যে প্রচলিত একপ্রকারের
চার-পংক্তির কবিতা
ফসজিন:
একপ্রকারের বিষাক্ত গ্যাস,
১৯৮৪এর ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার পিছনে এই রাসায়নিক যৌগটির একটি বিশাল ভূমিকা আছে
ফলিডল:
একধরনের কীটনাশক বিষ
বৈশাখী:
রবি শস্য তোলার সময় হলে
সেই মুহূর্তকে উদযাপন করে পঞ্জাব তথা উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পালিত একটি মরশুমি
কৃষিভিত্তিক উৎসব
দলবদ্ধ এই প্রয়াসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে স্মিতা খাটোরের। তাঁকে আমাদের ধন্যবাদ।